ভিনদেশে ২৪ ঘণ্টা বাংলা by শামীম আজাদ
আবার
শুনছি ১৫০৩ এ এম বেতার বাংলা রেডিও। বিদেশ-বিভুঁইয়ে এই ২৪ ঘণ্টা বাংলা
রেডিওতে আমি আমার শ্বাসের শব্দ পাই। দিনের ২৪টা ঘণ্টা মাঝেমধ্যে আমাকেও
শোনেন বিলেতে এ দেশের সবাই আর অনলাইনে সারা বিশ্বের শ্রোতা। সবচেয়ে মজা
পেয়েছি লাইভ রেডিও শো খাদ্যবিলাস—মায়ের হাতের রান্নার শো করে। চিন্তা করুন,
একবার শ্রোতাদের টেলিফোন নিচ্ছি, উসকে দিচ্ছি তাদের মায়ের স্মৃতি আবার
এদিকে ইউটিউব থেকে গান লোড করে তার শানে নজুল শুনিয়ে গান শোনাচ্ছি,
পরমুহূর্তেই হয়তো দিচ্ছি অনুষ্ঠানের মেইন রেসিপি আম্মা আনোয়ারা তরফদারের
রান্নার রেসিপি, যা কিনা নিজের মায়েরই রেসিপি আর সঙ্গে নিজের টিপস ও
অলটারনেটিভ হেলদি চয়েস। আমি তখন মাথায় হেডফোন লাগিয়ে কবিতার চেয়ে ফুলকপি
নিয়েই ব্যস্ত।
প্রতি মঙ্গলবার বেলা দুইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত পুরো এক ঘণ্টা বেতার বাংলার সেলফ-অপ স্টুডিওতে সামনে বিশাল একটা বোর্ড এন্তার সুইচ নিয়ে এর সবই করছি কিছুটা ইতস্তত করে। খালি মনে হয় কী টিপে কী ভেঙে ফেলি!
ভাবা যায় বিদেশ-বিভুঁইয়ে এমন কাণ্ড? আসলে কয়েক বছর আগের চেতনা।
জার্মানি থেকে আসা নাজিম, মুক্তিযোদ্ধা নাজিম চৌধুরী, জার্মানিতে আমার প্রিয়জনের বন্ধু বলে আমারও তা-ই। তার মুখে রেডিওর কথা শুনে নাজিমের সেই স্বপ্নঘোড়ায় লাফিয়ে উঠেছিলাম আর একদল উৎসাহী তরুণ-তরুণীকে স্ক্রিপ্ট লেখার ট্রেনিং দেওয়ার সময় নিজেও তাদের সঙ্গে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। কারণ, এ রেডিওতে যে কথা বলবে, সেই চালাবে—হবে সেলফ অপ। লোল গ্যালর ও কুশার দিলেন সেই ইনটেনসিভ ট্রেনিং। আমরা মাইন্ড ম্যাপিং থেকে ময়লা ফেলা আর ব্রডকাস্ট থেকে কুল এডিট—সবই শিখেছিলাম এবং পরীক্ষামূলক অনুষ্ঠান শুরু করেছিলাম। তারপর ঘষটাতে ঘষটাতে এই এত দূর।
কিন্তু আমি কি আর কুড়ি বয়সী এই ছেলেমেয়ের সঙ্গে পারি? রিলে রেসে পিছিয়ে পড়লাম কিন্তু মাঠে থাকলাম। কখনো ক্যাম্পেইনে, কখনো পরামর্শে, কখনো প্রোগ্রামে। অনভ্যাসে সব বিদ্যা হ্রাস হয়ে এখন লেগে আছে শুধু মুখে আর লেখায়। আজাদের দুই দুটো স্ট্রোক হয়ে পেসমেকার লাগানোর পর আমি বাইরের পৃথিবীর স্পেস থেকে ক্রমেই সরে এসেছিলাম। এখন তো সেও নেই।
মনে পড়ে গেল গত বছর আমার অনুষ্ঠানের শেষের দিকে আমি। স্টুডিওর ২ নম্বর নন সি থ্রু সাদা দরজাটা খোলা। হট সিট থেকে কাচের দেয়ালের ভেতর থেকে কে এল বা কে গেল দেখা যায়। দেখা যায় রিসেপশনের বিশাল ডেস্কটপ, হাজিরা বই, পাশে অর্ধভুক্ত চায়ের কাপ। পাশের প্যাসেজ, যেটা কিচেন পেরিয়ে বিগ বস ব্রাদার নাজিম চৌধুরীর অফিস। আমাদের তরুণ ও দক্ষ আরজেরা ওটা বন্ধই রাখে। আমি খোলা রাখি যাতে বাইরে থেকে শিপলু বা রুণা আমাকেই মনিটর করতে পারে।
শ্রোতাদের পছন্দের গান ছেড়ে মাত্র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁফ ছেড়েছি। তিন মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে আমার রাজহাঁসে চড়ে আজাদকে আনতে যেতে হবে রেস্পাইট থেকে। প্রতি বুধবার সকাল দশটা থেকে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত সেই রেস্পাইট ডিমেনশিয়া সেন্টার তাকে রাখে। গান, কুইজ, বেড়ানো—সবই ওরা সোনালি যবের মতো সুপক্ব মানুষের জন্য করে। আমি সে সুযোগে বাজার-হাট, ব্যাংক আর রেডিওর আরজেগিরি করি। বেরিয়ে আসার হুটোপুটিতে দেখিইনি ওই সাদা দরজার ভেতরে ঢুকে কেউ একজন কাচে লেপ্টে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। পোলো ক্যাপ পরা, দুই হাতে কী যেন ভরা নীল দুই প্লাস্টিক ব্যাগে অচেনা এক পুরুষ। হাসছে, যেন আমার অনেক চেনা।
বেরোতেই আপা স্লামালিকুম, আমি সাদিক। ওয়ালাইকুম, আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আপা, খুব মন দিয়ে আপনার অনুষ্ঠান শুনি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার বাংলা টিভির গৌরবের একাত্তর দেখি। আজ খাদ্যবিলাস শুনছিলাম লেইটনস্টোনে আমার খেতে—মানে? অ্যালটমেন্ট থেকে। আরে এ তো দেখি নগর চাষি! সেখানে শোনেন কী করে? আমার একটা ডিজিটাল সোলার রেডিও আছে। ওটা শুনতে শুনতে খেতে কাজ করি। আপা, আমরা তো সবাই মূলত কৃষক সন্তান...বাংলাদেশ এক গ্রামের নাম। আপনার অনুষ্ঠানে আমি দেশের মাটির রং দেখি, গন্ধ পাই। ওর কথা শুনতে শুনতে আমি এগোই...আজ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে সাঁই সাঁই করে সাইকেল চালিয়ে এসে গেছি। প্রিচিত হতে আর আপনার জন্য এই ঝোলায় কিছু শাক ও সুগন্ধি। থ্যাঙ্ক গড, পেয়েও গেলাম। মাই গড, আপনি জোন থ্রি থেকে সাইকেল চালিয়ে এই জোন ওয়ানে এসেছেন? জি আপা, এই যে খেতের পালংশাক, ধনিয়া, মৌরি পাতা ও জার্মান রকেট। আমি অভিভূত। পা সরে না। পরিযায়ী শামীম আজাদের আর কী চাই। এত ভালোবাসা এই রেডিও-টিভির কারণে!
গাড়ি ছুটল রমফোর্ডের রেস্পাইটের দিকে। বাতাসে বাতাসে প্রপেলার হয়ে সিকামোর উড়ছে। রেডিওতে বেতার বাংলায় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের অনুষ্ঠান। আমি মানসী বড়ুয়াকে শুনছি। আমার পাশের সিটে সাদিকের প্যাকেটগুলো। কী মনে হলো ট্রাফিক সিগন্যালে থামার সময় বাঁ হাতে কুস্তাকুস্তি করে একটা ব্যাগ খুলতেই গাড়ির ভেতর মিষ্টি মৌরির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। আমার তর সইল না, একটু ছিঁড়ে মুখে দিলাম। আহ্, সুগন্ধ আর মিষ্টিই ই ই!! আহ্, মিষ্টান্নের মতো সেই স্মৃতি।
এক দশক আগে বিলেতে একটি বাংলা ভাষার রেডিও হওয়ার চিন্তা নিয়ে কথা বলেছিলাম নাজিম চৌধুরীর সঙ্গে। আমরা সমবয়সী কিন্তু নাজিম আমাকে ডাকে শামীম আপা। আজ পূর্ব লন্ডনের শ্যাডোয়েলের হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের গেটের ভেতরে ঢুকলেই সেই স্বপ্নের বাস্তবতা। তারুণ্যে ভরপুর এক মিলনমেলা। বৈশাখী মেলা। ১৫০৩ এ এম আর ইন্টারনেটে তিন ডব্লিউর পর ডট অর্গ ডট ইউকে। এখন মন-প্রাণ ভাসিয়ে বিলেত থেকে আসা দুনিয়ার কথা শুনুন কিন্তু বাংলায়।
শামীম আজাদ: কবি ও কলামিস্ট।
lekhok@gmail.com
প্রতি মঙ্গলবার বেলা দুইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত পুরো এক ঘণ্টা বেতার বাংলার সেলফ-অপ স্টুডিওতে সামনে বিশাল একটা বোর্ড এন্তার সুইচ নিয়ে এর সবই করছি কিছুটা ইতস্তত করে। খালি মনে হয় কী টিপে কী ভেঙে ফেলি!
ভাবা যায় বিদেশ-বিভুঁইয়ে এমন কাণ্ড? আসলে কয়েক বছর আগের চেতনা।
জার্মানি থেকে আসা নাজিম, মুক্তিযোদ্ধা নাজিম চৌধুরী, জার্মানিতে আমার প্রিয়জনের বন্ধু বলে আমারও তা-ই। তার মুখে রেডিওর কথা শুনে নাজিমের সেই স্বপ্নঘোড়ায় লাফিয়ে উঠেছিলাম আর একদল উৎসাহী তরুণ-তরুণীকে স্ক্রিপ্ট লেখার ট্রেনিং দেওয়ার সময় নিজেও তাদের সঙ্গে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। কারণ, এ রেডিওতে যে কথা বলবে, সেই চালাবে—হবে সেলফ অপ। লোল গ্যালর ও কুশার দিলেন সেই ইনটেনসিভ ট্রেনিং। আমরা মাইন্ড ম্যাপিং থেকে ময়লা ফেলা আর ব্রডকাস্ট থেকে কুল এডিট—সবই শিখেছিলাম এবং পরীক্ষামূলক অনুষ্ঠান শুরু করেছিলাম। তারপর ঘষটাতে ঘষটাতে এই এত দূর।
কিন্তু আমি কি আর কুড়ি বয়সী এই ছেলেমেয়ের সঙ্গে পারি? রিলে রেসে পিছিয়ে পড়লাম কিন্তু মাঠে থাকলাম। কখনো ক্যাম্পেইনে, কখনো পরামর্শে, কখনো প্রোগ্রামে। অনভ্যাসে সব বিদ্যা হ্রাস হয়ে এখন লেগে আছে শুধু মুখে আর লেখায়। আজাদের দুই দুটো স্ট্রোক হয়ে পেসমেকার লাগানোর পর আমি বাইরের পৃথিবীর স্পেস থেকে ক্রমেই সরে এসেছিলাম। এখন তো সেও নেই।
মনে পড়ে গেল গত বছর আমার অনুষ্ঠানের শেষের দিকে আমি। স্টুডিওর ২ নম্বর নন সি থ্রু সাদা দরজাটা খোলা। হট সিট থেকে কাচের দেয়ালের ভেতর থেকে কে এল বা কে গেল দেখা যায়। দেখা যায় রিসেপশনের বিশাল ডেস্কটপ, হাজিরা বই, পাশে অর্ধভুক্ত চায়ের কাপ। পাশের প্যাসেজ, যেটা কিচেন পেরিয়ে বিগ বস ব্রাদার নাজিম চৌধুরীর অফিস। আমাদের তরুণ ও দক্ষ আরজেরা ওটা বন্ধই রাখে। আমি খোলা রাখি যাতে বাইরে থেকে শিপলু বা রুণা আমাকেই মনিটর করতে পারে।
