মনজুরের আপদ, নাছিরের বিপদ by সোহরাব হাসান
বন্দরনগর
চট্টগ্রাম অনেক দিক দিয়ে অগ্রগামী। এই চট্টগ্রামেই ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ
শাসকদের বিরুদ্ধে যুব বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এই চট্টগ্রামেই রচিত হয় একুশের
প্রথম কবিতা—‘আমি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। এই চট্টগ্রামেই ১৯৭১ সালের ২৬
মার্চ প্রথম বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়। পাহাড় ও
সমুদ্রবেষ্টিত চট্টগ্রাম একদা প্রাচ্যের রানির শিরোপা পেলেও এখন
অনুজ্জ্বল, শ্রীহীন। ১৮৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম পৌরসভা, যা
সিটি করপোরেশনে রূপ নেয় ১৯৯০ সালে। এই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হতে
যাচ্ছে ২৮ এপ্রিল। শহরজুড়ে সড়কের মোড়ে মোড়ে, দেয়ালে, ভবনে বিভিন্ন
প্রতীকসংবলিত সাদাকালো পোস্টার শোভা পাচ্ছে। মেয়র ও কাউন্সিলর
পদপ্রার্থীরা জোর প্রচার চালাচ্ছেন। কখনো প্রার্থীরা হেঁটে, কখনো গাড়িতে
করে ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন, ভোট চাইছেন। তাঁরা নিজ নিজ পরিকল্পনার কথা
বলছেন। কখনো প্রতিপক্ষের কঠোর সমালোচনা করছেন। আনন্দের কথা, নির্বাচন
কমিশন শুরু থেকে কড়া নজরদারিতে রাখছে প্রার্থীদের। অভিযোগ পাওয়ার পর তারা
ব্যবস্থা নিচ্ছে। কাউকে শোকজ করছে, কাউকে জরিমানা করছে। তার পরও নগরবাসী
শঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না। তঁাদের প্রশ্ন, নির্বাচনটি সুষ্ঠু হবে কি না?
নগরবাসী তঁাদের পছন্দসই প্রার্থী বেছে নিতে পারবেন কি না?
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে মোট ১২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মূল প্রার্থী দুজন চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের মোহাম্মদ মনজুর আলম এবং নাগরিক কমিটির আ জ ম নাছির। মনজুরের পক্ষে বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলের কর্মীরা এবং নাছিরের পক্ষে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মীরা মাঠে নামার ঘোষণা দিলেও সবাই নামছেন না। সিিট করপোরেশনের ৪১টি কাউন্সিলর পদে ২১৩ জন এবং সংরক্ষিত ১৪টি নারী আসনে ৬২ জন লড়ছেন। কাউন্সিলর পদে দুই দলের সমর্থক প্রার্থী থাকলেও এখন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।’
চট্টগ্রামের একজন সাংবাদিক বন্ধুর মতে, প্রধান দুই দলেই অন্তর্বিরোধ আছে। যে দল সেই বিরোধ কমিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে নির্বাচনী যুদ্ধে নামবে, সেই দলের প্রার্থীরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আরেক সাংবাদিক জানান, এ ক্ষেত্রে নাছিরের চেয়ে মনজুর কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। কেননা, নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক শাহাদত হোসেনের কেউ প্রার্থী হননি। ফলে বিএনপিতে গ্রুপিং কম। কিন্তু নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের মধ্যে শেষোক্তজন প্রার্থী হয়েছেন। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের সব নেতাকে ঢাকায় ডেকে নিয়ে নাছিরের পক্ষে কাজ করতে বলেছেন। অনেকে মাঠে সরব হলেও নীরব মহিউদ্দিন চৌধুরী। এই নীরবতা নাছিরের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। অনেকে মনে করেন, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখনো মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিকল্প নেই।
সাংবাদিক বন্ধু আরও জানালেন, বিএনপিতে অন্তর্দলীয় বিপদ কম হলেও অন্য আপৎ আছে। সেটি হলো বৃষ্টি। যে বৃষ্টি ২০১০ সালে মনজুরের জন্য আশীর্বাদ হয়েছিল, সেই বৃষ্টিই এখন তাঁর জন্য মহা আপৎ। ২০১০ সালে নির্বাচনের এক দিন আগে বৃষ্টিতে সয়লাব হয়ে যায় চট্টগ্রাম নগর, যার সুফল পান মনজুর আলম।
এবারেও সিটি নির্বাচনের প্রধান ইস্যু জলাবদ্ধতা। তবে নগরবাসীর অভিযোগ, মনজুর আলম জলাবদ্ধতা দূর করতে কার্যত কিছুই করেননি। বরং একদা পরিচ্ছন্ন চট্টগ্রাম এখন নোংরা আবর্জনার শহরে পরিণত হয়েছে। সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী নগরের সড়কগুলো প্রশস্ত করেছিলেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সিটি করপোরেশেনর আয় বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরি মনজুর আলম সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি। তবে তাঁর প্রধান গুণ সবাইকে নিয়ে চলা। তিনি সিটি করপোরেশনকে দলীয় আখড়ায় পরিণত করেননি। চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের নেতারা মনজুরের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে আরেকবার সুযোগ চান। কিন্তু প্রতিপক্ষ নাগরিক কমিটির দাবি, পাঁচ বছর যিনি ব্যর্থ হয়েছেন, তিনি আগামী দিনেও কিছু করতে পারবেন না। তিনি নগরবাসীকে নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত করেছেন। তাঁরা মনজুরের বিপরীতে আ জ ম নাছিরের কৃতিত্ব তুলে ধরছেন। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি ক্রীড়াঙ্গনকে বদলে দিয়েছেন। মেয়র নির্বাচিত হলে মহানগরকেও বদলে দেবেন।
এই দুই পক্ষের বাহাসে নগরবাসী বিভ্রান্ত। তাঁরা কারও ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না। নির্বাচনের ফলাফল কী হতে পারে? এই প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের একজন অধ্যাপক জানালেন, নগরবাসী এখনো মনস্থির করেননি। ভেবেচিন্তে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি আরও বললেন, যদি বৃষ্টি হয়, মনজুর বিপদে পড়বেন। আর যদি মহিউদ্দিন চৌধুরীর গোস্সা বা নীরবতা না ভাঙানো যায়, তাহলে নাছিরের জন্য সেটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
গত বৃহস্পতিবার মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে সিটি নির্বাচন নিয়ে মতামত চাইলে তিনি বলেন, ব্যালটের অধিকার রক্ষা করতে হবে। নগরের উন্নয়ন ও নাগরিক সেবা দুটোই নিশ্চিত করতে হবে। তাঁর কথায় দুজনের প্রতিই অনাস্থার আভাস পাওয়া যায়। তবে সাবেক এই মেয়র খোলাসা করে কিছু বলেননি।
গত শুক্রবার মনজুর আলম শুলকবহরে যান নির্বাচনী প্রচারে। কিন্তু একটি গলিতে পানি ছিল আগের রাতের বৃষ্টির কারণে। এরপর তিনি সেই গলিটিতে আর ঢোকেননি বলে জানান তাঁর প্রচারে সঙ্গে থাকা এক সাংবাদিক।
অন্যদিকে আ জ ম নাছির যেহেতু আগে সিটি করপোরেশনের কোনো দায়িত্বে ছিলেন না, তাই সিটি করপোরেশনের সাফল্য বা ব্যর্থতা তাঁর জন্য ইস্যু হবে না। ইস্যু হবে তাঁর অতীত রাজনীতি। মামলা ইত্যাদি। তবে নাগরিক কমিটির একজন নেতা বললেন, নিজে অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রার্থী বলে নাছির তরুণদের ভোট বেশি টানবেন। তাঁর প্রচারক দলেও তরুণদের সংখ্যা বেশি। কিন্তু ছাত্রলীগের ও যুবলীগের এই উৎসাহী কর্মীরা তাঁর সম্পদ হবেন, না বিপদ হবেন—সেটি নির্ভর করবে তাঁদের আচরণের ওপর।
চট্টগ্রামের নির্বাচনে আরেকটি নিয়ামক শক্তি হলো জামায়াতে ইসলামী ও সংখ্যালঘু ভোট। চট্টগ্রামে ২ লাখ ৬৮ হাজার সংখ্যালঘু ও আদিবাসী ভোটার আছেন বলে জানালেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের এক নেতা। তাঁর মতে, ২০১০ সালে নির্বাচনে মনজুর আলম জামায়াতসহ সব ইসলামী দলের ভোট পেলেও মহিউদ্দিন চৌধুরী অধিকাংশ সংখ্যালঘুর ভোট পাননি। তবে তাঁরা মনজুর আলমকেও ভোট দেননি। অনেকে কাউন্সিলর পদে পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিলেও মেয়র পদটি খালি রেখেছেন। একটি গোশালার দখলদারি নিয়ে অগ্নিযুগের বিপ্লবী প্রয়াত বিনোদবিহারী চৌধুরীর সঙ্গেও তিনি বিরোধে জড়িেয় পড়েছিলেন।
এবার কী হবে? জামায়াত-হেফাজতের ভোট মনজুর আলমের বাক্সে পড়বে। আর সংখ্যালঘুদের ভোট পাবেন আ জ ম নাছির।
এত দিন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন আরেকবার প্রার্থী হবেন, নগরবাসীকে শেষবারের জন্য সেবা করার সুযোগ পাবেন, কিন্তু দলীয় নেতৃত্ব তাতে সায় দেয়নি। এটিকে মহিউদ্দিন চৌধুরী ভালোভাবে নেননি। আবার আওয়ামী লীগ মহলে এ কথাও বেশ চাউর আছে যে শারীরিক অসুস্থতার কারণে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলেমেয়েরাই চাননি তিনি প্রার্থী হোন।
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে মহিউদ্দিন, ছালাম ও নাছির—এই ত্রিপক্ষীয় বিরোধ বহু পুরোনো। তিনজনই মেয়র পদে আগ্রহী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত শিকা ছিঁড়ল নাছিরের ভাগ্যে। আর আবদুচ ছালামকে অারও দুই বছরের জন্য সিডিএ চেয়ারম্যান করে তাঁকে সন্তুষ্ট করা হয়েছে। আর মহিউদ্দিন চৌধুরীর সব পথই কি বন্ধ? এ প্রশ্নের জবাবে এই প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা বলেছেন, সবার সব দিন একভাবে যায় না। তাঁর কথায় মনোবেদনার ছাপ স্পষ্ট।
এখন মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁর গড়া প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ব্যস্ত আছেন। সেখানে তাঁর অনুসারীরা আসেন, গল্প করেন, তাঁর আশীর্বাদ নেন; কিন্তু সিটি নির্বাচন নিয়ে একটি কথাও বলেন না। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মনোবেদনা ক্ষোভে পরিণত হয়েছে সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের এক চিঠিতে। তিনি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা নির্মাণে সিডিএর অনুমতি কেন নেওয়া হয়নি, জানতে চেয়েছেন। এর কড়া জবাব দিয়েছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এই চিঠি চালাচালি এবং নীরবতা যদি তাঁর অনুসারীদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, তার প্রভাব ভোটের বাক্সেও পড়া অসম্ভব নয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে মোট ১২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মূল প্রার্থী দুজন চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের মোহাম্মদ মনজুর আলম এবং নাগরিক কমিটির আ জ ম নাছির। মনজুরের পক্ষে বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলের কর্মীরা এবং নাছিরের পক্ষে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মীরা মাঠে নামার ঘোষণা দিলেও সবাই নামছেন না। সিিট করপোরেশনের ৪১টি কাউন্সিলর পদে ২১৩ জন এবং সংরক্ষিত ১৪টি নারী আসনে ৬২ জন লড়ছেন। কাউন্সিলর পদে দুই দলের সমর্থক প্রার্থী থাকলেও এখন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।’
চট্টগ্রামের একজন সাংবাদিক বন্ধুর মতে, প্রধান দুই দলেই অন্তর্বিরোধ আছে। যে দল সেই বিরোধ কমিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে নির্বাচনী যুদ্ধে নামবে, সেই দলের প্রার্থীরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আরেক সাংবাদিক জানান, এ ক্ষেত্রে নাছিরের চেয়ে মনজুর কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। কেননা, নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক শাহাদত হোসেনের কেউ প্রার্থী হননি। ফলে বিএনপিতে গ্রুপিং কম। কিন্তু নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের মধ্যে শেষোক্তজন প্রার্থী হয়েছেন। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের সব নেতাকে ঢাকায় ডেকে নিয়ে নাছিরের পক্ষে কাজ করতে বলেছেন। অনেকে মাঠে সরব হলেও নীরব মহিউদ্দিন চৌধুরী। এই নীরবতা নাছিরের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। অনেকে মনে করেন, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখনো মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিকল্প নেই।
সাংবাদিক বন্ধু আরও জানালেন, বিএনপিতে অন্তর্দলীয় বিপদ কম হলেও অন্য আপৎ আছে। সেটি হলো বৃষ্টি। যে বৃষ্টি ২০১০ সালে মনজুরের জন্য আশীর্বাদ হয়েছিল, সেই বৃষ্টিই এখন তাঁর জন্য মহা আপৎ। ২০১০ সালে নির্বাচনের এক দিন আগে বৃষ্টিতে সয়লাব হয়ে যায় চট্টগ্রাম নগর, যার সুফল পান মনজুর আলম।
এবারেও সিটি নির্বাচনের প্রধান ইস্যু জলাবদ্ধতা। তবে নগরবাসীর অভিযোগ, মনজুর আলম জলাবদ্ধতা দূর করতে কার্যত কিছুই করেননি। বরং একদা পরিচ্ছন্ন চট্টগ্রাম এখন নোংরা আবর্জনার শহরে পরিণত হয়েছে। সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী নগরের সড়কগুলো প্রশস্ত করেছিলেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সিটি করপোরেশেনর আয় বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরি মনজুর আলম সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি। তবে তাঁর প্রধান গুণ সবাইকে নিয়ে চলা। তিনি সিটি করপোরেশনকে দলীয় আখড়ায় পরিণত করেননি। চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের নেতারা মনজুরের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে আরেকবার সুযোগ চান। কিন্তু প্রতিপক্ষ নাগরিক কমিটির দাবি, পাঁচ বছর যিনি ব্যর্থ হয়েছেন, তিনি আগামী দিনেও কিছু করতে পারবেন না। তিনি নগরবাসীকে নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত করেছেন। তাঁরা মনজুরের বিপরীতে আ জ ম নাছিরের কৃতিত্ব তুলে ধরছেন। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি ক্রীড়াঙ্গনকে বদলে দিয়েছেন। মেয়র নির্বাচিত হলে মহানগরকেও বদলে দেবেন।
এই দুই পক্ষের বাহাসে নগরবাসী বিভ্রান্ত। তাঁরা কারও ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না। নির্বাচনের ফলাফল কী হতে পারে? এই প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের একজন অধ্যাপক জানালেন, নগরবাসী এখনো মনস্থির করেননি। ভেবেচিন্তে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি আরও বললেন, যদি বৃষ্টি হয়, মনজুর বিপদে পড়বেন। আর যদি মহিউদ্দিন চৌধুরীর গোস্সা বা নীরবতা না ভাঙানো যায়, তাহলে নাছিরের জন্য সেটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
গত বৃহস্পতিবার মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে সিটি নির্বাচন নিয়ে মতামত চাইলে তিনি বলেন, ব্যালটের অধিকার রক্ষা করতে হবে। নগরের উন্নয়ন ও নাগরিক সেবা দুটোই নিশ্চিত করতে হবে। তাঁর কথায় দুজনের প্রতিই অনাস্থার আভাস পাওয়া যায়। তবে সাবেক এই মেয়র খোলাসা করে কিছু বলেননি।
গত শুক্রবার মনজুর আলম শুলকবহরে যান নির্বাচনী প্রচারে। কিন্তু একটি গলিতে পানি ছিল আগের রাতের বৃষ্টির কারণে। এরপর তিনি সেই গলিটিতে আর ঢোকেননি বলে জানান তাঁর প্রচারে সঙ্গে থাকা এক সাংবাদিক।
অন্যদিকে আ জ ম নাছির যেহেতু আগে সিটি করপোরেশনের কোনো দায়িত্বে ছিলেন না, তাই সিটি করপোরেশনের সাফল্য বা ব্যর্থতা তাঁর জন্য ইস্যু হবে না। ইস্যু হবে তাঁর অতীত রাজনীতি। মামলা ইত্যাদি। তবে নাগরিক কমিটির একজন নেতা বললেন, নিজে অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রার্থী বলে নাছির তরুণদের ভোট বেশি টানবেন। তাঁর প্রচারক দলেও তরুণদের সংখ্যা বেশি। কিন্তু ছাত্রলীগের ও যুবলীগের এই উৎসাহী কর্মীরা তাঁর সম্পদ হবেন, না বিপদ হবেন—সেটি নির্ভর করবে তাঁদের আচরণের ওপর।
চট্টগ্রামের নির্বাচনে আরেকটি নিয়ামক শক্তি হলো জামায়াতে ইসলামী ও সংখ্যালঘু ভোট। চট্টগ্রামে ২ লাখ ৬৮ হাজার সংখ্যালঘু ও আদিবাসী ভোটার আছেন বলে জানালেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের এক নেতা। তাঁর মতে, ২০১০ সালে নির্বাচনে মনজুর আলম জামায়াতসহ সব ইসলামী দলের ভোট পেলেও মহিউদ্দিন চৌধুরী অধিকাংশ সংখ্যালঘুর ভোট পাননি। তবে তাঁরা মনজুর আলমকেও ভোট দেননি। অনেকে কাউন্সিলর পদে পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিলেও মেয়র পদটি খালি রেখেছেন। একটি গোশালার দখলদারি নিয়ে অগ্নিযুগের বিপ্লবী প্রয়াত বিনোদবিহারী চৌধুরীর সঙ্গেও তিনি বিরোধে জড়িেয় পড়েছিলেন।
এবার কী হবে? জামায়াত-হেফাজতের ভোট মনজুর আলমের বাক্সে পড়বে। আর সংখ্যালঘুদের ভোট পাবেন আ জ ম নাছির।
এত দিন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন আরেকবার প্রার্থী হবেন, নগরবাসীকে শেষবারের জন্য সেবা করার সুযোগ পাবেন, কিন্তু দলীয় নেতৃত্ব তাতে সায় দেয়নি। এটিকে মহিউদ্দিন চৌধুরী ভালোভাবে নেননি। আবার আওয়ামী লীগ মহলে এ কথাও বেশ চাউর আছে যে শারীরিক অসুস্থতার কারণে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলেমেয়েরাই চাননি তিনি প্রার্থী হোন।
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে মহিউদ্দিন, ছালাম ও নাছির—এই ত্রিপক্ষীয় বিরোধ বহু পুরোনো। তিনজনই মেয়র পদে আগ্রহী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত শিকা ছিঁড়ল নাছিরের ভাগ্যে। আর আবদুচ ছালামকে অারও দুই বছরের জন্য সিডিএ চেয়ারম্যান করে তাঁকে সন্তুষ্ট করা হয়েছে। আর মহিউদ্দিন চৌধুরীর সব পথই কি বন্ধ? এ প্রশ্নের জবাবে এই প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা বলেছেন, সবার সব দিন একভাবে যায় না। তাঁর কথায় মনোবেদনার ছাপ স্পষ্ট।
এখন মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁর গড়া প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ব্যস্ত আছেন। সেখানে তাঁর অনুসারীরা আসেন, গল্প করেন, তাঁর আশীর্বাদ নেন; কিন্তু সিটি নির্বাচন নিয়ে একটি কথাও বলেন না। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মনোবেদনা ক্ষোভে পরিণত হয়েছে সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের এক চিঠিতে। তিনি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা নির্মাণে সিডিএর অনুমতি কেন নেওয়া হয়নি, জানতে চেয়েছেন। এর কড়া জবাব দিয়েছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এই চিঠি চালাচালি এবং নীরবতা যদি তাঁর অনুসারীদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, তার প্রভাব ভোটের বাক্সেও পড়া অসম্ভব নয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
No comments