অসমতা মানুষকে নিঃশেষ করে দেয় by জোসেফ ই স্টিগলিৎস
এ
বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অ্যাঙ্গাস ডেটনের গবেষণার ক্ষেত্র
ছিল ‘ভোগ, দারিদ্র্য ও কল্যাণের বিশ্লেষণ’, যোগ্য মানুষ হিসেবেই তিনি এ
পুরস্কার পেয়েছেন। অক্টোবরে এই পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার পর তিনি অ্যান কেসের
সঙ্গে যৌথভাবে বেশ কয়েকটি সাড়া জাগানো কাজ করেছেন, সেগুলো প্রসিডিংস অব
দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস-এ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদমূল্যের বিচারে
তাঁর এই লেখাগুলো নোবেল অনুষ্ঠানের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চবিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত বা তার চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন সাদা ও মধ্যবয়সীদের ওপর বিপুলসংখ্যক তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কেস ও ডেটন দেখিয়েছেন, তাদের যেমন গড় আয়ু কমছে, তেমনি স্বাস্থ্যও খারাপ হচ্ছে। এর কারণগুলো হচ্ছে আত্মহত্যা, ওষুধ ও অ্যালকোহল আসক্তি। বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র গর্ববোধ করে, ২০০৯ সাল ছাড়া প্রতিবছরই দেশটির মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে। এই সমৃদ্ধির একটি সম্ভাব্য লক্ষণ হচ্ছে ভালো স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি (জিডিপির অনুপাতে) ব্যয় করলেও মানুষের আয়ুর দিক থেকে কিন্তু সে সর্বোচ্চ অবস্থায় নেই। যেমন: ফ্রান্স স্বাস্থ্যসেবায় জনপ্রতি জিডিপির ১২ শতাংশেরও কম ব্যয় করে, আর যুক্তরাষ্ট্র করে ১৭ শতাংশ। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের গড় আয়ু ফরাসিদের চেয়ে তিন বছর কম।
অনেক মানুষ বহু বছর ধরেই এই ফারাককে যুক্তি দিয়ে সিদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা যুক্তি দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ, ফলে শ্বেতাঙ্গ ও আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূতদের গড় আয়ুর পার্থক্যের কারণেই ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের গড় আয়ুর মধ্যে এই ফারাক সৃষ্টি হয়েছে। হ্যাঁ, স্বাস্থ্য খাতে বর্ণগত ফারাকের ব্যাপারটা সত্যিই আছে। ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষার ফলাফল অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে সাদাদের তুলনায় কালো পুরুষ ও নারীদের গড় আয়ু যথাক্রমে পাঁচ ও চার বছর কম। এই বৈষম্য স্রেফ মার্কিন সমাজের বৈচিত্র্যের নির্বিষ ফল নয়। এটা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের অসম্মানের লক্ষণ, অর্থাৎ আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূতদের বিরুদ্ধে চলমান সর্বব্যাপক বৈষম্যের ফল। সাদাদের তুলনায় কালোদের গড় আয় ৬০ শতাংশ কম। এই নিম্ন আয়ের ব্যাপারটা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে এ কারণে যে যুক্তরাষ্ট্রই পৃথিবীর একমাত্র উন্নত দেশ, যেখানে স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
অনেকে শ্বেতাঙ্গদের অল্প বয়সে মারা যাওয়ার দায়টা আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূতদের ঘাড়ে চাপিয়েছেন। কারণ হিসেবে তাঁরা কালোদের ‘জীবনযাপনের’ ধরন উল্লেখ করেছেন। এটা সম্ভবত সত্য যে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের অভ্যাস দরিদ্রদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। কিন্তু এই অভ্যাসগুলো আসলে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিণতিতেই গড়ে ওঠে, বর্ণবাদী চাপের কথা নাই বা বললাম।
কেস-ডেটনের সমীক্ষার ফলাফলে এটাই বোঝা যায় যে এসব তত্ত্ব আর হালে পানি পাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ আরও বিভক্ত হয়ে পড়ছে। বিভাজন কেবল সাদা ও কালোর মধ্যে নয়। সেটা ১ শতাংশ ও বাকিদের মধ্যে, উচ্চশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিতদের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে বর্ণ আর একমাত্র মানদণ্ড নয়। এই ফারাক এখন শুধু মজুরির বেলায় নয়, অল্প বয়সে মৃত্যুর ক্ষেত্রেও দেখা যায়। এখন উপার্জন কমে আসার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ নাগরিকেরাও দ্রুত মারা যাচ্ছে।
আমরা যারা যুক্তরাষ্ট্রের অসমতা নিয়ে কাজ করছি, তাদের কাছে এসব তথ্য-প্রমাণ খুব একটা বিস্ময়কর নয়। এই দেশে বর্তমানে একজন পূর্ণকালীন পুরুষ চাকরিজীবীর গড় আয় ৪০ বছর আগের তুলনায় কম। কেস-ডেটনের সমীক্ষায় দেখা যায়, এই সময়ে উচ্চবিদ্যালয় পাস করা পুরুষদের আয় ১৯ শতাংশ কমে গেছে।
ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠার আশায় যুক্তরাষ্ট্রের বহু নাগরিকই মহাজনি সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। ২০০৫ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এক আইন করে পরিবারগুলোর জন্য দেউলিয়া ঘোষিত হয়ে ঋণ মওকুফ পাওয়া অনেক কঠিন করে তুলেছেন। এরপর আসে সেই মহাধস, যার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কোটি কোটি নাগরিক ঘরবাড়ি ও চাকরি হারিয়েছেন। এর সঙ্গে যখন বেকারত্ব বিমা শেষ হয়ে গেল, তখন এই মানুষদের নিজেদের দেখভাল নিজেদের করা ছাড়া আর উপায় রইল না। সামাজিক নিরাপত্তার জাল (রেশনের খাদ্য ছাড়া) আর রইল না, ওদিকে যেসব ব্যাংক এই সংকট সৃষ্টি করেছিল, সরকার সেসব ব্যাংককে সাহায্য দিয়ে টিকিয়ে রাখল।
এরপর দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ নাগরিকের পক্ষেই আর মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। মহাধসের সময় তাদের দুর্বলতা পরিষ্কার হয়ে উঠল। যাঁরা স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের টাকা উধাও হয়ে গেল। যাঁরা নিরাপদ ভেবে সরকারি বন্ডে টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের অবসরকালীন উপার্জন প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এল। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ফেড) ক্রমাগতভাবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের সুদের হার কমাচ্ছিল। টিউশন ফি আকাশছোঁয়া হয়ে গেলে ঋণই হয়ে ওঠে একমাত্র ভরসার স্থল। কিন্তু শিক্ষাঋণ কখনোই মওকুফ হয় না বলে এই ঋণ আগের ঋণের চেয়েও বড় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এই ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপে পড়ে মধ্যবিত্তরা চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছিল, এ ছাড়া তাদের আর গত্যন্তরও ছিল না। ফলে মাদক ও অ্যালকোহল গ্রহণ এবং আত্মহত্যার পরিমাণ যে বেড়ে যাবে, তাতে বিস্ময়ের কী আছে।
১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে যখন আমি বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলাম, তখন রাশিয়া থেকেও এমন মন খারাপ করা খবর আসত। আমাদের তথ্য-উপাত্তে দেখা গেল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর দেশটির জিডিপি ৩০ শতাংশ কমে গেছে। রাশিয়ার পুরুষদের গড় আয়ু কমছিল, অথচ সারা পৃথিবীতে তা বাড়ছিল। এতে বোঝা যায়, রাশিয়ার অবস্থা তখন ভালো ছিল না, বিশেষ করে ছোট শহর ও গ্রামের অবস্থা।
আমি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কমিশন অন দ্য মেজারমেন্ট অব ইকোনমিক পারফরম্যান্স অ্যান্ড সোশ্যাল প্রগ্রেসের সহসভাপতি ছিলাম, যেখানে ডেটনও কাজ করেছেন। আমরা আগেই বলেছিলাম, জিডিপি দিয়ে একটি সমাজের ভালোমন্দ ঠিকমতো বোঝা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের সাদা পুরুষদের স্বাস্থ্য–বিষয়ক যে চিত্র আমরা দেখলাম, তাতে এই সিদ্ধান্ত আরও নিশ্চিত হয়। মধ্যবিত্তরা পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি, তারা এখন সাবেক মধ্যবিত্ত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন অর্থনীতিবিদ।
যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চবিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত বা তার চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন সাদা ও মধ্যবয়সীদের ওপর বিপুলসংখ্যক তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কেস ও ডেটন দেখিয়েছেন, তাদের যেমন গড় আয়ু কমছে, তেমনি স্বাস্থ্যও খারাপ হচ্ছে। এর কারণগুলো হচ্ছে আত্মহত্যা, ওষুধ ও অ্যালকোহল আসক্তি। বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র গর্ববোধ করে, ২০০৯ সাল ছাড়া প্রতিবছরই দেশটির মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে। এই সমৃদ্ধির একটি সম্ভাব্য লক্ষণ হচ্ছে ভালো স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি (জিডিপির অনুপাতে) ব্যয় করলেও মানুষের আয়ুর দিক থেকে কিন্তু সে সর্বোচ্চ অবস্থায় নেই। যেমন: ফ্রান্স স্বাস্থ্যসেবায় জনপ্রতি জিডিপির ১২ শতাংশেরও কম ব্যয় করে, আর যুক্তরাষ্ট্র করে ১৭ শতাংশ। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের গড় আয়ু ফরাসিদের চেয়ে তিন বছর কম।
অনেক মানুষ বহু বছর ধরেই এই ফারাককে যুক্তি দিয়ে সিদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা যুক্তি দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ, ফলে শ্বেতাঙ্গ ও আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূতদের গড় আয়ুর পার্থক্যের কারণেই ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের গড় আয়ুর মধ্যে এই ফারাক সৃষ্টি হয়েছে। হ্যাঁ, স্বাস্থ্য খাতে বর্ণগত ফারাকের ব্যাপারটা সত্যিই আছে। ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষার ফলাফল অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে সাদাদের তুলনায় কালো পুরুষ ও নারীদের গড় আয়ু যথাক্রমে পাঁচ ও চার বছর কম। এই বৈষম্য স্রেফ মার্কিন সমাজের বৈচিত্র্যের নির্বিষ ফল নয়। এটা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের অসম্মানের লক্ষণ, অর্থাৎ আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূতদের বিরুদ্ধে চলমান সর্বব্যাপক বৈষম্যের ফল। সাদাদের তুলনায় কালোদের গড় আয় ৬০ শতাংশ কম। এই নিম্ন আয়ের ব্যাপারটা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে এ কারণে যে যুক্তরাষ্ট্রই পৃথিবীর একমাত্র উন্নত দেশ, যেখানে স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
অনেকে শ্বেতাঙ্গদের অল্প বয়সে মারা যাওয়ার দায়টা আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূতদের ঘাড়ে চাপিয়েছেন। কারণ হিসেবে তাঁরা কালোদের ‘জীবনযাপনের’ ধরন উল্লেখ করেছেন। এটা সম্ভবত সত্য যে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের অভ্যাস দরিদ্রদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। কিন্তু এই অভ্যাসগুলো আসলে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিণতিতেই গড়ে ওঠে, বর্ণবাদী চাপের কথা নাই বা বললাম।
কেস-ডেটনের সমীক্ষার ফলাফলে এটাই বোঝা যায় যে এসব তত্ত্ব আর হালে পানি পাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ আরও বিভক্ত হয়ে পড়ছে। বিভাজন কেবল সাদা ও কালোর মধ্যে নয়। সেটা ১ শতাংশ ও বাকিদের মধ্যে, উচ্চশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিতদের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে বর্ণ আর একমাত্র মানদণ্ড নয়। এই ফারাক এখন শুধু মজুরির বেলায় নয়, অল্প বয়সে মৃত্যুর ক্ষেত্রেও দেখা যায়। এখন উপার্জন কমে আসার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ নাগরিকেরাও দ্রুত মারা যাচ্ছে।
আমরা যারা যুক্তরাষ্ট্রের অসমতা নিয়ে কাজ করছি, তাদের কাছে এসব তথ্য-প্রমাণ খুব একটা বিস্ময়কর নয়। এই দেশে বর্তমানে একজন পূর্ণকালীন পুরুষ চাকরিজীবীর গড় আয় ৪০ বছর আগের তুলনায় কম। কেস-ডেটনের সমীক্ষায় দেখা যায়, এই সময়ে উচ্চবিদ্যালয় পাস করা পুরুষদের আয় ১৯ শতাংশ কমে গেছে।
ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠার আশায় যুক্তরাষ্ট্রের বহু নাগরিকই মহাজনি সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। ২০০৫ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এক আইন করে পরিবারগুলোর জন্য দেউলিয়া ঘোষিত হয়ে ঋণ মওকুফ পাওয়া অনেক কঠিন করে তুলেছেন। এরপর আসে সেই মহাধস, যার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কোটি কোটি নাগরিক ঘরবাড়ি ও চাকরি হারিয়েছেন। এর সঙ্গে যখন বেকারত্ব বিমা শেষ হয়ে গেল, তখন এই মানুষদের নিজেদের দেখভাল নিজেদের করা ছাড়া আর উপায় রইল না। সামাজিক নিরাপত্তার জাল (রেশনের খাদ্য ছাড়া) আর রইল না, ওদিকে যেসব ব্যাংক এই সংকট সৃষ্টি করেছিল, সরকার সেসব ব্যাংককে সাহায্য দিয়ে টিকিয়ে রাখল।
এরপর দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ নাগরিকের পক্ষেই আর মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। মহাধসের সময় তাদের দুর্বলতা পরিষ্কার হয়ে উঠল। যাঁরা স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের টাকা উধাও হয়ে গেল। যাঁরা নিরাপদ ভেবে সরকারি বন্ডে টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের অবসরকালীন উপার্জন প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এল। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ফেড) ক্রমাগতভাবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের সুদের হার কমাচ্ছিল। টিউশন ফি আকাশছোঁয়া হয়ে গেলে ঋণই হয়ে ওঠে একমাত্র ভরসার স্থল। কিন্তু শিক্ষাঋণ কখনোই মওকুফ হয় না বলে এই ঋণ আগের ঋণের চেয়েও বড় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এই ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপে পড়ে মধ্যবিত্তরা চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছিল, এ ছাড়া তাদের আর গত্যন্তরও ছিল না। ফলে মাদক ও অ্যালকোহল গ্রহণ এবং আত্মহত্যার পরিমাণ যে বেড়ে যাবে, তাতে বিস্ময়ের কী আছে।
১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে যখন আমি বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলাম, তখন রাশিয়া থেকেও এমন মন খারাপ করা খবর আসত। আমাদের তথ্য-উপাত্তে দেখা গেল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর দেশটির জিডিপি ৩০ শতাংশ কমে গেছে। রাশিয়ার পুরুষদের গড় আয়ু কমছিল, অথচ সারা পৃথিবীতে তা বাড়ছিল। এতে বোঝা যায়, রাশিয়ার অবস্থা তখন ভালো ছিল না, বিশেষ করে ছোট শহর ও গ্রামের অবস্থা।
আমি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কমিশন অন দ্য মেজারমেন্ট অব ইকোনমিক পারফরম্যান্স অ্যান্ড সোশ্যাল প্রগ্রেসের সহসভাপতি ছিলাম, যেখানে ডেটনও কাজ করেছেন। আমরা আগেই বলেছিলাম, জিডিপি দিয়ে একটি সমাজের ভালোমন্দ ঠিকমতো বোঝা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের সাদা পুরুষদের স্বাস্থ্য–বিষয়ক যে চিত্র আমরা দেখলাম, তাতে এই সিদ্ধান্ত আরও নিশ্চিত হয়। মধ্যবিত্তরা পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি, তারা এখন সাবেক মধ্যবিত্ত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন অর্থনীতিবিদ।
No comments