বাংলাদেশের পাকিস্তান উপসর্গ by মিজানুর রহমান খান
বাংলাদেশ ক্রমেই গণতান্ত্রিক শাসনের
অযোগ্য হয়ে পড়ার দিকে যাচ্ছে কি না, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে
বিবেচনার দাবি রাখে। দেশটি এমন দিকে যাচ্ছে, যেখান থেকে তার ফেরা আর কখনোই
সহজ হবে না। সরকারি পরিসংখ্যানই নির্দেশ করছে যে জনপ্রশাসনে এমন কিছু
ভয়ানক লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে, যা আগে দেখা যায়নি৷ এ জন্য ক্ষমতাসীন না কেবল
বিরোধী দল, কে কতটা দায়ী, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে কিন্তু তাতে
বাস্তবতার হেরফের হবে না। শাসনগত কিছু মৌলিক বিষয় নষ্ট করা হলে তা পরে আর
ঠিক করা অসম্ভব কিংবা দুরূহ হয়ে পড়ে৷
পাকিস্তানে সেনাপ্রধানকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মানতে কথিত জাতীয় ঐকমত্য এখন প্রায় প্রতিষ্ঠিত! শাসন অনুপযোগী পরিবেশে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ জনপ্রতিনিধিদের জন্য কত লজ্জা ও অপমানজনক হতে পারে, সেটা নওয়াজ-জারদারি ও ইমরান-কাদরিরা দেখিয়ে দিচ্ছেন। পাকিস্তানে যা ঘটল, তা অনুচ্চারিত অভ্যুত্থান। সামরিক বাহিনী কার্যত দেশ চালাচ্ছে। ঐতিহাসিক ম্যান্ডেটধারী নওয়াজ ও সংসদীয় বিরোধী দল, যেটি রওশন এরশাদ মার্কা নয়, তারা নাটকের চরিত্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের এই ত্রাহি মধুসূদন অবস্থাটি হৃদয়ঙ্গম করা উচিত। তারা দ্রুত স্বীকার করলে ভালো যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সমস্যা দুই বড় দলের ঐকমত্য মানে স্রেফ একটি আশু ভোট উৎসবের মধ্যেই নিহিত নয়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করলে এবং প্রধান বিরোধী দলের তরফে জ্বালাও-পোড়াও দূরে থাক, গোলাপের পাপড়ি ছিটানোও দেখা যাচ্ছে যথেষ্ট নয়। আসমা জাহাঙ্গীর বলেছেন,‘এখন আমরা সবাই জানি কে পাকিস্তান শাসন করছে (ওয়াশিংটন পোস্ট, ২৮ আগস্ট ২০১৪)।’ ১৬ মাস আগে পাকিস্তান ভোট করেছিল। দুই দল মিলে বিচারক, নির্বাচন কমিশনার এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গড়েও শান্তি মিলল না। এখন উর্দিধারীদের মধ্যস্থতা লাগছে৷
পাকিস্তানে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল একদা এতটাই তিক্ত বিরোধে লিপ্ত ছিল যে তারা কখনো প্রতিষ্ঠান গড়তে দিতে রাজি হয়নি। সেই অবস্থা চলছে এখানেও। তারা গণতন্ত্র বলতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর বুঝে এসেছে এবং ইদানীং কার্যত তাও বিসর্জন দিয়েছে। দুই বড় দলের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠাকেই বলা হয়েছে জাতীয় ঐক্য। কিন্তু সেটা অর্জন করতেও পাকিস্তান এত বেশি সময় নিয়েছে যে দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি করে কোনো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে তারা বাকি রাখেনি। তাই বিরোধ মীমাংসার জন্য কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানই গ্রহণযোগ্য নয়। সেনারাই তাই সেরা সংবিধান রক্ষাকর্তা।
