জননিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা- শুধু পুলিশনির্ভরতা সুফল দেবে না

সন্দেহ নেই যে কার্যকর সিসিটিভি-ভিত্তিক নিরাপত্তাব্যবস্থা অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধ এবং অপরাধ চিহ্নিতকরণ ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্বে আধুনিক নগরগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা ক্রমে সিসিটিভি-নির্ভর হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ব্রিটেনের স্কুল ও হাসপাতালের মতো সংবেদনশীল স্থানগুলোর পর্যবেক্ষণে সাড়ে সাত লাখ, এমনকি দেশটির প্রতি ১৪ জনের জন্য একটি ক্যামেরা চালু রয়েছে। বারাক ওবামার সাম্প্রতিক ভারত সফরকালে রাতারাতি দিল্লিতে ১৫ হাজার সিসিটিভি বসানোর পরে দিল্লি হাইকোর্ট মন্তব্য করেছিলেন যে নাগরিক নিরাপত্তার জন্য এমন গতি দেখা যায় না!
আমরা গুলশান-বনানীতে সক্রিয় নাগরিক শরিকানায় ১০০ ক্যামেরা দিয়ে ইতিমধ্যেই প্রাথমিক কাজ শুরুর উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। পুলিশ ও নাগরিকেরা একটি প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। কিন্তু এ ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা রাজধানীবাসী পুরো নগরে সামগ্রিকভাবে আশা করবে। বাড়তি নিরাপত্তা শ্রেণিগত ধারণা হওয়ার নয়, এমনকি তা লিখিতভাবে রাখা হলে তা থেকে খুব সুফলও আশা করা যাবে না। গুলশান-বনানীর সোসাইটির সদস্যরা যেভাবে মোটা অঙ্কের অর্থ জোগান দিতে পেরেছেন, সেভাবে অন্য অনেক এলাকার মানুষ দিতে পারবেন না। কিন্তু তাঁদেরও একই প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত নিরাপত্তার প্রয়োজন। তবে আমরা এটাও বলব, নগরের অন্যান্য এলাকার মানুষ যেন গুলশানের পুলিশ-নাগরিক যৌথ উদ্যোগকে খুবই ইতিবাচক হিসেবে দেখেন এবং অনুসরণীয় মডেল হিসেবে বাস্তবায়ন করেন। কারণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে গ্রহণযোগ্য সেবা পেতে তাদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকা সমীচীন মনে হয় না। তাদের ওপর সচেতন নাগরিকের নিবিড় তদারকি একটা রক্ষাকবচ হতে পারে।
তবে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এখন পর্যন্ত সিসি ক্যামেরার মতো আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আগের চেয়ে নিরাপত্তা বাড়াতে পেরেছেন, সেটি হলফ করে বলা যায় না। পয়লা বৈশাখে নারী নিগ্রহকারীদের শনাক্ত করতে শতাধিক সিসিটিভির ফুটেজ যে কাজে দেয়নি, তা আমরা উদ্বেগের সঙ্গেই লক্ষ করেছি। তাই পুলিশ-নাগরিক যৌথ উদ্যোগই কাম্য।
গুলশান–বনানী এলাকায় ১০০ সিসি ক্যামেরা
আপডেট: ০২:০৭, মে ১৫, ২০১৫ > এলাকাবাসী ও পুলিশের যৌথ উদ্যোগে গুলশান, বনানী ও নিকেতন এলাকার নিরাপত্তা রক্ষায় যুক্ত হয়েছে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা। প্রাথমিক পর্যায়ে ১০০ ক্যামেরা বসিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে সিসি ক্যামেরা দিয়ে পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
ক্যামেরাগুলো যানবাহনের নম্বরপ্লেট শনাক্ত করতে পারবে। ফলে চুরি যাওয়া গাড়ি ওই ক্যামেরার আওতায় এলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত হবে। ওই এলাকাগুলোর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ক্যামেরাগুলো কাজে লাগবে। গুলশান থানা ও আবদুল গণি রোডে পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে ওই ক্যামেরাগুলো পর্যবেক্ষণ করা হবে।
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মূলত গুলশান থানার উদ্যোগে গত বছরের নভেম্বরে সাংসদ রহমতউল্লাহকে প্রধান করে ১৩ সদস্যের গুলশান থানা আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির সমন্বয়ক হলেন বারিধারা সোসাইটির সাবেক সভাপতি ফিরোজ এম হাসান, গুলশান সোসাইটির সভাপতি সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা, নিকেতন ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সভাপতি শামসুল আরেফিন ও গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের সভাপতি রাফেজ আলম। এ ছাড়া প্রতি সমিতি থেকে আরও চারজন করে কমিটিতে রয়েছেন। পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি), গুলশান থানার ওসি, অ্যানালিস্টসহ কমিটির মোট সদস্যসংখ্যা ১৩। কমিটির সভায় প্রায় সাত কোটি টাকায় ৬০০ ক্যামেরা ও নিয়ন্ত্রণকক্ষের যন্ত্রপাতি কেনার প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রথম সভাতেই প্রায় ২ কোটি ৯ লাখ টাকা উঠে আসে। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে ১০০ ক্যামেরা বসিয়ে পর্যবেক্ষণ কাজ শুরু হয়েছে।
রাজধানীর গুলশান এলাকার নিরাপত্তাব্যবস্থার নজরদারিতে
বিভিন্ন সড়কে পুলিশ ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে বসানো
ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা (বৃত্তাকার চিহ্নিত)।
গুলশান থানায় খোলা হয়েছে এসব ক্যামেরার
নিয়ন্ত্রণকক্ষ (ডানে) l ছবি: প্রথম আলো
সাংসদ রহমতউল্লাহর সভাপতিত্বে গুলশানের একটি হোটেলে সিসি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মূল পর্বে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক, র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যোগ দেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই কমিটির সমন্বয়ক ফিরোজ এম হাসান একটি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা দেন। তিনি বলেন, কথা ছিল প্রথম পর্যায়ে ৫৫টি ক্যামেরা লাগানো হবে। কিন্তু মানুষের বিপুল সাড়ার কারণে ১০০ ক্যামেরা নিয়ে কাজ শুরু করা গেছে। ক্যামেরাগুলো একটি খুঁটিতে (পোল মাউন্টেড) লাগানো থাকবে। একটি খুঁটিতে দুটি, কোথাও চারটি থেকে ছয়টি পর্যন্ত ক্যামেরা লাগানো থাকবে। ওই খুঁটিতেই ডিভি (ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার) বক্স থাকবে। গুলশান থানা ও ডিএমপির নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে এই ক্যামেরার চিত্র পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করা হবে। যদি ডিএমপি অনুমোদন করে, তাহলে মোবাইল ফোনেও এই চিত্র দেখা সম্ভব হবে। পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার ও গুলশান থানার ওসি এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। তিনি বলেন, ক্যামেরা গাড়ির নম্বরপ্লেট শনাক্ত করতে পারবে। এর ফলে কোনো গাড়ি চুরি হলে বা অপরাধীদের গাড়ির নম্বরপ্লেট ওই সিস্টেমে কালো তালিকাভুক্ত করে রাখবে পুলিশ। ওই নম্বরসহ গাড়ি ক্যামেরার আওতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ন্ত্রণকক্ষে ঘণ্টা বেজে উঠবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও অপরাধী শনাক্তকরণে এ ব্যবস্থা কাজে লাগানো যাবে।
মেয়র আনিসুল হক তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘মেয়রের একার পক্ষে কোনো কাজ করা সম্ভব নয়, যদি জনগণ সহযোগিতা না করেন। আমাকে একটু গোছাতে দুই থেকে তিন মাস সময় দিন। আশা করছি, আপনাদের আগের থেকে ভালো একটি শহর উপহার দিতে পারব। আগামী দুই বছরের মধ্যে একটু বেশি স্বস্তি, একটু বেশি নিরাপত্তা দিতে পারব।’
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহীদুল হক বলেন, সেন্ট্রাল লন্ডনে প্রায় পাঁচ হাজার সিকিউরিটি কোম্পানি রয়েছে। সেখানে সরকারি নিরাপত্তার পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে জনগণ তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন। ঢাকা শহরেও এমন সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে বলে তাঁর আশা।
মেয়রকে উদ্দেশ করে আইজিপি বলেন, ‘আগে ছিলেন বিজনেস লিডার, এখন হয়েছেন পাবলিক লিডার। আপনার দায়িত্ব এখন অনেক। আপনি নিরাশ হবেন না। আমরা সব সময় আপনার সঙ্গে আছি।’
র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘ঢাকা শহরের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ-জনগণের অংশীদারত্বের একটি নতুন যুগের সূচনা হলো। যদি আমরা দেশটাকে এগিয়ে নিতে চাই, উন্নয়ন চাই, তাহলে সরকার ও জনগণের মধ্যে শক্ত অংশীদারত্ব হতে হবে।’
ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘গুলশান, বারিধারা ও নিকেতন সোসাইটি যে দায়িত্ব নিয়েছে, তা দৃষ্টান্তমূলক। যানজট নিয়ন্ত্রণে আমরা রাস্তার চিত্র সরাসরি দেখে ব্যবস্থা নিতে পারব। কোনো গাড়ি চুরি হলে সহজে শনাক্ত করা যাবে। কোথাও কোনো অপরাধ ঘটলে তিন-চার মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে যাওয়া সম্ভব হবে।’
শেষ পর্যায়ে অনুষ্ঠানে যোগ দেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এ রকম কর্মপ্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই। এই উদ্যোগ নিরাপত্তার জন্য যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।’
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপির নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদের রেড নোটিশের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তিনি কীভাবে ভারতে গেলেন, তা জানার জন্য তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
গুলশান থানার পুলিশ ও কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গুলশান, বারিধারা ও নিকেতন সমিতিকে এখন পর্যন্ত ২ কোটি ৯ লাখ টাকা দিয়েছে ২১ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এদের সবার বাসা ও কার্যালয় গুলশান থানা এলাকায়। আরও বেশ কয়েকজন টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন, যা দিয়ে পরবর্তী সময়ে আরও ৫০০ ক্যামেরা বসানোর কাজ হবে। সমিতিগুলো এই ক্যামেরা দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। পুলিশ মনিটরে এগুলোর ফুটেজ নজরদারি করবে। তবে এর জন্য গুলশানের সাধারণ বাসিন্দাদের কোনো অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে না।

No comments

Powered by Blogger.