রাজনৈতিক নিরাপত্তার সর্বোত্তম নিশ্চয়তা হলো গণতন্ত্র by আফসান চৌধুরী
গণতন্ত্র কোন একক কিছু নয়। এর অনেক পর্যায়
ও স্তর আছে। মাঝে মাঝে, অনেক জায়গায় এর কিছু অংশ, যেমন অর্থনৈতিক গণতন্ত্র
ও সামাজিক গণতন্ত্র ব্যর্থ হয় বা খুব দ্রুত পতিত হয়, সেখানে এটা রাজনৈতিক
গণতন্ত্র নয়। আমরা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশে এটা
দেখেছি। সেখানে অর্থনৈতিক সমতার একটি মাত্রা ছিল। কিন্তু তা রাজনৈতিক
গণতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত ছিল না। ফলে গোটা প্রক্রিয়াটাই ভেঙে পড়ে। এই
সময়ের মাঝে বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জীবনহানি ঘটে। সেখানে থাকা অবস্থায়,
গোটা সরকার ব্যবস্থা ভেঙে যাবার পর মারাত্মক অর্থনৈতিক অবস্থার ভয়াবহতা আমি
প্রত্যক্ষ করেছি। এর অসহায় শিকার, যেমন, অধ্যাপকের স্ত্রীরা রাস্তায়
ভিক্ষা করছিলেন, তরুণীরা পতিতাবৃত্তি বেছে নিচ্ছিলেন, অপরদিকে তাদের মায়েরা
হয়তো কারো কাছে বাসায় খাবারের জন্য কড়া নাড়ছিলেন। এটা সম্ভবত চরম অসহায়
কারো পরিস্থিতির উদাহরণ। কিন্তু সাধারণ ভেঙে পড়াটা সবার ক্ষেত্রেই হয়েছিল।
পাশাপাশি চরম ও নির্মমভাবে টাকা বানানোয় লিপ্ত ছিল অনেকে। মার্ক্সিস্ট
রাষ্ট্রে প্রোথিত লেনিনবাদের দ্বিধান্বিত স্বপ্নের দ্বারা নির্মম মৃত্যু
ঘটেছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের। দুই বা ততধিক গণতন্ত্রের মাঝে ভারসাম্য আনয়ন,
যা সরকার ব্যবস্থার জন্য অতিপ্রয়োজনীয়, তা বুঝতে পারেনি সেই রাষ্ট্র। তাই
যখন রাজনৈতিক গণতন্ত্র থাকবে না, তখন বুদ্ধিবৃত্তিক গণতন্ত্রের প্রয়োজনও
থাকবে না, অবধারিতভাবে মৃত্যু ঘটবে মুক্তচিন্তার। যা ঘটে, যখন ঘটে, তা সবার
জন্য দৃশ্যমান হয়। তা কেবলমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার মধ্যেই নয় বরং
বর্তমান রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশসমূহেও দেখা যায়। গণতন্ত্রের অভাব,
দুর্নীতি ও সামরিকায়নের উত্থানের ফলে সেখানে স্বৈরতন্ত্রই সাধারণ দৃশ্যে
পরিণত হয়েছে। যেই ভোদকা পার্লামেন্টের বিকল্প নয়, যা শক্তিসমূহের কাছে
গ্রহণযোগ্য নয়, তা কেবলমাত্র পরবর্তী অশান্তির জন্য জায়গা খালি করে।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অভাবের সঙ্গে এই পূর্বাভাসের মূল লুকিয়ে আছে।
প্রচলিত সমাজতন্ত্রবাহী চীনের ইতিমধ্যেই মৃত্যু ঘটেছে। সেখানেও বিভিন্ন
পরিস্থিতির মধ্যে সংঘর্ষ বাধছে। কারণ পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিচালিত
হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির অধীনে, যেটি নিজেই একটি মুক্ত প্রতিষ্ঠান নয়। এর
ফলে সেখানে দুর্নীতির বিস্ফোরণ ঘটছে। বিভিন্ন নেতা, এমনকি পলিটব্যুরোর
সদস্যরা পর্যন্ত দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন। গ্রেপ্তারও হচ্ছেন।
কমিউনিস্ট পার্টির গোপন, জবাবদিহিতাহীন ও স্বেচ্ছাচারী সরকারের সঙ্গে
