রাশি রাশি প্রতিশ্রুতি আর আইনি বাস্তবতা by আলী ইমাম মজুমদার
ঢাকা
উত্তর ও দক্ষিণ আর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন দ্বারপ্রান্তে। জোর
প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন সিটি মেয়র ও কাউন্সিলর পদগুলোতে
প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীরা। উদ্দেশ্য একটাই—ভোটারদের সপক্ষে এনে
জয়লাভ। কোনো কোনো প্রার্থী এসব প্রতিশ্রুতি আবার ইশতেহার আকারেও প্রকাশ
করছেন। জনজীবনের বহু সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার রয়েছে সেসব ইশতেহারে। এসব
প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলে নগরবাসীর সমস্যা বহুলাংশে দূর হবে। তাই
নির্বাচনী প্রচার অভিযানে এগুলোর মূল্য আছে। এসব অঙ্গীকারের প্রতি আকৃষ্ট
হয়ে ভোটারদের অনেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। তবে সবাই নন। কেউ কেউ হয়তো-বা
সিদ্ধান্ত নেবেন প্রার্থীদের অতীত, তাঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিংবা
দলীয় আনুগত্য বিবেচনায়। তাহলেও এসব বিচ্ছিন্ন প্রতিশ্রুতি কিংবা এর সমন্বিত
রূপ নির্বাচনী ইশতেহারের বিষয়টি উপেক্ষণীয় নয়।
এসব নির্বাচনী অঙ্গীকারের ভিত্তিতে যাঁরা ভোট দেবেন, তাঁদের প্রত্যাশা থাকবে, নির্বাচিত হলে সেই প্রার্থী এগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করবেন। যাঁরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাঁদের ভাবনাও একই রকম হওয়ার কথা। যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের ভোট নিলেন, তা বাস্তবায়ন করা নির্বাচিত ব্যক্তির নৈতিক দায়িত্ব। প্রতিশ্রুতিকে ভোটার ও নির্বাচন প্রার্থীর মধ্যে একটি পবিত্র চুক্তি বললেও অত্যুক্তি হবে না। তবে যেসব প্রতিশ্রুতির বিবরণ খবরের কাগজে দেখা যায়, নির্বাচিত হলেও সেগুলো বাস্তবায়ন তাঁদের দ্বারা কতটুকু সম্ভব, এটি প্রার্থীরা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, এমনটি তো মনে হয় না। জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দল কিংবা প্রার্থীর পক্ষ থেকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, নির্বাচিত প্রার্থীদের পক্ষে তা বাস্তবায়ন সিটি করপোরেশনের চেয়ে অনেকাংশে সহজ। কেননা, সেখানে আইনি বাধা থাকলেও আইন পরিবর্তনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদে রয়েছে। আর সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই যেহেতু সরকার গঠন করে, তাদের পক্ষে এ বাধা অনতিক্রম্য নয়। আর্থিক কিংবা প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতায় কিছু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে হয়তো-বা সম্ভব হয় না। সেগুলো ভোটাররা মেনে নেন। সদিচ্ছার অভাবেও বেশ কিছু অঙ্গীকার পূরণ করা হয় না। এ সম্পর্কে ক্ষুব্ধ থাকেন ভোটদাতা জনগণ।
তবে সিটি করপোরেশন আইন দ্বারা গঠিত সংস্থাবিশেষ। তাদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব আইনে নির্ধারিত। করারোপের ক্ষমতাও সীমিত। সেখানে তারা চাইলেও অনেক কিছুই তাদের এখতিয়ারের বাইরে থাকে। শুধু দেনদরবার করতে পারে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে। রাজনৈতিক অনুকূল পরিবেশে থাকলে প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় হতে পারে। এতেও তেমন কিছু ফল দেয় না, এমনটা আমরা নিকট অতীতে অখণ্ড ঢাকা সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে দেখেছি। সে ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া কিংবা সেগুলো ইশতেহার আকারে প্রকাশে প্রার্থীদের সতর্ক হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি বিতরণব্যবস্থায় এ করপোরেশনগুলোর কোনোই এখতিয়ার নেই। ভিন্ন ভিন্ন আইন ও বিধি দ্বারা এগুলো পরিচালিত। অথচ প্রার্থীদের অনেকেই এসব সমস্যা সমাধানের ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। বিষয়গুলোর নগরজীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বটে। এগুলোর সমাধানও সবাই চান। তা সমাধান করতে কারও না কারও এগিয়ে আসাও সংগত। তবে সিটি মেয়র ও কাউন্সিলরদের এ ক্ষেত্রে বিরাজমান আইনি পরিপ্রেক্ষিতে তেমন কোনো অবদান রাখার সুযোগ নেই। তেমনি বড় কোনো সুযোগ নেই যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখার। রাস্তাঘাট মেরামত ও আবর্জনা দূরীভূত করে তাঁরা এতে প্রান্তিক পর্যায়ে অবদান রাখতে পারেন। উল্লেখ্য, যন্ত্রচালিত যানবাহন রেজিস্ট্রেশন ও চলাচলব্যবস্থা আইনে বিআরটিএ আর মেট্রোপলিটন পুলিশের আওতায় রয়েছে। ইমারত নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা রাজউক কিংবা সিডিএর। তারা যথাযথ পার্কিং-সুবিধা ছাড়াই অথবা কাগুজে ব্যবস্থা রেখে বড় ধরনের যানজটের কারণ ঘটাচ্ছে। এ সংস্থাগুলোও সিটি করপোরেশনের আওতায় নেই। কেউ কেউ ঢাকা মহানগরকে হরতালমুক্ত রাখার বিষয়েও অঙ্গীকার করছেন। প্রতিশ্রুতিটি সম্পূর্ণ সমর্থনযোগ্য হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা ব্যতিরেকে এটা করা আদৌ সম্ভব কি না, ভেবে দেখার বিষয়। আবার কেউ-বা বলছেন মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত নগর গড়ে তুলবেন। এ দুটো বিষয়ে কোনো আইনেই সিটি করপোরেশনের কোনো ভূমিকা নেই।
তাহলে আমরা বিবেচ্য নির্বাচনকালে আসা এসব প্রতিশ্রুতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করতে পারি? সমস্যা যেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো আশু সমাধানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো বিতর্ক নেই। সবাই চান সমাধান। নিশ্চয়ই চাইবেন ভোটপ্রত্যাশীরাও। তবে এগুলোর সমাধান সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত নয়। এটা জানা দরকার ভোটারদের। আর নির্বাচন প্রার্থীদের তো বটেই। এগুলোকে আমরা তাঁদের পবিত্র ইচ্ছারূপে দেখতে চাই। আর দেখতে চাই এসব সমস্যা সমাধানে সিটি করপোরেশনগুলোর আইনে তাদের ক্ষমতায়ন করা হোক। অপরিকল্পিতভাবে সিটি করপোরেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করার আগে যেগুলো আছে, সেগুলো কার্যকর করা আবশ্যক। নগর-পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ আর ট্রাফিক-ব্যবস্থা নগরবাসীর নিত্যদিনের জীবনযাত্রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাই এর সব ও পূর্ণ ক্ষমতা সিটি করপোরেশনগুলোরই থাকা উচিত। আইনকানুনের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সংশোধন করে এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে করপোরেশনগুলোর আওতায় আনার প্রস্তাব যৌক্তিক। এসব বিষয় নিয়ে নগর সরকারের ধারণা এসেছে। সমন্বয়ের প্রয়োজনে এ ধরনের কাজে নতুন কোনো সংস্থা চাপিয়ে দেওয়া সমস্যাকে আরও জটিল করবে। নির্বাচিত সিটি করপোরেশনগুলোর হাতে এ দায়িত্ব দেওয়া সব বিবেচনাতেই সংগত। উল্লেখ্য, আমাদের দেশের সব কটি সিটি করপোরেশনের আয়তন, জনসংখ্যা, সম্পদ ও অবকাঠামো এক রূপ নয়। তাই সূচনাতে ঢাকার দুটো এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে নিয়ে দেশের রাজধানী ও বাণিজ্যিক রাজধানীতে এ ধরনের নগর সরকার চালুর ভাবনা এখন সময়ের দাবি। এ করপোরেশনগুলোর প্রতিটিতে বসবাসকারী জনসংখ্যা পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। তাই কেন্দ্রীভূত প্রশাসনের ধারণা থেকে প্রকৃত প্রস্তাবে বেরিয়ে আসা দেশের শাসনব্যবস্থা ও উন্নয়ন কার্যক্রম সবকিছুরই সহায়ক হবে। এতে রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক চরিত্র বিনষ্ট কিংবা সরকারের মৌলিক নিয়ন্ত্রণে বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আদৌ নেই। মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত নগর গড়ার মতো দায়িত্ব এই মুহূর্তেই নগর সরকারের কাছে দেওয়া হয়তো-বা সম্ভব হবে না। তবে তারা জনমত সংগঠিত করে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সহায়তা করতে পারে। ওই সংস্থাগুলোর এ বিষয়ে শৈথিল্য কিংবা যোগসাজশ থাকলে আনতে পারে সরকারের নজরে। করপোরেশনগুলোর সম্পদে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাদের অনুদাননির্ভর না রেখে সম্পদ সংগ্রহের জন্য বাস্তব ও ন্যায়সংগত আইনি ব্যবস্থাও সরকারকে করে দিতে হবে। পাশাপাশি সস্তা জনপ্রিয়তার হাতছানি উপেক্ষা করে ন্যায্য করারোপ ও আদায়ে তাদের উদ্যোগী হওয়ারও আবশ্যকতা থাকবে।
নগর সরকারের বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক দলেরই অঙ্গীকার নেই। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকার তাদের আছে বটে; তবে বাস্তবে তারা করে চলে উল্টোটা। তা না হলে বিস্তৃত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বহাল থাকতে সব সরকারের সময়েই প্রত্যেক সাংসদের বরাবরে বছর বছর কয়েক কোটি টাকা করে পূর্ত কাজের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা হতো না। আর এসব বিবেচনায় রেখে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তাঁদের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা আর ইশতেহার তৈরি করা প্রয়োজন ছিল। তাঁরা তা কতটুকু করেছেন, এ বিষয়ে সন্দিহান হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। সরলমনা ভোটারদের কাছে চমকপ্রদ প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হবেন। পরে সূচনাতেই হোঁচট খাবেন এসব বিষয়ে। ‘বুদ্ধিমানেরা’ হয়তো প্রতিশ্রুতির ধারেকাছেও যাবেন না। যাঁরা যাবেন, তাঁরা শেষতক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কিংবা এরূপ কিছু একটা অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতার গ্লানি ঢাকতে চাইবেন। এমনটা হওয়া আদৌ সংগত নয়। সিটি করপোরেশনগুলোর প্রকৃত ক্ষমতায়নের দাবি যৌক্তিক। যাঁরা নির্বাচিত হবেন, তাঁরাই দলমত-নির্বিশেষে এ দাবির সঙ্গে সুর মেলানোর প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি যে ক্ষমতা এখন তাঁদের নেই, সে বিষয়ে কোনো কার্যক্রম গ্রহণের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেওয়াও যেকোনো প্রার্থীর জন্য অসংগত ও অনৈতিক।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
এসব নির্বাচনী অঙ্গীকারের ভিত্তিতে যাঁরা ভোট দেবেন, তাঁদের প্রত্যাশা থাকবে, নির্বাচিত হলে সেই প্রার্থী এগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করবেন। যাঁরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাঁদের ভাবনাও একই রকম হওয়ার কথা। যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের ভোট নিলেন, তা বাস্তবায়ন করা নির্বাচিত ব্যক্তির নৈতিক দায়িত্ব। প্রতিশ্রুতিকে ভোটার ও নির্বাচন প্রার্থীর মধ্যে একটি পবিত্র চুক্তি বললেও অত্যুক্তি হবে না। তবে যেসব প্রতিশ্রুতির বিবরণ খবরের কাগজে দেখা যায়, নির্বাচিত হলেও সেগুলো বাস্তবায়ন তাঁদের দ্বারা কতটুকু সম্ভব, এটি প্রার্থীরা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, এমনটি তো মনে হয় না। জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দল কিংবা প্রার্থীর পক্ষ থেকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, নির্বাচিত প্রার্থীদের পক্ষে তা বাস্তবায়ন সিটি করপোরেশনের চেয়ে অনেকাংশে সহজ। কেননা, সেখানে আইনি বাধা থাকলেও আইন পরিবর্তনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদে রয়েছে। আর সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই যেহেতু সরকার গঠন করে, তাদের পক্ষে এ বাধা অনতিক্রম্য নয়। আর্থিক কিংবা প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতায় কিছু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে হয়তো-বা সম্ভব হয় না। সেগুলো ভোটাররা মেনে নেন। সদিচ্ছার অভাবেও বেশ কিছু অঙ্গীকার পূরণ করা হয় না। এ সম্পর্কে ক্ষুব্ধ থাকেন ভোটদাতা জনগণ।
