কখন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে বলা যায় না -সাক্ষাৎকারে: আকবর আলি খান by মশিউল আলম
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান
সরকারের সচিব ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন
করেছেন।অবসরজীবনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান ও গ্রন্থ রচনায়
নিয়োজিত আছেন।
প্রথম আলো :আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য সরকার গঠন করার পর ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এই সরকারের দেশ পরিচালনা সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আকবর আলি খান :সামগ্রিকভাবে গতানুগতিক ধারায়ই সরকার চলছে। এটা যে একটা নতুন নির্বাচিত সরকার, তা বোঝার কোনো উপায় নেই। তবু যদি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে বলা যায়, নির্বাচনের পরে কিছু কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
প্রথম আলো :যেমন?
আকবর আলি খান :যেমন, দেশপ্রেমিক মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নির্বাচনের আগে উত্থাপন করা যাচ্ছিল না। তদন্ত হওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু নতুন মন্ত্রিসভায় পুরোনো অনেক মন্ত্রী বাদ পড়ে যান এবং তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত এখন চলছে বলে দেখা যাচ্ছে। আরেকটি পরিবর্তন হলো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধের মাত্রা বেড়ে গেছে এবং এসবের সঙ্গে সরকারি দলের সম্পৃক্ততা সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। মন্ত্রিসভা পরিবর্তনের মাধ্যমে কিছু আশার ইঙ্গিত এসেছিল, কিন্তু জনগণ আইনশৃঙ্খলার অবনতির ব্যাপারে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও হতাশ হয়ে পড়ছে।
প্রথম আলো :কিন্তু সরকারকে তো উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে না। তারা বলছে, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া আইনশৃঙ্খলার তেমন কোনো অবনতি ঘটেনি।
আকবর আলি খান :আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারে সরকার যে কিছুই করছে না তা নয়। যেমন, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সেটা আদালত কিংবা জনগণের কাছে যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। এই পরিস্থিতির যদি পরিবর্তন না করা যায় এবং দেশের আইনশৃঙ্খলার যদি ক্রম-অবনতি ঘটতে থাকে, তাহলে সেটা সরকারের জন্যও ভালো হবে না, দেশের জন্যও ভালো হবে না।
প্রথম আলো :সাধারণত দেখা যায়, কোনো মন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যখন দায়িত্বরত থাকেন, তখন তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আমলে নেওয়া হয় না। তাঁরা যখন দায়িত্ব থেকে বিদায় নেন, কেবল তখনই তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত হয়। এখনো কি সেটাই ঘটছে না?
আকবর আলি খান :যেসব মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত এখন হচ্ছে, তাঁরা মন্ত্রীর পদে বহাল না থাকলেও কিন্তু ক্ষমতাবলয়ের একদম বাইরে চলে যাননি। তাঁরা এখনো ক্ষমতাসীন দলেরই নেতা। তাঁদের কেউ সাংসদ, কেউ বা কোনো সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, এ রকম বিভিন্ন পদে তাঁরা আছেন। সুতরাং এটা বলা যাচ্ছে না যে তাঁরা ক্ষমতার একদম বাইরে যাওয়ার পরে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে।
প্রথম আলো :আপনি কি মনে করেন, তাঁদের শাস্তি হবে?
আকবর আলি খান :তদন্তের ফল শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে আমরা তা জানি না। কিন্তু তদন্ত যে হচ্ছে, সেটাও একটা আশার লক্ষণ। মনে হয়, নির্বাচনের আগে সরকার এসব বিষয়ে যে অবস্থানে ছিল, সেটার হয়তো পরিবর্তন হয়েছে। সাবেক মন্ত্রীদের দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে সরকারের কোনো কোনো মহলে উৎসাহ দেখা যাচ্ছে, যাতে দুর্নীতি কমে আসে। তবে এটা কতটুকু স্থায়ী হবে এবং এর ফল কী হবে, সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই। কারণ, ফল পাওয়ার জন্য দরকার আদালতের মাধ্যমে বিচার নিষ্পন্ন করা। কিন্তু এ দেশে আদালতে দীর্ঘসূত্রতা সুবিদিত; সেখানে অতি দ্রুত কোনো বিচার হবে কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।
প্রথম আলো :কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের গড়িমসির ঝোঁক লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন, মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য বিদেশিদের সম্মাননা ক্রেস্টের সোনা-রুপা জালিয়াতির ঘটনার তদন্ত আর এগোচ্ছে না। এর মধ্যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করলেন, ক্রেস্টে সোনা কতটুকু দেওয়া হয়েছে তা বড় ব্যাপার নয়, সম্মাননা যে দেওয়া হয়েছে, সেটাই বড় ব্যাপার...
