বার্সেলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদ by সাযযাদ কাদির

প্রথমে কানাডা’র কুইবেক, তারপর যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ড, এখন স্পেনের কাতালুনিয়া। তারিখ ৯ই নভেম্বর ২০১৪। স্বাধীনতার জন্য গণভোট। তবে কানাডা ও যুক্তরাজ্য যেমন রাজি ছিল পক্ষে-বিপক্ষে ভোটে, তেমন রাজি নয় স্পেন। তাঁরা বিষয়টি নিয়ে যাবেন সাংবিধানিক আদালতে। সেখানে রায় কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষেই যাবে বলে নিশ্চিত ধারণা করা যায়, কারণ কোনও প্রদেশের কোনও ভাবে স্বাধীন হয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই স্পেনের সংবিধানে। এর মধ্যে স্কটল্যান্ডে গণভোট এবং নিজেদের দ্বারাই স্বাধীনতার উদ্যোগ পরিত্যক্ত হওয়ার ঘটনা ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে সেখানে। স্পেন ১৭টি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত। প্রতিটি অঞ্চলের আছে ব্যাপক ভিত্তিতে আইন, বিচার ও প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন এবং নিজস্ব পার্লামেন্ট ও আঞ্চলিক সরকার,  তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে যথেষ্ট তারতম্য আছে অঞ্চলভেদে। দু’টি অঞ্চল বাস্ক ও নাভারে’র আছে পূর্ণ আর্থিক স্বায়ত্তশাসন, চারটি ঐতিহ্যিক জাতিসত্তা আনদালুসিয়া, বাস্ক, কাতালুনিয়া ও গালিসিয়া-কে এর বাইরেও দেয়া হয়েছে অধিকতর ক্ষমতা। তাদের আঞ্চলিক প্রেসিডেন্ট যে কোনও সময় নির্বাচনের সময়-তারিখ ঘোষণা করতে পারেন পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে। এছাড়া, তাদের আছে নিজস্ব পুলিশ বাহিনী। কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যবস্থাকেই বলেন পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। তাঁদের দাবি, সরকার-প্রশাসনের এত বিকেন্দ্রীকরণ নেই পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে।
এ সপ্তাহে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ ও কাতালুনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা’য় তুঙ্গে উঠেছে রাজনৈতিক বিতর্ক। কাতালুনিয়া’র ‘জেনারালিতাত’ (আঞ্চলিক সরকার)-এর প্রেসিডেন্ট আরতুর মাস ই গাভারো (৫৮) বলেছেন, ‘সংবিধান ব্যবহার করে স্তব্ধ করা যাবে না কাতালুনিয়ার মানুষকে।’ আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ৯ই নভেম্বরকে স্বাধীনতার জন্য গণভোট গ্রহণের তারিখ ঘোষণা করে এক ডিক্রি জারি করতে যাচ্ছেন তিনি। আরতুর মাস বলেন, গত ১৯শে সেপ্টেম্বর কাতালুনিয়া’র পারলামেন্টে গণভোটের ব্যাপারে যে আইন পাস করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ সাংবিধানিক। ওদিকে কেন্দ্রীয় সরকার এখন অপেক্ষায়- কখন ওই ডিক্রিতে স্বাক্ষর করা হয় আর কখন ওই প্রকাশ-প্রচার করা হয় আনুষ্ঠানিক ভাবে, তাহলেই তাঁরা নালিশ ঠুকতে যেতে পারেন সাংবিধানিক আদালতে। যদি তাঁদের নালিশ শুনতে রাজি হয় আদালত তাহলে চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত আর গণভোট অনুষ্ঠানের আয়োজনে এগিয়ে যেতে পারবে না কাতালুনিয়া।
স্কটল্যান্ডে স্বাধীনতার প্রশ্নে অনুষ্ঠিত গণভোটে ‘না’ ভোট জয়যুক্ত হওয়ায় অনেক কাতালান হতাশ হলেও আরতুর মাস বলেন, ‘ওই ভোটের কোনও প্রভাব-প্রতিক্রিয়া পড়বে না আমাদের ভোটে।’ স্পেন সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাঁকে নিশ্চেষ্ট রাখতে। ২০শে সেপটেম্বর উপ- প্রধানমন্ত্রী সুরাইয়া সায়েঞ্জ দে সানতামারিয়া আন্তন (৪৩) বলেছেন, ‘যাঁরা কোনও কিছু শাসন-নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁদের উদ্দেশ্যে আমাদের বলার কথা একটাই- আইন মেনে চলুন। কোনও সিদ্ধান্তের পক্ষে স্বাক্ষর করা বা না করার আগে তাঁকে ভাবতে হবে- তিনি ওই অঞ্চলের সকল মানুষের প্রেসিডেন্ট; সেখানকার অনেকে এ রকম ভাবেন তো অনেকে আবার ও রকম ভাবেন।’ পরদিনই এ বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন আরতুর মাস। বলেছেন, ‘জনগণ কথা বলতে চায়। তাদের এই কথা বলা বন্ধ করতে সংবিধানের ব্যবহার করা কি উচিত? কাতালান সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস রয়েছে সুদীর্ঘকালের, সংবিধানের পাশাপাশি তা-ও দাবি রাখে বিবেচনার। আমি কাতালুনিয়া সরকারের ১২৯তম প্রেসিডেন্ট। স্পেনের ১৯৭৮ সালের সংবিধানের বহু আগে থেকেই অস্তিত্ব রয়েছে এ সরকারের।’ ওই দিনই স্বাধীনতা-বিরোধী ‘ইউনিয়ন, প্রোগ্রেস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি পার্টি’র নেত্রী রোজা মারিয়া দিয়েজ গনজালেজ (৬২) অভিযোগ করেন, মি. মাস লুকোচুরি খেলছেন। বলছেন না কবে স্বাক্ষর করবেন ডিক্রিতে, কবে প্রকাশ করবেন সংশ্লিষ্ট আইন। দেশের বেশির ভাগ মানুষকে তিনি রেখেছেন অনিশ্চয়তায়, সৃষ্টি করেছেন এক আইনগত নিরাপত্তাহীনতা।’ এ অভিযোগের কারণ- আদালত অবৈধ ঘোষণা করতে পারে এই আশঙ্কায় গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আগে যথেষ্ট অনীহা দেখিয়েছেন মাস, কিন্তু তাঁর ওপর গণভোটের ব্যাপারে প্রবল চাপ ছিল বরাবরই। স্বাধীনতাকামী কাতালানদের বড় অভিযোগ, তাঁদের রাজস্বের প্রায় পুরোটাই নিয়ে নেয় কেন্দ্রীয় সরকার; উপরন্তু তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে কোণঠাসা করে রাখে সব দিক থেকে। কেন্দ্রীয় সরকার বলে, স্পেনের সঙ্গে যুক্ত থাকাতেই আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটছে কাতালুনিয়ার; আর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পর্র্যায়েই স্বায়ত্তশাসন ভোগ করছেন কাতালানরা। ফুটবলের মাঠে রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা’র ঐতিহ্যিক লড়াই রাজনীতি ও স্বাধীনতার ইতিহাসে কি রূপ নিয়ে দেখা দেয় এখন তা-ই ভাবনার বিষয় সকলের।
২২.০৯.২০১৪

No comments

Powered by Blogger.