তবে সিটি করপোরেশন আইন দ্বারা গঠিত সংস্থাবিশেষ। তাদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব আইনে নির্ধারিত। করারোপের ক্ষমতাও সীমিত। সেখানে তারা চাইলেও অনেক কিছুই তাদের এখতিয়ারের বাইরে থাকে। শুধু দেনদরবার করতে পারে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে। রাজনৈতিক অনুকূল পরিবেশে থাকলে প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় হতে পারে। এতেও তেমন কিছু ফল দেয় না, এমনটা আমরা নিকট অতীতে অখণ্ড ঢাকা সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে দেখেছি। সে ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া কিংবা সেগুলো ইশতেহার আকারে প্রকাশে প্রার্থীদের সতর্ক হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি বিতরণব্যবস্থায় এ করপোরেশনগুলোর কোনোই এখতিয়ার নেই। ভিন্ন ভিন্ন আইন ও বিধি দ্বারা এগুলো পরিচালিত। অথচ প্রার্থীদের অনেকেই এসব সমস্যা সমাধানের ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। বিষয়গুলোর নগরজীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বটে। এগুলোর সমাধানও সবাই চান। তা সমাধান করতে কারও না কারও এগিয়ে আসাও সংগত। তবে সিটি মেয়র ও কাউন্সিলরদের এ ক্ষেত্রে বিরাজমান আইনি পরিপ্রেক্ষিতে তেমন কোনো অবদান রাখার সুযোগ নেই। তেমনি বড় কোনো সুযোগ নেই যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখার। রাস্তাঘাট মেরামত ও আবর্জনা দূরীভূত করে তাঁরা এতে প্রান্তিক পর্যায়ে অবদান রাখতে পারেন। উল্লেখ্য, যন্ত্রচালিত যানবাহন রেজিস্ট্রেশন ও চলাচলব্যবস্থা আইনে বিআরটিএ আর মেট্রোপলিটন পুলিশের আওতায় রয়েছে। ইমারত নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা রাজউক কিংবা সিডিএর। তারা যথাযথ পার্কিং-সুবিধা ছাড়াই অথবা কাগুজে ব্যবস্থা রেখে বড় ধরনের যানজটের কারণ ঘটাচ্ছে। এ সংস্থাগুলোও সিটি করপোরেশনের আওতায় নেই। কেউ কেউ ঢাকা মহানগরকে হরতালমুক্ত রাখার বিষয়েও অঙ্গীকার করছেন। প্রতিশ্রুতিটি সম্পূর্ণ সমর্থনযোগ্য হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা ব্যতিরেকে এটা করা আদৌ সম্ভব কি না, ভেবে দেখার বিষয়। আবার কেউ-বা বলছেন মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত নগর গড়ে তুলবেন। এ দুটো বিষয়ে কোনো আইনেই সিটি করপোরেশনের কোনো ভূমিকা নেই।
তাহলে আমরা বিবেচ্য নির্বাচনকালে আসা এসব প্রতিশ্রুতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করতে পারি? সমস্যা যেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো আশু সমাধানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো বিতর্ক নেই। সবাই চান সমাধান। নিশ্চয়ই চাইবেন ভোটপ্রত্যাশীরাও। তবে এগুলোর সমাধান সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত নয়। এটা জানা দরকার ভোটারদের। আর নির্বাচন প্রার্থীদের তো বটেই। এগুলোকে আমরা তাঁদের পবিত্র ইচ্ছারূপে দেখতে চাই। আর দেখতে চাই এসব সমস্যা সমাধানে সিটি করপোরেশনগুলোর আইনে তাদের ক্ষমতায়ন করা হোক। অপরিকল্পিতভাবে সিটি করপোরেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করার আগে যেগুলো আছে, সেগুলো কার্যকর করা আবশ্যক। নগর-পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ আর ট্রাফিক-ব্যবস্থা নগরবাসীর নিত্যদিনের জীবনযাত্রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাই এর সব