একজন সাহসী ব্যক্তি প্রধান বিচারপতি পদে থাকা সত্ত্বেও ইমরান-কাদরিরা বলছেন, নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগের সুষ্ঠু বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত নওয়াজকে স্বপদে বহাল রেখে সম্ভব নয়। অথচ পাকিস্তানি ইসি বাংলাদেশ কায়দায় নয়, রীতিমতো দ্বিদলীয় স্বচ্ছতায়, সুষ্ঠু সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এটা যখন করার ছিল তখন তারা করেনি। জেনারেলদের ধাওয়া খেয়ে বিদেশে নির্বাসনে গিয়েই তবে বেনজির-নওয়াজ গণতন্ত্র সনদে সই করেছিলেন এবং বেনজির নিহত হওয়ার পরে দুই দল একত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী পাস করেছে। পাকিস্তান এভাবে প্রমাণ করছে যে অত্যন্ত বেশি সময় গণতান্ত্রিক খেলার নিয়ম মানতে অপারগ থাকলে তার কড়া মাশুল দিতে হয়।
প্রেসক্লাবে শাহদীন মালিকের উদ্যোগে ডাকা গুম হওয়া পরিবারের জবানবন্দিতে পাকিস্তানি আমল, বিশেষ করে একাত্তরের এবং তার আগের নিষ্ঠুরতার বিবরণ এসেছে। শহীদ মতিউর ও জোহাদের স্মরণ করেছেন ড. কামাল হোসেন। পাঞ্জাবি শাসক চক্র সংখ্যালঘু হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠকে শাসনে অপকৌশল আরোপ করেছিল। তারা পণ করেছিল, যে করেই হোক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছে গদি ছাড়া যাবে না। রক্তের উত্তরাধিকার না থাকার ঘাটতি পূরণ করেছে কঠিন কায়েমি স্বার্থ। সাতচল্লিশের আগেও একদল লোক ছিল, যাদের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের সঙ্গে দেখা গেছে। তারা ভেবেছে, নতুন রাষ্ট্র হলে হিন্দু জমিদারেরা রিক্ত হবে, চলে যাবে। তাদের সম্পদ ও প্রভাবশালী শূন্যস্থানগুলো মুফতে মিলবে। তারা সংখ্যায় লঘু কিন্তু সুবিধাভোগী, ক্ষমতার সঙ্গে থেকে তারা পাঞ্জাবি সংখ্যালঘুদের সঙ্গে বোল তুলেছে। ‘বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ’কে নিষ্ক্রিয় করতে পাঞ্জাবিরা আমলাতন্ত্রকে কবজাবন্দী করতে পেরেছিল। ঐতিহ্যগতভাবে আমলাতন্ত্র সব সময় শানশওকত ও ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট পছন্দ করে, নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সব সময় নির্বাচনকে যমের মতো ভয় করেছে। সোহরাওয়ার্দীর ওপর আঘাত হানো। কারণ, তাঁর জনপ্রিয় ভিত্তি আছে। তাঁকে সরাও, খয়ের খাঁ বসাও। নির্বাচন লাগবে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পকেট কমিটির মহামারি সাতচল্লিশে স্বাধীনতালাভের পরপরই শাসকগোষ্ঠীর কূটকৌশল স্মরণ করিয়ে দেয়। চৌধুরী খালেকুজ্জামানকে পূর্ববঙ্গে পাঠানো হয়েছিল। তাঁর মিশন ছিল, মুসলিম লীগের বিভিন্ন স্তর থেকে বাঙালির জনপ্রতিনিধি হটাও। পাঞ্জাবিদের পেয়ারের বান্দা বসাও।
কায়েমি স্বার্থান্বেষীরা মূলত সংখ্যালঘু হয়। অথচ তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে শাসন করবে, এটাই ঔপনিবেশিক শাসনের মৌলিক কলা। বাংলাদেশ শাসনে আমরা ভিন্ন কী দেখি? পাঞ্জাবি নীতি ছিল, রাজনৈতিকভাবে দায়িত্বশীল পদগুলোয় বশংবদ আর প্রশাসনের মুখ্য পদগুলোয় অবাঙালি বসাও। বাঙালি হলো বিরোধী দল। ক্ষমতার প্রতিপক্ষ। সুতরাং ওই বশংবদের দল ও অবাঙালি আমলাদের কাজ ছিল বাঙালিদের মধ্যে অনৈক্য ও হানাহানির প্রতিটি সুযোগকে ব্যবহার করা। তারা হাসতে হাসতে নির্বাচনপদ্ধতি বিকৃত করেছিল। মূল কারণ নির্বাচনভীতি, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের জয়ের পরে তা আরও জেঁকে বসল। তাঁবেদার অবাঙালিদের তালুবন্দী মুসলিম লীগ ওই ভোটে মুছে গেল। তাই দুই মাস না যেতেই যুক্তফ্রন্ট সরকার ভাঙা হলো। সুষ্ঠু নির্বাচনভীতির কারণেই গণপরিষদ ভাঙা হয়েছিল। কারণ, চুয়ান্নতে দ্বিকক্ষ সংসদীয় ছাঁচে খসড়া সংবিধান বিল চূড়ান্ত হলো। তখন তারা দেখল, এটা পাস হলে বাঙালিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে নিম্নকক্ষে। তাই পাঞ্জাবিরা সেটা চুয়ান্নর অক্টোবরে ভেঙে দিল। রাজনীতিক দিয়েই গণপরিষদকে চূড়ান্তভাবে অকার্যকর, অপমানিত, অপদস্থ করে তাকে সমাহিত করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সামরিক বাহিনী ছিল পর্দার আড়ালে।
পর্দা সরতেই গোলাম মোহাম্মদ, বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর মতো ভাঁড়দের দেখা গেল। মঞ্চে প্রবেশ উদ্যত ‘নায়কের’ মুখচ্ছবি দর্শক গ্রিন রুমের অলিন্দ থেকেই দেখতে পেলেন। রাজনীতিকেরা যেখানে সম্পূর্ণ অপদার্থ, শুধু ক্ষমতায় থাকার লোভে আত্মমর্যাদা শতভাগ বিসর্জনে প্রস্তুত, সেখানে সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের বাঁচাতে পারেন না। প্রধান বিচারপতি মুনির পাঞ্জাবি ষড়যন্ত্রকেই অভিবাদন জানালেন। এর একটু বাদেই আমরা দেখলাম, মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হচ্ছে। এবং সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে পরোক্ষ ভোটের বিধানসংবলিত দ্বিতীয় গণপরিষদ হলো ১৯৫৫ সালে। এর পর থেকে সত্তরের নির্বাচন পর্যন্ত প্রতিটি সংবিধান সংশোধনী সেনাস্বার্থ রক্ষা সাপেক্ষে করা হয়েছে। তারা এমনভাবেই তাদের ক্ষমতার প্রতিপক্ষকে ঠেকাল যে টানাটানিতে দেশটাই ভেঙে গেল। নির্বাচন ও জনপ্রতিনিধিত্ব অস্বীকার এবং ধ্বংস করার কারণেই বাঙালির ভোটে গড়া পাকিস্তান ভোটের অভাবে (ভাতের অভাবে নয়!) হাড় জিরজির হতে হতে মারা গেল।
পাকিস্তানে আরেকবার পর্দা সরেছে। সেখানে আইয়ুবরূপী জেনারেল রাহিল যেন একই ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো। তারা প্রমাণ রেখে চলছে ইতিহাস থেকে তারা শিক্ষা নেওয়ার জাতি নয়। এই লেখা শুরু করেছিলাম এটা বোঝাতে যে শাসন অনুপযোগী অকার্যকরতা বাংলাদেশে গভীর হচ্ছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, অভিযোগপত্রভুক্তদের মন্ত্রিসভায় অযোগ্য করতে। আর বাংলাদেশে এটিই, এমনকি দণ্ডিত থাকা মন্ত্রী হওয়ার গর্বিত যোগ্যতা হতে পারে। গত মন্ত্রিসভার একজন আদালতেই বলেন দণ্ড সরান, মন্ত্রী হব। অভিযুক্ত, দণ্ডিত ও বিচারাধীন আসামির মধ্যকার বাস্তব পার্থক্য মুছে যাচ্ছে। সরকারি প্রভাব ও নিগড়মুক্ত কোনো গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কার্যকর অস্তিত্ব দ্রুত লোপ পাচ্ছে। শত গুমের গণশুনানিতে কেউ কোনো সরকারি সংস্থাকে সমীহ করে কথা বলেননি। ষাটের দশকে অন্যায্য গ্রেপ্তার ভন্ডুলের কার্যকর অস্ত্র ছিল হেবিয়াস কর্পাস রিট। আজ তা এতটাই অপ্রাসঙ্গিক যে কামাল হোসেন হয়তো তার তুলনামূলক স্মৃতিচারণা অর্থহীন মনে করেন। বরং অনন্য গণসংগীতশিল্পী সায়ানের কণ্ঠে যখন সুর উঠল ‘আল্লাহ তুমি কার’, তখন তা অধিকতর অর্থপূর্ণ হয়ে উঠল। সমবেতদের হৃদয় ছুঁয়ে গেল, তাঁদের চোখ ভিজিয়ে দিল। সম্প্রচার ও গুম নীতি হলো ক্ষমতাসীনদের মনস্তত্ত্বের এক্স-রে রিপোর্ট। এতে তাদের আমলাতন্ত্র তোয়াজ ব্যাধি ধরা পড়েছে। মনে হচ্ছে লুটপাট ও ক্ষমতার অপব্যবহার এবং শাসনব্যবস্থার পদ্ধতিগত বিকৃতকরণের মধ্যে পার্থক্য টানার সময় এসেছে। ২০০২-০৬ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা যখন বছরে গড়ে ৮১২, তখন সেটা ২০০৯-১৩ সালে গড়ে মাত্র ১২৩টিতে নেমে এসেছে। অথচ এখন এক দিনেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দেড় শর বেশি অভিযোগপত্র জন্ম নেওয়ার তুঘলকি নজির তৈরি হচ্ছে।
বিএনপি-আওয়ামী সংঘাত হ্রাস কি শান্তির লক্ষণ? পুলিশের ওপর হামলার সংখ্যাগত তুলনা বিশ্লেষণে ভয়ানক উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে ওঠে। বিএনপির গত আমলে বছরে গড়ে পুলিশ যেখানে ২৮১টি হামলার শিকার হয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগের গত পাঁচ বছরে পুলিশের ওপর গড়ে বছরে ৬৬৫টি হামলা হয়েছে। গত বছর ইতিহাসের সর্বোচ্চ এক হাজার ২৫৭টি হামলা হয়েছে পুলিশের ওপর। শুধু ভোটদান বাক্সের গণতন্ত্র এ রকম চিত্র বদলাবে না। একটা সমাজ রূপান্তরকরণ লাগবে। গাঢ় কৃষ্ণপক্ষের গভীর অমানিশা ভেদ করে এক দিনে ঢাকায় দুটি আশাবাদী হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। গুম আর সম্প্রচার নীতিবিরোধী অর্থবহ নাগরিক সংলাপ হয়েছে। এই নাগরিক সমাজকে অকুণ্ঠ অভিবাদন।
ষাটের দশকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও খান সারোয়ার মুরশিদ নিউ ভেলুজ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। কারণ, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, সমাজ রূপান্তরকরণের জন্য পুরোনা মূল্যবোধে আঘাত হানতে হবে। ড. কামালের অক্সফোর্ড গবেষণাপত্রের ভাষায়, মূল্যবোধ যখন ‘কর্তৃত্ববাদী, ঔপনিবেশিক এবং সামন্ততান্ত্রিক ধারানির্ভর’ হয়, তখন তা দিয়ে সমাজ রূপান্তরকরণ ঘটানো যায় না। বর্তমানে আমরা সেই রুগ্ণ ধারায় হাবুডুবু খাচ্ছি। সবার আগে এটা ছুড়ে ফেলতে হবে। তরুণ প্রজন্মের কাছে নিউ ভেলুজ—যা দুই বড় দলের অপরাজনীতি প্রত্যাখ্যান করবে, তা পুনঃপ্রকাশের উদ্যোগ কামনা করি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
পাকিস্তানে সেনাপ্রধানকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মানতে কথিত জাতীয় ঐকমত্য এখন প্রায় প্রতিষ্ঠিত! শাসন অনুপযোগী পরিবেশে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ জনপ্রতিনিধিদের জন্য কত লজ্জা ও অপমানজনক হতে পারে, সেটা নওয়াজ-জারদারি ও ইমরান-কাদরিরা দেখিয়ে দিচ্ছেন। পাকিস্তানে যা ঘটল, তা অনুচ্চারিত অভ্যুত্থান। সামরিক বাহিনী কার্যত দেশ চালাচ্ছে। ঐতিহাসিক ম্যান্ডেটধারী নওয়াজ ও সংসদীয় বিরোধী দল, যেটি রওশন এরশাদ মার্কা নয়, তারা নাটকের চরিত্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের এই ত্রাহি মধুসূদন অবস্থাটি হৃদয়ঙ্গম করা উচিত। তারা দ্রুত স্বীকার করলে ভালো যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সমস্যা দুই বড় দলের ঐকমত্য মানে স্রেফ একটি আশু ভোট উৎসবের মধ্যেই নিহিত নয়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করলে এবং প্রধান বিরোধী দলের তরফে জ্বালাও-পোড়াও দূরে থাক, গোলাপের পাপড়ি ছিটানোও দেখা যাচ্ছে যথেষ্ট নয়। আসমা জাহাঙ্গীর বলেছেন,‘এখন আমরা সবাই জানি কে পাকিস্তান শাসন করছে (ওয়াশিংটন পোস্ট, ২৮ আগস্ট ২০১৪)।’ ১৬ মাস আগে পাকিস্তান ভোট করেছিল। দুই দল মিলে বিচারক, নির্বাচন কমিশনার এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গড়েও শান্তি মিলল না। এখন উর্দিধারীদের মধ্যস্থতা লাগছে৷
পাকিস্তানে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল একদা এতটাই তিক্ত বিরোধে লিপ্ত ছিল যে তারা কখনো প্রতিষ্ঠান গড়তে দিতে রাজি হয়নি। সেই অবস্থা চলছে এখানেও। তারা গণতন্ত্র বলতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর বুঝে এসেছে এবং ইদানীং কার্যত তাও বিসর্জন দিয়েছে। দুই বড় দলের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠাকেই বলা হয়েছে জাতীয় ঐক্য। কিন্তু সেটা অর্জন করতেও পাকিস্তান এত বেশি সময় নিয়েছে যে দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি করে কোনো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে তারা বাকি রাখেনি। তাই বিরোধ মীমাংসার জন্য কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানই গ্রহণযোগ্য নয়। সেনারাই তাই সেরা সংবিধান রক্ষাকর্তা।
একজন সাহসী ব্যক্তি প্রধান বিচারপতি পদে থাকা সত্ত্বেও ইমরান-কাদরিরা বলছেন, নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগের সুষ্ঠু বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত নওয়াজকে স্বপদে বহাল রেখে সম্ভব নয়। অথচ পাকিস্তানি ইসি বাংলাদেশ কায়দায় নয়, রীতিমতো দ্বিদলীয় স্বচ্ছতায়, সুষ্ঠু সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এটা যখন করার ছিল তখন তারা করেনি। জেনারেলদের ধাওয়া খেয়ে বিদেশে নির্বাসনে গিয়েই তবে বেনজির-নওয়াজ গণতন্ত্র সনদে সই করেছিলেন এবং বেনজির নিহত হওয়ার পরে দুই দল একত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী পাস করেছে। পাকিস্তান এভাবে প্রমাণ করছে যে অত্যন্ত বেশি সময় গণতান্ত্রিক খেলার নিয়ম মানতে অপারগ থাকলে তার কড়া মাশুল দিতে হয়।
প্রেসক্লাবে শাহদীন মালিকের উদ্যোগে ডাকা গুম হওয়া পরিবারের জবানবন্দিতে পাকিস্তানি আমল, বিশেষ করে একাত্তরের এবং তার আগের নিষ্ঠুরতার বিবরণ এসেছে। শহীদ মতিউর ও জোহাদের স্মরণ করেছেন ড. কামাল হোসেন। পাঞ্জাবি শাসক চক্র সংখ্যালঘু হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠকে শাসনে অপকৌশল আরোপ করেছিল। তারা পণ করেছিল, যে করেই হোক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছে গদি ছাড়া যাবে না। রক্তের উত্তরাধিকার না থাকার ঘাটতি পূরণ করেছে কঠিন কায়েমি স্বার্থ। সাতচল্লিশের আগেও একদল লোক ছিল, যাদের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের সঙ্গে দেখা গেছে। তারা ভেবেছে, নতুন রাষ্ট্র হলে হিন্দু জমিদারেরা রিক্ত হবে, চলে যাবে। তাদের সম্পদ ও প্রভাবশালী শূন্যস্থানগুলো মুফতে মিলবে। তারা সংখ্যায় লঘু কিন্তু সুবিধাভোগী, ক্ষমতার সঙ্গে থেকে তারা পাঞ্জাবি সংখ্যালঘুদের সঙ্গে বোল তুলেছে। ‘বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ’কে নিষ্ক্রিয় করতে পাঞ্জাবিরা আমলাতন্ত্রকে কবজাবন্দী করতে পেরেছিল। ঐতিহ্যগতভাবে আমলাতন্ত্র সব সময় শানশওকত ও ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট পছন্দ করে, নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সব সময় নির্বাচনকে যমের মতো ভয় করেছে। সোহরাওয়ার্দীর ওপর আঘাত হানো। কারণ, তাঁর জনপ্রিয় ভিত্তি আছে। তাঁকে সরাও, খয়ের খাঁ বসাও। নির্বাচন লাগবে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পকেট কমিটির মহামারি সাতচল্লিশে স্বাধীনতালাভের পরপরই শাসকগোষ্ঠীর কূটকৌশল স্মরণ করিয়ে দেয়। চৌধুরী খালেকুজ্জামানকে পূর্ববঙ্গে পাঠানো হয়েছিল। তাঁর মিশন ছিল, মুসলিম লীগের বিভিন্ন স্তর থেকে বাঙালির জনপ্রতিনিধি হটাও। পাঞ্জাবিদের পেয়ারের বান্দা বসাও।
কায়েমি স্বার্থান্বেষীরা মূলত সংখ্যালঘু হয়। অথচ তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে শাসন করবে, এটাই ঔপনিবেশিক শাসনের মৌলিক কলা। বাংলাদেশ শাসনে আমরা ভিন্ন কী দেখি? পাঞ্জাবি নীতি ছিল, রাজনৈতিকভাবে দায়িত্বশীল পদগুলোয় বশংবদ আর প্রশাসনের মুখ্য পদগুলোয় অবাঙালি বসাও। বাঙালি হলো বিরোধী দল। ক্ষমতার প্রতিপক্ষ। সুতরাং ওই বশংবদের দল ও অবাঙালি আমলাদের কাজ ছিল বাঙালিদের মধ্যে অনৈক্য ও হানাহানির প্রতিটি সুযোগকে ব্যবহার করা। তারা হাসতে হাসতে নির্বাচনপদ্ধতি বিকৃত করেছিল। মূল কারণ নির্বাচনভীতি, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের জয়ের পরে তা আরও জেঁকে বসল। তাঁবেদার অবাঙালিদের তালুবন্দী মুসলিম লীগ ওই ভোটে মুছে গেল। তাই দুই মাস না যেতেই যুক্তফ্রন্ট সরকার ভাঙা হলো। সুষ্ঠু নির্বাচনভীতির কারণেই গণপরিষদ ভাঙা হয়েছিল। কারণ, চুয়ান্নতে দ্বিকক্ষ সংসদীয় ছাঁচে খসড়া সংবিধান বিল চূড়ান্ত হলো। তখন তারা দেখল, এটা পাস হলে বাঙালিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে নিম্নকক্ষে। তাই পাঞ্জাবিরা সেটা চুয়ান্নর অক্টোবরে ভেঙে দিল। রাজনীতিক দিয়েই গণপরিষদকে চূড়ান্তভাবে অকার্যকর, অপমানিত, অপদস্থ করে তাকে সমাহিত করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সামরিক বাহিনী ছিল পর্দার আড়ালে।
পর্দা সরতেই গোলাম মোহাম্মদ, বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর মতো ভাঁড়দের দেখা গেল। মঞ্চে প্রবেশ উদ্যত ‘নায়কের’ মুখচ্ছবি দর্শক গ্রিন রুমের অলিন্দ থেকেই দেখতে পেলেন। রাজনীতিকেরা যেখানে সম্পূর্ণ অপদার্থ, শুধু ক্ষমতায় থাকার লোভে আত্মমর্যাদা শতভাগ বিসর্জনে প্রস্তুত, সেখানে সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের বাঁচাতে পারেন না। প্রধান বিচারপতি মুনির পাঞ্জাবি ষড়যন্ত্রকেই অভিবাদন জানালেন। এর একটু বাদেই আমরা দেখলাম, মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হচ্ছে। এবং সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে পরোক্ষ ভোটের বিধানসংবলিত দ্বিতীয় গণপরিষদ হলো ১৯৫৫ সালে। এর পর থেকে সত্তরের নির্বাচন পর্যন্ত প্রতিটি সংবিধান সংশোধনী সেনাস্বার্থ রক্ষা সাপেক্ষে করা হয়েছে। তারা এমনভাবেই তাদের ক্ষমতার প্রতিপক্ষকে ঠেকাল যে টানাটানিতে দেশটাই ভেঙে গেল। নির্বাচন ও জনপ্রতিনিধিত্ব অস্বীকার এবং ধ্বংস করার কারণেই বাঙালির ভোটে গড়া পাকিস্তান ভোটের অভাবে (ভাতের অভাবে নয়!) হাড় জিরজির হতে হতে মারা গেল।
পাকিস্তানে আরেকবার পর্দা সরেছে। সেখানে আইয়ুবরূপী জেনারেল রাহিল যেন একই ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো। তারা প্রমাণ রেখে চলছে ইতিহাস থেকে তারা শিক্ষা নেওয়ার জাতি নয়। এই লেখা শুরু করেছিলাম এটা বোঝাতে যে শাসন অনুপযোগী অকার্যকরতা বাংলাদেশে গভীর হচ্ছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, অভিযোগপত্রভুক্তদের মন্ত্রিসভায় অযোগ্য করতে। আর বাংলাদেশে এটিই, এমনকি দণ্ডিত থাকা মন্ত্রী হওয়ার গর্বিত যোগ্যতা হতে পারে। গত মন্ত্রিসভার একজন আদালতেই বলেন দণ্ড সরান, মন্ত্রী হব। অভিযুক্ত, দণ্ডিত ও বিচারাধীন আসামির মধ্যকার বাস্তব পার্থক্য