শ্রোতাদের পছন্দের গান ছেড়ে মাত্র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁফ ছেড়েছি। তিন মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে আমার রাজহাঁসে চড়ে আজাদকে আনতে যেতে হবে রেস্পাইট থেকে। প্রতি বুধবার সকাল দশটা থেকে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত সেই রেস্পাইট ডিমেনশিয়া সেন্টার তাকে রাখে। গান, কুইজ, বেড়ানো—সবই ওরা সোনালি যবের মতো সুপক্ব মানুষের জন্য করে। আমি সে সুযোগে বাজার-হাট, ব্যাংক আর রেডিওর আরজেগিরি করি। বেরিয়ে আসার হুটোপুটিতে দেখিইনি ওই সাদা দরজার ভেতরে ঢুকে কেউ একজন কাচে লেপ্টে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। পোলো ক্যাপ পরা, দুই হাতে কী যেন ভরা নীল দুই প্লাস্টিক ব্যাগে অচেনা এক পুরুষ। হাসছে, যেন আমার অনেক চেনা।
বেরোতেই আপা স্লামালিকুম, আমি সাদিক। ওয়ালাইকুম, আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আপা, খুব মন দিয়ে আপনার অনুষ্ঠান শুনি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার বাংলা টিভির গৌরবের একাত্তর দেখি। আজ খাদ্যবিলাস শুনছিলাম লেইটনস্টোনে আমার খেতে—মানে? অ্যালটমেন্ট থেকে। আরে এ তো দেখি নগর চাষি! সেখানে শোনেন কী করে? আমার একটা ডিজিটাল সোলার রেডিও আছে। ওটা শুনতে শুনতে খেতে কাজ করি। আপা, আমরা তো সবাই মূলত কৃষক সন্তান...বাংলাদেশ এক গ্রামের নাম। আপনার অনুষ্ঠানে আমি দেশের মাটির রং দেখি, গন্ধ পাই। ওর কথা শুনতে শুনতে আমি এগোই...আজ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে সাঁই সাঁই করে সাইকেল চালিয়ে এসে গেছি। প্রিচিত হতে আর আপনার জন্য এই ঝোলায় কিছু শাক ও সুগন্ধি। থ্যাঙ্ক গড, পেয়েও গেলাম। মাই গড, আপনি জোন থ্রি থেকে সাইকেল চালিয়ে এই জোন ওয়ানে এসেছেন? জি আপা, এই যে খেতের পালংশাক, ধনিয়া, মৌরি পাতা ও জার্মান রকেট। আমি অভিভূত। পা সরে না। পরিযায়ী শামীম আজাদের আর কী চাই। এত ভালোবাসা এই রেডিও-টিভির কারণে!
গাড়ি ছুটল রমফোর্ডের রেস্পাইটের দিকে। বাতাসে বাতাসে প্রপেলার হয়ে সিকামোর উড়ছে। রেডিওতে বেতার বাংলায় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের অনুষ্ঠান। আমি মানসী বড়ুয়াকে শুনছি। আমার পাশের সিটে সাদিকের প্যাকেটগুলো। কী মনে হলো ট্রাফিক সিগন্যালে থামার সময় বাঁ হাতে কুস্তাকুস্তি করে একটা ব্যাগ খুলতেই গাড়ির ভেতর মিষ্টি মৌরির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। আমার তর সইল না, একটু ছিঁড়ে মুখে দিলাম। আহ্, সুগন্ধ আর মিষ্টিই ই ই!! আহ্, মিষ্টান্নের মতো সেই স্মৃতি।
এক দশক আগে বিলেতে একটি বাংলা ভাষার রেডিও হওয়ার চিন্তা নিয়ে কথা বলেছিলাম নাজিম চৌধুরীর সঙ্গে। আমরা সমবয়সী কিন্তু নাজিম আমাকে ডাকে শামীম আপা। আজ পূর্ব লন্ডনের শ্যাডোয়েলের হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের গেটের ভেতরে ঢুকলেই সেই স্বপ্নের বাস্তবতা। তারুণ্যে ভরপুর এক মিলনমেলা। বৈশাখী মেলা। ১৫০৩ এ এম আর ইন্টারনেটে তিন ডব্লিউর পর ডট অর্গ ডট ইউকে। এখন মন-প্রাণ ভাসিয়ে বিলেত থেকে আসা দুনিয়ার কথা শুনুন কিন্তু বাংলায়।
শামীম আজাদ: কবি ও কলামিস্ট।
lekhok@gmail.com
No comments