আকবর আলি খান :তবু সরকার স্বীকার করেছে যে এখানে প্রতারণা হয়েছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন এ ব্যাপারে তদন্ত করছে। এটা আশার লক্ষণ। এ ধরনের পরিস্থিতি কয়েক বছর আগে হয়তো সম্ভব ছিল না। আমি বলছি না যে সমস্যার একেবারে সমাধান হয়ে গেছে, বলতে চাইছি যে কিছু আশার আলো হয়তো দেখা যাচ্ছে।
প্রথম আলো :আপনি বললেন, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সম্পৃক্ততা সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু অপহরণ ও খুনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের সম্পৃক্ততার কথাও জানা যাচ্ছে। পুলিশের গ্রেপ্তার–বাণিজ্য, গ্রেপ্তারের পর টাকার দাবিতে পিটিয়ে মেরে ফেলা ইত্যাদি অভিযোগও বেড়ে যাচ্ছে। এগুলো তো সরকারের শাসনপ্রক্রিয়াকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে।
আকবর আলি খান :সে জন্য আমিও দেশের সাধারণ মানুষের মতোই উদ্বিগ্ন। কারণ, এই পরিস্থিতি যদি দ্রুত পরিবর্তন করা না হয়, তাহলে আমরা এমন পরিস্থিতির দিকে চলে যাব, যেখানে পরিবর্তন করা অত্যন্ত শক্ত হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর গুরুত্ব দিয়ে সরকারের অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
প্রথম আলো :আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও সরকারের রাষ্ট্রপরিচালনায় কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পেছনে কি দেশের গণতন্ত্রহীন পরিবেশের কোনো সম্পর্ক থেকে থাকতে পারে? কেউ কেউ বলছেন, যেহেতু এই সরকার জনগণের রায় নিয়ে আসেনি, তাই এর দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহির বোধে ঘাটতি রয়েছে। আপনি কী মনে করেন?
আকবর আলি খান :দায়িত্বশীল সরকার থাকলে এসব ব্যাপারে নিশ্চয়ই আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতো। সঠিকভাবে নির্বাচিত সরকার না থাকলে এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে সেটা দেখা দেবে কি দেবে না, সেটা নির্ভর করে নেতৃত্বের ওপরে। নেতৃত্ব অন্তত দুর্নীতির ব্যাপারে একটা গঠনমূলক মনোভাব দেখিয়েছেন, সে ধরনের মনোভাব যদি আইনশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রপরিচালনার অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা যায়, তাহলে কিছু ফল পাওয়া যেতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি, তাতে খুব একটা আশার কিছু আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
প্রথম আলো :অর্থনীতির ক্ষেত্রে সরকারের কর্মসম্পাদন কতটা সহায়ক হচ্ছে? বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ—এগুলোর ক্ষেত্রে সরকারের অবদান কী?
আকবর আলি খান :অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের কিছু সহায়ক ভূমিকা থাকতে পারে, কিন্তু সরকারই এখানে প্রধান নিয়ামক নয়। যদি হতো, তাহলে অতি সম্প্রতি আমরা যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে এসেছি, সেখানে প্রবৃদ্ধি অনেক কমে যেত। কিন্তু তা ঘটেনি। প্রবৃদ্ধি না কমার কারণ হলো, সরকার যত দুর্বল হচ্ছে, বেসরকারি খাত তত শক্তিশালী হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি মূলত বেসরকারি খাতের এবং আমি মনে করি, এটা এ দেশের অশিক্ষিত মানুষের অবদান। বাংলাদেশের কৃষকেরা কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন। অদক্ষ শ্রমিকেরা বিদেশে কাজ করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন। পোশাকশিল্পের অশিক্ষিত নারী শ্রমিকেরা বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আনছেন এবং ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী অজস্র অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত নারী-পুরুষ অর্থনীতি সচল রেখেছেন। সুতরাং যদিও সরকারের অনেক ব্যর্থতা আছে, তা সত্ত্বে আমাদের এসব অশিক্ষিত সৃজনশীল মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে দেশের অর্থনীতির চাকা চালু রয়েছে।
প্রথম আলো :অর্থাৎ সরকারের ব্যর্থতা পুষিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের সৃজনশীল কর্মোদ্যমের কারণে?
আকবর আলি খান :সাধারণত দেখা গেছে, নতুন সরকার এলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে। কিন্তু বর্তমানে তা হচ্ছে না। প্রবৃদ্ধি পাঁচ-ছয় শতাংশের মধ্যেই আটকে আছে। সরকার বলেছিল, তারা প্রবৃদ্ধি আট শতাংশে উন্নীত করবে, কিন্তু তা করতে পারেনি এবং কবে করতে পারবে তার নিশ্চয়তা নেই। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে সুশাসন দরকার।
প্রথম আলো :আপনি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে বর্ণনা করবেন? সেনাশাসন কিংবা জরুরি অবস্থা চলছে না; একটা নির্বাচিত সরকারই ক্ষমতায় আছে। কিন্তু দেশের পরিবেশ কি গণতান্ত্রিক?
আকবর আলি খান :বাংলাদেশের মূল সমস্যা হলো, সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সংখ্যা খুবই কম এবং তাদের ভূমিকা খুবই সীমিত। যে দুটি বড় গোষ্ঠী রাজনীতিতে কাজ করছে, তারা কেউই অতীতে নিষ্ঠার সঙ্গে গণতন্ত্র চর্চা করেনি। গণতন্ত্রের প্রতি তাদের কারোরই কোনো অঙ্গীকার নেই। রাজনীতি এখন একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি যে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে, সেটি অতীতের খারাপ নির্বাচনগুলোকে হার মানিয়ে দিয়েছে। এই প্রথমবার সংসদের ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। এটা আইনসম্মত হতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্রের যা নির্যাস, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এটা গণতান্ত্রিক নয়।
প্রথম আলো :কিন্তু কোনো রাজনৈতিক প্রতিরোধ তো নেই। প্রধান বিরোধী দলসহ সবাই যেন এটা মেনেই নিয়েছে। এরশাদের স্বৈরশাসনকালেও তো এমন প্রতিরোধহীন পরিবেশ দেখা যায়নি।
আকবর আলি খান :বাংলাদেশের মানুষ সব সময় গণতন্ত্রকে সমর্থন করেছে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। কাজেই আমার ধারণা, এ ধরনের নির্বাচন বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করার মতো রাজনৈতিক শক্তি সোচ্চার হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের আচরণের মধ্যে বড় ধরনের কোনো তফাত নেই। এ ছাড়া বিরোধী দল এখন একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, বিশেষত বিএনপির নেতারা অত্যন্ত প্রবীণ। তাঁরা আর বেশি দিন দলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। তরুণ নেতারাও সুসংগঠিত ও সুসংহত নন। সব মিলিয়ে নির্বাচনের পরে তাদের আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ায় তাদের আন্দোলন করার ক্ষমতার বিশ্বাসযোগ্যতাও কমে গেছে। তা ছাড়া অতীতে, সামরিক স্বৈরশাসনের আমলে যা ঘটেছে, এখনো তা ঘটবে এমন আশা করা ঠিক হবে না। কিন্তু এই গণতন্ত্রহীন পরিবেশ নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা ক্ষোভ আছে। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কখন কীভাবে ঘটবে, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের অনুপস্থিতি মিলিয়ে দেশে একটা সংকটময় পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সব দলের অংশগ্রহণে একটা গণতান্ত্রিক নির্বাচন হওয়া উচিত।
প্রথম আলো :আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আকবর আলি খান :ধন্যবাদ।
No comments