দাতাকে চিনতে হবে by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

দাতাকে চিনতে হবে, না হলে কাজ হবে না। আমরা দাতাকেই চিনি না। নিজেই সর্বেসর্বা হয়ে বসি। যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত সেদিন বলে গেলেন, এ দেশে আইএস জেঁকে বসার আগে ওদের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। তা না হলে কাজ হবে না, যেমনটি ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্যে। সাদ্দামকে ফাঁসিতে ঝোলাতে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নতুন আলকায়েদা। তাতে আরো কষ্টকর হলো সব কিছু। ১০ বছর আগে থেকেই বলা হচ্ছিল কাউকে-না-কাউকে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। না হলে বাধবে লড়াই।
ইরাকে বেশ কয়েকবার গিয়েছি ব্যাবিলন সঙ্গীত সম্মেলনে যোগ দিতে। একবারও সাদ্দামের সাথে দেখা হয়নি। বলা হলো উনি ব্যস্ত ইরাক-ইরান যুদ্ধ নিয়ে। তাকে বলতে চেয়েছিলাম- সঙ্ঘাত নয়, আলোচনার পথেই ইরাক নিজেকে সামলে নিতে পারবে। এ দিকে সঙ্ঘাত দিনে দিনে বেড়ে গেল। তারপর যুদ্ধ। লাখ লাখ লোক মারা গেল। এখন আমেরিকা বেরিয়ে আসতে চাইলেও পারছে না। যদি আগে থেকে আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত থাকত, এমনটি হয়তো হতো না। এই ধ্বংসযজ্ঞ এড়ানো যেত। আসল দাতাকে চিনতে চাই না। দাতার কাছে ক্ষমা চাইলে সহজে হবে পার্থিব সঙ্ঘাতের সমাধান।
সাদ্দামের সাথে দেখা না হলেও, হলো জসীমের সাথে, তার তথ্যমন্ত্রী। এ কথা সে কথার পর জানালাম, সম্ভব হলে সাদ্দামের সাথে দেখা করতে চাই। বলল, সম্ভব হবে না। জানতে চাইল কেন? বললাম এ জন্য যে, আমেরিকার সাথে সে একটা রফা করুক এটাই আমার ইচ্ছা। তা না হলে আমেরিকা তাকে বাঁচতে দেবে না। কথাটা জসীম উড়িয়ে দিলো না। বলল, আমরা মার্কিনিদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি যে, আমাদের কাছে লুকানো মারণাস্ত্র নেই। ওরা বলছে, সেটা এক দিন না এক দিন প্রমাণ হবেই। ১০ বছর পর আজো প্রমাণ হয়নি যে, ওদের কাছে ‘ডব্লিউএমডি’ অথবা ‘ওইপেন্স অব মাস ডেস্ট্রাকশন’, অর্থাৎ গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল। তবুও কৌশলটি ওদের কাজে লেগেছে। মুসলমানদের তিন নেতা ভুট্টো, সাদ্দাম ও গাদ্দাফিকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো। শেষ ফলাফল কারো জানা নেই। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালার হাতে। আল্লাহ অসীম রহমতের অধিকারী। যদি তার কাছে ক্ষমা চাওয়া না হয়, ফলাফল কী হবে, তা কল্পনাও করা যায় না।
আল্লাহ চাইছেন যেন বান্দারা অপরকেও মূল্য দেয়। না দিলে ফলাফল হবে সঙ্ঘাত। অনেক প্রাণ বিসর্জিত হবে। সব জীবের প্রতি যিনি দয়ালু, কারো প্রতি বিন্দুমাত্র তারতম্য প্রদর্শন না করে তিনি রহমান, পরমদয়ালু। রহমানকে অন্তর থেকে উপলব্ধি করার জন্য প্রয়োজন দয়ালু হৃদয়ের। যে দয়ালু নয়, তার প্রার্থনার কী দাম? যে দয়ালু নয়, সে সমাজে প্রভাবপ্রতিপত্তি সত্ত্বেও তার জন্য কারো ভালোবাসা সচরাচর প্রত্যক্ষ করা যায় না। তাই দয়ার সমুদ্র যিনি, তার কাছ থেকেই শিক্ষা নিতে হবে দাক্ষিণ্য। সংসারে অনেক ভালো লোক আছেন যারা হিসাবে অনড়, হিসাবের কড়ায় গণ্ডায় ওপরের সিঁড়ি বেয়ে সর্বোচ্চ আসনে স্থান নিয়েছেন, দয়াদাক্ষিণ্যের ধার দিয়েও যাননি। জীবনের শেষ প্রান্তে দয়াময়কে খোঁজার জন্য পরিপূর্ণ আবেগে ছুটে আসেন মসজিদে। ঢোকার মুহূর্তে তাদের দিকে চেয়ে আছেন নিরন্ন মানুষ। ঢুকছেন যিনি তার শেখা একটিই মন্ত্র : ‘মাফ কর, মাফ কর।’ পকেটে পয়সা আর বাড়ি গাড়ি সবই আছে। কয়েকটি টাকা পকেট থেকে বের করতে কতই না দ্বিধা সংশয়। করুণাময়কে সারা দিন জপ করলেও লাভ হবে না। করুণাময়কে পেতে করুণার চর্চায় নিজেকে বিলিয়ে তবেই ঢুকতে হয় মসজিদে। তার চেয়ে আল্লাহকে বলি সারা দিন : ক্ষমা করো, প্রভু।
যে লোকটি সঞ্চয় থেকে একটি সিকি কবুল করল অভাবীর কাছে, কত সহজে তার অশ্রুবন্যা প্রবাহিত হলো। সেদিনের মতো তার ইবাদত আল্লাহর কাছে হলো সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। দয়াল দাতা আল্লাহর কাছে তার নাম দাতা হিসেবে লিপিবদ্ধ হলো। একটি সিকির দাতা সারা দিন কী আনন্দের মধ্যে অতিবাহিত করলো তা শুধু সেই জানে।
ভারত-পাকিস্তান সামনাসামনি যুদ্ধাবস্থায়। দু’পক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, কার এমন সাহস আছে? পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফ, তাকে আগে চিনতাম। এখন নয়। দেখা হলে কুরআন শরিফ নিয়ে তার সামনে এগিয়ে দিতাম। বলতাম, দেখো এই জায়গায় : ‘তানজিলুম মিনার রাহমানির রাহিম’। পরমদয়ালু দয়ালুর দিকে তাকাও। তা হলে তোমার ভারী মন করে দেয়া হবে পাখির পালকের মতো নরম। রহমানের নাম উচ্চারণের সাথে সাথে যদি তোমার অন্তর থেকে একটি স্র্রোত প্রবাহিত হয়, তা হলেই তুমি সফল। এই নামটি জপ করার সাথে সাথে প্রবাহের শুরু। জপ করতে করতে তুমি পৌঁছে যাবে দয়ার সাগরে।
কুরআনে ‘আর রহমান’ শব্দটি ৫৭ বার উচ্চারিত। দেশে বিদেশে ঘুরলাম অনেক। থাইল্যান্ড, জাপান ও চীনে বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে বসে থাকেন ভিক্ষুরা। তাদের কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। কেউ দিলে খান, না দিলে খান না। ওরা বসে থাকেন রহমানের আশায়। সামান্য একটু খাওয়া, এতেই খুশি। সকাল থেকে যদি কেউ রহমানের কাছে ধর্ণা দিয়ে বসেন নিজের প্রত্যাশাকে সর্বনিন্মে এনে, তা হলে তার জীবনে শান্তির সুশীতল বাতাস প্রবাহিত হবে, এটাই সত্যি। নরেন্দ্র মোদির সাথে দেখা হলে তাকে বলতাম, তার ধর্মপ্রাণতা আমার পছন্দ, কিন্তু সব ধর্মের সব মানুষের জন্য থাকতে হবে সমান ধর্মপ্রাণতা। আমার জন্যও তা প্রযোজ্য।
লেখক : সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.