গণমাধ্যম -প্রেস কমিশন বনাম সম্প্রচার নীতিমালা by শওকত মাহমুদ
জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে
নাগরিকদের মন-মগজে তোলপাড়। এই প্রতিক্রিয়ায় হয়তো ভয় পেয়েছে সরকারও;
যে জন্য তথ্যমন্ত্রী ছাড়া আর কোনো মন্ত্রী এর পক্ষে মুখ খুলছেন না। এমন
সময়ে ভয়ানক সব শর্ত জুড়ে দিয়ে একটি গেজেট করা হয়েছে যে জনগণ একে
‘সম্প্রচার ভীতিমালা’ হিসেবেই ভাবছে। আসলে কী এমন প্রয়োজন পড়ল যে
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের শর্তওয়ালা অংশগুলোর বাস্তবায়নে আইনের আগে
নীতিমালা নাজেল করা হলো!
নীতিমালা না মানলে কী হবে? কয়েক মাসের মধ্যে নাকি তথ্যমন্ত্রী আইন করবেন। স্বাধীনতার পর মিডিয়া এত বছর এমন নীতিমালা ছাড়াই চলল। সম্প্রচার গণমাধ্যম এক যুগ অমন সব দাঁতালো আইন ছাড়া চলল, তা আর কয়েকটা মাস অপেক্ষা করলে কী হতো? একবারে আইন করে রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্টে পাস করিয়ে নেওয়া যেত। মনে হয়, সামনের আন্দোলন সামাল দেওয়ার জন্য কণ্ঠরোধের এই ভীতিকর আয়োজন। সর্বোপরি বিরোধী দল ও জনগণকে পর্দার অন্তরালে নিয়ে ফেলা। গণমাধ্যমের জন্য উপনিষদের মন্ত্রই সরকার অনুসরণ করছে: ‘হিরণ্ময় পাত্রে সত্যেরে আবৃত রাখো’।
ভাব ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বের প্রায় সর্বত্র আন্দোলন হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। বঙ্গ-পাক-ভারত উপমহাদেশে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আন্দোলনের পরিপূরক ছিল মত প্রকাশের অধিকারের আন্দোলন। স্বাধীন বাংলাদেশেও এর ব্যত্যয় তো হয়ইনি, বরং সগৌরবে ধারাবাহিকতাকে উঁচু রেখেছে।
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জন্য বাংলাদেশের একমাত্র প্রেস কমিশনের রিপোর্টটি একটি যুগান্তকারী দলিল। এই দলিল দুষ্প্রাপ্য বলে এর উল্লেখও কম। আজকের তথ্যমন্ত্রী সংবিধানের যে ৩৯ অনুচ্ছেদের ডুগডুগি বাজাচ্ছেন, সে সম্পর্কে প্রেস কমিশন সেই ১৯৮৩ সালেই মত দিয়ে রেখেছে। ভাবতে অবাক লাগে, বিশ্বের নানা দেশ যখন তথ্য অধিকার বা তথ্যের স্বাধীনতা আইন করার চিন্তাও করেনি, আমাদের ওই কমিশন দুর্নীতি রোধে এবং নাগরিক অধিকার প্রশস্তকরণে ওই আইন করার তাগিদ দিয়েছিল। সম্প্রচার নীতিমালা কমিটির সদস্যরা বোধ হয় এসব জানতেন না।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন ওই কমিশনের সদস্য ছিলেন ডাকসাইটে সম্পাদক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা। বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিষয়ে প্রেস কমিশনের পর্যবেক্ষণটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—ভারত বাদে বিশ্বের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার যুক্তিসংগত কারণ হিসেবে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিষয়টি উল্লিখিত নেই। ভারতীয় সংবিধানে এই নিয়ন্ত্রণমূলক বিধানটি ১৯৫১-এর প্রথম সংশোধনী মারফত অন্তর্ভুক্ত হয়। বাংলাদেশের সংবিধান শুরু থেকেই তা ধারণ করে। এই বাধাকে অনেকেই বিরোধিতা করছেন এ জন্য যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিষয়ে অথবা এর সংবেদনশীলতার ব্যাপারে সংবাদপত্র সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধ দেখিয়ে আসছে। এ বিষয়ে এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে যে সংবাদপত্র সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। আমরা মনে করি, সংবাদপত্রকে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবাধে মত প্রকাশ ও পর্যালোচনা করতে দেওয়া উচিত। এটা অনস্বীকার্য, এ ধরনের আলোচনা নানা দৃষ্টিকোণ তুলে ধরে সদর্থক অবদান রাখতে পারে, যা অন্যভাবে জানা সম্ভব নয়। এ-ও মনে রাখা প্রয়োজন যে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ও পররাষ্ট্রনীতি কোনো স্থির বিষয় নয় এবং সংবাদপত্রে এসবের ব্যাপক আলোচনা বরং কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের জন্য সহায়ক।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার একটি শর্ত যে বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়, তা বাংলাদেশের মানুষ কখনো বুঝতে পারেনি বা বোঝার জন্য কোনো দৃষ্টান্তও তৈরি হয়নি। বর্তমান সময়ে দৈনিক ইনকিলাব সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল তথ্যমন্ত্রী বর্ণিত একটি কারণের জন্য। তিনি বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য সাতক্ষীরা নিয়ে প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছিল। কিন্তু অন্য আইনে, অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তি আইনে কর্মটি সারা হয় এবং কয়েকজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়।
জারি করা সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়নে তথ্য মন্ত্রণালয় প্রেস কমিশনের সুপারিশে কান তো দেয়ইনি, বরং সংবিধানের শর্তকে এক ধাপ ডিঙিয়ে গেছে। বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ব্যাখ্যায় নীতিমালা বলছে, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের অনুকূলে এমন ধরনের প্রচারণা, যা বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে বিরোধের কোনো একটি বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে, এমন দৃশ্য ও বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। এটি কেমন কথা? মেলে না তো ওই শর্তের সঙ্গে। আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যদি হিম্মত থাকে, প্রকাশ করুক বন্ধু ও শত্রু রাষ্ট্রের তালিকা। তা না হলে মিডিয়া বুঝবে কী করে?
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ বলছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হলো।
এর প্রতিটি শর্ত সম্পর্কে প্রেস কমিশনের রিপোর্ট বিশদ আলোচনা করেছে এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা যেন ওসব শর্তের বেড়িতে আটকা না পড়ে, সে কথাও জোর দিয়ে বলা হয়েছে। যুক্তিসংগত বাধানিষেধ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে প্রদত্ত লোপেজ কমিশনের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে আতাউর কমিশন বলছে—‘স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বশীলতার ধারণাটি এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে দায়িত্বশীলতার ওপর গুরুত্বটি কার্যত অধিকারের লঙ্ঘনে পৌঁছে যায়।’ সবার উচিত রোগের প্রতিকার অনুসন্ধান, রোগীকে মেরে ফেলা নয়। আমেরিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠা-পুরুষ জেমস ম্যাডিসন, বিল অব রাইটস, যাতে কংগ্রেসকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাবিরোধী আইন করতে বারণ করা হয়, উত্থাপনকালে এই অধিকারের বিধিনিষেধ সম্পর্কে বলেছিলেন, যদি কোনো গাছের আগাছা কাটতে গিয়ে ফলদায়ক ডালটি কাটা পড়ে, তবে ক্ষতিকারক আগাছা বাড়তে দেওয়া ভালো। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘আই উড র্যাদার প্রেফার এ কমপ্লিটলি ফ্রি প্রেস উইথ অল দ্য ডেঞ্জারস ইনভলবড ইন দ্য রং ইউজ অব দ্য ফ্রিডম দ্যান এ সাপ্রেসড অর রেগুলেটেড প্রেস।’ (একটি দমিত বা নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমের চেয়ে আমি বরং বেশি পছন্দ করব অপব্যবহারের সকল বিপদসহই একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন সংবাদমাধ্যম।)
