নীরব প্রতিশোধ নেয়ার আহ্বান
সিটি
নির্বাচনে ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসীকে সরকারের অপকর্ম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে
নীরব বিপ্লবের মাধ্যমে নীরব প্রতিশোধ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বলেছেন, ২৮শে এপ্রিল মঙ্গলবার নীরব প্রতিশোধ নেয়ার
আহ্বান জানাচ্ছি। আপনাদের ভোট অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক বিরাট শক্তি। সঠিকভাবে
সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করুন। নীরব বিপ্লব ঘটান। আপনার ভোট হোক অন্যায়-অবিচারের
বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভোট। আপনারা কেউ ভয় পাবেন না। অনিয়ম ও কারচুপি দেখলে
সবাই মিলে প্রতিবাদ করবেন। ভোট শেষে বিকাল থেকে ভোটকেন্দ্রে পাহারা বসাবার
জন্য আমি নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। গণনা শেষে ফলাফল বুঝে নিয়ে
আপনারা কেন্দ্র ত্যাগ করবেন। যাতে আপনাদের দেয়া রায় ওরা বদলে ফেলতে না
পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে খালেদা জিয়া বলেন, আপনি
বিনা ভোটে রাজকীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। এই দম্ভ
ত্যাগ করুন। মনে রাখবেন, সবদিন সমান যায় না। এ পর্যন্ত যাই করেছেন, ৩টি
সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হতে দিন। রাষ্ট্রক্ষমতা আপনার কাছে বাঘের পিঠে
সওয়ার হওয়ার মতো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আপনি নামতে ভয় পাচ্ছেন। আপনি ভয় পাবেন
না। আমরা আপনার মতো প্রতিশোধপ্রবণ নই। উগ্র স্বভাব ও জিঘাংসার মনোবৃত্তি
বদলান। গণতন্ত্র ও সংলাপের পথে আসুন। আমরা আপনাকে সহি সালামতে নিরাপদে
নামতে সাহায্য করবো এবং একই সমতলে দাঁড়িয়ে নির্বাচন করবো। মানুষ যাকে খুশি
বেছে নেবে। আসুন, সেই পথটা অন্তত খুলে দেই। সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া
জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে কেন সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন
তার কারণ ব্যাখ্যা করেন। সেই সঙ্গে বিচারিক ক্ষমতাসহ ভোটের দিন সশস্ত্র
বাহিনীকে নির্বাচনী এলাকাজুড়ে মোতায়েনের দাবি জানান। সিটি নির্বাচন ও
সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গতকাল দুপুরে নিজের গুলশান কার্যালয়ে আয়োজিত
সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
নীরব প্রতিশোধ নিন, নীরব বিপ্লব ঘটান
খালেদা জিয়া ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসীর উদ্দেশে বলেন, মনে রাখবেন- দেশের সম্পদ লুটপাট, আপনাদের রক্ত শুষে এরা টাকার পাহাড় গড়েছে। কাজেই এরা যে টাকা বিলাচ্ছে, সেটা আপনাদেরই টাকা। ওদের কাছ থেকে এ টাকা নিলেও ভোট বিক্রি করবেন না। টাকা নেবেন কিন্তু বিবেক অনুযায়ী ভোট দেবেন। কারণ, ভোট বিক্রি আর ঈমান বিক্রি একই কথা। আওয়ামী লীগ যেভাবে উগ্র-সন্ত্রাসী ও দাম্ভিক হয়ে উঠেছে কোনভাবে এই তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফল কেড়ে নিতে পারলে তারা আপনাদেরকে আর মানুষ বলেই গণ্য করবে না। জোর করে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে গেলে মা-বোনেরা নিরাপদে থাকতে পারবেন না। ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারবেন না। প্রবীণ ও সম্মানিত নাগরিকদের সম্মান থাকবে না। তরুণদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা আরও বিপথগামী হবে। শিক্ষাঙ্গন আরও কলুষিত ও সন্ত্রাসকবলিত হবে। খালেদা জিয়া বলেন, এবার নিজেদের স্বার্থেই বুঝে-শুনে ভোট দিতে হবে এবং ভোটের ফল বুঝে নিতে হবে। আমি নগরবাসীর প্রতি আবেদন রাখছি, আপনারা দয়া করে ঢাকা দক্ষিণে আমাদের সমর্থিত প্রার্থী মির্জা আব্বাসকে মগ মার্কায়, ঢাকা উত্তরে তাবিদ আউয়ালকে বাস মার্কায় এবং চট্টগ্রামে মনজুর আলমকে কমলালেবু মার্কায় ভোট দিন। কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর পদেও আমাদের সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট দিন। আপনার ভোট হোক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভোট। আমরা মিথ্যা ও অসম্ভব প্রতিশ্রুতি দেয়ার পক্ষে নই। শুধু বলবো, আপনি দয়া করে পরিবর্তনের পক্ষে, স্বস্তির পক্ষে, শান্তির পক্ষে আপনার ভোটটি দিন। গুণ্ডামি, সন্ত্রাস, অপমানের বিরুদ্ধে ভোট দিন। মা-বোনের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য ভোট দিন। ভোট শেষে বিকাল থেকে ভোটকেন্দ্রে পাহারা বসাবার জন্য আমি নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। গণনা শেষে ফলাফল বুঝে নিয়ে আপনারা কেন্দ্র ত্যাগ করবেন। ভোটের দিন এবং এর পরে কোন উস্কানির ফাঁদে পা না দেয়ার এবং কোন গুজবে কান না দেয়ার জন্য আমি অনুরোধ করছি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তার ফলাফল মেনে নেয়ার জন্যও আমি সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ভোট গ্রহণ, গণনা, ফল ঘোষণা ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় যারা নির্বাচনী দায়িত্বে থাকবেন তাদের সকলের প্রতি আমার অনুরোধ, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব পালন করবেন। কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবেন না।
যে ৭ কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণ
খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের আন্দোলন চলাকালে আকস্মিকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী ৩টি সিটিতে তার মনোনীত মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করেন। তারা হয়তো ভেবেছিল, সর্বব্যাপী আক্রমণে পর্যুদস্ত বিএনপি সিটি নির্বাচন থেকে দূরে থাকবে। এখন নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে সে সন্দেহ দেশবাসীর মতো আমাদেরও ছিল এবং আছে। তা সত্ত্বেও আমরা ৭টি কারণে এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কারণগুলো হচ্ছে- ১. জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবি করেছি, স্থানীয় নির্বাচনে নয়। ২. দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে ২০দলীয় জোট অংশ নিয়ে সবগুলো সিটিতে বিপুল ভোটে জিতেছে। জনগণের বিপুল সমর্থন যে বিএনপি ও ২০দলীয় জোটের প্রতি রয়েছে, তা সবগুলো নির্বাচনেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৩. সভা-সমাবেশসহ সকল গণতান্ত্রিক অধিকার ও জনগণের কাছে যাবার সুযোগ আমাদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সীমিত আকারে হলেও সে সুযোগ আমরা নিতে চেয়েছি। ৪. একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে সকল পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থায় আমরা বিশ্বাস করি। জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করেছি। ৫. একদলীয় শাসন থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংসদীয় পদ্ধতি ও জনগণের সরাসরি ভোটে সিটি করপোরেশনে মেয়র নির্বাচনের ব্যবস্থাও বিএনপিই করেছে। তাই সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকাটাই বিএনপি যুক্তিসঙ্গত মনে করেছে। ৬. জনগণের ওপর আমাদের অটুট আস্থা রয়েছে বলে মনে করি, মানুষ সুযোগ পেলেই আমাদের সমর্থিত প্রার্থীদের বিপুল ভোটে বিজয়ী করবে। ৭. এই নির্বাচনকে আমরা সরকার, শাসক দল, নির্বাচন কমিশন, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য একটি টেস্ট কেস হিসেবেও নিয়েছি। তিনি বলেন, এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এ নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কোন পরিবর্তন হবে না। কারচুপির মাধ্যমে তারা জনগণের রায় বদলালে আবারও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে, এদের অধীনে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবান্তর।
যে কারণে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট দেবেন
ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসীর উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, ক্ষমতাসীনরা ৫ই জানুয়ারি আপনাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আপনারা ভোট কেন্দ্রে না গেলেও ৪০ ভাগ ভোট পড়েছে বলে হিসাব দিয়ে আপনাদের অপমান করেছে। ভোট ছাড়াই জনগণের ভুয়া প্রতিনিধি সেজেছে। শেয়ারবাজার লুট করে আপনাদের ফতুর করেছে। কুইক রেন্টালের নামে বিদ্যুৎখাত থেকে বেশুমার অর্থ লুটেছে। পদ্মা সেতুর টাকা চুরি করেছে। দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলো লুটে খেয়েছে। মানুষের রক্ত শুষে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। খালেদা জিয়া বলেন, এরা আপনার সন্তান ও ভাইদের গুম, খুন, অপহরণ করে পথেঘাটে লাশ ফেলে রেখেছে। বহু মায়ের কোল খালি, অনেক বধূকে স্বামীহারা, মাকে সন্তানহারা, বোনকে ভাইহারা করেছে। রক্তপিপাসু এই শাসকদের হত্যা-নির্যাতনে ঘরে ঘরে আজ কান্নার রোল। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ঢাকা নগরীকে দ্বিখণ্ডিত করেছে কিন্তু সেবাখাতে সমন্বয়ের কোন ব্যবস্থা করেনি। নির্বাচন ছাড়াই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে প্রশাসক বসিয়ে শোষণ ও দুর্নীতি করেছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও অন্যান্য প্রতিনিধিদের মিথ্যা মামলায় আটক এবং তাদেরকে বহিষ্কার করে সারা দেশের ভোটারদের অপমান করেছে। খালেদা জিয়া বলেন, এরা বসবাসের অনুপযোগী করে ফেলেছে এই রাজধানীকে। নাগরিক সেবার কোন ব্যবস্থা না করে বড় বড় প্রকল্পের নামে নিজেদের পকেট ভারী করেছে কমিশনের টাকায়। মাদকের ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়ে তরুণ সমাজকে বিপথগামী করছে। তিনি বলেন, রানা প্লাজা বিপর্যয়ে এ সরকার বহু শ্রমজীবী মানুষের জীবন নিয়েছে। ক্ষতিপূরণের টাকা সংগ্রহ করে তা দেয়নি। ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকারী গার্মেন্ট শ্রমিককে হত্যা ও নির্যাতন করেছে। খালেদা জিয়া বলেন, রাজধানী ঢাকায় হেফাজতের সমাবেশে রাতের অন্ধকারে হামলা করে এতিম ও আলেমদের রক্ত নিয়েছে। এরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন করেছে। তাদের মন্দিরের প্রতিমার স্বর্ণালংকার ও অর্থ লুট করেছে। পরিকল্পিত পন্থায় দাঙ্গা বাধিয়ে রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মন্দির ধ্বংস করেছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া সারা দেশের মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেছে। সম্মানিত নাগরিকদের অপমান করেছে। খালেদা জিয়া বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক দখল করে নিয়ে গেছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। নিত্যপণ্যের দামের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবন দুর্বিষহ করেছে। জনগণকে দেয়া প্রতিটি ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। খালেদা জিয়া বলেন, দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, জুলুম ও দলীয়করণে প্রতিটি স্তরের মানুষকে এ সরকার অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নারীর সম্ভ্রমহানি ও লাঞ্ছনায় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। সিটি করপোরেশনসহ সকল ঠিকাদারি কাজে টেন্ডার ডাকাতির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারসমূহকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করেছে। আড়াল করেছে প্রকৃত অপরাধীদের। এদের মদতে নারায়ণগঞ্জে র্যাব কর্মকর্তারা ১১ খুনের পৈশাচিক ঘটনা ঘটিয়েছে। বিদেশী অতিথিদের দেয়া স্বর্ণপদকের সোনাও চুরি করে সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করেছে।
সরকারের সব হিসাব উল্টে গেছে
