কঠিন পরীক্ষায় পাকিস্তানের গণতন্ত্র
শেষ পর্যন্ত রক্তপাতই ঘটল। ইসলামাবাদের সর্বোচ্চ সুরক্ষিত এলাকা ‘রেড জোন’ থেকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দিতে শক্তি প্রয়োগ করল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দফায় দফায় আলোচনা সত্ত্বেও চলমান সংকট সমাধানে তেমন কোনো অগ্রগতি না হওয়া এবং সেনাপ্রধানের মধ্যস্থতা নিয়ে ধূম্রজালের মধ্যে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিল সরকার। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের আশঙ্কা নিয়ে কয়েক দিন ধরেই চলা গুঞ্জনের আগুনে ঘি ঢালল শনিবারের সংঘাত। এই প্রেক্ষাপটে সবার দৃষ্টি এখন সেনাপ্রধান রাহিল শরিফের দিকে। সরকারের পদত্যাগের দাবিতে দুই সপ্তাহ ধরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছিল ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ও আধ্যাত্মিক নেতা তাহির উল-কাদরির দল পাকিস্তান আওয়ামী তেহরিকের (পিএটি) নেতা-কর্মীরা। দুই নেতা শনিবার রাতে কর্মী-সমর্থকদের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানালে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। এর জেরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে গোটা দেশ। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, কোন দিকে যাচ্ছে পাকিস্তান? টানা প্রায় ছয় বছর ধরে চলা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে? নাকি আবারও মুখ থুবড়ে পড়বে জনগণের প্রত্যাশা? ১৯৪৭ সালে জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশটির ক্ষমতায় ছিল সেনাবাহিনী। ৬৭ বছরের ইতিহাসে শুধু গত বছরই নির্বাচিত কোনো সরকার মেয়াদ শেষে নির্বাচিত আরেক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। পিটিআই ও পিএটির অভিযোগ, গত পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি হয়েছে।
ইমরান খান ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়ার ডাক দিয়েছেন। কিন্তু ‘নয়া পাকিস্তান’ কী, কীভাবে সেই পাকিস্তান গড়া হবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেননি তিনি। আর কাদরি সরকারের ‘পদ্ধতিগত পরিবর্তনের’ দাবি তুলেছেন। কিন্তু তিনিও এর ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তাই তাঁদের আন্দোলন দৃশ্যত মূলত নওয়াজের পদত্যাগের দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনেকের মতে, এ কারণেই মাত্র এক বছর আগে ক্ষমতায় আসা নওয়াজের বিরুদ্ধে জনগণ সেভাবে রাস্তায় নামেনি। পাকিস্তানের অনেক সরকারি কর্মকর্তার মতে, সামরিক বাহিনীর ইঙ্গিত পেয়েই সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেমেছেন ইমরান ও কাদরি। এ কারণেই পিটিআইয়ের দেওয়া ছয়টি দাবির মধ্যে সরকার পাঁচটি মেনে নিলেও ইমরান আন্দোলন থেকে সরে আসছেন না। পর্যবেক্ষকদের কারও কারও মতে, সাবেক সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফকে বিচারের মুখোমুখি করা, চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করা ও তালেবানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে সিদ্ধান্তহীনতার কারণে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ওপর নাখোশ সেনাবাহিনী। তবে ইমরান ও কাদরি উভয়েই সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আঁতাতের কথা অস্বীকার করেছেন। পাকিস্তানে এই ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নতুন নয়। জাতীয় ঐকমত্যের অভাবে দেশটিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসন এবং দুর্বল বেসামরিক সরকার চক্রাকারে ক্ষমতাসীন হচ্ছে। তবে এবার পরিস্থিতি বোধ হয় কিছুটা ভিন্ন। প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) সরকারবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত নয়। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এর পরও তা মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ। সামরিক বাহিনীর ‘দ্বারস্থ’ হতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
No comments