ভারতীয় সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে ছয়টি মূল স্বাধীনতার কথা আছে। প্রথমটি হলো ভাব ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা। ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’—এ দুটি শব্দই ওই সংবিধানে নেই। কিন্তু ভারতের সর্বোচ্চ আদালত নানা রায়ে এই অধিকারের ব্যাখ্যায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি টেনে এনে তা নিশ্চিত করেছেন। ভারতীয় সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাষ সি. ক্যাশপ তাঁর আমাদের সংবিধান বইয়েউল্লেখ করেছেন—‘সামাজিক ও রাজনৈতিক মতবিনিময়ের প্রধান শর্তই হলো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। আদালতের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তুলে ধরা এবং সংবিধানের ঘোষণা অস্বীকার করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থী যেসব আইন ও প্রশাসনিক নির্দেশ থাকবে, সেগুলো বাতিল করা (এক্সপ্রেস নিউজ পেপার্স প্রা. লি. বনাম কেন্দ্র AIR 1958 SC 896)। ফলে সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ চালু করা অথবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংবাদ ও মতামত প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি, বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলে বিবেচিত হয় (বীরেন্দ্র বনাম পাঞ্জাব AIR 1958 SC 896)।’
বাংলাদেশ প্রেস কমিশন রাষ্ট্রদ্রোহ বা জনশৃঙ্খলা সম্পর্কে এই মতামত জানিয়েছে যে রাষ্ট্র ও সরকারকে এক করে দেখা ঠিক হবে না। সরকারের সমালোচনা মানে রাষ্ট্রের সমালোচনা নয়। দণ্ডবিধির ১২৪(ক)–এর অপব্যবহারে অতীতে বহু সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়েছে। এ ধারাটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বড় প্রতিবন্ধক। এটি সর্বমহলে স্বীকৃত যে বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রতিটি বিরোধী দলের অধিকার রয়েছে সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরার। রিপোর্টের সুপারিশ হলো, দণ্ডবিধির ১২৪(ক) এমনভাবে সংশোধন করা উচিত, যাতে সরকারের সমালোচনা রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের আওতায় না পড়ে, যদি না সহিংসতা ও জনবিশৃঙ্খলা উসকে দেওয়া হয়।
বর্তমান সরকারের জারি করা সম্প্রচার নীতিমালায় (ভীতি) সরকারের সমালোচনার কণ্ঠরোধই প্রাধান্য পেয়েছে।
২০১২ সালের ১৫ মে হাইকোর্ট বরেণ্য ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল উপন্যাসটি রায়ের আদলে লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অমন ঘটনা এ মাটিতে এই প্রথম। ভাব প্রকাশের অন্যতম বাহন সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্যও। সাংবাদিকতা সত্য তুলে ধরে, আর সাহিত্য এগোয় সমান্তরাল সত্য রচনার মধ্য দিয়ে।
আশা করি, সরকার পুরো নীতিমালা বাতিল করে রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে আলোকিত নীতিমালা প্রণয়নের আয়োজন করবে। তবে বিচার বিভাগকে সংসদের তাঁবে নিয়ে আসার কতৃর্ত্বপরায়ণ উদ্যোগে সে আশা উবে যাচ্ছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘সত্য নির্ধারণ মন্ত্রণালয়’ হয়ে ওঠার ভয়ানক ক্ষমতা গণতন্ত্রকে যে আরও বিপর্যস্ত করবে, এতে সন্দেহ নেই।
শওকত মাহমুদ: সাংবাদিক। সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন।
নীতিমালা না মানলে কী হবে? কয়েক মাসের মধ্যে নাকি তথ্যমন্ত্রী আইন করবেন। স্বাধীনতার পর মিডিয়া এত বছর এমন নীতিমালা ছাড়াই চলল। সম্প্রচার গণমাধ্যম এক যুগ অমন সব দাঁতালো আইন ছাড়া চলল, তা আর কয়েকটা মাস অপেক্ষা করলে কী হতো? একবারে আইন করে রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্টে পাস করিয়ে নেওয়া যেত। মনে হয়, সামনের আন্দোলন সামাল দেওয়ার জন্য কণ্ঠরোধের এই ভীতিকর আয়োজন। সর্বোপরি বিরোধী দল ও জনগণকে পর্দার অন্তরালে নিয়ে ফেলা। গণমাধ্যমের জন্য উপনিষদের মন্ত্রই সরকার অনুসরণ করছে: ‘হিরণ্ময় পাত্রে সত্যেরে আবৃত রাখো’।
ভাব ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বের প্রায় সর্বত্র আন্দোলন হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। বঙ্গ-পাক-ভারত উপমহাদেশে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আন্দোলনের পরিপূরক ছিল মত প্রকাশের অধিকারের আন্দোলন। স্বাধীন বাংলাদেশেও এর ব্যত্যয় তো হয়ইনি, বরং সগৌরবে ধারাবাহিকতাকে উঁচু রেখেছে।
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জন্য বাংলাদেশের একমাত্র প্রেস কমিশনের রিপোর্টটি একটি যুগান্তকারী দলিল। এই দলিল দুষ্প্রাপ্য বলে এর উল্লেখও কম। আজকের তথ্যমন্ত্রী সংবিধানের যে ৩৯ অনুচ্ছেদের ডুগডুগি বাজাচ্ছেন, সে সম্পর্কে প্রেস কমিশন সেই ১৯৮৩ সালেই মত দিয়ে রেখেছে। ভাবতে অবাক লাগে, বিশ্বের নানা দেশ যখন তথ্য অধিকার বা তথ্যের স্বাধীনতা আইন করার চিন্তাও করেনি, আমাদের ওই কমিশন দুর্নীতি রোধে এবং নাগরিক অধিকার প্রশস্তকরণে ওই আইন করার তাগিদ দিয়েছিল। সম্প্রচার নীতিমালা কমিটির সদস্যরা বোধ হয় এসব জানতেন না।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন ওই কমিশনের সদস্য ছিলেন ডাকসাইটে সম্পাদক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা। বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিষয়ে প্রেস কমিশনের পর্যবেক্ষণটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—ভারত বাদে বিশ্বের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার যুক্তিসংগত কারণ হিসেবে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিষয়টি উল্লিখিত নেই। ভারতীয় সংবিধানে এই নিয়ন্ত্রণমূলক বিধানটি ১৯৫১-এর প্রথম সংশোধনী মারফত অন্তর্ভুক্ত হয়। বাংলাদেশের সংবিধান শুরু থেকেই তা ধারণ করে। এই বাধাকে অনেকেই বিরোধিতা করছেন এ জন্য যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিষয়ে অথবা এর সংবেদনশীলতার ব্যাপারে সংবাদপত্র সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধ দেখিয়ে আসছে। এ বিষয়ে এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে যে সংবাদপত্র সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। আমরা মনে করি, সংবাদপত্রকে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবাধে মত প্রকাশ ও পর্যালোচনা করতে দেওয়া উচিত। এটা অনস্বীকার্য, এ ধরনের আলোচনা নানা দৃষ্টিকোণ তুলে ধরে সদর্থক অবদান রাখতে পারে, যা অন্যভাবে জানা সম্ভব নয়। এ-ও মনে রাখা প্রয়োজন যে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ও পররাষ্ট্রনীতি কোনো স্থির বিষয় নয় এবং সংবাদপত্রে এসবের ব্যাপক আলোচনা বরং কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের জন্য সহায়ক।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার একটি শর্ত যে বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়, তা বাংলাদেশের মানুষ কখনো বুঝতে পারেনি বা বোঝার জন্য কোনো দৃষ্টান্তও তৈরি হয়নি। বর্তমান সময়ে দৈনিক ইনকিলাব সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল তথ্যমন্ত্রী বর্ণিত একটি কারণের জন্য। তিনি বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য সাতক্ষীরা নিয়ে প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছিল। কিন্তু অন্য আইনে, অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তি আইনে কর্মটি সারা হয় এবং কয়েকজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়।
জারি করা সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়নে তথ্য মন্ত্রণালয় প্রেস কমিশনের সুপারিশে কান তো দেয়ইনি, বরং সংবিধানের শর্তকে এক ধাপ ডিঙিয়ে গেছে। বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ব্যাখ্যায় নীতিমালা বলছে, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের অনুকূলে এমন ধরনের প্রচারণা, যা বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে বিরোধের কোনো একটি বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে, এমন দৃশ্য ও বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। এটি কেমন কথা? মেলে না তো ওই শর্তের সঙ্গে। আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যদি হিম্মত থাকে, প্রকাশ করুক বন্ধু ও শত্রু রাষ্ট্রের তালিকা। তা না হলে মিডিয়া বুঝবে কী করে?
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ বলছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হলো।
এর প্রতিটি শর্ত সম্পর্কে প্রেস কমিশনের রিপোর্ট বিশদ আলোচনা করেছে এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা যেন ওসব শর্তের বেড়িতে আটকা না পড়ে, সে কথাও জোর দিয়ে বলা হয়েছে। যুক্তিসংগত বাধানিষেধ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে প্রদত্ত লোপেজ কমিশনের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে আতাউর কমিশন বলছে—‘স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বশীলতার ধারণাটি এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে দায়িত্বশীলতার ওপর গুরুত্বটি কার্যত অধিকারের লঙ্ঘনে পৌঁছে যায়।’ সবার উচিত রোগের প্রতিকার অনুসন্ধান, রোগীকে মেরে ফেলা নয়। আমেরিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠা-পুরুষ জেমস ম্যাডিসন, বিল অব রাইটস, যাতে কংগ্রেসকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাবিরোধী আইন করতে বারণ করা হয়, উত্থাপনকালে এই অধিকারের বিধিনিষেধ সম্পর্কে বলেছিলেন, যদি কোনো গাছের আগাছা কাটতে গিয়ে ফলদায়ক ডালটি কাটা পড়ে, তবে ক্ষতিকারক আগাছা বাড়তে দেওয়া ভালো। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘আই উড র্যাদার প্রেফার এ কমপ্লিটলি ফ্রি প্রেস উইথ অল দ্য ডেঞ্জারস ইনভলবড ইন দ্য রং ইউজ অব দ্য ফ্রিডম দ্যান এ সাপ্রেসড অর রেগুলেটেড প্রেস।’ (একটি দমিত বা নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমের চেয়ে আমি বরং বেশি পছন্দ করব অপব্যবহারের সকল বিপদসহই একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন সংবাদমাধ্যম।)
ভারতীয় সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে ছয়টি মূল স্বাধীনতার কথা আছে। প্রথমটি হলো ভাব ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা। ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’—এ দুটি শব্দই ওই সংবিধানে নেই। কিন্তু ভারতের সর্বোচ্চ আদালত নানা রায়ে এই অধিকারের ব্যাখ্যায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি টেনে এনে তা নিশ্চিত করেছেন। ভারতীয় সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাষ সি. ক্যাশপ তাঁর আমাদের সংবিধান বইয়েউল্লেখ করেছেন—‘সামাজিক ও রাজনৈতিক মতবিনিময়ের প্রধান শর্তই হলো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। আদালতের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তুলে ধরা এবং সংবিধানের ঘোষণা অস্বীকার করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থী যেসব আইন ও প্রশাসনিক নির্দেশ থাকবে, সেগুলো বাতিল করা (এক্সপ্রেস নিউজ পেপার্স প্রা. লি. বনাম কেন্দ্র AIR 1958 SC 896)। ফলে সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ চালু করা অথবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংবাদ ও মতামত প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি, বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলে বিবেচিত হয় (বীরেন্দ্র বনাম পাঞ্জাব AIR 1958 SC 896)।’
বাংলাদেশ প্রেস কমিশন রাষ্ট্রদ্রোহ বা জনশৃঙ্খলা সম্পর্কে এই মতামত জানিয়েছে যে রাষ্ট্র ও সরকারকে এক করে দেখা ঠিক হবে না। সরকারের সমালোচনা মানে রাষ্ট্রের সমালোচনা নয়। দণ্ডবিধির ১২৪(ক)–এর অপব্যবহারে অতীতে বহু সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়েছে। এ ধারাটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বড় প্রতিবন্ধক। এটি সর্বমহলে স্বীকৃত যে বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রতিটি বিরোধী দলের অধিকার রয়েছে সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরার। রিপোর্টের সুপারিশ হলো, দণ্ডবিধির ১২৪(ক) এমনভাবে সংশোধন করা উচিত, যাতে সরকারের সমালোচনা রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের আওতায় না পড়ে, যদি না সহিংসতা ও জনবিশৃঙ্খলা উসকে দেওয়া হয়।
বর্তমান সরকারের জারি করা সম্প্রচার নীতিমালায় (ভীতি) সরকারের সমালোচনার কণ্ঠরোধই প্রাধান্য পেয়েছে।
২০১২ সালের ১৫ মে হাইকোর্ট বরেণ্য ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল উপন্যাসটি রায়ের আদলে লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অমন ঘটনা এ মাটিতে এই প্রথম। ভাব প্রকাশের অন্যতম বাহন সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্যও। সাংবাদিকতা সত্য তুলে ধরে, আর সাহিত্য এগোয় সমান্তরাল সত্য রচনার মধ্য দিয়ে।
আশা করি, সরকার পুরো নীতিমালা বাতিল করে রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে আলোকিত নীতিমালা প্রণয়নের আয়োজন করবে। তবে বিচার বিভাগকে সংসদের তাঁবে নিয়ে আসার কতৃর্ত্বপরায়ণ উদ্যোগে সে আশা উবে যাচ্ছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘সত্য নির্ধারণ মন্ত্রণালয়’ হয়ে ওঠার ভয়ানক ক্ষমতা গণতন্ত্রকে যে আরও বিপর্যস্ত করবে, এতে সন্দেহ নেই।
শওকত মাহমুদ: সাংবাদিক। সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন।
No comments