খালেদা জিয়া বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে এই নগরীতে ক’দিন জনসংযোগে নেমে জনগণের যে আবেগ ও উচ্ছ্বাস দেখেছি, তাতে আমি অভিভূত। মানুষ উদ্বেলিত। পরিবর্তন কামনায় অধীর। আমি যেদিকেই গিয়েছি, বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো মানুষ নেমে এসেছে উচ্ছ্বসিত হয়ে, ভয়ভীতি উপেক্ষা করে। এই গণজোয়ার দেখে আওয়ামী লীগ দিশাহারা হয়ে পড়েছে। তাদের সব হিসাবনিকাশ পাল্টে গেছে। তিনি বলেন, আমার হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, কামান-বন্দুক নেই, পুলিশ-র্যাব-বিজিপি-আনসার নেই। কোন বাহিনী বা সশস্ত্র সন্ত্রাসী নেই। আমার আছে শুধু আল্লাহ্র ওপর ভরসা আর দেশবাসীর সমর্থন ও দোয়া। এর উপর নির্ভর করেই আমি রাজপথে নেমেছি। জনগণের কাছে যাচ্ছি। খালেদা জিয়া বলেন, এতে এতো ভয় পাবার কী আছে? কিন্তু তারা ভয় পেয়েছে। এতদিন তারা প্রচার করতো, আমি নাকি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। বিএনপি ও ২০ দলের কোন জনসমর্থন নেই। কিন্তু আমি জনসংযোগে নামতেই যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে, তাতে তাদের এতো দিনকার সব প্রচারণা মিথ্যে হয়ে গেছে।
অল্পের জন্য বেঁচে গেছি
খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে আমার বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়েছেন। প্রকাশ্যে হাজারো মানুষের সামনে ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে উত্তরা, কাওরানবাজার, ফকিরেরপুলের কাছে ও বাংলামোটরে আমার গাড়িবহরে পরপর চারদিন হামলা করেছে। হামলায় আমার উপদেষ্টা ও পুলিশের সাবেক আইজি আবদুল কাইয়ুম, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, আমার দুজন নিরাপত্তা রক্ষীসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও নেতা-কর্মী আহত হয়েছে। পুলিশের সহযোগিতায় হামলায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেয়। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। আমি যে-পাশে বসা ছিলাম, সেই পাশেই গাড়ির জানালার কাঁচে গুলি লাগে। এতে গ্লাস ভেদ না করলেও তা ফেটে যায়। আল্লাহর রহমতে অল্পের জন্য আমার জীবন রক্ষা পায়। এটা যে আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত সুপরিকল্পিত হামলা ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। খালেদা জিয়া বলেন, প্র্রতিটি হামলার ঘটনাই প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের সরাসরি উসকানির ফল এবং সুপরিকল্পিত। এসব হামলায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অংশ নেয়। সংবাদপত্রে ও টেলিভিশনের সচিত্র প্রতিবেদনে হামলাকারীদের অনেকের চেহারা স্পষ্ট। অনেকের নামধাম ও সাংগঠনিক পরিচয় আপনাদের রিপোর্টেই তুলে ধরা হয়েছে। সন্ত্রাসীরা কেউ কেউ সাংবাদিকদের কাছে হামলায় অংশ নেয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকারও করেছে। ফকিরেরপুলের কাছে আমার গাড়িবহরে হামলার সময় ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী নিজে উপস্থিত ছিলেন। কাওরানবাজারে আমার প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে পরিচালিত সশস্ত্র হামলায় অংশগ্রহণকারীদের কয়েকজনকে ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর পাশে থেকে তার পক্ষে প্রচার চালাতে দেখা গেছে। এই হামলাকারীদের কাউকে কাউকে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও পুলিশের বিতর্কিত কর্মকর্তাদের পাশে ছবিতে দেখা গেছে। আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বারবার হামলা চালানো সত্ত্বেও একজন সন্ত্রাসীকেও এখন পর্যন্ত ধরা হয়নি। বরং যারা আক্রান্ত ও আহত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেই মামলা নেয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে আমাদের সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের। আটক করা এবং হুমকি দেয়া হচ্ছে বিএনপির নেতা-কর্মী, সমর্থক ও ভোটারদের। কিন্তু ধারাবাহিক এসব হামলা ও নির্বাচনী প্রচার কাজে বাধা দেয়ার বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশন কোন পদক্ষেপ নেয়া দূরে থাকুক; টু-শব্দটি পর্যন্ত করেনি। আমার প্রাণনাশের লক্ষ্যে দলীয় সন্ত্রাসীদের হামলার পর প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনাকে যেভাবে ‘নাটক’ আখ্যা দিয়েছেন এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যেভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত। আমি বুঝতে পারছি, এর কোন বিচার হবে না। খালেদা জিয়া বলেন, জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন। তিনি রক্ষা করলে আমাকে কেউ হত্যা করতে পারবে না। বিশেষ করে ঢাকাবাসীকে বলবো, আপনারা দেখছেন, ক্ষমতার দম্ভে আমার সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হচ্ছে! আমার স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশকে ভালবেসে এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। অল্প কিছুদিন আগে আমি আমার আদরের ছোট ছেলেটিকে চিরকালের জন্য হারিয়েছি। আমার একমাত্র জীবিত সন্তানটি অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন ধরে দূরদেশে চিকিৎসাধীন রয়েছে। জীবনের এই প্রান্তে এসে প্রিয় মাতৃভূমিতে স্বজনহীন পরিবেশে চরম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে এখনও আমি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাধ্যমতো সংগ্রাম করে যাচ্ছি। এখন আপনারাই আমার স্বজন, আপনারাই আমার আত্মীয়। আমার সকল তৎপরতা আপনাদেরকেই ঘিরে। তাই সব অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিকার ও উপযুক্ত জবাব দেয়ার ভার আজ আমি আপনাদের উপরেই অর্পণ করলাম।
সুযোগ পেলে ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসী জবাব দেবে
