মোদির টার্গেট কানেকটিভিটি by মাসুদ করিম
কানেকটিভিটি'র (সংযোগ) নামে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার বিষয়টি আবারো আলোচনায় |
ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসন্ন বাংলাদেশ সফরকালে কানেকটিভিটি বাড়ানোর
ওপর দেশটি অধিক গুরুত্ব আরোপ করছে। এই কানেকটিভিটির আওতায় বাংলাদেশের
পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী ভারত। চট্টগ্রাম ও মংলা
সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ওই দেশটি আরও ১৫টি রুটে
ট্রানজিটও চায়। এছাড়া তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য এবং
যাত্রী পরিবহনে নৌ, সড়ক, রেল ও সমুদ্রপথে সংযোগ বাড়াতে চায় ভারত। এজন্য
উপযুক্ত অবকাঠামো উন্নয়নে তারা প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতেও প্রস্তুত।
জুনের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ সফরে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ভারতের পক্ষ থেকে আগামী ৬ ও ৭ জুন এই সফরের প্রস্তাব করা হয়েছে। চূড়ান্ত তারিখ ঘোষণা করা হবে সফরের ১০ দিন আগে। মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তার অংশ হিসেবে তিনি প্রথম সফর করেন ভুটান। বাংলাদেশ সফরও এরই অংশ। এই সফরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনা আছে। সম্প্রতি সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করেছে ভারত। এতে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সমস্যার সমাধান হচ্ছে। এই বিল পাস করায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে উষ্ণতার আবহ তৈরি হয়েছে, যা এই সফরের ওপর প্রভাব ফেলবে। এছাড়া তিস্তার ব্যাপারেও কিছুটা সুখবর দিতে পারেন মোদি। ইতিমধ্যেই তিনি এ বিষয়ে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের মধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। মোদির সফরে তিস্তা চুক্তির সম্ভাবনা কম। তবে চুক্তি সম্পাদনে মোদির সদিচ্ছা পুনর্ব্যক্ত করতে পারেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন বাংলাদেশ সফরকালে যেসব ক্ষেত্রে বড় চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা আছে সেগুলোর সঙ্গেও কানেকটিভিটির প্রশ্ন জড়িত। উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি সই হলে ভারতের তিনটি সমুদ্রবন্দর অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তম, উড়িষ্যার প্যারাদ্বীপ ও কলকাতার হলদিয়া বন্দরের সঙ্গে বাংলাদেশের মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হবে। এই বন্দরগুলোর মধ্যে মাঝারি আকৃতির পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করবে। এদিকে দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান নৌ ট্রানজিট চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির ফলেও কানেকটিভিটি বাড়বে।
চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আরও ১৫টি রুটে ট্রানজিট চাইছে ভারত। এসব বিষয় এখন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। দুর্বল অবকাঠামো, পর্যাপ্ত পরিবহনের অভাব এবং ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের চূড়ান্ত মাশুল নির্ধারণ না হওয়ায় এসব বিষয়ে দ্রুত অগ্রগতি সাধন করা সম্ভব হচ্ছে না। নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফরকালে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার এসব ক্ষেত্রে গতি সঞ্চারের চেষ্টা থাকবে বলে মনে হচ্ছে।
মোদির সফরে কী ইস্যু অধিক গুরুত্ব পাবে জানতে চাইলে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করেছেন ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি রোববার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশে এটা তার প্রথম সফর। সফরকালে সব ইস্যুই আলোচনা হবে। বিশেষ করে এই সফরের ঠিক আগে ভারতের পার্লামেন্টে সীমান্ত চুক্তির বিল পাস হওয়ায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইনপুট হিসেবে কাজ করবে। এছাড়াও অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন, কানেকটিভিটি প্রভৃতি ইস্যুতে আলোচনা হবে বলে মনে করি।’ কানেকটিভিটি ইস্যু সম্পর্কে বীণা সিক্রি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরে কানেকটিভিটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে আলোচনা হবে। নৌ ট্রানজিটসহ অন্যান্য ট্রানজিটের ব্যাপারে অনেক চুক্তি ও ডকুমেন্ট ইতিমধ্যেই দু’দেশের মধ্যে রয়েছে। এখন সেগুলোর কার্যকর ব্যবহারের লক্ষ্যে আরও আলোচনা হবে। বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ ভারত আগেই দিয়েছে। আমি নিশ্চিত, প্রধানমন্ত্রী মোদি ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশের জন্য আরও নতুন ঋণ ঘোষণা করবেন।’
মোদির সফর সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত অভিমত, মোদি এবারের সফরকালে ট্রানজিটের ব্যাপারে বড় কোনো চাপ সৃষ্টি করবেন না। কারণ এটা তার প্রথম সফর। তিনি সম্ভবত কানেকটিভিটির জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তার প্রতি জোর দেবেন। অবকাঠামো উন্নয়ন হয়ে গেলে ট্রানজিট পাওয়ার বিষয়ে ভারতের পক্ষে বড় একটি যুক্তি দাঁড় করানো সম্ভব হবে। এই মুহূর্তে ট্রানজিটের পক্ষে বড় যুক্তি দেখানো সম্ভব নয়।’
তৌহিদ হোসেন মনে করেন, ‘সীমান্ত চুক্তি সম্পাদন করে ভারত আসলে বাংলাদেশকে কিছু দেয়নি। দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা একটি সমস্যার নিষ্পত্তি করেছে। তার বিনিময়ে ট্রানজিট পাওয়া যৌক্তিক নয়। তাছাড়া তিস্তা চুক্তি এখনই হচ্ছে না। মোদি তার সফরে মমতা ব্যানার্জিকে সঙ্গে নিয়ে আসার মানে হল তিস্তার ইস্যুতে কিছু অগ্রগতি হতে পারে। ফলে এই সফরেই ট্রানজিটের জন্য জোরালো কিছু হওয়ার কথা নয়। ট্রানজিট নিয়ে নীতিগত আলোচনা হতে পারে।’
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ভারতের প্রধান দুই উদ্বেগ হল নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দেশটির অবশিষ্ট অংশের সংযোগ স্থাপনে সহযোগিতা। শেখ হাসিনার সরকার গত ছয় বছরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে ভারতকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে নিরাপত্তার উদ্বেগ দূর করেছে। ভারত এ বিষয়ে সহযোগিতার কারণে বাংলাদেশের প্রতি সন্তুষ্ট। এখন কানেকটিভিটি স্থাপনে উদ্বেগ দূর করতে চায়। এক্ষেত্রে অবকাঠামো সমস্যা বড় বাধা হয়ে আছে। এজন্য তারা উপযুক্ত অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা দিতেও প্রস্তুত বলে জানা গেছে।
ঢাকায় ভারতের একজন কূটনীতিক বলেছেন, মোদির সরকারের ঝোঁক হল ব্যবসা-বাণিজ্য জোরদারের মাধ্যমে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কানেকটিভিটি অপরিহার্য। যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ উপকৃত হবেন। ফলে পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতেই দুই দেশ উন্নয়নের পথে অগ্রসর হবে।
নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক সূত্র মতে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে ভারতকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতকে সহায়তা করতে হবে। বাংলাদেশের সরকারি হিসেবে, কানেকটিভিটির জন্য বাংলাদেশকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে অবকাঠামো খাতে কমপক্ষে এক হাজার চারশ’ কোটি ডলার বিনিয়োগ দরকার। সরকারের একার পক্ষে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ জোগান দেয়া সম্ভব নয়। তাই এই খাতে বিদেশী বিনিয়োগকে স্বাগত জানায় বাংলাদেশ। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারত বেশি সুবিধা ভোগ করবে বিধায় অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এমন দাবিকে ভারত যৌক্তিক বলে মনে করে বিধায় অবকাঠামোর উন্নয়নে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে। এক্ষেত্রে ভারত ইতিমধ্যেই দেয়া একশ’ কোটি ডলারের পাশাপাশি নতুন আরও প্রায় তিনশ’ কোটি ডলার ঋণ দিতে আগ্রহী বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এতেও অবকাঠামো পুরোপুরি উপযুক্ত হবে না। এ অবস্থায় ভারত নৌপথের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের ঋণ গ্রহণে আন্তর্জাতিক সংস্থাটির কাছে দু’দেশের যৌথ প্রস্তাব দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের আগে কানেকটিভিটি জোরদারে অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা করতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বর্তমানে ভারত সফর করছেন। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন রোববার এক বিবৃতিতে জানায়, ভারতের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিষয়ক মন্ত্রী নিতিন গড়কড়ির আমন্ত্রণে ওবায়দুল কাদের এই সফর করছেন। ১৬ থেকে ২০ মে পর্যন্ত ওবায়দুল কাদেরের এ সফর। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে অবকাঠামো খাতে ঋণের বিষয়ে সফরকালে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানা গেছে। এদিকে মোদির সফরের আগে ঢাকায় দু’দেশের বিদ্যুৎ সচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। ঢাকায় এখন দু’দেশের বাণিজ্য সচিব পর্যায়ে বৈঠক চলছে। মোদির সফরের প্রস্তুতির লক্ষ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী শিগগিরই ভারত সফরে যেতে পারেন।
ঢাকায় উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ভারত আগের ঋণের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রায় তিনশ’ কোটি ডলার নতুন ঋণ দিতে আগ্রহী রয়েছে। নতুন ঋণে নতুন প্রকল্প যেমন আছে, তেমনি আগের প্রকল্পও থাকবে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ২১৫ কোটি ডলার ঋণের প্রকল্প প্রস্তাব প্রস্তুত করতে পেরেছে। ফলে যাচাই-বাছাইয়ের পর সেখান থেকে চূড়ান্ত প্রকল্পগুলোর জন্য আসন্ন সফরে ঋণ ঘোষণা করতে পারেন মোদি।
ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে অগ্রাধিকার কানেকটিভিটি : ভারতের ঋণে যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলোতে কানেকটিভিটি অগ্রাধিকারে রয়েছে। এসব প্রকল্পে ভারতীয় ঋণের অংশ বাদে অবশিষ্ট অর্থ বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। ভারতীয় ঋণে ডবল ডেকার, সিঙ্গেল ডেকার, এসি ও নন-এসি আর্টিকুলেটেড বাস ক্রয়, রেলের জন্য ট্যাঙ্কার ওয়াগন, বগি ক্রয় ও কনটেইনার ব্রেকার, ব্রডগেজ ও ডিজেল ইলেক্ট্রিক লোকোমোটিভ, নৌপথ ও মংলা বন্দরের জন্য ড্রেজার ক্রয়, খুলনা-মংলা বন্দর রেললাইনের সম্ভাব্যতা যাচাই, ভৈরব সেতু ও অ্যাপ্রোচ রেললাইন নির্মাণ প্রভৃতি প্রকল্প রয়েছে।
নতুন করে ২১৫ কোটি ডলার প্রস্তাবিত ঋণে সিরাজগঞ্জ-বগুড়া রেললাইন, দর্শনা-খুলনা রেললাইন, সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপ নির্মাণ প্রকল্প রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে প্রকল্পের মধ্যে আছে সিরাজগঞ্জ-বগুড়া সঞ্চালন লাইন এবং ১৫ থেকে ২০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি প্রকল্প। নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আশুগঞ্জ নদীবন্দর উন্নয়নে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প। মহাসড়ক বিভাগের অধীনে মহাসড়ক নির্মাণে সরঞ্জাম ক্রয় এবং ১০০টি ট্রাক ক্রয় প্রকল্প। তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও দুটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
উপকূলীয় জাহাজ চলাচল ও নৌ ট্রানজিট : মোদির সফরকালে উপকূলীয় জাহাজ চলাচলে একটি চুক্তি সই হচ্ছে। এই চুক্তির অধীনে ভারতের তিনটি সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে বাংলাদেশের দুটি সমুদ্রবন্দরের মধ্যে মাঝারি আকৃতির জাহাজ চলাচল করবে। এতে সমুদ্রপথেও দু’দেশের মধ্যে কানেকটিভিটি জোরদার হবে। এই চুক্তির আওতায় শুধু পণ্য আনা-নেয়া করা যাবে। কোনো যুদ্ধজাহাজ কিংবা জরিপ জাহাজ চলাচল করতে পারবে না। এদিকে সমুদ্রপথে কানেকটিভিটি জোরদারে পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে ভারত। ভারতের দিক থেকে স্পর্শকাতরতার কারণে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই চীনের অর্থায়নে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রকল্প থেকে সরে এসেছে। এখন পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের চিন্তাভাবনা চলছে। এদিকে সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং সমুদ্র নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারতের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র সমুদ্রপথে আসার সন্দেহ রয়েছে ভারতের। বাংলাদেশের টহল দল অস্ত্র চোরাচালানি ধরতে গেলে চোরাচালানকারিরা অস্ত্র সাগরের পানিতে ফেলে দেয় বলেও ভারত মনে করে। এক্ষেত্রেও সহযোগিতা জোরদার চায় ভারত। এদিকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে নদীপথে পণ্য চলাচলে বিদ্যমান চুক্তি প্রতি দু’বছর পরপর নবায়ন করতে হয়। মোদির সফরকালে এই চুক্তি নবায়নের মেয়াদ পাঁচ বছর করা হবে। চার বছর পর কোনো পক্ষ আপত্তি না করলে পাঁচ বছর পর স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে চুক্তি নবায়ন হয়ে যাবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে নদীপথে ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজ প্রবেশ করে আশুগঞ্জ নদীবন্দরে তা খালাস করা হয়।
