সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সব অংশীদারের by এম সাখাওয়াত হোসেন
২৮
এপ্রিল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের
প্রচার-প্রচারণা এখন শেষ সপ্তাহে পৌঁছেছে। প্রার্থীরা দিন-রাত ছুটে
বেড়াচ্ছেন ভোটারদের মন সন্তুষ্ট করতে। এই তিন শহরের প্রায় ৬০ লাখ ভোটার ভোট
প্রয়োগ করার যোগ্য। আমাদের দেশে তথা সমগ্র উপমহাদেশে ভোট প্রদান
বাধ্যতামূলক নয়। ঐচ্ছিক হলেও ভোটারদের রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের প্রতি কর্তব্য
হিসেবে ভোট প্রদান একটি পবিত্র দায়িত্ব বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মতামত দিয়ে
থাকেন।
আমাদের দেশের সাধারণ ভোটাররাও অত্যন্ত রাজনীতিসচেতন। কাজেই খুব বেশি সমস্যা না হলে উৎসাহের সঙ্গে ভোট প্রদান করে থাকেন। তবে তার পূর্বশর্ত পরিবেশ। বিশেষ করে নারী ভোটারদের বেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, শান্ত পরিবেশ এবং নির্বাচন-প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা থাকলে সমাগম সবচেয়ে বেশি হয়। মনে রাখতে হবে যে বর্তমানেও নারী ভোটারের সংখ্যা পুরুষের প্রায় সমান। যেহেতু তিন সিটি নির্বাচন শহরকেন্দ্রিক, কাজেই ধরে নেওয়া যায় এখানে নারী ভোটারদের ভোট থেকে বিরত রাখার আর সব উপাদান প্রায় অনুপস্থিত। কাজেই ভোটের আগে এবং ভোটের দিনের নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং এ ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার শুধু নির্বাচন কমিশনের, অন্য কারও নয়। নির্বাচন কমিশনের বিবেচনা ও কাজে অন্য কোনো সংস্থা বা ব্যক্তির পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়।
আমাদের দেশের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনে নিরাপত্তা বিধানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশাল সদস্যের প্রয়োজন হয়। ভোটারদের আশ্বস্ত করতে এবং পরিবেশ সমুন্নত রাখতে মাত্রাতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রয়োজন হয়। এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আমাদের দেশের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সংস্কৃতির নিম্নমুখী অবস্থান। মনমানসিকতায় নির্বাচনে যেমন করেই হোক জেতার প্রবল ইচ্ছা ধারণ করার কারণে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক দল তথা প্রার্থীদের যে সহযোগিতার প্রয়োজন, তা পাওয়া যায় না। তা ছাড়া অনেক প্রার্থীর, বিশেষ করে এ ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী, অতীত কর্মকাণ্ড সমাজে একধরনের অস্বস্তির সৃষ্টি করে। এসব কারণেই ভোটাররা এবং সরকারি দলের বাইরে অন্যান্য দলের প্রার্থীদের মধ্যে আস্থার অভাব তৈরি হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রচলিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর, বিশেষ করে পুলিশের কিছু কিছু সদস্যের বেশ কিছু আচরণ ও অবস্থান পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হয়নি।
বর্তমান দাবির প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ প্রার্থী এবং ভোটারদের আস্থাহীনতাই প্রধান কারণ মনে হয়। বিশেষ করে সরকার-সমর্থিত প্রার্থী নন এমন বেশির ভাগ প্রার্থী এমনকি সরকারের সঙ্গে থাকা জাতীয় পার্টি-সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষ থেকে এমন অনাস্থার কথা প্রকাশ করে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি তোলা হয়েছে। এর অধিকতর বিশ্লেষণ হলো সরকার-সমর্থিত প্রার্থী এবং সমর্থনকারী গোষ্ঠী ছাড়া সিংহভাগ প্রার্থী ও ভোটার একধরনের আস্থাহীনতায় ভুগছেন। বর্তমানে এই তিন নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয় হলো নির্বাচন কমিশনের পক্ষে জনগণের তথা ভোটারদের আস্থা অর্জন। তবে আমার অভিজ্ঞতায় চট্টগ্রামের নির্বাচনে অতীতেও সেনাবাহিনীর উপস্থিতি পরিস্থিতির সামাল দিতে সাহায্য করেছিল।
যেমনটা বলেছি যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিম্নমুখী, কোনোভাবেই উন্নত বলা যায় না। রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ধরনের আচরণ, বাক্যবাণ ব্যবহার হয় তা এই অবস্থানের প্রমাণ। সে কারণেই কোনো প্রার্থী, বিশেষ করে সরকারি দলের বা সমর্থিত প্রার্থী ছাড়া নির্বাচনে পরাজয় সহজে মেনে নিতে চান না। পরাজয়ের কারণের প্রথম তিরের লক্ষ্য নির্বাচন কমিশন। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে ভেবে দেখতে হবে তাদের করণীয় কী হতে পারে। এ বাস্তবতা এবং আস্থার সংকট উভয়ই অতীতে সেনা মোতায়েনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে সরকারি দল জয়ী হলে পরাজিতরা সেনাবাহিনীর অনুপস্থিতিকেই বড় করে দেখাবে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করা হবে। সেনা মোতায়েন করা হলে এ অভিযোগের জায়গা কমে আসবে, অন্যথায় সুষ্ঠু নির্বাচনও অনুকূলে না গেলে ভিন্নমাত্রা পাবে।
এখনো আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে সহনশীলতার লেশমাত্র দৃশ্যমান নয়। ইতিমধ্যে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে আক্রমণের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনী পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এ পরিবেশ যাতে আরও উত্তপ্ত না হয়, নির্বাচন কমিশনকে সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।
অবশ্য এরই মধ্য এই তিন সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তরফে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হলেও এখন বলা হচ্ছে যে সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে না। ফলে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া বা না নেওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকল বলে মনে হয় না। তবে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপ্রতুলতা নয়, নির্বাচন কমিশনকে সব দিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে হলে তাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা জরুরি। কারণ, সেনাবাহিনী বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত নয়, ২০১১ সালে সংজ্ঞাটি পরিবর্তিত হয়েছে।
নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। একই আঙ্গিকে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি, আইনশৃঙ্খলার ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবেই কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত। একইভাবে আস্থার পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে সরকার ও অন্য শরিকেরা সহযোগীর ভূমিকা পালন করে মাত্র। এখানে অবশ্যই সরকারের ভূমিকা মুখ্য। কোনো পক্ষেরই এ এখতিয়ারে দখল দেওয়া বা যা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা, তেমন বিষয়ে কারোরই বক্তব্য দেওয়া উচিত নয়। এ ধরনের বক্তব্য নির্বাচন কমিশনকে এক কঠিন পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়। এমনিতেই আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশনকে কমবেশি সব সময়েই কোনো না কোনো পক্ষের সমালোচনার মধ্যে থাকতে হয়।
যা-ই হোক ভোটারদের নিরাপত্তা, আস্থার পরিস্থিতি এবং নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখেই সেনা নিয়োগের অথবা না নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বা করা হবে। মনে রাখতে হবে সার্থকতার বহু দাবিদার হবে কিন্তু ব্যর্থতার দায়ভার নেওয়ার কাউকে পাওয়া যাবে না (Succes has many fathers, failure is orphan) আমাদের দেশটি ইউনিটারি ব্যবস্থার। এখানে ভারতের মতো আলাদা সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্স নেই, সে কারণেই সেনাবাহিনীর দাবি ওঠে। যা-ই হোক, এ সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের।
সুষ্ঠু নির্বাচন যে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে বিশেষ বাহিনীর উপস্থিতিতেই নিশ্চিত হতে পারে বা নির্বাচন কমিশন এককভাবে সম্পাদিত করতে পারে, তেমনটি মোটেই নয়। নির্বাচন কমিশনের সব পক্ষেরই সহযোগিতা প্রয়োজন, যার মধ্যে প্রার্থীদের দায়িত্বও রয়েছে। ভোট গ্রহণের দিন প্রতি বুথে প্রার্থীর যে এজেন্ট নিয়োগ করা হয়, ওই দিনে তাঁর দায়িত্ব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমার পূর্বাভিজ্ঞতায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, বেশির ভাগ প্রার্থী যেনতেনভাবে এজেন্ট নিয়োগ করেন। এজেন্টের কাজ শুধু সঠিক ভোটারকে শনাক্ত করাই নয়, বরং বুথের সমগ্র কর্মকাণ্ড এবং সেন্টারে ভোট গণনা ও ফলাফলের সনদ গ্রহণ পর্যন্ত তাঁর দায়িত্ব।
অতীতে এজেন্ট বিষয়টি নির্বাচনী আইন ও বিধিতে তেমন বিস্তারিত উল্লেখ ছিল না। পরবর্তী সময়ে নির্বাচনী এজেন্টদের কর্মকাণ্ডের ওপর নির্বাচনী বিধিতে বিশদভাবে বিধৃত করা হয়েছে। প্রতিটি প্রার্থীর উচিত স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) বিধিমালার ধারা ২৫ এবং ওই ধারার তফসিল ও সংলগ্নিগুলো ভালোভাবে প্রতিটি এজেন্টকে অবহিত করানো, অন্যথায় এজেন্টের কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন যেকোনো প্রার্থী। এ ধারা বেশ নতুন এবং হয়তো বহু প্রার্থীই সঠিকভাবে অবহিত নন। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন স্ব-উদ্যোগে ধারাটি সম্বন্ধে প্রার্থী অথবা প্রার্থী প্রধান নির্বাচনী এজেন্টদের সম্যক ধারণা দিতে পারেন অথবা নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বেসরকারি সংগঠন এ কাজটি করতে পারে। বিষয়টি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
আমাদের দেশে বহু পরাজিত প্রার্থীকে অভিযোগ করতে শোনা যায় যে ব্যালট বাক্স পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। যার মানে আগাম ব্যালট ভর্তি করে গণনার সময় ব্যালট বাক্স পরিবর্তন করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এ ধরনের অভিযোগকারী বর্তমান স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স সম্বন্ধে হয় কোনো ধারণাই রাখেন না অথবা বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেন। এ বিষয়টি এখন অতীত। বর্তমানে যে আধুনিক ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা হয়, তার প্রতিটি ইউনিক নম্বর দ্বারা চিহ্নিত, যার রেকর্ড ডিজিটাল পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশনে প্রতিটি বুথের হিসাবে রক্ষিত। তা ছাড়া পাঁচটি লক স্ট্রিপে আলাদা ইউনিক নম্বর রয়েছে। ভোট গ্রহণের আগে, আইন ও উল্লিখিত বিধির ধারা ২৮ মোতাবেক, পোলিং অফিসার লক-এর ইউনিক নম্বর এবং ব্যালট বাক্সের নম্বর এজেন্টদের নির্বাচনী বিধিতে উল্লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য। ভোট গণনার সময় এজেন্টদের উপস্থিতিতে ব্যালট বাক্স খোলার আগে এজেন্টদের এবং প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব ওই সব নম্বর মেলানোর পর বাক্সের লক-বা সিল ভাঙা। উল্লেখ্য যে, শুধু বাক্সেই নয়, বাক্সের প্রয়োজনীয় সিল বা লকও আমদানীকৃত, দেশে নকল করা সম্ভব নয়। এবং এসব সিল বা লক একেবারেই ব্যবহারযোগ্য।
প্রতিটি নির্বাচনের আগে প্রার্থী এবং ভোটার প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ব্যবস্থাপনার এসব বিষয়ে জনগণ ও ভোটারদের জ্ঞাত করালে নির্বাচন কমিশনের ওপরে অহেতুক চাপ ও অভিযোগ কম হবে বলে বিশ্বাস।
আগামী তিনটি নির্বাচনকে আরও স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু করতে এসব বিষয় নির্বাচন কমিশন ধর্তব্যের মধ্যে নেবে বলে আশা করি। নির্বাচন স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু হলে এর দাবিদার অনেকেই হবে। তবে তেমন না হলে এর দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ছাড়া আর কেউ বহন করবে না। আশা করব নির্বাচন কমিশন এসব বিষয় নিয়ে আরও দৃশ্যমান হবে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
আমাদের দেশের সাধারণ ভোটাররাও অত্যন্ত রাজনীতিসচেতন। কাজেই খুব বেশি সমস্যা না হলে উৎসাহের সঙ্গে ভোট প্রদান করে থাকেন। তবে তার পূর্বশর্ত পরিবেশ। বিশেষ করে নারী ভোটারদের বেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, শান্ত পরিবেশ এবং নির্বাচন-প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা থাকলে সমাগম সবচেয়ে বেশি হয়। মনে রাখতে হবে যে বর্তমানেও নারী ভোটারের সংখ্যা পুরুষের প্রায় সমান। যেহেতু তিন সিটি নির্বাচন শহরকেন্দ্রিক, কাজেই ধরে নেওয়া যায় এখানে নারী ভোটারদের ভোট থেকে বিরত রাখার আর সব উপাদান প্রায় অনুপস্থিত। কাজেই ভোটের আগে এবং ভোটের দিনের নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং এ ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার শুধু নির্বাচন কমিশনের, অন্য কারও নয়। নির্বাচন কমিশনের বিবেচনা ও কাজে অন্য কোনো সংস্থা বা ব্যক্তির পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়।
আমাদের দেশের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনে নিরাপত্তা বিধানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশাল সদস্যের প্রয়োজন হয়। ভোটারদের আশ্বস্ত করতে এবং পরিবেশ সমুন্নত রাখতে মাত্রাতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রয়োজন হয়। এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আমাদের দেশের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সংস্কৃতির নিম্নমুখী অবস্থান। মনমানসিকতায় নির্বাচনে যেমন করেই হোক জেতার প্রবল ইচ্ছা ধারণ করার কারণে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক দল তথা প্রার্থীদের যে সহযোগিতার প্রয়োজন, তা পাওয়া যায় না। তা ছাড়া অনেক প্রার্থীর, বিশেষ করে এ ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী, অতীত কর্মকাণ্ড সমাজে একধরনের অস্বস্তির সৃষ্টি করে। এসব কারণেই ভোটাররা এবং সরকারি দলের বাইরে অন্যান্য দলের প্রার্থীদের মধ্যে আস্থার অভাব তৈরি হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রচলিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর, বিশেষ করে পুলিশের কিছু কিছু সদস্যের বেশ কিছু আচরণ ও অবস্থান পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হয়নি।
বর্তমান দাবির প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ প্রার্থী এবং ভোটারদের আস্থাহীনতাই প্রধান কারণ মনে হয়। বিশেষ করে সরকার-সমর্থিত প্রার্থী নন এমন বেশির ভাগ প্রার্থী এমনকি সরকারের সঙ্গে থাকা জাতীয় পার্টি-সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষ থেকে এমন অনাস্থার কথা প্রকাশ করে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি তোলা হয়েছে। এর অধিকতর বিশ্লেষণ হলো সরকার-সমর্থিত প্রার্থী এবং সমর্থনকারী গোষ্ঠী ছাড়া সিংহভাগ প্রার্থী ও ভোটার একধরনের আস্থাহীনতায় ভুগছেন। বর্তমানে এই তিন নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয় হলো নির্বাচন কমিশনের পক্ষে জনগণের তথা ভোটারদের আস্থা অর্জন। তবে আমার অভিজ্ঞতায় চট্টগ্রামের নির্বাচনে অতীতেও সেনাবাহিনীর উপস্থিতি পরিস্থিতির সামাল দিতে সাহায্য করেছিল।
যেমনটা বলেছি যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিম্নমুখী, কোনোভাবেই উন্নত বলা যায় না। রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ধরনের আচরণ, বাক্যবাণ ব্যবহার হয় তা এই অবস্থানের প্রমাণ। সে কারণেই কোনো প্রার্থী, বিশেষ করে সরকারি দলের বা সমর্থিত প্রার্থী ছাড়া নির্বাচনে পরাজয় সহজে মেনে নিতে চান না। পরাজয়ের কারণের প্রথম তিরের লক্ষ্য নির্বাচন কমিশন। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে ভেবে দেখতে হবে তাদের করণীয় কী হতে পারে। এ বাস্তবতা এবং আস্থার সংকট উভয়ই অতীতে সেনা মোতায়েনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে সরকারি দল জয়ী হলে পরাজিতরা সেনাবাহিনীর অনুপস্থিতিকেই বড় করে দেখাবে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করা হবে। সেনা মোতায়েন করা হলে এ অভিযোগের জায়গা কমে আসবে, অন্যথায় সুষ্ঠু নির্বাচনও অনুকূলে না গেলে ভিন্নমাত্রা পাবে।
এখনো আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে সহনশীলতার লেশমাত্র দৃশ্যমান নয়। ইতিমধ্যে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে আক্রমণের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনী পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এ পরিবেশ যাতে আরও উত্তপ্ত না হয়, নির্বাচন কমিশনকে সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।
অবশ্য এরই মধ্য এই তিন সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তরফে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হলেও এখন বলা হচ্ছে যে সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে না। ফলে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া বা না নেওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকল বলে মনে হয় না। তবে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপ্রতুলতা নয়, নির্বাচন কমিশনকে সব দিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে হলে তাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা জরুরি। কারণ, সেনাবাহিনী বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত নয়, ২০১১ সালে সংজ্ঞাটি পরিবর্তিত হয়েছে।
নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। একই আঙ্গিকে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি, আইনশৃঙ্খলার ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবেই কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত। একইভাবে আস্থার পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে সরকার ও অন্য শরিকেরা সহযোগীর ভূমিকা পালন করে মাত্র। এখানে অবশ্যই সরকারের ভূমিকা মুখ্য। কোনো পক্ষেরই এ এখতিয়ারে দখল দেওয়া বা যা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা, তেমন বিষয়ে কারোরই বক্তব্য দেওয়া উচিত নয়। এ ধরনের বক্তব্য নির্বাচন কমিশনকে এক কঠিন পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়। এমনিতেই আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশনকে কমবেশি সব সময়েই কোনো না কোনো পক্ষের সমালোচনার মধ্যে থাকতে হয়।
যা-ই হোক ভোটারদের নিরাপত্তা, আস্থার পরিস্থিতি এবং নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখেই সেনা নিয়োগের অথবা না নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বা করা হবে। মনে রাখতে হবে সার্থকতার বহু দাবিদার হবে কিন্তু ব্যর্থতার দায়ভার নেওয়ার কাউকে পাওয়া যাবে না (Succes has many fathers, failure is orphan) আমাদের দেশটি ইউনিটারি ব্যবস্থার। এখানে ভারতের মতো আলাদা সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্স নেই, সে কারণেই সেনাবাহিনীর দাবি ওঠে। যা-ই হোক, এ সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের।
সুষ্ঠু নির্বাচন যে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে বিশেষ বাহিনীর উপস্থিতিতেই নিশ্চিত হতে পারে বা নির্বাচন কমিশন এককভাবে সম্পাদিত করতে পারে, তেমনটি মোটেই নয়। নির্বাচন কমিশনের সব পক্ষেরই সহযোগিতা প্রয়োজন, যার মধ্যে প্রার্থীদের দায়িত্বও রয়েছে। ভোট গ্রহণের দিন প্রতি বুথে প্রার্থীর যে এজেন্ট নিয়োগ করা হয়, ওই দিনে তাঁর দায়িত্ব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমার পূর্বাভিজ্ঞতায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, বেশির ভাগ প্রার্থী যেনতেনভাবে এজেন্ট নিয়োগ করেন। এজেন্টের কাজ শুধু সঠিক ভোটারকে শনাক্ত করাই নয়, বরং বুথের সমগ্র কর্মকাণ্ড এবং সেন্টারে ভোট গণনা ও ফলাফলের সনদ গ্রহণ পর্যন্ত তাঁর দায়িত্ব।
অতীতে এজেন্ট বিষয়টি নির্বাচনী আইন ও বিধিতে তেমন বিস্তারিত উল্লেখ ছিল না। পরবর্তী সময়ে নির্বাচনী এজেন্টদের কর্মকাণ্ডের ওপর নির্বাচনী বিধিতে বিশদভাবে বিধৃত করা হয়েছে। প্রতিটি প্রার্থীর উচিত স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) বিধিমালার ধারা ২৫ এবং ওই ধারার তফসিল ও সংলগ্নিগুলো ভালোভাবে প্রতিটি এজেন্টকে অবহিত করানো, অন্যথায় এজেন্টের কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন যেকোনো প্রার্থী। এ ধারা বেশ নতুন এবং হয়তো বহু প্রার্থীই সঠিকভাবে অবহিত নন। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন স্ব-উদ্যোগে ধারাটি সম্বন্ধে প্রার্থী অথবা প্রার্থী প্রধান নির্বাচনী এজেন্টদের সম্যক ধারণা দিতে পারেন অথবা নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বেসরকারি সংগঠন এ কাজটি করতে পারে। বিষয়টি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
আমাদের দেশে বহু পরাজিত প্রার্থীকে অভিযোগ করতে শোনা যায় যে ব্যালট বাক্স পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। যার মানে আগাম ব্যালট ভর্তি করে গণনার সময় ব্যালট বাক্স পরিবর্তন করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এ ধরনের অভিযোগকারী বর্তমান স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স সম্বন্ধে হয় কোনো ধারণাই রাখেন না অথবা বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেন। এ বিষয়টি এখন অতীত। বর্তমানে যে আধুনিক ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা হয়, তার প্রতিটি ইউনিক নম্বর দ্বারা চিহ্নিত, যার রেকর্ড ডিজিটাল পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশনে প্রতিটি বুথের হিসাবে রক্ষিত। তা ছাড়া পাঁচটি লক স্ট্রিপে আলাদা ইউনিক নম্বর রয়েছে। ভোট গ্রহণের আগে, আইন ও উল্লিখিত বিধির ধারা ২৮ মোতাবেক, পোলিং অফিসার লক-এর ইউনিক নম্বর এবং ব্যালট বাক্সের নম্বর এজেন্টদের নির্বাচনী বিধিতে উল্লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য। ভোট গণনার সময় এজেন্টদের উপস্থিতিতে ব্যালট বাক্স খোলার আগে এজেন্টদের এবং প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব ওই সব নম্বর মেলানোর পর বাক্সের লক-বা সিল ভাঙা। উল্লেখ্য যে, শুধু বাক্সেই নয়, বাক্সের প্রয়োজনীয় সিল বা লকও আমদানীকৃত, দেশে নকল করা সম্ভব নয়। এবং এসব সিল বা লক একেবারেই ব্যবহারযোগ্য।
প্রতিটি নির্বাচনের আগে প্রার্থী এবং ভোটার প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ব্যবস্থাপনার এসব বিষয়ে জনগণ ও ভোটারদের জ্ঞাত করালে নির্বাচন কমিশনের ওপরে অহেতুক চাপ ও অভিযোগ কম হবে বলে বিশ্বাস।
আগামী তিনটি নির্বাচনকে আরও স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু করতে এসব বিষয় নির্বাচন কমিশন ধর্তব্যের মধ্যে নেবে বলে আশা করি। নির্বাচন স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু হলে এর দাবিদার অনেকেই হবে। তবে তেমন না হলে এর দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ছাড়া আর কেউ বহন করবে না। আশা করব নির্বাচন কমিশন এসব বিষয় নিয়ে আরও দৃশ্যমান হবে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
No comments