ও পূর্ণ ক্ষমতা সিটি করপোরেশনগুলোরই থাকা উচিত। আইনকানুনের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সংশোধন করে এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে করপোরেশনগুলোর আওতায় আনার প্রস্তাব যৌক্তিক। এসব বিষয় নিয়ে নগর সরকারের ধারণা এসেছে। সমন্বয়ের প্রয়োজনে এ ধরনের কাজে নতুন কোনো সংস্থা চাপিয়ে দেওয়া সমস্যাকে আরও জটিল করবে। নির্বাচিত সিটি করপোরেশনগুলোর হাতে এ দায়িত্ব দেওয়া সব বিবেচনাতেই সংগত। উল্লেখ্য, আমাদের দেশের সব কটি সিটি করপোরেশনের আয়তন, জনসংখ্যা, সম্পদ ও অবকাঠামো এক রূপ নয়। তাই সূচনাতে ঢাকার দুটো এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে নিয়ে দেশের রাজধানী ও বাণিজ্যিক রাজধানীতে এ ধরনের নগর সরকার চালুর ভাবনা এখন সময়ের দাবি। এ করপোরেশনগুলোর প্রতিটিতে বসবাসকারী জনসংখ্যা পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। তাই কেন্দ্রীভূত প্রশাসনের ধারণা থেকে প্রকৃত প্রস্তাবে বেরিয়ে আসা দেশের শাসনব্যবস্থা ও উন্নয়ন কার্যক্রম সবকিছুরই সহায়ক হবে। এতে রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক চরিত্র বিনষ্ট কিংবা সরকারের মৌলিক নিয়ন্ত্রণে বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আদৌ নেই। মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত নগর গড়ার মতো দায়িত্ব এই মুহূর্তেই নগর সরকারের কাছে দেওয়া হয়তো-বা সম্ভব হবে না। তবে তারা জনমত সংগঠিত করে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সহায়তা করতে পারে। ওই সংস্থাগুলোর এ বিষয়ে শৈথিল্য কিংবা যোগসাজশ থাকলে আনতে পারে সরকারের নজরে। করপোরেশনগুলোর সম্পদে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাদের অনুদাননির্ভর না রেখে সম্পদ সংগ্রহের জন্য বাস্তব ও ন্যায়সংগত আইনি ব্যবস্থাও সরকারকে করে দিতে হবে। পাশাপাশি সস্তা জনপ্রিয়তার হাতছানি উপেক্ষা করে ন্যায্য করারোপ ও আদায়ে তাদের উদ্যোগী হওয়ারও আবশ্যকতা থাকবে।
নগর সরকারের বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক দলেরই অঙ্গীকার নেই। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকার তাদের আছে বটে; তবে বাস্তবে তারা করে চলে উল্টোটা। তা না হলে বিস্তৃত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বহাল থাকতে সব সরকারের সময়েই প্রত্যেক সাংসদের বরাবরে বছর বছর কয়েক কোটি টাকা করে পূর্ত কাজের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা হতো না। আর এসব বিবেচনায় রেখে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তাঁদের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা আর ইশতেহার তৈরি করা প্রয়োজন ছিল। তাঁরা তা কতটুকু করেছেন, এ বিষয়ে সন্দিহান হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। সরলমনা ভোটারদের কাছে চমকপ্রদ প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হবেন। পরে সূচনাতেই হোঁচট খাবেন এসব বিষয়ে। ‘বুদ্ধিমানেরা’ হয়তো প্রতিশ্রুতির ধারেকাছেও যাবেন না। যাঁরা যাবেন, তাঁরা শেষতক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কিংবা এরূপ কিছু একটা অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতার গ্লানি ঢাকতে চাইবেন। এমনটা হওয়া আদৌ সংগত নয়। সিটি করপোরেশনগুলোর প্রকৃত ক্ষমতায়নের দাবি যৌক্তিক। যাঁরা নির্বাচিত হবেন, তাঁরাই দলমত-নির্বিশেষে এ দাবির সঙ্গে সুর মেলানোর প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি যে ক্ষমতা এখন তাঁদের নেই, সে বিষয়ে কোনো কার্যক্রম গ্রহণের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেওয়াও যেকোনো প্রার্থীর জন্য অসংগত ও অনৈতিক।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments