বাবলুর মারপ্যাঁচে পদ হারালেন শেঠ by মহিউদ্দীন জুয়েল
চট্টগ্রামে দলীয় মহাসচিব জিয়াউদ্দিন
বাবলুর মারপ্যাঁচে পদ হারালেন জাতীয় পার্টির অন্যতম কাণ্ডারি সোলায়মান আলম
শেঠ। এরশাদের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এ ব্যক্তি এখন মরিয়া দলে ঢুকতে।
তবে তাকে ঠেকাতে পুরোদমে মাঠে সক্রিয় মহাসচিবের সুনজরে থাকা মোরশেদ মুরাদ
ইব্রাহিম ও মাহজাবীন মোর্শেদ দম্পতি। মাহজাবীন বর্তমানে জাপার এমপি।
সোলায়মান শেঠের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। জিয়াউদ্দিন বাবলুর
সঙ্গে সম্পর্ক ভাল না থাকায় সোলায়মান শেঠের ওপর খড়গ চলছে বলে গতকাল
সন্ধ্যায় মানবজমিনের কাছে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে সম্পর্ক
জোরদার করার বিষয়ে চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সব বৈঠক ভেস্তে গেছে
বলে স্বীকার করেন।
সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর জিয়াউদ্দিন বাবলুর সফর বেড়ে যায় বন্দর নগরীতে। আর তার হাত ধরেই দল গোছানোর কাজ পান বর্তমান এমপি মাহজাবীন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন সোলায়মান আলম শেঠ। তিনি বিষয়টি নিয়ে এরশাদকে জানাতেই দূরত্ব তৈরি হয় জিয়াউদ্দিন বাবলুর সঙ্গে। সর্বশেষ জাপায় বড় ধরনের রদবদলের পর চট্টগ্রামে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিভেদ তৈরি হয়। একটি পক্ষ ব্যারিস্টার আনিস ও জিয়াউদ্দিন বাবলুকে সমর্থন করে। আর তার এ সমর্থন আদায়ের কাজটি করেন রাতারাতি আস্থাভাজন হন মাহজাবীন মোরশেদ। সম্প্রতি সোলায়মান আলম শেঠকে দল থেকে জোরপূর্বক অব্যাহতি দেয়ার ঘটনায় তোপের মুখে পড়েন জিয়াউদ্দিন বাবলু। তাকে দলে ফিরিয়ে নিতে ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘেরাওসহ চারদিনের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে বিদ্রোহীরা।
চলতি বছরের গত আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পূর্ণাঙ্গ সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। পরে যুগ্ম আহ্বায়কদের এক সভায় নগরীর ১৫ থানা ও ৪১ ওয়ার্ডের সকল ধরনের সাংগঠনিক কমিটি ভেঙে দেয়া হয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোন ওয়ার্ডে কমিটি গঠন করতে পারেনি মাহজাবীন সমর্থিত কমিটি। আর দলীয় এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জাপার রাজনীতিতে ঢুকতে ফের মরিয়া সোলায়মান আলম শেঠ। এজন্য তিনি একাধিকবার জিয়াউদ্দিন বাবলুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু বারবারই বাবলু তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে আলাপকালে জানান। তিনি জানান, চট্টগ্রামে জাপার রাজনীতিতে দীর্ঘ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে সক্রিয় রয়েছেন। ২০০৪ সালে নগর কমিটির আহ্বায়ক হন। ২০১৩ সালে এসে সভাপতির পদ পান। বর্তমানে তাকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। কিন্তু কি কারণে তা তিনি জানেন না। তবে এই ক্ষেত্রে তিনি জিয়াউদ্দিন বাবলুর ভূমিকাকে বড় করে দেখছেন। সোলায়মান আলম শেঠ বলেন, মহাসচিব বাবলুর জন্য আমি চট্টগ্রাম-৯ কোতোয়ালি আসনটি ছেড়ে দিয়েছি। অথচ তিনি আমার ওপর যে আচরণ করেছেন তা একজন নিবেদিত নেতা হিসেবে মেনে নেয়া সত্যিই কষ্টকর। কি কারণে এমনটি করেছেন তা জানি না। শুনেছি আগামী ২৮ তারিখ আমাকে দলে ফিরিয়ে নিতে একটি বৈঠক হবে। তবে আমি এরশাদ স্যারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছি দলের ভেতর এমন রাজনীতি হলে আমি আর জাপায় নেই।
শেঠ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জিয়াউদ্দিন বাবলু সাহেবের ছোট বোনের হাজব্যান্ড আমার বন্ধু। সে হিসেবে তিনি আমার পূর্বপরিচিত। অথচ তিনি আমাকে কোণঠাসা করে যাদের চট্টগ্রামে দায়িত্ব দিয়েছেন তারা কতটুকু দক্ষ তা সবাই দেখেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি ক্ষুব্ধ। তাই সামনের মেয়র নির্বাচনে দলের বাইরে থেকে আমি দাঁড়াবো।
তৃণমূলের কয়েকজন নেতাকর্মী জানান, দলীয় মহাসচিবের সঙ্গে সোলায়মান আলম শেঠের এমন দূরত্বে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তৃণমূলে। ইতিমধ্যে মহাসচিবের আস্থাভাজন মাহজাবীনের অনুসারীদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। কৌশলে শেঠকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়ার পর এ দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে। শেঠপন্থিরা তার আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে বুধবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব চত্বরে মানববন্ধন করবেন। পরদিন বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল, ২রা অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি থেকে গণপদত্যাগ করবেন বলে জানান।
সাবেক প্রচার সম্পাদক নাছির উদ্দিন ছিদ্দিকী বলেন, মহাসচিবের সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে শেঠ সাহেবকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে শুনেছি। অন্যদিকে তাকে বাদ দিয়ে এমপি মাহজাবীনকে আহ্বায়ক করে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করা হয়েছে। এ নিয়ে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে তা শিগগিরই কেটে যাবে বলে মনে করছি। দলীয় হাইকমান্ড সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন।
সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক মাহজাবীন মোর্শেদ মানবজমিনকে বলেন, পার্টির মহাসচিব বলেছেন জাপাকে নতুন করে সাজানো হবে। সুবিধাভোগীদের বাদ দিয়ে তৃণমূলদের নিয়ে দল গোছাবেন। যারা বাদ পড়েছেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় পার্টি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। আগের কমিটি দল চালাতে পারছিল না। তাই মহাসচিব বাবলু সাহেব নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।
সূত্র জানায়, মাহজাবীন মোরশেদ জাপার ভাইস চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি হয়ে কাজ করছেন পুরো চট্টগ্রামে। অন্যদিকে কোটিপতি সোলায়মান আলম শেঠ নগর শাখার সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। তবে দুই নেতা দু’টি পদে থাকলেও বর্তমানে কেউই কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না। চট্টগ্রাম মহানগর জাতীয় পার্টিতে আহ্বায়ক সোলায়মান আলম শেঠ এরশাদপন্থি ও মাহজাবীন ব্যারিস্টার আনিস-জিয়াউদ্দিন বাবলুপন্থি হিসেবে পরিচিত। দু’জনের দ্বন্দ্বটা শুরু হয় জাপার কমিটি গঠন নিয়ে। গত বছরের ৩০শে মার্চ মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম মহানগর জাতীয় পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনে সোলায়মান আলম শেঠ সভাপতি ও তপন চক্রবর্তীকে সাধারণ সম্পাদক করে ঘোষিত হয় ১১১ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাহী কমিটি। মাহজাবীন মোরশেদ ওই সময় অভিযোগ করেন, সোলায়মান আলম শেঠ কমিটি গঠনের আগে ৮ যুগ্ম আহ্বায়কের মধ্যে ৭ জনকে সম্মেলনের ব্যাপারে কিছু বলেননি। কোন ধরনের আলাপ-আলোচনা ছাড়া তার একক সিদ্ধান্তে সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।
পরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সোলায়মান আলম শেঠ বলেন, দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভাল। সাংসদ মাহজাবীন মোরশেদ এখন নিষ্ক্রিয়। তিনি বহিষ্কৃত লোকদের নিয়ে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কার্যকলাপ করে যাচ্ছেন। আমি বিষয়টি দলের চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি।
তিনি বলেন, মাহজাবীন মোর্শেদ এসব বন্ধ না করলে আমরা চট্টগ্রাম থেকে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করবো। বিগত সময়ে উনাকে আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি কখনও আসেননি। এমনকি মহানগর অফিসেও তিনি কখনও যাননি। অভিযোগ প্রসঙ্গে মাহজাবীন মোরশেদ বলেন, আমার সঙ্গে যারা কাজ করছেন তারা জাতীয় পার্টির নিবেদিতপ্রাণ। এসব নেতা-কর্মীকে কখনওই বহিষ্কার করা হয়নি। সোলায়মান আলম শেঠ গায়ের জোরে সব কিছু করতে চাইছেন। নতুন মহাসচিব হওয়ায় তিনি কেন জানি বেশ আতঙ্কে আছেন। আর সে কারণে আবোল তাবোল বকছেন।
No comments