কোপেনহেগেন-প্যারিস এক্সপ্রেস চলছেই by লারস ক্রিশ্চিয়ান লিলহোল্ট
কার্বন ডাই–অক্সাইড নিঃসরণের ৯০ শতাংশ চুক্তির আওতায় চলে আসবে |
২০০৯
সালে যখন কোপেনহেগেনে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সম্মেলন চলছিল, তখন
আমি সেখানে একজন সাংসদ হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। তখন আমার মনে হয়েছিল, এক
দুনিয়া পরিবর্তনকারী ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হতে যাচ্ছি। অনেক বছর ধরেই আমরা
গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে একটি উচ্চাভিলাষী ও বাধ্যবাধকতাসম্পন্ন চুক্তি
করার চেষ্টা করে আসছি, ফলে সবার দৃষ্টি ছিল ডেনমার্কের দিকে। কিন্তু
দুর্ভাগ্যবশত, বৈশ্বিক আর্থিক সংকট ও জাতীয় স্বার্থ সাংঘর্ষিক জায়গায় চলে
গেলে আমরা কোনো পূর্ণাঙ্গ চুক্তিতে আসতে পারিনি।
এবার আবারও জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয়েছে, তুমুল গতিতেই তা এগোচ্ছে, সেখানে একটি চুক্তি হবে, সে আশায় মানুষ বুক বেঁধেছে। এবার একটি ভালো চুক্তি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ডেনমার্কের জলবায়ু-বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে আমি নিজেও সেখানে উপস্থিত। আমি বিশ্বাস করি, এবারের সম্মেলনে পুরো পৃথিবীই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ওপর লাগাম দেওয়ার ব্যাপারে সিরিয়াস হবে।
ছয় বছর আগের তুলনায় এবারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন। যখন কোপেনহেগেন সম্মেলন শুরু হলো, তখন বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা প্রায় ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছিল, সারা পৃথিবীই সে কারণে ধুঁকছিল। বিশিষ্ট রাজনীতিকেরা তখন প্রশ্ন তুলেছিল, মানুষের কারণেই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে কি না; ওদিকে শিল্পগোষ্ঠীগুলো বাধ্যবাধকতাসম্পন্ন চুক্তির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল।
আজ বৈশ্বিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, ওদিকে জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক বিজ্ঞানীরা এর কারণ সম্পর্কিত সব সন্দেহের অবসান ঘটিয়েছেন। আবার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও পরিবেশের পক্ষে লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছে। ২০০৯ সালে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ সবুজ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আজ তাঁদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, তাঁরা রীতিমতো একটি দলে পরিণত হয়েছেন। যেমন: গত নভেম্বরেই গোল্ডম্যান স্যাক্স ঘোষণা দিয়েছে, তারা ২০২৫ সালের মধ্যে সবুজ শক্তিতে ১৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
আলোচনার গতি-প্রকৃতিই আসলে বদলে গেছে। না, এবার আর আমরা নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা কারও ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি না, বরং এমন একটি কাঠামো প্রণয়নের চেষ্টা করছি, যেখানে সব দেশ নিজের মতো করে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবে। ফলে প্রতিটি দেশই আসলে চুক্তি প্রণয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা একটি ব্যাপার বুঝতে পেরেছে, সেটা হলো কিছু না করার ফল কিন্তু ভয়ংকর হবে, আর নিঃসরণ কমালে তা আখেরে আমাদের জন্য ভালো হবে।
সব জায়গাতেই উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। গত বছর চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ২০২৫ সালের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ ২৬ থেকে ২৮ শতাংশ কমাতে রাজি হয়েছে, আর চীন বলেছে, তারা ২০৩০ সালে নিঃসরণের চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছাবে, আর তারপর নিঃসরণ কমাবে।
এই নতুন মনোভঙ্গির কারণে জলবায়ু-বিষয়ক আলোচনার পরিসর আরও বিস্তৃত হয়েছে। প্যারিসের যে চুক্তি হবে, তাতে ১৮০টির বেশি দেশ অংশ নেবে, ফলে বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ৯০ শতাংশ এর আওতায় চলে আসবে। তুলনা করলে দেখা যায়, কিয়োটো প্রটোকলের সীমা ছিল বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ১৫ শতাংশ।
হ্যাঁ, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আরও অনেক কিছু করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এবং আরও অনেক কিছু করতেও হবে। আগামী ২৫ বছরে বিশ্বে শক্তি ব্যবহারের চাহিদা অন্তত এক-তৃতীয়াংশ বাড়বে, বিশেষ করে চীন ও ভারতের মতো দেশের চাহিদা বাড়বে বলে ধারণা করা যায়, যারা ওইসিডিভুক্ত (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) নয়। আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে যে এই চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে তারা যেন টেকসই পদ্ধতি গ্রহণ করে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির মতো সংগঠনগুলো দুনিয়াকে দূষণমুক্ত শক্তি ব্যবহারের দিকে ধাবিত করার বেলায় আগের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
কোপেনহেগেন সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মনে হচ্ছে, তারা সেটা করার ক্ষেত্রে ঠিক পথেই আছে। এটা অর্জন করতে হলে আমাদের বাজারের শক্তির ওপর লাগাম দিতে হবে, সরকারি তহবিল ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতে হবে, যাতে বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে ড্যানিশ ক্লাইমেট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, যার মাধ্যমে দেশটির সরকার বড় বড় পেনশন তহবিলের টাকাসহ নানা বিনিয়োগ করে থাকে, অন্যদের জন্য উদাহরণ হতে পারে।
এটা করতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি কমাতে হবে, একই সঙ্গে আমাদের নতুন ধরনের আর্থিক হাতিয়ার নির্মাণ করতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীদের নিজের সমস্যা নিজে সমাধান করতে উৎসাহিত করা যায়, সরকারি তহবিলের ওপর নির্ভর না করেই। প্যারিসে একটি চুক্তি হলে তা আমাদের জন্য বহু প্রয়োজনীয় বৈশ্বিক কাঠামোর সন্ধান দেবে, বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য যা খুবই প্রয়োজনীয়। না, এর মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই শেষ হয়ে যাবে না, কিন্তু সেটা সবুজ অর্থনীতির দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য শক্তিশালী ভিত্তি প্রস্তুত করবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
লারস ক্রিশ্চিয়ান লিলহোল্ট: ডেনমার্কের জ্বালানি, পরিষেবা ও জলবায়ু-বিষয়ক মন্ত্রী।
এবার আবারও জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয়েছে, তুমুল গতিতেই তা এগোচ্ছে, সেখানে একটি চুক্তি হবে, সে আশায় মানুষ বুক বেঁধেছে। এবার একটি ভালো চুক্তি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ডেনমার্কের জলবায়ু-বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে আমি নিজেও সেখানে উপস্থিত। আমি বিশ্বাস করি, এবারের সম্মেলনে পুরো পৃথিবীই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ওপর লাগাম দেওয়ার ব্যাপারে সিরিয়াস হবে।
ছয় বছর আগের তুলনায় এবারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন। যখন কোপেনহেগেন সম্মেলন শুরু হলো, তখন বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা প্রায় ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছিল, সারা পৃথিবীই সে কারণে ধুঁকছিল। বিশিষ্ট রাজনীতিকেরা তখন প্রশ্ন তুলেছিল, মানুষের কারণেই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে কি না; ওদিকে শিল্পগোষ্ঠীগুলো বাধ্যবাধকতাসম্পন্ন চুক্তির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল।
আজ বৈশ্বিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, ওদিকে জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক বিজ্ঞানীরা এর কারণ সম্পর্কিত সব সন্দেহের অবসান ঘটিয়েছেন। আবার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও পরিবেশের পক্ষে লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছে। ২০০৯ সালে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ সবুজ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আজ তাঁদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, তাঁরা রীতিমতো একটি দলে পরিণত হয়েছেন। যেমন: গত নভেম্বরেই গোল্ডম্যান স্যাক্স ঘোষণা দিয়েছে, তারা ২০২৫ সালের মধ্যে সবুজ শক্তিতে ১৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
আলোচনার গতি-প্রকৃতিই আসলে বদলে গেছে। না, এবার আর আমরা নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা কারও ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি না, বরং এমন একটি কাঠামো প্রণয়নের চেষ্টা করছি, যেখানে সব দেশ নিজের মতো করে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবে। ফলে প্রতিটি দেশই আসলে চুক্তি প্রণয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা একটি ব্যাপার বুঝতে পেরেছে, সেটা হলো কিছু না করার ফল কিন্তু ভয়ংকর হবে, আর নিঃসরণ কমালে তা আখেরে আমাদের জন্য ভালো হবে।
সব জায়গাতেই উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। গত বছর চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ২০২৫ সালের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ ২৬ থেকে ২৮ শতাংশ কমাতে রাজি হয়েছে, আর চীন বলেছে, তারা ২০৩০ সালে নিঃসরণের চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছাবে, আর তারপর নিঃসরণ কমাবে।
এই নতুন মনোভঙ্গির কারণে জলবায়ু-বিষয়ক আলোচনার পরিসর আরও বিস্তৃত হয়েছে। প্যারিসের যে চুক্তি হবে, তাতে ১৮০টির বেশি দেশ অংশ নেবে, ফলে বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ৯০ শতাংশ এর আওতায় চলে আসবে। তুলনা করলে দেখা যায়, কিয়োটো প্রটোকলের সীমা ছিল বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ১৫ শতাংশ।
হ্যাঁ, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আরও অনেক কিছু করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এবং আরও অনেক কিছু করতেও হবে। আগামী ২৫ বছরে বিশ্বে শক্তি ব্যবহারের চাহিদা অন্তত এক-তৃতীয়াংশ বাড়বে, বিশেষ করে চীন ও ভারতের মতো দেশের চাহিদা বাড়বে বলে ধারণা করা যায়, যারা ওইসিডিভুক্ত (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) নয়। আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে যে এই চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে তারা যেন টেকসই পদ্ধতি গ্রহণ করে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির মতো সংগঠনগুলো দুনিয়াকে দূষণমুক্ত শক্তি ব্যবহারের দিকে ধাবিত করার বেলায় আগের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
কোপেনহেগেন সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মনে হচ্ছে, তারা সেটা করার ক্ষেত্রে ঠিক পথেই আছে। এটা অর্জন করতে হলে আমাদের বাজারের শক্তির ওপর লাগাম দিতে হবে, সরকারি তহবিল ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতে হবে, যাতে বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে ড্যানিশ ক্লাইমেট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, যার মাধ্যমে দেশটির সরকার বড় বড় পেনশন তহবিলের টাকাসহ নানা বিনিয়োগ করে থাকে, অন্যদের জন্য উদাহরণ হতে পারে।
এটা করতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি কমাতে হবে, একই সঙ্গে আমাদের নতুন ধরনের আর্থিক হাতিয়ার নির্মাণ করতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীদের নিজের সমস্যা নিজে সমাধান করতে উৎসাহিত করা যায়, সরকারি তহবিলের ওপর নির্ভর না করেই। প্যারিসে একটি চুক্তি হলে তা আমাদের জন্য বহু প্রয়োজনীয় বৈশ্বিক কাঠামোর সন্ধান দেবে, বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য যা খুবই প্রয়োজনীয়। না, এর মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই শেষ হয়ে যাবে না, কিন্তু সেটা সবুজ অর্থনীতির দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য শক্তিশালী ভিত্তি প্রস্তুত করবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
লারস ক্রিশ্চিয়ান লিলহোল্ট: ডেনমার্কের জ্বালানি, পরিষেবা ও জলবায়ু-বিষয়ক মন্ত্রী।
No comments