১৫ রুটে ট্রানজিট চায় ভারত : বাংলাদেশের ওপর দিয়ে নদী, স্থল, রেলপথে ট্রানজিট চালুর প্রস্তাব অনেক আগেই দিয়ে রেখেছে ভারত। এসব প্রস্তাব বাংলাদেশ এখন যাচাই-বাছাই করছে। তবে অবকাঠামো উন্নত না হওয়া ও মাশুল চালুর সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত না হওয়ায় প্যাকেজ আকারে ট্রানজিট প্রস্তাব ঝুলে থাকলেও এসব বিষয়ে পৃথকভাবে অগ্রগতি হচ্ছে।
বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত তার ট্রানজিট প্রস্তাবে ১৫টি রুটের উল্লেখ করেছে। এসব রুট চট্টগ্রাম কিংবা মংলা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে বিদ্যমান সংযোগের বর্ধিত অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। এসব রুট হল বাংলাদেশের এক অংশ থেকে ভারতের অন্য অংশে সংযোগ স্থাপন করবে। রুটগুলো হল আখাউড়া-আগরতলা, সাবরুম-রামগড়, দেমাগিরি-তেগামুখ, বিবিরবাজার-শ্রীরামপুর, বিলোনিয়া-বিলোনিয়া, বেতুলি-পুরনো রংনা বাজার, চাতলাপুর-মনু, তামাবিল-ডাউকি, বরসরা-বরসরা, হালুয়াঘাট-ঘাসুয়াপাড়া, সুনামগঞ্জ-সেলবাজার, দর্শনা-গেদে, রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ, বিরল-রাধিকাপুর এবং বেনাপোল-পেট্রাপোল। এসব রুটের কোনো কোনোটির ব্যাপারে মোদির সফরে অগ্রগতির আশা করা হচ্ছে। যদিও এসব রুটের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে প্রত্যেকটির ধরন বুঝে পৃথক ছোট ছোট চুক্তির মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রেলপথে কানেকটিভিটি : ভারত রেলপথে বাংলাদেশের সঙ্গে কানেকটিভিটি জোরদারে আগ্রহী বেশি। কেননা রেলপথে কোনো যানজট হয় না। সময় ও খরচও কম। ফলে রেললাইনের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে। আখাউড়া ও আগরতলার মধ্যে ভারত একটি রেললাইন স্থাপন করে দেবে বলে জানিয়েছে। এতে করে নৌ ট্রানজিট রুটে আসা পণ্য রেলপথে আগরতলায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। ভারতের সঙ্গে রেলপথে যোগাযোগ বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে দুই দেশ। বর্তমানে ঢাকা-কলকাতা মৈত্রী এক্সপ্রেস চালু আছে। রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ হয়ে মালবাহী ট্রেনের পরীক্ষামূলক চলাচলও হয়েছে। এদিকে খুলনা থেকে পশ্চিমবঙ্গে আরেকটি মৈত্রী এক্সপ্রেস চালুর বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ রেলওয়ের লাইনগুলো উন্নয়ন, মিটারগেজ ও ব্রডগেজের সমন্বয় সাধনেও উদ্যোগী ভারত। কারণ যমুনা সেতু এবং পদ্মা সেতুসহ বিদ্যমান গোটা রেলব্যবস্থা ব্যবহারে আগ্রহী ভারত। ভারতের অনুদানের ২০ কোটি ডলার পদ্মা সেতুতে ব্যবহার করবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ চাইছে ত্রিপুরা : বিবিসি জানায়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার প্রতিবেশী বাংলাদেশের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ এবং সড়কপথে ট্রানজিটের সুবিধা চেয়েছেন। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, ভারতের পার্লামেন্টে স্থলসীমান্ত বিল পাস হওয়ার পর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে আস্থা তৈরি হয়েছে তাতে তিনি আশা করছেন যে দিল্লি এবার এই বিষয়গুলোও ঢাকার কাছে উত্থাপন করবে।
ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে চলতি বছরেই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফরে মি. সরকারও তার সঙ্গী হবেন আর এই পটভূমিতে ত্রিপুরার দাবিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে।
মি. সরকার জানান, বাংলাদেশের কাছে তাদের প্রথম চাওয়া হবে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ। তার কথায়, ‘ত্রিপুরাসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো যদি চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে পারে, সেখান থেকে মালামাল পরিবহনের সুযোগ পায় তাহলে লাভ হবে দু’দেশেরই।’