খালেদা জিয়া বলেন, দেশবাসী নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এই টেস্ট কেসে সরকার, ক্ষমতাসীন দল, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শোচনীয়ভাবে ফেইল করে চলেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিতে তাদের ভোট ডাকাতির পরিকল্পনার দোসর হয়ে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন সেনা মোতায়েনের কথা বলে এক ধূর্ত অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। এতে প্রমাণ হলো, আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস, ভোট ডাকাতি ও কারসাজির মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে ফেলার এবং ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখানোর যে পরিকল্পনা এঁটেছে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীকে তারা বাধা বলে মনে করছে। আমরা বিচারিক ক্ষমতাসহ সশস্ত্র বাহিনীকে নির্বাচনী এলাকাজুড়ে ভোটের দিন এবং আগে-পরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মোতায়েন করতে আবারও দাবি জানাচ্ছি। খালেদা জিয়া বলেন, ক্ষমতাসীনদের ভোটার ভীতি ও পরাজয়ের আলামত সব দিক দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাই তারা আমাদের প্রচার কাজে বাধা দিচ্ছে ও হামলা চালাচ্ছে। ভোটাররা যাতে ভয় পেয়ে ভোটকেন্দ্রে না যায় তেমন ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করতেই তারা সর্বমুখী সন্ত্রাস চালাচ্ছে। পুলিশ বাহিনীকে তারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের অবস্থা যাচাইয়ে সরজমিনে জরিপের কাজে নামিয়েছে। পুলিশ ও সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদেরকে হুমকি দিচ্ছে। সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরকে মন্ত্রী-এমপিরা সরকার সমর্থক প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণায় নামতে বাধ্য করছেন। নিম্নবিত্ত ও বস্তি এলাকায় গরিব মানুষের ভোট কেনার অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে পাওয়া যাচ্ছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মানুষ একটুখানি সুযোগ পেলেই নীরব ভোট বিপ্লব ঘটিয়ে এসব অপতৎপরতা ও অত্যাচারের বদলা নেবে, উপযুক্ত জবাব দেবে।
তার কান্না মানুষ অভিনয় মনে করে
খালেদা জিয়া বলেন, বোমা হামলায় ও বিনা বিচারে প্রায় সমান সংখ্যক মানুষকে হত্যার ঘটনার ব্যাপারে আমরা আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছি। পুনরুল্লেখ করে বলছি, আমরা হত্যা, নাশকতা, সন্ত্রাস ও লাশের রাজনীতি করি না। সন্ত্রাস-নির্ভর নষ্ট রাজনীতির চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে আওয়ামী লীগ। তারা জনগণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ভীত হয়ে দু’ধারা ছুরির মতো অপকৌশল নিয়েছিল। আমাদের কর্মসূচি ভণ্ডুল করতে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে সশস্ত্র প্রহরায় একদিকে পথে যানবাহন নামিয়েছে। অপরদিকে সেই যানবাহনে বোমা হামলায় মানুষ হত্যা করে তার দায় বিরোধী দলের উপর চাপিয়ে হত্যা, নির্যাতন, গুম, গণগ্রেপ্তার ও একতরফা অপপ্রচারের পথ উন্মুক্ত করেছে। তবে অপরাজনীতি ও একতরফা অপপ্রচার দেশের বেশির ভাগ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকীর একটি বক্তব্যের উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, মানুষ মারায় যদি জেতার প্রশ্ন আসে শেখ হাসিনা তাতে অবশ্যই জিতেছেন। তবে কেঁদে তিনি জিততে পারেননি। তার কান্নাকে এদেশের বেশির ভাগ মানুষ ‘কান্নার অভিনয়’ হিসেবেই মনে করেন।
সরকার অপকৌশলকে কৌশল হিসেবে নিয়েছে
খালেদা জিয়া বলেন, রাজনীতিতে কৌশল থাকে কিন্তু নিম্নরুচির মানুষেরা অপকৌশলকে কৌশল ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। জনগণের সমর্থন নয়, সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও অপপ্রচারকেই তারা জেতার পথ বলে ধরে নিয়েছে। যুক্তি, সংযম, সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সংলাপের পথ তারা এড়িয়ে চলতে চায়। দেশে সকল সংকটের সূত্র সেখানেই। তিনি বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বিরোধী দল ও ভিন্নমত দমন এবং জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ-বিক্ষোভ স্তব্ধ করার কাজে নিয়োজিত রেখে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন দলের লোকদেরকে আইনের ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছে। দেশে কোন অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নেই। সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে দলীয় স্বার্থে ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। দেশে এমন সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে, ক্ষমতাসীন ছাড়া আর কারও যেন সুবিচার পাওয়ার কোন অধিকার নেই। এ সময় তিনি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ ও ছাত্রদলের সাবেক সংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান খোকনকে নিখোঁজ নেতাদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উৎকণ্ঠা প্রকাশ ও তাদের সন্ধান দাবি করেন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে প্রতিবেশী নেপাল ও ভারতে বহু মানুষের প্রাণহানি এবং আমাদের দেশের আহত ও নিহতের ঘটনায় গভীরভাবে মর্মাহত বলে মন্তব্য করেন। পহেলা বৈশাখ টিএসসি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ও দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতিতদের প্রতি সহানুভূতি জানাচ্ছি। এসব ঘৃণ্য অপরাধীদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
প্রশ্নোত্তর খালেদা
