বিরক্ত করবেন না, ‘রাজনীতি’ চলছে by ফারুক ওয়াসিফ
রিকশার চেয়ে বড় মানবতাবাদী যন্ত্র আর কী
আছে? উত্তরবঙ্গ থেকে মধ্যবঙ্গ পর্যন্ত বন্যা যতই ছড়াচ্ছে, ততই ঢাকায়
আনাড়ি রিকশাচালকদের দেখা পাচ্ছি বেশি। এভাবেই ঢাকার মোহাম্মদপুরে পেলাম
নদীভাঙা গ্রামের কৃষক রেজাউলকে।
যার কেউ নেই, তাঁর রিকশা আছে। ভূমিহীন কৃষক, কর্মহীন শ্রমিক, নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ‘ভদ্রলোক’দের আর কেউ না বাঁচালেও রিকশা তাঁদের পেট বাঁচাবে। রিকশার প্যাড্ল ঠেলা-ই ক্ষুধার বিরুদ্ধে তাঁর জীবনবিমা। বগুড়ার সারিয়াকান্দির কৃষক কাম মুদি দোকানি রেজাউল গত সপ্তাহে ছিলেন গেরস্ত কৃষক। এ সপ্তাহে তিনি হলেন রিকশাচালক। ছিলেন এলাকার তাগড়া যুবক, এখন হলেন নামহীন ‘মফিজ’। দুর্যোগে পড়া মানুষের এটা কমন গল্প।
ঢাকাসহ বড় বড় শহরের বেশির ভাগ রিকশাচালকের পেছনেই পাবেন বাস্তুহীন, কর্মহীন, ভূমিহীন হওয়ার বাস্তব কাহিনি। সারিয়াকান্দির যুবক রেজাউলের মতো মানুষেরা খুলনার বন্ধ পাটকল থেকে, উপকূলের জলবায়ুদুর্গত এলাকা থেকে, খুলনার নোনাজলের গ্রামগুলো থেকে এবং এখন কুড়িগ্রাম-রংপুর-গাইবান্ধা-বগুড়া-সিরাজগঞ্জের নদীকূল থেকে এক ধাক্কায় রাজধানীতে এসে পড়ছে। কেউ জানল না, সরকার দেখল না, কত সহস্র মানুষের জীবন সহসা নিচে পড়ে গেল।
উদ্বাস্তুদের আগমন দুর্যোগের লক্ষণ। আর্মেনিয়ার লোককাহিনিতে ঘাসফড়িংয়ের হিজরত মানে বিপদ আসছে। চীনে পলায়মান ব্যাঙের পিছু পিছু অমঙ্গল আসে বলে বিশ্বাস করা হয়। পিঁপড়াদের পালানো দেখলে সনাতন বাংলাদেশিরা বন্যার জন্য প্রস্তুত হয়। আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্রের আছে বিজ্ঞানভিত্তিক পূর্বাভাসব্যবস্থা। বন্যা যে আসছে, তার কোনোই পূর্বাভাস কেন তারা দিতে পারল না? সরকারের নৌ, আবহাওয়া ও জলবায়ু দপ্তর কী করেছিল গত দুই মাস? সরকার ব্যস্ত মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী দমন আর ক্ষমতার কলকবজা সামলানোয়। জনমানুষের কথা দরবারি চিন্তায় অফ টপিক, অপ্রাসঙ্গিক। জবাবদিহির চিন্তাটাও তেমনই অফ টপিক!
কয়েক বিঘা জমি, ছোট্ট একটা মুদি দোকান আর সাংসারিক কাজকর্ম করে বউ-বেটা নিয়ে জীবন চলত রেজাউলের। কিন্তু এক রাতে বিনা নোটিশে বাঁধ ভেঙে গেল যমুনার। যমুনার কালো পানি কোনো সুযোগ না দিয়েই ঘরবাড়ি-আসবাব ডুবিয়ে দিল। রেজাউল সে রাতে ঘুম ভেঙে পা নামিয়ে দেখেন পানি; হু হু করে বাড়ছে। কিচ্ছু বাঁচানো যায়নি। তিন বিঘা জমি, মুদি দোকান—সব যমুনার পেটে।
প্রকৃতিকে দোষ দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। সারিয়াকান্দি দেশের সবচেয়ে বন্যাপ্রবণ এলাকা। কোটি কোটি টাকা খরচ করে সেখানে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বছর বছর এর সংস্কারে খরচ হয় বিপুল টাকা। প্রকৌশলী থেকে শুরু করে ঠিকাদার-মাস্তান পর্যন্ত সেই টাকার ফজিলত ভোগ করে। গত ২৯ জুলাই সেই বাঁধের মাটি কেটে পাউবো বানায় রিং বাঁধ। এ যেন রক্তক্ষরণে দুর্বলের দেহ থেকে রক্ত নিয়ে তারই দেহে দেওয়ার ব্যবস্থা! ঠিক এক মাস পরে বাঁধের সেই জায়গাটি পানির চাপে ভেঙে যায়। ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম। এ রকম অতর্কিত বাঁধ ভেঙে জনপদ প্লাবিত হওয়ার খবর আসছে বিভিন্ন জেলা থেকে। এসব বাঁধের নির্মাতা, প্রকৌশলী, ঠিকাদার এবং দেখভালের দায়িত্বে থাকা পাউবোর কারও শাস্তি হওয়ার খবর তো আসছে না। নাকি, সেটাও অফ টপিক!
নদীই বা কেন এত খল হয়ে উঠল? ভুল নদীশাসনে আর ভারতের পানি প্রত্যাহারের কারণে নদীর স্বভাব নষ্ট হয়েছে। নদীর বুক বালুতে ভরে যাওয়ায় অল্পেই কূল উপচানো বন্যা হয়। দেশময় প্লাবনভূমি আর খাল-বিল-জলাশয় দখল করায় বানের পানি সমুদ্রের দিকে নেমে যাওয়ার পথ পায় না। ক্ষমতাবানদের দোষে ক্ষমতাবঞ্চিত ব্যক্তিরা ভোগে; তারও বিচার হয় না। এর দায় প্রকৃতির নয়, রাজনীতির, সরকারের, প্রশাসনিক দুর্নীতি আর ভুল নীতির। কিন্তু সেই আলোচনা তো অফ টপিক!
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার তিন দিকে তিন নদী: ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা আর ধরলা। সেখানে জায়গায় জায়গায় স্লুইসগেট আছে বটে, কিন্তু সেগুলোর কী কাজ, তা জানা যায় না। চিলমারীর গণকমিটির নেতা শিক্ষক নাহিদ হাসানের মতে, স্লুইসগেট খোলা থাকায় বন্যা হয়েছে, কিন্তু বন্ধ থাকলে কী হতো, তা-ও তো বলা যায় না। অর্থাৎ নদীশাসনের জন্য তৈরি এসব স্থাপনার অনেকগুলোই আসলে কোনো কাজে আসে না। হয় সেগুলো ভুল জায়গায় ভুল প্রযুক্তিতে নির্মিত, অথবা অবহেলা আর অব্যবহারে কার্যত অচল।
এ সময়টায় কৃষকেরা আমন ধানের চাষ করেন। যখন জমি ও বসতি দুটোই পানির তলায়, যখন আমনের বীজতলা ধ্বংস, তখন ফসল রক্ষায় কী করেছিল সরকারের কৃষি বিভাগ? আবহাওয়া, কৃষি ও সেচ এবং নদীশাসনের সঙ্গে সরকার প্রশাসনের নিবিড় সমন্বয় ছাড়া কৃষির মানুষজনদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা কল্পনা করা যায় না। আমাদের বাস্তববাদী বিজ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্রযন্ত্র সুদিনের কল্পনার ধার ধারে না। তাই মানুষের সুরক্ষার নিশ্চয়তা ছাড়াই তারা নিরাপদ তন্দ্রায় থাকতে পারে। এদিকে রেজাউলের, ‘ঢাকাত মন থাকে না’।
চরগুলো ডোবা। মাস দুয়েকের মধ্যে আমন ওঠার কথা। বাঁধ না ভাঙলে এ সপ্তাহেই আমন লাগানো হতো কৃষির চরাচরে। এক মাস পরে যখন ধানে দুধ আসার কথা, তখন রেজাউলদের ঘাম ঝরবে ঢাকা শহরে। চরগুলোও ডোবা, সেখানে ধান বা বাদাম বা সবজি ফলানো কঠিন হবে। অর্থনীতির জন্যও বন্যার চেয়ে বড় বিপদ সেটাই। বন্যাটা যেকোনোভাবে পার হবে, কিন্তু নতুন মৌসুমের ফসল ঘরে না এলে মঙ্গা অবধারিত। পুরুষরা তখন রিকশা চালাতে নামবে। বউ-বেটিরা ঠিকা কাজ নেবেন, পোশাকশিল্পের লাঞ্ছিত শ্রমিক হবেন; পতিত হবেন এমন সব পেশায়, যেখানে একবার ঢুকলে আর বেরোনো যায় না।
এমন সময় রেজাউলদের দরকার ছিল ত্রাণ, কাজ, ক্ষতিপূরণ ও আশ্রয়। কিন্তু তিনি পেলেন অগতির গতি তিন চাকার জীবন। বানের পানির চেয়ে দ্রুত পায়ে তাঁরা চলে এসেছেন ঢাকায়। আরও আসছেন এবং আরও অনেকে পেছনে ধুঁকছেন।
সরকার যে তাঁদের ব্যথার ব্যথী হবে, তেমন ভরসা নেই। বিজনেস অ্যাজ অ্যাজুয়াল চলবে। তার পরও জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, লোনাপানির জোয়ার, মিল-কারখানা বন্ধসহ হরেক কারণে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের ঢলের পেছন পেছন ক্রমেই এগিয়ে আসবে সামাজিক নৈরাজ্যের দিন। রেজাউলের মতো হঠাৎ নিঃস্ব রিকশাচালকেরাই আমাদের ঘাসফড়িং, নৈরাজ্যের পূর্বাভাস বহন করে তাঁরা আসছেন। তাঁরা আর তাঁদের জীবন এক চিরস্থায়ী অফ টপিক! সরকার ও বিরোধী দল রাজনীতিতে ব্যস্ত। এসব দেখার সময় কোথায় তাদের?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
যার কেউ নেই, তাঁর রিকশা আছে। ভূমিহীন কৃষক, কর্মহীন শ্রমিক, নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ‘ভদ্রলোক’দের আর কেউ না বাঁচালেও রিকশা তাঁদের পেট বাঁচাবে। রিকশার প্যাড্ল ঠেলা-ই ক্ষুধার বিরুদ্ধে তাঁর জীবনবিমা। বগুড়ার সারিয়াকান্দির কৃষক কাম মুদি দোকানি রেজাউল গত সপ্তাহে ছিলেন গেরস্ত কৃষক। এ সপ্তাহে তিনি হলেন রিকশাচালক। ছিলেন এলাকার তাগড়া যুবক, এখন হলেন নামহীন ‘মফিজ’। দুর্যোগে পড়া মানুষের এটা কমন গল্প।
ঢাকাসহ বড় বড় শহরের বেশির ভাগ রিকশাচালকের পেছনেই পাবেন বাস্তুহীন, কর্মহীন, ভূমিহীন হওয়ার বাস্তব কাহিনি। সারিয়াকান্দির যুবক রেজাউলের মতো মানুষেরা খুলনার বন্ধ পাটকল থেকে, উপকূলের জলবায়ুদুর্গত এলাকা থেকে, খুলনার নোনাজলের গ্রামগুলো থেকে এবং এখন কুড়িগ্রাম-রংপুর-গাইবান্ধা-বগুড়া-সিরাজগঞ্জের নদীকূল থেকে এক ধাক্কায় রাজধানীতে এসে পড়ছে। কেউ জানল না, সরকার দেখল না, কত সহস্র মানুষের জীবন সহসা নিচে পড়ে গেল।
উদ্বাস্তুদের আগমন দুর্যোগের লক্ষণ। আর্মেনিয়ার লোককাহিনিতে ঘাসফড়িংয়ের হিজরত মানে বিপদ আসছে। চীনে পলায়মান ব্যাঙের পিছু পিছু অমঙ্গল আসে বলে বিশ্বাস করা হয়। পিঁপড়াদের পালানো দেখলে সনাতন বাংলাদেশিরা বন্যার জন্য প্রস্তুত হয়। আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্রের আছে বিজ্ঞানভিত্তিক পূর্বাভাসব্যবস্থা। বন্যা যে আসছে, তার কোনোই পূর্বাভাস কেন তারা দিতে পারল না? সরকারের নৌ, আবহাওয়া ও জলবায়ু দপ্তর কী করেছিল গত দুই মাস? সরকার ব্যস্ত মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী দমন আর ক্ষমতার কলকবজা সামলানোয়। জনমানুষের কথা দরবারি চিন্তায় অফ টপিক, অপ্রাসঙ্গিক। জবাবদিহির চিন্তাটাও তেমনই অফ টপিক!
কয়েক বিঘা জমি, ছোট্ট একটা মুদি দোকান আর সাংসারিক কাজকর্ম করে বউ-বেটা নিয়ে জীবন চলত রেজাউলের। কিন্তু এক রাতে বিনা নোটিশে বাঁধ ভেঙে গেল যমুনার। যমুনার কালো পানি কোনো সুযোগ না দিয়েই ঘরবাড়ি-আসবাব ডুবিয়ে দিল। রেজাউল সে রাতে ঘুম ভেঙে পা নামিয়ে দেখেন পানি; হু হু করে বাড়ছে। কিচ্ছু বাঁচানো যায়নি। তিন বিঘা জমি, মুদি দোকান—সব যমুনার পেটে।
প্রকৃতিকে দোষ দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। সারিয়াকান্দি দেশের সবচেয়ে বন্যাপ্রবণ এলাকা। কোটি কোটি টাকা খরচ করে সেখানে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বছর বছর এর সংস্কারে খরচ হয় বিপুল টাকা। প্রকৌশলী থেকে শুরু করে ঠিকাদার-মাস্তান পর্যন্ত সেই টাকার ফজিলত ভোগ করে। গত ২৯ জুলাই সেই বাঁধের মাটি কেটে পাউবো বানায় রিং বাঁধ। এ যেন রক্তক্ষরণে দুর্বলের দেহ থেকে রক্ত নিয়ে তারই দেহে দেওয়ার ব্যবস্থা! ঠিক এক মাস পরে বাঁধের সেই জায়গাটি পানির চাপে ভেঙে যায়। ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম। এ রকম অতর্কিত বাঁধ ভেঙে জনপদ প্লাবিত হওয়ার খবর আসছে বিভিন্ন জেলা থেকে। এসব বাঁধের নির্মাতা, প্রকৌশলী, ঠিকাদার এবং দেখভালের দায়িত্বে থাকা পাউবোর কারও শাস্তি হওয়ার খবর তো আসছে না। নাকি, সেটাও অফ টপিক!
নদীই বা কেন এত খল হয়ে উঠল? ভুল নদীশাসনে আর ভারতের পানি প্রত্যাহারের কারণে নদীর স্বভাব নষ্ট হয়েছে। নদীর বুক বালুতে ভরে যাওয়ায় অল্পেই কূল উপচানো বন্যা হয়। দেশময় প্লাবনভূমি আর খাল-বিল-জলাশয় দখল করায় বানের পানি সমুদ্রের দিকে নেমে যাওয়ার পথ পায় না। ক্ষমতাবানদের দোষে ক্ষমতাবঞ্চিত ব্যক্তিরা ভোগে; তারও বিচার হয় না। এর দায় প্রকৃতির নয়, রাজনীতির, সরকারের, প্রশাসনিক দুর্নীতি আর ভুল নীতির। কিন্তু সেই আলোচনা তো অফ টপিক!
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার তিন দিকে তিন নদী: ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা আর ধরলা। সেখানে জায়গায় জায়গায় স্লুইসগেট আছে বটে, কিন্তু সেগুলোর কী কাজ, তা জানা যায় না। চিলমারীর গণকমিটির নেতা শিক্ষক নাহিদ হাসানের মতে, স্লুইসগেট খোলা থাকায় বন্যা হয়েছে, কিন্তু বন্ধ থাকলে কী হতো, তা-ও তো বলা যায় না। অর্থাৎ নদীশাসনের জন্য তৈরি এসব স্থাপনার অনেকগুলোই আসলে কোনো কাজে আসে না। হয় সেগুলো ভুল জায়গায় ভুল প্রযুক্তিতে নির্মিত, অথবা অবহেলা আর অব্যবহারে কার্যত অচল।
এ সময়টায় কৃষকেরা আমন ধানের চাষ করেন। যখন জমি ও বসতি দুটোই পানির তলায়, যখন আমনের বীজতলা ধ্বংস, তখন ফসল রক্ষায় কী করেছিল সরকারের কৃষি বিভাগ? আবহাওয়া, কৃষি ও সেচ এবং নদীশাসনের সঙ্গে সরকার প্রশাসনের নিবিড় সমন্বয় ছাড়া কৃষির মানুষজনদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা কল্পনা করা যায় না। আমাদের বাস্তববাদী বিজ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্রযন্ত্র সুদিনের কল্পনার ধার ধারে না। তাই মানুষের সুরক্ষার নিশ্চয়তা ছাড়াই তারা নিরাপদ তন্দ্রায় থাকতে পারে। এদিকে রেজাউলের, ‘ঢাকাত মন থাকে না’।
চরগুলো ডোবা। মাস দুয়েকের মধ্যে আমন ওঠার কথা। বাঁধ না ভাঙলে এ সপ্তাহেই আমন লাগানো হতো কৃষির চরাচরে। এক মাস পরে যখন ধানে দুধ আসার কথা, তখন রেজাউলদের ঘাম ঝরবে ঢাকা শহরে। চরগুলোও ডোবা, সেখানে ধান বা বাদাম বা সবজি ফলানো কঠিন হবে। অর্থনীতির জন্যও বন্যার চেয়ে বড় বিপদ সেটাই। বন্যাটা যেকোনোভাবে পার হবে, কিন্তু নতুন মৌসুমের ফসল ঘরে না এলে মঙ্গা অবধারিত। পুরুষরা তখন রিকশা চালাতে নামবে। বউ-বেটিরা ঠিকা কাজ নেবেন, পোশাকশিল্পের লাঞ্ছিত শ্রমিক হবেন; পতিত হবেন এমন সব পেশায়, যেখানে একবার ঢুকলে আর বেরোনো যায় না।
এমন সময় রেজাউলদের দরকার ছিল ত্রাণ, কাজ, ক্ষতিপূরণ ও আশ্রয়। কিন্তু তিনি পেলেন অগতির গতি তিন চাকার জীবন। বানের পানির চেয়ে দ্রুত পায়ে তাঁরা চলে এসেছেন ঢাকায়। আরও আসছেন এবং আরও অনেকে পেছনে ধুঁকছেন।
সরকার যে তাঁদের ব্যথার ব্যথী হবে, তেমন ভরসা নেই। বিজনেস অ্যাজ অ্যাজুয়াল চলবে। তার পরও জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, লোনাপানির জোয়ার, মিল-কারখানা বন্ধসহ হরেক কারণে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের ঢলের পেছন পেছন ক্রমেই এগিয়ে আসবে সামাজিক নৈরাজ্যের দিন। রেজাউলের মতো হঠাৎ নিঃস্ব রিকশাচালকেরাই আমাদের ঘাসফড়িং, নৈরাজ্যের পূর্বাভাস বহন করে তাঁরা আসছেন। তাঁরা আর তাঁদের জীবন এক চিরস্থায়ী অফ টপিক! সরকার ও বিরোধী দল রাজনীতিতে ব্যস্ত। এসব দেখার সময় কোথায় তাদের?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
No comments