তিনি বলেন, ‘এই প্রস্তাবটি বাংলাদেশের বিবেচনায় আছে বলেই আমি জানি। তারা সরাসরি এটি কখনও নাকচ করে দেননি, আবার পরিষ্কার করে ছাড়পত্রও দেননি।’
জুনে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসছেন। সেই সফরে মি. সরকার নিজেই সড়কপথে ট্রানজিট এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের দাবির পক্ষে সওয়াল করবেন, আর তাতে সমর্থন থাকবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারেরও।
জুনের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ সফরে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ভারতের পক্ষ থেকে আগামী ৬ ও ৭ জুন এই সফরের প্রস্তাব করা হয়েছে। চূড়ান্ত তারিখ ঘোষণা করা হবে সফরের ১০ দিন আগে। মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তার অংশ হিসেবে তিনি প্রথম সফর করেন ভুটান। বাংলাদেশ সফরও এরই অংশ। এই সফরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনা আছে। সম্প্রতি সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করেছে ভারত। এতে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সমস্যার সমাধান হচ্ছে। এই বিল পাস করায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে উষ্ণতার আবহ তৈরি হয়েছে, যা এই সফরের ওপর প্রভাব ফেলবে। এছাড়া তিস্তার ব্যাপারেও কিছুটা সুখবর দিতে পারেন মোদি। ইতিমধ্যেই তিনি এ বিষয়ে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের মধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। মোদির সফরে তিস্তা চুক্তির সম্ভাবনা কম। তবে চুক্তি সম্পাদনে মোদির সদিচ্ছা পুনর্ব্যক্ত করতে পারেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন বাংলাদেশ সফরকালে যেসব ক্ষেত্রে বড় চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা আছে সেগুলোর সঙ্গেও কানেকটিভিটির প্রশ্ন জড়িত। উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি সই হলে ভারতের তিনটি সমুদ্রবন্দর অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তম, উড়িষ্যার প্যারাদ্বীপ ও কলকাতার হলদিয়া বন্দরের সঙ্গে বাংলাদেশের মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হবে। এই বন্দরগুলোর মধ্যে মাঝারি আকৃতির পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করবে। এদিকে দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান নৌ ট্রানজিট চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির ফলেও কানেকটিভিটি বাড়বে।
চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আরও ১৫টি রুটে ট্রানজিট চাইছে ভারত। এসব বিষয় এখন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। দুর্বল অবকাঠামো, পর্যাপ্ত পরিবহনের অভাব এবং ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের চূড়ান্ত মাশুল নির্ধারণ না হওয়ায় এসব বিষয়ে দ্রুত অগ্রগতি সাধন করা সম্ভব হচ্ছে না। নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফরকালে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার এসব ক্ষেত্রে গতি সঞ্চারের চেষ্টা থাকবে বলে মনে হচ্ছে।
মোদির সফরে কী ইস্যু অধিক গুরুত্ব পাবে জানতে চাইলে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করেছেন ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি রোববার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশে এটা তার প্রথম সফর। সফরকালে সব ইস্যুই আলোচনা হবে। বিশেষ করে এই সফরের ঠিক আগে ভারতের পার্লামেন্টে সীমান্ত চুক্তির বিল পাস হওয়ায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইনপুট হিসেবে কাজ করবে। এছাড়াও অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন, কানেকটিভিটি প্রভৃতি ইস্যুতে আলোচনা হবে বলে মনে করি।’ কানেকটিভিটি ইস্যু সম্পর্কে বীণা সিক্রি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরে কানেকটিভিটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে আলোচনা হবে। নৌ ট্রানজিটসহ অন্যান্য ট্রানজিটের ব্যাপারে অনেক চুক্তি ও ডকুমেন্ট ইতিমধ্যেই দু’দেশের মধ্যে রয়েছে। এখন সেগুলোর কার্যকর ব্যবহারের লক্ষ্যে আরও আলোচনা হবে। বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ ভারত আগেই দিয়েছে। আমি নিশ্চিত, প্রধানমন্ত্রী মোদি ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশের জন্য আরও নতুন ঋণ ঘোষণা করবেন।’
মোদির সফর সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত অভিমত, মোদি এবারের সফরকালে ট্রানজিটের ব্যাপারে বড় কোনো চাপ সৃষ্টি করবেন না। কারণ এটা তার প্রথম সফর। তিনি সম্ভবত কানেকটিভিটির জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তার প্রতি জোর দেবেন। অবকাঠামো উন্নয়ন হয়ে গেলে ট্রানজিট পাওয়ার বিষয়ে ভারতের পক্ষে বড় একটি যুক্তি দাঁড় করানো সম্ভব হবে। এই মুহূর্তে ট্রানজিটের পক্ষে বড় যুক্তি দেখানো সম্ভব নয়।’
তৌহিদ হোসেন মনে করেন, ‘সীমান্ত চুক্তি সম্পাদন করে ভারত আসলে বাংলাদেশকে কিছু দেয়নি। দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা একটি সমস্যার নিষ্পত্তি করেছে। তার বিনিময়ে ট্রানজিট পাওয়া যৌক্তিক নয়। তাছাড়া তিস্তা চুক্তি এখনই হচ্ছে না। মোদি তার সফরে মমতা ব্যানার্জিকে সঙ্গে নিয়ে আসার মানে হল তিস্তার ইস্যুতে কিছু অগ্রগতি হতে পারে। ফলে এই সফরেই ট্রানজিটের জন্য জোরালো কিছু হওয়ার কথা নয়। ট্রানজিট নিয়ে নীতিগত আলোচনা হতে পারে।’
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ভারতের প্রধান দুই উদ্বেগ হল নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দেশটির অবশিষ্ট অংশের সংযোগ স্থাপনে সহযোগিতা। শেখ হাসিনার সরকার গত ছয় বছরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে ভারতকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে নিরাপত্তার উদ্বেগ দূর করেছে। ভারত এ বিষয়ে সহযোগিতার কারণে বাংলাদেশের প্রতি সন্তুষ্ট। এখন কানেকটিভিটি স্থাপনে উদ্বেগ দূর করতে চায়। এক্ষেত্রে অবকাঠামো সমস্যা বড় বাধা হয়ে আছে। এজন্য তারা উপযুক্ত অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা দিতেও প্রস্তুত বলে জানা গেছে।
ঢাকায় ভারতের একজন কূটনীতিক বলেছেন, মোদির সরকারের ঝোঁক হল ব্যবসা-বাণিজ্য জোরদারের মাধ্যমে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কানেকটিভিটি অপরিহার্য। যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ উপকৃত হবেন। ফলে পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতেই দুই দেশ উন্নয়নের পথে অগ্রসর হবে।
নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক সূত্র মতে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে ভারতকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতকে সহায়তা করতে হবে। বাংলাদেশের সরকারি হিসেবে, কানেকটিভিটির জন্য বাংলাদেশকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে অবকাঠামো খাতে কমপক্ষে এক হাজার চারশ’ কোটি ডলার বিনিয়োগ দরকার। সরকারের একার পক্ষে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ জোগান দেয়া সম্ভব নয়। তাই এই খাতে বিদেশী বিনিয়োগকে স্বাগত জানায় বাংলাদেশ। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারত বেশি সুবিধা ভোগ করবে বিধায় অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এমন দাবিকে ভারত যৌক্তিক বলে মনে করে বিধায় অবকাঠামোর উন্নয়নে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে। এক্ষেত্রে ভারত ইতিমধ্যেই দেয়া একশ’ কোটি ডলারের পাশাপাশি নতুন আরও প্রায় তিনশ’ কোটি ডলার ঋণ দিতে আগ্রহী বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এতেও অবকাঠামো পুরোপুরি উপযুক্ত হবে না। এ অবস্থায় ভারত নৌপথের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের ঋণ গ্রহণে আন্তর্জাতিক সংস্থাটির কাছে দু’দেশের যৌথ প্রস্তাব দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের আগে কানেকটিভিটি জোরদারে অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা করতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বর্তমানে ভারত সফর করছেন। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন রোববার এক বিবৃতিতে জানায়, ভারতের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিষয়ক মন্ত্রী নিতিন গড়কড়ির আমন্ত্রণে ওবায়দুল কাদের এই সফর করছেন। ১৬ থেকে ২০ মে পর্যন্ত ওবায়দুল কাদেরের এ সফর। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে অবকাঠামো খাতে ঋণের বিষয়ে সফরকালে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানা গেছে। এদিকে মোদির সফরের আগে ঢাকায় দু’দেশের বিদ্যুৎ সচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। ঢাকায় এখন দু’দেশের বাণিজ্য সচিব পর্যায়ে বৈঠক চলছে। মোদির সফরের প্রস্তুতির লক্ষ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী শিগগিরই ভারত সফরে যেতে পারেন।
ঢাকায় উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ভারত আগের ঋণের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রায় তিনশ’ কোটি ডলার নতুন ঋণ দিতে আগ্রহী রয়েছে। নতুন ঋণে নতুন প্রকল্প যেমন আছে, তেমনি আগের প্রকল্পও থাকবে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ২১৫ কোটি ডলার ঋণের প্রকল্প প্রস্তাব প্রস্তুত করতে পেরেছে। ফলে যাচাই-বাছাইয়ের পর সেখান থেকে চূড়ান্ত প্রকল্পগুলোর জন্য আসন্ন সফরে ঋণ ঘোষণা করতে পারেন মোদি।
ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে অগ্রাধিকার কানেকটিভিটি : ভারতের ঋণে যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলোতে কানেকটিভিটি অগ্রাধিকারে রয়েছে। এসব প্রকল্পে ভারতীয় ঋণের অংশ বাদে অবশিষ্ট অর্থ বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। ভারতীয় ঋণে ডবল ডেকার, সিঙ্গেল ডেকার, এসি ও নন-এসি আর্টিকুলেটেড বাস ক্রয়, রেলের জন্য ট্যাঙ্কার ওয়াগন, বগি ক্রয় ও কনটেইনার ব্রেকার, ব্রডগেজ ও ডিজেল ইলেক্ট্রিক লোকোমোটিভ, নৌপথ ও মংলা বন্দরের জন্য ড্রেজার ক্রয়, খুলনা-মংলা বন্দর রেললাইনের সম্ভাব্যতা যাচাই, ভৈরব সেতু ও অ্যাপ্রোচ রেললাইন নির্মাণ প্রভৃতি প্রকল্প রয়েছে।
নতুন করে ২১৫ কোটি ডলার প্রস্তাবিত ঋণে সিরাজগঞ্জ-বগুড়া রেললাইন, দর্শনা-খুলনা রেললাইন, সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপ নির্মাণ প্রকল্প রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে প্রকল্পের মধ্যে আছে সিরাজগঞ্জ-বগুড়া সঞ্চালন লাইন এবং ১৫ থেকে ২০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি প্রকল্প। নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আশুগঞ্জ নদীবন্দর উন্নয়নে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প। মহাসড়ক বিভাগের অধীনে মহাসড়ক নির্মাণে সরঞ্জাম ক্রয় এবং ১০০টি ট্রাক ক্রয় প্রকল্প। তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও দুটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
উপকূলীয় জাহাজ চলাচল ও নৌ ট্রানজিট : মোদির সফরকালে উপকূলীয় জাহাজ চলাচলে একটি চুক্তি সই হচ্ছে। এই চুক্তির অধীনে ভারতের তিনটি সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে বাংলাদেশের দুটি সমুদ্রবন্দরের মধ্যে মাঝারি আকৃতির জাহাজ চলাচল করবে। এতে সমুদ্রপথেও দু’দেশের মধ্যে কানেকটিভিটি জোরদার হবে। এই চুক্তির আওতায় শুধু পণ্য আনা-নেয়া করা যাবে। কোনো যুদ্ধজাহাজ কিংবা জরিপ জাহাজ চলাচল করতে পারবে না। এদিকে সমুদ্রপথে কানেকটিভিটি জোরদারে পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে ভারত। ভারতের দিক থেকে স্পর্শকাতরতার কারণে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই চীনের অর্থায়নে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রকল্প থেকে সরে এসেছে। এখন পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের চিন্তাভাবনা চলছে। এদিকে সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং সমুদ্র নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারতের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র সমুদ্রপথে আসার সন্দেহ রয়েছে ভারতের। বাংলাদেশের টহল দল অস্ত্র চোরাচালানি ধরতে গেলে চোরাচালানকারিরা অস্ত্র সাগরের পানিতে ফেলে দেয় বলেও ভারত মনে করে। এক্ষেত্রেও সহযোগিতা জোরদার চায় ভারত। এদিকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে নদীপথে পণ্য চলাচলে বিদ্যমান চুক্তি প্রতি দু’বছর পরপর নবায়ন করতে হয়। মোদির সফরকালে এই চুক্তি নবায়নের মেয়াদ পাঁচ বছর করা হবে। চার বছর পর কোনো পক্ষ আপত্তি না করলে পাঁচ বছর পর স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে চুক্তি নবায়ন হয়ে যাবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে নদীপথে ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজ প্রবেশ করে আশুগঞ্জ নদীবন্দরে তা খালাস করা হয়।
১৫ রুটে ট্রানজিট চায় ভারত : বাংলাদেশের ওপর দিয়ে নদী, স্থল, রেলপথে ট্রানজিট চালুর প্রস্তাব অনেক আগেই দিয়ে রেখেছে ভারত। এসব প্রস্তাব বাংলাদেশ এখন যাচাই-বাছাই করছে। তবে অবকাঠামো উন্নত না হওয়া ও মাশুল চালুর সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত না হওয়ায় প্যাকেজ আকারে ট্রানজিট প্রস্তাব ঝুলে থাকলেও এসব বিষয়ে পৃথকভাবে অগ্রগতি হচ্ছে।
বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত তার ট্রানজিট প্রস্তাবে ১৫টি রুটের উল্লেখ করেছে। এসব রুট চট্টগ্রাম কিংবা মংলা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে বিদ্যমান সংযোগের বর্ধিত অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। এসব রুট হল বাংলাদেশের এক অংশ থেকে ভারতের অন্য অংশে সংযোগ স্থাপন করবে। রুটগুলো হল আখাউড়া-আগরতলা, সাবরুম-রামগড়, দেমাগিরি-তেগামুখ, বিবিরবাজার-শ্রীরামপুর, বিলোনিয়া-বিলোনিয়া, বেতুলি-পুরনো রংনা বাজার, চাতলাপুর-মনু, তামাবিল-ডাউকি, বরসরা-বরসরা, হালুয়াঘাট-ঘাসুয়াপাড়া, সুনামগঞ্জ-সেলবাজার, দর্শনা-গেদে, রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ, বিরল-রাধিকাপুর এবং বেনাপোল-পেট্রাপোল। এসব রুটের কোনো কোনোটির ব্যাপারে মোদির সফরে অগ্রগতির আশা করা হচ্ছে। যদিও এসব রুটের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে প্রত্যেকটির ধরন বুঝে পৃথক ছোট ছোট চুক্তির মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রেলপথে কানেকটিভিটি : ভারত রেলপথে বাংলাদেশের সঙ্গে কানেকটিভিটি জোরদারে আগ্রহী বেশি। কেননা রেলপথে কোনো যানজট হয় না। সময় ও খরচও কম। ফলে রেললাইনের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে। আখাউড়া ও আগরতলার মধ্যে ভারত একটি রেললাইন স্থাপন করে দেবে বলে জানিয়েছে। এতে করে নৌ ট্রানজিট রুটে আসা পণ্য রেলপথে আগরতলায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। ভারতের সঙ্গে রেলপথে যোগাযোগ বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে দুই দেশ। বর্তমানে ঢাকা-কলকাতা মৈত্রী এক্সপ্রেস চালু আছে। রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ হয়ে মালবাহী ট্রেনের পরীক্ষামূলক চলাচলও হয়েছে। এদিকে খুলনা থেকে পশ্চিমবঙ্গে আরেকটি মৈত্রী এক্সপ্রেস চালুর বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ রেলওয়ের লাইনগুলো উন্নয়ন, মিটারগেজ ও ব্রডগেজের সমন্বয় সাধনেও উদ্যোগী ভারত। কারণ যমুনা সেতু এবং পদ্মা সেতুসহ বিদ্যমান গোটা রেলব্যবস্থা ব্যবহারে আগ্রহী ভারত। ভারতের অনুদানের ২০ কোটি ডলার পদ্মা সেতুতে ব্যবহার করবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ চাইছে ত্রিপুরা : বিবিসি জানায়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার প্রতিবেশী বাংলাদেশের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ এবং সড়কপথে ট্রানজিটের সুবিধা চেয়েছেন। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, ভারতের পার্লামেন্টে স্থলসীমান্ত বিল পাস হওয়ার পর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে আস্থা তৈরি হয়েছে তাতে তিনি আশা করছেন যে দিল্লি এবার এই বিষয়গুলোও ঢাকার কাছে উত্থাপন করবে।
ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে চলতি বছরেই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফরে মি. সরকারও তার সঙ্গী হবেন আর এই পটভূমিতে ত্রিপুরার দাবিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে।
মি. সরকার জানান, বাংলাদেশের কাছে তাদের প্রথম চাওয়া হবে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ। তার কথায়, ‘ত্রিপুরাসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো যদি চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে পারে, সেখান থেকে মালামাল পরিবহনের সুযোগ পায় তাহলে লাভ হবে দু’দেশেরই।’
তিনি বলেন, ‘এই প্রস্তাবটি বাংলাদেশের বিবেচনায় আছে বলেই আমি জানি। তারা সরাসরি এটি কখনও নাকচ করে দেননি, আবার পরিষ্কার করে ছাড়পত্রও দেননি।’
জুনে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসছেন। সেই সফরে মি. সরকার নিজেই সড়কপথে ট্রানজিট এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের দাবির পক্ষে সওয়াল করবেন, আর তাতে সমর্থন থাকবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারেরও।
No comments