পুঁজিবাদী মুক্তবাজার একসঙ্গে থাকতে পারে না। এই ধরনের প্রতিটি পরিস্থিতি
সংঘর্ষের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। এটি রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রক্রিয়া বা
চেষ্টাকে ব্যাহত করে ও শেষ পর্যন্ত পরাজিত করে। সরকারের উদ্দেশ্যের মধ্যে
অনেক বাস্তবতা আছে। কিন্তু একটি উন্নত সামাজিক-অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক
উৎকর্ষ সাধন থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত কোন সমাজই অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র
ব্যতীত তা অর্জন করতে পারেনি। যেই রোগে সমাজতান্ত্রিক সমাজগুলো অতীতে
ভুগেছে, সেই একই জীবাণু তারা এখনও গ্রহণ করছে। তারা বহুত্ববাদ মেনে নিচ্ছে।
বিভিন্ন ধারণা, এমনকি সাংঘর্ষিকগুলোও, একসঙ্গে থাকার কথা তাদের পুস্তকেও
নেই। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এই বিন্যাসই হয়ে আসছে। নাৎসিবাদী জার্মানি- একক
জাতি, সোভিয়েত ইউনিয়ন- রাজনীতিতে এক, এসব হচ্ছে এই ধরনের মনোভাবের ভাল
উদাহরণ। ভিন্ন মতাবলম্বীদের মানসিক রোগী বলে সার্টিফিকেট দেয়ার সঙ্গে এক
সময় জড়িত ছিলেন এমন একজন চিকিৎসকের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নে আমার সাক্ষাৎ
হয়েছিল। তার কাছে জানতে চেয়েছিলামÑ কেন তিনি এমনটা করেছেন। তিনি বললেন,
আমরা মনে করি এটা একটা চমৎকার ব্যবস্থা। সুতরাং যে-ই এর বিরোধিতা করবে তা
হবে মানসিক দিক থেকে অসুস্থতা। তিনি এখন কি মনে করেন আমি জানতে চাইলাম।
তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন এবং বললেন, আপনাকে বুঝতে হবে যে- আর কি সব
ব্যবস্থা আছে আমরা তা জানি না। সোভিয়েত ব্যবস্থা বাদে অন্য কোন ব্যবস্থা যে
থাকতে পারে এ বিষয়ে আমাদের কোন ধারণা ছিল না। তিনিই বুঝতে পেরেছেন যে,
আদর্শ ও চিকিৎসা বিজ্ঞান কখনও একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলা উচিত নয়।
আমাদের সমাজের প্রায় সব স্তরে অসহিষ্ণুতার একই রকম বিদ্যমান। বিনিময়ে আমরা আমাদের লোকজনকে কিছুই দিইনি। এর সমস্যার মূলে রয়েছে উন্নত প্রতিষ্ঠান, যা বহুমাত্রিক গণতন্ত্রকে সমর্থন করে। এসব সমস্যার মধ্যে সবার আগে যে বিষয়টি আসে তা হলো নির্বাচনী গণতন্ত্র। এটা এজন্য যে, রাজনীতিতে সামান্য গণতন্ত্র থাকলেও একটি চমৎকার নির্বাচন করা সম্ভব। ১৯৯০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়টিই চলছে বাংলাদেশে। নির্ধারিত নির্বাচনের সামান্য আগে ২০০৭ সালে আমি একটি গবেষণা করি। তাতে দেখা যায় যে, ১৯৯০-এর পরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো নিয়ে জনগণ অত্যন্ত খুশি। তবে তারা মনে করেন, তেমন নির্বাচন কমই হয়েছে। দারিদ্র্য হ্রাসের সঙ্গে নির্বাচন সম্পর্কযুক্ত হতে পারে না। এর সঙ্গে পার্লামেন্টের কর্মকা-েরও কোন কিছু করার নেই। ১৫তম সংশোধনীর ফলে নির্বাচনকেন্দ্রীক রাজনীতির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। আসল কথা হলো- সব সরকারের আমলেই পার্লামেন্ট বসলেও তা থেকেছে অকেজো। বিনিময়ে পাওয়া গেছে উদ্দেশ্যহীন কিছু। এর ফলে বিগত ও বর্তমান পার্লামেন্ট তা থেকে আলাদা কিছু নয়। যে কোনভাবেই হোক বিরোধীরা অনুপস্থিত। তাহলে বাংলাদেশের কোথায় আমরা গণতন্ত্র খুঁজবো? রাজনৈতিক গণতন্ত্র বেশি বা কম অনুপস্থিত। বিরোধী দলবিহীন একটি রাজনৈতিক জীবনে আটকে আছে বর্তমান সরকার। এটা শুনতে কঠিন লাগে, ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব সব দলকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা। তারা তা করেনি। ফলে এতে সৃষ্টি হয়েছে বিএনপির মতো রাজনীতিতে অপরিপক্ব একটি দলের। তারা ফাঁদে পা দিয়েছে এবং দূরে সরে গেছে। আওয়ামী লীগ যথার্থই ধারণা করতে পেরেছে যে, রাজনীতি নিয়ে জনগণ অতো মাথা ঘামায় না। তারা নির্বাচনের ইস্যুতে রাজপথে নামবে না। এমনকি তারা নির্বাচনের পরেও রাজপথে নামবে না। আওয়ামী লীগের ওই ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এমন বিজয় নিয়ে বিপদ আছে তারা। এখন যেসব অসন্তোষ, অভিযোগ, সমস্যার কথা পার্লামেন্ট থেকে প্রচার করা হয় না, তা প্রচার হচ্ছে মিডিয়ায়। একটি রাষ্ট্রের অব্যাহত চলার পথে সেটা হচ্ছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকল্প। দৃশ্যত, উচ্চপর্যায়ের ক্ষোভের মুখে পড়েছে মিডিয়া। তাই মিডিয়া যাতে অনুমোদিত সীমার বেশি সমালোচনা করতে না পারে সে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এটা অপরিহার্য যে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাউন্টার থেকে কাউন্টেস্ট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। রাজনৈতিক উল্লেখ করার মতো বিরোধী দলের অনুপস্থিতির অর্থ হলো তার স্থান দখল করে মিডিয়া। এতে যা ঘটতে পারে তা আগেই বলা হয়েছে। এতে আন্ডারগ্রাউন্ড ও অন্যান্য স্থানে প্রতিবাদ বিক্ষোভ গড়ে উঠবে। সেই প্রতিবাদ নিয়ন্ত্রণ করা সত্যিকার অর্থেই অনেকটা কঠিন। তবে তা নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য। সর্বস্তরে গণতন্ত্র হলো প্রত্যেকের জন্য রাজনৈতিক নিরাপত্তার সর্বোত্তম নিশ্চয়তা। বহুমাত্রিক গণতন্ত্র ছাড়া কোন রাষ্ট্রই টিকে থাকেনি। গণতন্ত্র না থাকার কারণে পুরো সমাজতন্ত্রের বিলোপ ঘটেছে। কার্যকর একটি গণতন্ত্রের লেবাস না পরলে বাংলাদেশ কতদূর যেতে পারবে- এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে ভবিষ্যত।
আমাদের সমাজের প্রায় সব স্তরে অসহিষ্ণুতার একই রকম বিদ্যমান। বিনিময়ে আমরা আমাদের লোকজনকে কিছুই দিইনি। এর সমস্যার মূলে রয়েছে উন্নত প্রতিষ্ঠান, যা বহুমাত্রিক গণতন্ত্রকে সমর্থন করে। এসব সমস্যার মধ্যে সবার আগে যে বিষয়টি আসে তা হলো নির্বাচনী গণতন্ত্র। এটা এজন্য যে, রাজনীতিতে সামান্য গণতন্ত্র থাকলেও একটি চমৎকার নির্বাচন করা সম্ভব। ১৯৯০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়টিই চলছে বাংলাদেশে। নির্ধারিত নির্বাচনের সামান্য আগে ২০০৭ সালে আমি একটি গবেষণা করি। তাতে দেখা যায় যে, ১৯৯০-এর পরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো নিয়ে জনগণ অত্যন্ত খুশি। তবে তারা মনে করেন, তেমন নির্বাচন কমই হয়েছে। দারিদ্র্য হ্রাসের সঙ্গে নির্বাচন সম্পর্কযুক্ত হতে পারে না। এর সঙ্গে পার্লামেন্টের কর্মকা-েরও কোন কিছু করার নেই। ১৫তম সংশোধনীর ফলে নির্বাচনকেন্দ্রীক রাজনীতির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। আসল কথা হলো- সব সরকারের আমলেই পার্লামেন্ট বসলেও তা থেকেছে অকেজো। বিনিময়ে পাওয়া গেছে উদ্দেশ্যহীন কিছু। এর ফলে বিগত ও বর্তমান পার্লামেন্ট তা থেকে আলাদা কিছু নয়। যে কোনভাবেই হোক বিরোধীরা অনুপস্থিত। তাহলে বাংলাদেশের কোথায় আমরা গণতন্ত্র খুঁজবো? রাজনৈতিক গণতন্ত্র বেশি বা কম অনুপস্থিত। বিরোধী দলবিহীন একটি রাজনৈতিক জীবনে আটকে আছে বর্তমান সরকার। এটা শুনতে কঠিন লাগে, ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব সব দলকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা। তারা তা করেনি। ফলে এতে সৃষ্টি হয়েছে বিএনপির মতো রাজনীতিতে অপরিপক্ব একটি দলের। তারা ফাঁদে পা দিয়েছে এবং দূরে সরে গেছে। আওয়ামী লীগ যথার্থই ধারণা করতে পেরেছে যে, রাজনীতি নিয়ে জনগণ অতো মাথা ঘামায় না। তারা নির্বাচনের ইস্যুতে রাজপথে নামবে না। এমনকি তারা নির্বাচনের পরেও রাজপথে নামবে না। আওয়ামী লীগের ওই ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এমন বিজয় নিয়ে বিপদ আছে তারা। এখন যেসব অসন্তোষ, অভিযোগ, সমস্যার কথা পার্লামেন্ট থেকে প্রচার করা হয় না, তা প্রচার হচ্ছে মিডিয়ায়। একটি রাষ্ট্রের অব্যাহত চলার পথে সেটা হচ্ছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকল্প। দৃশ্যত, উচ্চপর্যায়ের ক্ষোভের মুখে পড়েছে মিডিয়া। তাই মিডিয়া যাতে অনুমোদিত সীমার বেশি সমালোচনা করতে না পারে সে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এটা অপরিহার্য যে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাউন্টার থেকে কাউন্টেস্ট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। রাজনৈতিক উল্লেখ করার মতো বিরোধী দলের অনুপস্থিতির অর্থ হলো তার স্থান দখল করে মিডিয়া। এতে যা ঘটতে পারে তা আগেই বলা হয়েছে। এতে আন্ডারগ্রাউন্ড ও অন্যান্য স্থানে প্রতিবাদ বিক্ষোভ গড়ে উঠবে। সেই প্রতিবাদ নিয়ন্ত্রণ করা সত্যিকার অর্থেই অনেকটা কঠিন। তবে তা নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য। সর্বস্তরে গণতন্ত্র হলো প্রত্যেকের জন্য রাজনৈতিক নিরাপত্তার সর্বোত্তম নিশ্চয়তা। বহুমাত্রিক গণতন্ত্র ছাড়া কোন রাষ্ট্রই টিকে থাকেনি। গণতন্ত্র না থাকার কারণে পুরো সমাজতন্ত্রের বিলোপ ঘটেছে। কার্যকর একটি গণতন্ত্রের লেবাস না পরলে বাংলাদেশ কতদূর যেতে পারবে- এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে ভবিষ্যত।
আফসান চৌধুরী, সাংবাদিক ও গবেষক
নিউ এজ পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার অনুবাদ
No comments