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, জাতীয় নির্বাচনের জন্য অবশ্যই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার লাগবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আমরা জিতলেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও ঠুঁটো জগন্নাথ নির্বাচন কমিশন শুদ্ধ হয়ে যাবে না। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল ২০ দল। তবে সার্বিক পরিস্থিতিতে সেটার ব্যাপারে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে আমরা বসতে পারিনি। তবে বাস্তবে অবরোধ কর্মসূচি এখন অনেক নিষ্ক্রিয়। সমঝোতা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সমঝোতা আমাদের মধ্যেই হবে। এখানে বিদেশী কূটনীতিকদের প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। সিটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন কিনা এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি ক্যান্টনমেন্টের ভোটার। আর ক্যান্টনমেন্ট সিটি করপোরেশনের মধ্যে নয়। গাড়িবহর নিয়ে গণসংযোগ চালানোর ব্যাপারে ইসির অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমার নিরাপত্তারক্ষীদের কয়েকটি গাড়ির সঙ্গে সাংবাদিকদের গাড়ি ছিল। এখন সাংবাদিকদের আমার বহরের সঙ্গে গণ্য করা হলে সেটা আপনারাই বিচার করুন। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই বিধি ভঙ্গ করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, স্থায়ী কমিটি সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, নজরুল ইসলাম খান, জোটের শরিক খেলাফত মজলিসের আমীর মুহাম্মদ ইসহাক, এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, ইসলামী ঐক্যজোটের আমীর আবদুল লতিফ নেজামী, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, লেবার পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, এনডিপি সভাপতি খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজাসহ বিএনপি ও জোটের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
নীরব প্রতিশোধ নিন, নীরব বিপ্লব ঘটান
খালেদা জিয়া ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসীর উদ্দেশে বলেন, মনে রাখবেন- দেশের সম্পদ লুটপাট, আপনাদের রক্ত শুষে এরা টাকার পাহাড় গড়েছে। কাজেই এরা যে টাকা বিলাচ্ছে, সেটা আপনাদেরই টাকা। ওদের কাছ থেকে এ টাকা নিলেও ভোট বিক্রি করবেন না। টাকা নেবেন কিন্তু বিবেক অনুযায়ী ভোট দেবেন। কারণ, ভোট বিক্রি আর ঈমান বিক্রি একই কথা। আওয়ামী লীগ যেভাবে উগ্র-সন্ত্রাসী ও দাম্ভিক হয়ে উঠেছে কোনভাবে এই তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফল কেড়ে নিতে পারলে তারা আপনাদেরকে আর মানুষ বলেই গণ্য করবে না। জোর করে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে গেলে মা-বোনেরা নিরাপদে থাকতে পারবেন না। ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারবেন না। প্রবীণ ও সম্মানিত নাগরিকদের সম্মান থাকবে না। তরুণদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা আরও বিপথগামী হবে। শিক্ষাঙ্গন আরও কলুষিত ও সন্ত্রাসকবলিত হবে। খালেদা জিয়া বলেন, এবার নিজেদের স্বার্থেই বুঝে-শুনে ভোট দিতে হবে এবং ভোটের ফল বুঝে নিতে হবে। আমি নগরবাসীর প্রতি আবেদন রাখছি, আপনারা দয়া করে ঢাকা দক্ষিণে আমাদের সমর্থিত প্রার্থী মির্জা আব্বাসকে মগ মার্কায়, ঢাকা উত্তরে তাবিদ আউয়ালকে বাস মার্কায় এবং চট্টগ্রামে মনজুর আলমকে কমলালেবু মার্কায় ভোট দিন। কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর পদেও আমাদের সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট দিন। আপনার ভোট হোক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভোট। আমরা মিথ্যা ও অসম্ভব প্রতিশ্রুতি দেয়ার পক্ষে নই। শুধু বলবো, আপনি দয়া করে পরিবর্তনের পক্ষে, স্বস্তির পক্ষে, শান্তির পক্ষে আপনার ভোটটি দিন। গুণ্ডামি, সন্ত্রাস, অপমানের বিরুদ্ধে ভোট দিন। মা-বোনের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য ভোট দিন। ভোট শেষে বিকাল থেকে ভোটকেন্দ্রে পাহারা বসাবার জন্য আমি নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। গণনা শেষে ফলাফল বুঝে নিয়ে আপনারা কেন্দ্র ত্যাগ করবেন। ভোটের দিন এবং এর পরে কোন উস্কানির ফাঁদে পা না দেয়ার এবং কোন গুজবে কান না দেয়ার জন্য আমি অনুরোধ করছি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তার ফলাফল মেনে নেয়ার জন্যও আমি সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ভোট গ্রহণ, গণনা, ফল ঘোষণা ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় যারা নির্বাচনী দায়িত্বে থাকবেন তাদের সকলের প্রতি আমার অনুরোধ, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব পালন করবেন। কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবেন না।
যে ৭ কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণ
খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের আন্দোলন চলাকালে আকস্মিকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী ৩টি সিটিতে তার মনোনীত মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করেন। তারা হয়তো ভেবেছিল, সর্বব্যাপী আক্রমণে পর্যুদস্ত বিএনপি সিটি নির্বাচন থেকে দূরে থাকবে। এখন নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে সে সন্দেহ দেশবাসীর মতো আমাদেরও ছিল এবং আছে। তা সত্ত্বেও আমরা ৭টি কারণে এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কারণগুলো হচ্ছে- ১. জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবি করেছি, স্থানীয় নির্বাচনে নয়। ২. দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে ২০দলীয় জোট অংশ নিয়ে সবগুলো সিটিতে বিপুল ভোটে জিতেছে। জনগণের বিপুল সমর্থন যে বিএনপি ও ২০দলীয় জোটের প্রতি রয়েছে, তা সবগুলো নির্বাচনেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৩. সভা-সমাবেশসহ সকল গণতান্ত্রিক অধিকার ও জনগণের কাছে যাবার সুযোগ আমাদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সীমিত আকারে হলেও সে সুযোগ আমরা নিতে চেয়েছি। ৪. একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে সকল পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থায় আমরা বিশ্বাস করি। জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করেছি। ৫. একদলীয় শাসন থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংসদীয় পদ্ধতি ও জনগণের সরাসরি ভোটে সিটি করপোরেশনে মেয়র নির্বাচনের ব্যবস্থাও বিএনপিই করেছে। তাই সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকাটাই বিএনপি যুক্তিসঙ্গত মনে করেছে। ৬. জনগণের ওপর আমাদের অটুট আস্থা রয়েছে বলে মনে করি, মানুষ সুযোগ পেলেই আমাদের সমর্থিত প্রার্থীদের বিপুল ভোটে বিজয়ী করবে। ৭. এই নির্বাচনকে আমরা সরকার, শাসক দল, নির্বাচন কমিশন, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য একটি টেস্ট কেস হিসেবেও নিয়েছি। তিনি বলেন, এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এ নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কোন পরিবর্তন হবে না। কারচুপির মাধ্যমে তারা জনগণের রায় বদলালে আবারও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে, এদের অধীনে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবান্তর।
যে কারণে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট দেবেন
ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসীর উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, ক্ষমতাসীনরা ৫ই জানুয়ারি আপনাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আপনারা ভোট কেন্দ্রে না গেলেও ৪০ ভাগ ভোট পড়েছে বলে হিসাব দিয়ে আপনাদের অপমান করেছে। ভোট ছাড়াই জনগণের ভুয়া প্রতিনিধি সেজেছে। শেয়ারবাজার লুট করে আপনাদের ফতুর করেছে। কুইক রেন্টালের নামে বিদ্যুৎখাত থেকে বেশুমার অর্থ লুটেছে। পদ্মা সেতুর টাকা চুরি করেছে। দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলো লুটে খেয়েছে। মানুষের রক্ত শুষে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। খালেদা জিয়া বলেন, এরা আপনার সন্তান ও ভাইদের গুম, খুন, অপহরণ করে পথেঘাটে লাশ ফেলে রেখেছে। বহু মায়ের কোল খালি, অনেক বধূকে স্বামীহারা, মাকে সন্তানহারা, বোনকে ভাইহারা করেছে। রক্তপিপাসু এই শাসকদের হত্যা-নির্যাতনে ঘরে ঘরে আজ কান্নার রোল। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ঢাকা নগরীকে দ্বিখণ্ডিত করেছে কিন্তু সেবাখাতে সমন্বয়ের কোন ব্যবস্থা করেনি। নির্বাচন ছাড়াই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে প্রশাসক বসিয়ে শোষণ ও দুর্নীতি করেছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও অন্যান্য প্রতিনিধিদের মিথ্যা মামলায় আটক এবং তাদেরকে বহিষ্কার করে সারা দেশের ভোটারদের অপমান করেছে। খালেদা জিয়া বলেন, এরা বসবাসের অনুপযোগী করে ফেলেছে এই রাজধানীকে। নাগরিক সেবার কোন ব্যবস্থা না করে বড় বড় প্রকল্পের নামে নিজেদের পকেট ভারী করেছে কমিশনের টাকায়। মাদকের ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়ে তরুণ সমাজকে বিপথগামী করছে। তিনি বলেন, রানা প্লাজা বিপর্যয়ে এ সরকার বহু শ্রমজীবী মানুষের জীবন নিয়েছে। ক্ষতিপূরণের টাকা সংগ্রহ করে তা দেয়নি। ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকারী গার্মেন্ট শ্রমিককে হত্যা ও নির্যাতন করেছে। খালেদা জিয়া বলেন, রাজধানী ঢাকায় হেফাজতের সমাবেশে রাতের অন্ধকারে হামলা করে এতিম ও আলেমদের রক্ত নিয়েছে। এরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন করেছে। তাদের মন্দিরের প্রতিমার স্বর্ণালংকার ও অর্থ লুট করেছে। পরিকল্পিত পন্থায় দাঙ্গা বাধিয়ে রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মন্দির ধ্বংস করেছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া সারা দেশের মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেছে। সম্মানিত নাগরিকদের অপমান করেছে। খালেদা জিয়া বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক দখল করে নিয়ে গেছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। নিত্যপণ্যের দামের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবন দুর্বিষহ করেছে। জনগণকে দেয়া প্রতিটি ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। খালেদা জিয়া বলেন, দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, জুলুম ও দলীয়করণে প্রতিটি স্তরের মানুষকে এ সরকার অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নারীর সম্ভ্রমহানি ও লাঞ্ছনায় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। সিটি করপোরেশনসহ সকল ঠিকাদারি কাজে টেন্ডার ডাকাতির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারসমূহকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করেছে। আড়াল করেছে প্রকৃত অপরাধীদের। এদের মদতে নারায়ণগঞ্জে র্যাব কর্মকর্তারা ১১ খুনের পৈশাচিক ঘটনা ঘটিয়েছে। বিদেশী অতিথিদের দেয়া স্বর্ণপদকের সোনাও চুরি করে সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করেছে।
সরকারের সব হিসাব উল্টে গেছে
খালেদা জিয়া বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে এই নগরীতে ক’দিন জনসংযোগে নেমে জনগণের যে আবেগ ও উচ্ছ্বাস দেখেছি, তাতে আমি অভিভূত। মানুষ উদ্বেলিত। পরিবর্তন কামনায় অধীর। আমি যেদিকেই গিয়েছি, বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো মানুষ নেমে এসেছে উচ্ছ্বসিত হয়ে, ভয়ভীতি উপেক্ষা করে। এই গণজোয়ার দেখে আওয়ামী লীগ দিশাহারা হয়ে পড়েছে। তাদের সব হিসাবনিকাশ পাল্টে গেছে। তিনি বলেন, আমার হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, কামান-বন্দুক নেই, পুলিশ-র্যাব-বিজিপি-আনসার নেই। কোন বাহিনী বা সশস্ত্র সন্ত্রাসী নেই। আমার আছে শুধু আল্লাহ্র ওপর ভরসা আর দেশবাসীর সমর্থন ও দোয়া। এর উপর নির্ভর করেই আমি রাজপথে নেমেছি। জনগণের কাছে যাচ্ছি। খালেদা জিয়া বলেন, এতে এতো ভয় পাবার কী আছে? কিন্তু তারা ভয় পেয়েছে। এতদিন তারা প্রচার করতো, আমি নাকি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। বিএনপি ও ২০ দলের কোন জনসমর্থন নেই। কিন্তু আমি জনসংযোগে নামতেই যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে, তাতে তাদের এতো দিনকার সব প্রচারণা মিথ্যে হয়ে গেছে।
অল্পের জন্য বেঁচে গেছি
খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে আমার বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়েছেন। প্রকাশ্যে হাজারো মানুষের সামনে ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে উত্তরা, কাওরানবাজার, ফকিরেরপুলের কাছে ও বাংলামোটরে আমার গাড়িবহরে পরপর চারদিন হামলা করেছে। হামলায় আমার উপদেষ্টা ও পুলিশের সাবেক আইজি আবদুল কাইয়ুম, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, আমার দুজন নিরাপত্তা রক্ষীসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও নেতা-কর্মী আহত হয়েছে। পুলিশের সহযোগিতায় হামলায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেয়। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। আমি যে-পাশে বসা ছিলাম, সেই পাশেই গাড়ির জানালার কাঁচে গুলি লাগে। এতে গ্লাস ভেদ না করলেও তা ফেটে যায়। আল্লাহর রহমতে অল্পের জন্য আমার জীবন রক্ষা পায়। এটা যে আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত সুপরিকল্পিত হামলা ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। খালেদা জিয়া বলেন, প্র্রতিটি হামলার ঘটনাই প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের সরাসরি উসকানির ফল এবং সুপরিকল্পিত। এসব হামলায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অংশ নেয়। সংবাদপত্রে ও টেলিভিশনের সচিত্র প্রতিবেদনে হামলাকারীদের অনেকের চেহারা স্পষ্ট। অনেকের নামধাম ও সাংগঠনিক পরিচয় আপনাদের রিপোর্টেই তুলে ধরা হয়েছে। সন্ত্রাসীরা কেউ কেউ সাংবাদিকদের কাছে হামলায় অংশ নেয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকারও করেছে। ফকিরেরপুলের কাছে আমার গাড়িবহরে হামলার সময় ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী নিজে উপস্থিত ছিলেন। কাওরানবাজারে আমার প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে পরিচালিত সশস্ত্র হামলায় অংশগ্রহণকারীদের কয়েকজনকে ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর পাশে থেকে তার পক্ষে প্রচার চালাতে দেখা গেছে। এই হামলাকারীদের কাউকে কাউকে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও পুলিশের বিতর্কিত কর্মকর্তাদের পাশে ছবিতে দেখা গেছে। আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বারবার হামলা চালানো সত্ত্বেও একজন সন্ত্রাসীকেও এখন পর্যন্ত ধরা হয়নি। বরং যারা আক্রান্ত ও আহত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেই মামলা নেয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে আমাদের সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের। আটক করা এবং হুমকি দেয়া হচ্ছে বিএনপির নেতা-কর্মী, সমর্থক ও ভোটারদের। কিন্তু ধারাবাহিক এসব হামলা ও নির্বাচনী প্রচার কাজে বাধা দেয়ার বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশন কোন পদক্ষেপ নেয়া দূরে থাকুক; টু-শব্দটি পর্যন্ত করেনি। আমার প্রাণনাশের লক্ষ্যে দলীয় সন্ত্রাসীদের হামলার পর প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনাকে যেভাবে ‘নাটক’ আখ্যা দিয়েছেন এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যেভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত। আমি বুঝতে পারছি, এর কোন বিচার হবে না। খালেদা জিয়া বলেন, জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন। তিনি রক্ষা করলে আমাকে কেউ হত্যা করতে পারবে না। বিশেষ করে ঢাকাবাসীকে বলবো, আপনারা দেখছেন, ক্ষমতার দম্ভে আমার সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হচ্ছে! আমার স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশকে ভালবেসে এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। অল্প কিছুদিন আগে আমি আমার আদরের ছোট ছেলেটিকে চিরকালের জন্য হারিয়েছি। আমার একমাত্র জীবিত সন্তানটি অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন ধরে দূরদেশে চিকিৎসাধীন রয়েছে। জীবনের এই প্রান্তে এসে প্রিয় মাতৃভূমিতে স্বজনহীন পরিবেশে চরম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে এখনও আমি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাধ্যমতো সংগ্রাম করে যাচ্ছি। এখন আপনারাই আমার স্বজন, আপনারাই আমার আত্মীয়। আমার সকল তৎপরতা আপনাদেরকেই ঘিরে। তাই সব অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিকার ও উপযুক্ত জবাব দেয়ার ভার আজ আমি আপনাদের উপরেই অর্পণ করলাম।
সুযোগ পেলে ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসী জবাব দেবে
খালেদা জিয়া বলেন, দেশবাসী নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এই টেস্ট কেসে সরকার, ক্ষমতাসীন দল, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শোচনীয়ভাবে ফেইল করে চলেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিতে তাদের ভোট ডাকাতির পরিকল্পনার দোসর হয়ে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন সেনা মোতায়েনের কথা বলে এক ধূর্ত অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। এতে প্রমাণ হলো, আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস, ভোট ডাকাতি ও কারসাজির মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে ফেলার এবং ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখানোর যে পরিকল্পনা এঁটেছে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীকে তারা বাধা বলে মনে করছে। আমরা বিচারিক ক্ষমতাসহ সশস্ত্র বাহিনীকে নির্বাচনী এলাকাজুড়ে ভোটের দিন এবং আগে-পরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মোতায়েন করতে আবারও দাবি জানাচ্ছি। খালেদা জিয়া বলেন, ক্ষমতাসীনদের ভোটার ভীতি ও পরাজয়ের আলামত সব দিক দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাই তারা আমাদের প্রচার কাজে বাধা দিচ্ছে ও হামলা চালাচ্ছে। ভোটাররা যাতে ভয় পেয়ে ভোটকেন্দ্রে না যায় তেমন ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করতেই তারা সর্বমুখী সন্ত্রাস চালাচ্ছে। পুলিশ বাহিনীকে তারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের অবস্থা যাচাইয়ে সরজমিনে জরিপের কাজে নামিয়েছে। পুলিশ ও সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদেরকে হুমকি দিচ্ছে। সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরকে মন্ত্রী-এমপিরা সরকার সমর্থক প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণায় নামতে বাধ্য করছেন। নিম্নবিত্ত ও বস্তি এলাকায় গরিব মানুষের ভোট কেনার অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে পাওয়া যাচ্ছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মানুষ একটুখানি সুযোগ পেলেই নীরব ভোট বিপ্লব ঘটিয়ে এসব অপতৎপরতা ও অত্যাচারের বদলা নেবে, উপযুক্ত জবাব দেবে।
তার কান্না মানুষ অভিনয় মনে করে
খালেদা জিয়া বলেন, বোমা হামলায় ও বিনা বিচারে প্রায় সমান সংখ্যক মানুষকে হত্যার ঘটনার ব্যাপারে আমরা আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছি। পুনরুল্লেখ করে বলছি, আমরা হত্যা, নাশকতা, সন্ত্রাস ও লাশের রাজনীতি করি না। সন্ত্রাস-নির্ভর নষ্ট রাজনীতির চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে আওয়ামী লীগ। তারা জনগণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ভীত হয়ে দু’ধারা ছুরির মতো অপকৌশল নিয়েছিল। আমাদের কর্মসূচি ভণ্ডুল করতে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে সশস্ত্র প্রহরায় একদিকে পথে যানবাহন নামিয়েছে। অপরদিকে সেই যানবাহনে বোমা হামলায় মানুষ হত্যা করে তার দায় বিরোধী দলের উপর চাপিয়ে হত্যা, নির্যাতন, গুম, গণগ্রেপ্তার ও একতরফা অপপ্রচারের পথ উন্মুক্ত করেছে। তবে অপরাজনীতি ও একতরফা অপপ্রচার দেশের বেশির ভাগ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকীর একটি বক্তব্যের উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, মানুষ মারায় যদি জেতার প্রশ্ন আসে শেখ হাসিনা তাতে অবশ্যই জিতেছেন। তবে কেঁদে তিনি জিততে পারেননি। তার কান্নাকে এদেশের বেশির ভাগ মানুষ ‘কান্নার অভিনয়’ হিসেবেই মনে করেন।
সরকার অপকৌশলকে কৌশল হিসেবে নিয়েছে
খালেদা জিয়া বলেন, রাজনীতিতে কৌশল থাকে কিন্তু নিম্নরুচির মানুষেরা অপকৌশলকে কৌশল ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। জনগণের সমর্থন নয়, সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও অপপ্রচারকেই তারা জেতার পথ বলে ধরে নিয়েছে। যুক্তি, সংযম, সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সংলাপের পথ তারা এড়িয়ে চলতে চায়। দেশে সকল সংকটের সূত্র সেখানেই। তিনি বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বিরোধী দল ও ভিন্নমত দমন এবং জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ-বিক্ষোভ স্তব্ধ করার কাজে নিয়োজিত রেখে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন দলের লোকদেরকে আইনের ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছে। দেশে কোন অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নেই। সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে দলীয় স্বার্থে ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। দেশে এমন সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে, ক্ষমতাসীন ছাড়া আর কারও যেন সুবিচার পাওয়ার কোন অধিকার নেই। এ সময় তিনি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ ও ছাত্রদলের সাবেক সংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান খোকনকে নিখোঁজ নেতাদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উৎকণ্ঠা প্রকাশ ও তাদের সন্ধান দাবি করেন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে প্রতিবেশী নেপাল ও ভারতে বহু মানুষের প্রাণহানি এবং আমাদের দেশের আহত ও নিহতের ঘটনায় গভীরভাবে মর্মাহত বলে মন্তব্য করেন। পহেলা বৈশাখ টিএসসি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ও দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতিতদের প্রতি সহানুভূতি জানাচ্ছি। এসব ঘৃণ্য অপরাধীদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
প্রশ্নোত্তর খালেদা
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, জাতীয় নির্বাচনের জন্য অবশ্যই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার লাগবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আমরা জিতলেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও ঠুঁটো জগন্নাথ নির্বাচন কমিশন শুদ্ধ হয়ে যাবে না। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল ২০ দল। তবে সার্বিক পরিস্থিতিতে সেটার ব্যাপারে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে আমরা বসতে পারিনি। তবে বাস্তবে অবরোধ কর্মসূচি এখন অনেক নিষ্ক্রিয়। সমঝোতা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সমঝোতা আমাদের মধ্যেই হবে। এখানে বিদেশী কূটনীতিকদের প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। সিটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন কিনা এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি ক্যান্টনমেন্টের ভোটার। আর ক্যান্টনমেন্ট সিটি করপোরেশনের মধ্যে নয়। গাড়িবহর নিয়ে গণসংযোগ চালানোর ব্যাপারে ইসির অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমার নিরাপত্তারক্ষীদের কয়েকটি গাড়ির সঙ্গে সাংবাদিকদের গাড়ি ছিল। এখন সাংবাদিকদের আমার বহরের সঙ্গে গণ্য করা হলে সেটা আপনারাই বিচার করুন। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই বিধি ভঙ্গ করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, স্থায়ী কমিটি সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, নজরুল ইসলাম খান, জোটের শরিক খেলাফত মজলিসের আমীর মুহাম্মদ ইসহাক, এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, ইসলামী ঐক্যজোটের আমীর আবদুল লতিফ নেজামী, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, লেবার পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, এনডিপি সভাপতি খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজাসহ বিএনপি ও জোটের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
No comments