মুছে যাচ্ছে। সরকারি প্রভাব ও নিগড়মুক্ত কোনো গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কার্যকর অস্তিত্ব দ্রুত লোপ পাচ্ছে। শত গুমের গণশুনানিতে কেউ কোনো সরকারি সংস্থাকে সমীহ করে কথা বলেননি। ষাটের দশকে অন্যায্য গ্রেপ্তার ভন্ডুলের কার্যকর অস্ত্র ছিল হেবিয়াস কর্পাস রিট। আজ তা এতটাই অপ্রাসঙ্গিক যে কামাল হোসেন হয়তো তার তুলনামূলক স্মৃতিচারণা অর্থহীন মনে করেন। বরং অনন্য গণসংগীতশিল্পী সায়ানের কণ্ঠে যখন সুর উঠল ‘আল্লাহ তুমি কার’, তখন তা অধিকতর অর্থপূর্ণ হয়ে উঠল। সমবেতদের হৃদয় ছুঁয়ে গেল, তাঁদের চোখ ভিজিয়ে দিল। সম্প্রচার ও গুম নীতি হলো ক্ষমতাসীনদের মনস্তত্ত্বের এক্স-রে রিপোর্ট। এতে তাদের আমলাতন্ত্র তোয়াজ ব্যাধি ধরা পড়েছে। মনে হচ্ছে লুটপাট ও ক্ষমতার অপব্যবহার এবং শাসনব্যবস্থার পদ্ধতিগত বিকৃতকরণের মধ্যে পার্থক্য টানার সময় এসেছে। ২০০২-০৬ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা যখন বছরে গড়ে ৮১২, তখন সেটা ২০০৯-১৩ সালে গড়ে মাত্র ১২৩টিতে নেমে এসেছে। অথচ এখন এক দিনেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দেড় শর বেশি অভিযোগপত্র জন্ম নেওয়ার তুঘলকি নজির তৈরি হচ্ছে।
বিএনপি-আওয়ামী সংঘাত হ্রাস কি শান্তির লক্ষণ? পুলিশের ওপর হামলার সংখ্যাগত তুলনা বিশ্লেষণে ভয়ানক উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে ওঠে। বিএনপির গত আমলে বছরে গড়ে পুলিশ যেখানে ২৮১টি হামলার শিকার হয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগের গত পাঁচ বছরে পুলিশের ওপর গড়ে বছরে ৬৬৫টি হামলা হয়েছে। গত বছর ইতিহাসের সর্বোচ্চ এক হাজার ২৫৭টি হামলা হয়েছে পুলিশের ওপর। শুধু ভোটদান বাক্সের গণতন্ত্র এ রকম চিত্র বদলাবে না। একটা সমাজ রূপান্তরকরণ লাগবে। গাঢ় কৃষ্ণপক্ষের গভীর অমানিশা ভেদ করে এক দিনে ঢাকায় দুটি আশাবাদী হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। গুম আর সম্প্রচার নীতিবিরোধী অর্থবহ নাগরিক সংলাপ হয়েছে। এই নাগরিক সমাজকে অকুণ্ঠ অভিবাদন।
ষাটের দশকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও খান সারোয়ার মুরশিদ নিউ ভেলুজ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। কারণ, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, সমাজ রূপান্তরকরণের জন্য পুরোনা মূল্যবোধে আঘাত হানতে হবে। ড. কামালের অক্সফোর্ড গবেষণাপত্রের ভাষায়, মূল্যবোধ যখন ‘কর্তৃত্ববাদী, ঔপনিবেশিক এবং সামন্ততান্ত্রিক ধারানির্ভর’ হয়, তখন তা দিয়ে সমাজ রূপান্তরকরণ ঘটানো যায় না। বর্তমানে আমরা সেই রুগ্ণ ধারায় হাবুডুবু খাচ্ছি। সবার আগে এটা ছুড়ে ফেলতে হবে। তরুণ প্রজন্মের কাছে নিউ ভেলুজ—যা দুই বড় দলের অপরাজনীতি প্রত্যাখ্যান করবে, তা পুনঃপ্রকাশের উদ্যোগ কামনা করি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments