আচরণে সত্যি সচেতন হলে by সাহস রতন
সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষকে প্রয়োজন ও আত্মরক্ষার তাগিদে দলগতভাবে চলাফেরা এবং বসবাস করতে হচ্ছে যার সর্বশেষ ফলাফল হলো আজকের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। যেহেতু ব্যক্তি মানুষ নিয়েই পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাই ব্যক্তির সচেতনতা ছাড়া উন্নত সমাজ কোনভাবেই আশা করা যায় না। অন্যভাবে বললে, সচেতন ব্যক্তিরাই পারে উন্নত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। দুর্নীতিমুক্ত, স্বনির্ভর ও উন্নত সমাজ গড়তে হলে প্রথমেই রাষ্ট্রের প্রধান সম্পদ, তার জনগণকে, সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। জনগণের ‘কনশাসনেস লেভেল’ একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনের নানাবিধ সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো তার অসচেতন জনগোষ্ঠী। অনেকেই আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন তবে বাস্তব কিছু উদাহরণ উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
প্রথমেই নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কয়েকটি উদাহরণ দিই। বেশ কিছু দিন আগে সান্ধ্যকালীন আড্ডা থেকে বাসায় ফিরছি। রাত ন’টার মতো হবে। গাড়ি ড্রাইভ করে গ্রীন রোড-পান্থপথ সিগন্যাল থেকে ডানে মোড় দিয়ে সোনারগাঁও সিগন্যালের দিকে এগোচ্ছি। এর মধ্যে হঠাৎ পেছন থেকে ‘ধর ধর’ চিৎকারের শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একজন ট্রাফিক পুলিশ; ‘ওই ছিনতাইকারী- ধর ধর’ বলে চিৎকার করে একজনকে পেছন থেকে ধাওয়া করছে। আর যার উদ্দেশ্যে বলা, সেই অল্পবয়সী ছেলেটি, কখনও রাস্তার মাঝের ডিভাইডারের উপর দিয়ে, কখনও বা চলতে থাকা গাড়ির ফাঁক গলে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করছে। ফলে উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসতে থাকা পথচারীর মুখোমুখি হচ্ছে। পুরো দৃশ্যটি ঘটলো আমার মতো আরও অনেকের চোখের সামনে কিন্তু আশ্চর্য আমরা কেউই ছিনতাইকারীটিকে আটকাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করিনি। ওকে জাপটে ধরারও প্রয়োজন ছিল না, শুধু আলতো একটা ল্যাং দিলেই ছিটকে পড়তো রাস্তায়। আর পেছন থেকে ধেয়ে আসা পুলিশটি অনায়াসে তাকে ধরতে পারতো। এটুকু দায়িত্ব সচেতন না হলো কিভাবে চলবে! আমার প্রসঙ্গ ‘সচেতন ব্যক্তি মানেই উন্নত সমাজ।’ আমি মনে করি ব্যক্তিকে সচেতন করে গড়ে তুলতে না পারলে আমাদের জাতীয় জীবনে ভাল কোন কিছুই ঘটবে না।
তেলের দাম বেড়েছে কিন্তু আগেই বাস ভাড়া দূরত্বের তুলনায় বেশি হয়ে আছে বলে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাসভাড়া বাড়ানো যাবে না। তারপরও কন্ডাক্টর ৫ টাকা বেশি বাড়া চাইছে এবং বেশির ভাগ যাত্রীই দু’একবার গ্যাঁ-গোঁ করে তা দিয়েও দিচ্ছে। কেউ একজন বেঁকে বসলো ন্যায্য কারণেই। তার কথা হলো- ‘খবরের কাগজে পড়েছি, টিভিতে নিউজ দেখেছি, ভাড়া বাড়ানো যাবে না, তারপরও বেশি বাড়া চাও কেন?’ উত্তরে কন্ডাক্টরের জবাব- ‘আফনে গিয়া মালিকরে জিগান। মালিক আমারে কইয়া দিছে ৫ টাকা বেশি নিতে, আমি কম নিবার পারুম না।’ মালিক-শ্রমিক এ চক্রটি সুযোগ পেলেই যে কারণে বা অকারণে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে, এটি তো আর কারও অজানা নয়। তারপরও একজন যাত্রী এটির প্রতিবাদ করছে দেখেও বাকিরা চুপ মেরে থাকছে। কখনও এমনও হয়, পাশের যাত্রী বলে ওঠে- ‘আরে ভাই দিয়া দেন তো, খামোখা ঝামেলা করে কি হবে? সবাই তো দিয়ে দিচ্ছে দেখেন না? আপনি একা কি করবেন। বেশি বাড়াবাড়ি করলে হয়তো গাড়ি সাইড করে আপনাকে নামিয়েই দিবে।’ ভেবে দেখুন তো একবার, আমরা দিনের পর দিন এভাবেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে নিজের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছি না? বাসে ত্রিশের অধিক যাত্রী থাকার পরও মাত্র একজন কন্ডাক্টরের অন্যায় আবদারের কাছে নতি স্বীকার করছে সবাই। এভাবে চললে কোনদিনই এসব অন্যায়-অবিচার বন্ধ হবে না। কিন্তু এমন যদি হতো, পাঁচ টাকা বেশি চাওয়ার পর বেশির ভাগ যাত্রীই সেটি না দিয়ে প্রতিবাদ করছে, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে এমনটি এত সহজে ঘটতো না। আমরা কখনও চেষ্টা করেও দেখিনি, তাই না?
ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কে সারা বছরই খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। ওয়াসার ড্রেনেজ ডিভিশন আন্ডারগ্রাইন্ড সুয়্যারেজ পাইপ বসানের কাজ শেষ করে যাওয়ার পর মিউনিসিপাল করপোরেশন রাস্তার উপরের অংশের বিটুমিনাস কার্পেটিং কাজ সম্পন্ন করবে। এর মাস খানেক পর টেলিফোন কোম্পানী আসবে নতুন ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ লাইনের কাজ করার জন্য। যার ফলস্বরূপ আবারও কেবলই মাত্র নির্মিত রাস্তাটি কাটা হবে। টেলিফোন কোম্পানির কাজ শেষ হবার পর মিউনিসিপাল করপোরেশন আবার রাস্তাটি মেরামত করবে এবং তারও ক’মাস পর আসবে তিতাস গ্যাস কোম্পানি গ্যাস লাইনের কাজ করার জন্য। সমন্বয়হীনতার কথা বলে জনগণ প্রদত্ত ট্যাক্সের টাকা লুটপাট করে এসব দুর্নীতি দিনের আলোয় আমাদের চোখের সামনে ঘটছে বছরের পর বছর। এ রাস্তাটি দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ, আমি-আপনি আসা-যাওয়া করছি। প্রত্যেকে নিজেদের অনেক সচেতন হিসেবে ভাবছি। কিন্তু কোন দিন একজনও কি জিজ্ঞেস করেছি- কি ব্যাপার? পনেরো দিন আগেই না রাস্তাটি মেরামত করা হলো, আবার কেন এটি কাটাকাটি হচ্ছে? প্রথমবার কাটার সময় এক সঙ্গে সব কাজ শেষ হলো না কেন? আমার বিশ্বাস, রাস্তায় চলমান একশ’ জন পথচারীও যদি দৈনিক এ প্রতিবাদটি করতো তাহলে এ অন্যায়টি অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যেতো। কেন সবগুলো কাজ একসঙ্গে হলো না? কর্মরত শ্রমিক কিংবা ঠিকাদার যেই হোক না কেন, প্রতিনিয়ত প্রশ্নের মুখোমুখি হলে এতসব অন্যায়-অবিচার অনায়াসে এভাবে চালাতে পারতো না।
অনেকগুলো বাস্তব উদাহরণের পর এবার একটা অন্যরকম দৃশ্য কল্পনা করা যাক। মি. মফিজ, সামান্য খুচরা ব্যবসায়ী তবে তিনি একজন নিয়মিত করদাতা। তো তার একটি সমস্যা নিয়ে পার্শ্ববর্তী থানায় গেলেন জিডি করতে। থানার অভ্যর্থনা কক্ষে উপস্থিত হতেই ডিউটিরত অফিসারটি অত্যন্ত সুন্দর করে সালাম দিয়ে স্বাগত জানিয়ে বললো- স্যার কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি? -আমি এসেছি একটা জিডি করতে। আমার বাসার পাশের মাঠে গত দু’দিন ধরে রাতভর উচ্চস্বরে মাইক বাজতেছে। পুরো এলাকার মানুষজন বিশেষ করে বয়স্করা ভীষণ বিরক্ত। অনেকেই এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, শব্দ দূষণের ফলে পর্যাপ্ত ঘুমুতে না পারার কারণে। এ বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখবেন? -স্যার, আপনি এখানটায় বসুন। আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। আপনার নাম ঠিকানা কিছুই প্রয়োজন নেই, আপনি শুধু যেখানটায় এমনটা ঘটছে ওখানকার লোকেশন আমাকে বলুন স্যার, আমি এক্ষুণি জিডি এন্ট্রি করছি- বলে অফিসারটি চেয়ার টেনে দিলো। পুলিশ অফিসারটির মুখে বার বার স্যার শুনে এবং চেয়ার এগিয়ে দিচ্ছে দেখে মি. মফিজ কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে- আরে না না ঠিক আছে, আমি সামান্য খুচরা ব্যবসায়ী, আমাকে স্যার বলতে হবে না- বলে নিজেই চেয়ার টেনে বসলেন। অফিসারটি আরও কাঁচুমাচু হয়ে বললো- কি যে বলেন স্যার; আপনাকেই তো স্যার বলতে হবে। আপনি ও আপনার মত আরও অনেক করদাতাদের প্রদত্ত কর থেকেই তো আমার বেতন-ভাতা হচ্ছে। আমি বউ-বাচ্চা নিয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। আপনারাই তো আমার এমপ্লয়ার। আপনাকে স্যার বলে সম্বোধন করাটা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্যের অংশ।
দৃশ্যটি কাল্পনিক কিন্তু এমনটাই তো স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল, নয় কি? সমস্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা তো জনগণকেই দিতে হচ্ছে, কখনও ট্যাক্স বা ভ্যাট বা আয়কর হিসেবে। কোথায় ওরা আমাকে স্যার স্যার করবে, তা না, আমি বোকার মতো আমার নিজের ক্ষমতা ও অবস্থান সম্পর্কে অসচেতন বলেই আমার নিয়োগকৃত কর্মচারীকে স্যার বলে সম্বোধন করছি। স্যার বলাটা কোন খারাপ কিছু না কিন্তু যে ভঙ্গিতে বলা হচ্ছে সেটিতেই আপত্তি। বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি আমাদের বোধগম্য হবে তত দ্রুত আমরা এগিয়ে যেতে পারবো।
বাংলাদেশের জনগণ, আমরা; প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন এলে একবার জাগ্রত হই। অতঃপর পাঁচ বছরের জন্য শীত নিদ্রায় চলে যাই। এই সময়ের মধ্যে কোন ধরনের অন্যায়-অবিচার-রাহাজানিই আমাদেরকে কোন ভাবেই ছুঁয়ে যায় না। গ-ারের চেয়েও বেশি সহনশীল হয়ে গেছি আমরা। অতি মাত্রায় সহনশীলতা আমাদের শুধু পিছিয়েই দেয় নি উপরন্তু, দুর্নীতিবাজ-চোরাগোষ্ঠীর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক বেশি। এ অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নিজেকে জাগ্রত রাখতে হবে প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ। অন্যায়-অবিচার-ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। নিজে সত্যিকার অর্থেই সচেতন ব্যক্তির মতো আচরণ করতে হবে। তবেই কেবল সমৃদ্ধি আসবে, উন্নতি ঘটবে রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গে।
আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে সচেতন হলে, নিকট ভবিষ্যতে একটি উন্নত ও আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ পাওয়া খুব কঠিন কি?
প্রথমেই নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কয়েকটি উদাহরণ দিই। বেশ কিছু দিন আগে সান্ধ্যকালীন আড্ডা থেকে বাসায় ফিরছি। রাত ন’টার মতো হবে। গাড়ি ড্রাইভ করে গ্রীন রোড-পান্থপথ সিগন্যাল থেকে ডানে মোড় দিয়ে সোনারগাঁও সিগন্যালের দিকে এগোচ্ছি। এর মধ্যে হঠাৎ পেছন থেকে ‘ধর ধর’ চিৎকারের শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একজন ট্রাফিক পুলিশ; ‘ওই ছিনতাইকারী- ধর ধর’ বলে চিৎকার করে একজনকে পেছন থেকে ধাওয়া করছে। আর যার উদ্দেশ্যে বলা, সেই অল্পবয়সী ছেলেটি, কখনও রাস্তার মাঝের ডিভাইডারের উপর দিয়ে, কখনও বা চলতে থাকা গাড়ির ফাঁক গলে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করছে। ফলে উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসতে থাকা পথচারীর মুখোমুখি হচ্ছে। পুরো দৃশ্যটি ঘটলো আমার মতো আরও অনেকের চোখের সামনে কিন্তু আশ্চর্য আমরা কেউই ছিনতাইকারীটিকে আটকাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করিনি। ওকে জাপটে ধরারও প্রয়োজন ছিল না, শুধু আলতো একটা ল্যাং দিলেই ছিটকে পড়তো রাস্তায়। আর পেছন থেকে ধেয়ে আসা পুলিশটি অনায়াসে তাকে ধরতে পারতো। এটুকু দায়িত্ব সচেতন না হলো কিভাবে চলবে! আমার প্রসঙ্গ ‘সচেতন ব্যক্তি মানেই উন্নত সমাজ।’ আমি মনে করি ব্যক্তিকে সচেতন করে গড়ে তুলতে না পারলে আমাদের জাতীয় জীবনে ভাল কোন কিছুই ঘটবে না।
তেলের দাম বেড়েছে কিন্তু আগেই বাস ভাড়া দূরত্বের তুলনায় বেশি হয়ে আছে বলে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাসভাড়া বাড়ানো যাবে না। তারপরও কন্ডাক্টর ৫ টাকা বেশি বাড়া চাইছে এবং বেশির ভাগ যাত্রীই দু’একবার গ্যাঁ-গোঁ করে তা দিয়েও দিচ্ছে। কেউ একজন বেঁকে বসলো ন্যায্য কারণেই। তার কথা হলো- ‘খবরের কাগজে পড়েছি, টিভিতে নিউজ দেখেছি, ভাড়া বাড়ানো যাবে না, তারপরও বেশি বাড়া চাও কেন?’ উত্তরে কন্ডাক্টরের জবাব- ‘আফনে গিয়া মালিকরে জিগান। মালিক আমারে কইয়া দিছে ৫ টাকা বেশি নিতে, আমি কম নিবার পারুম না।’ মালিক-শ্রমিক এ চক্রটি সুযোগ পেলেই যে কারণে বা অকারণে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে, এটি তো আর কারও অজানা নয়। তারপরও একজন যাত্রী এটির প্রতিবাদ করছে দেখেও বাকিরা চুপ মেরে থাকছে। কখনও এমনও হয়, পাশের যাত্রী বলে ওঠে- ‘আরে ভাই দিয়া দেন তো, খামোখা ঝামেলা করে কি হবে? সবাই তো দিয়ে দিচ্ছে দেখেন না? আপনি একা কি করবেন। বেশি বাড়াবাড়ি করলে হয়তো গাড়ি সাইড করে আপনাকে নামিয়েই দিবে।’ ভেবে দেখুন তো একবার, আমরা দিনের পর দিন এভাবেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে নিজের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছি না? বাসে ত্রিশের অধিক যাত্রী থাকার পরও মাত্র একজন কন্ডাক্টরের অন্যায় আবদারের কাছে নতি স্বীকার করছে সবাই। এভাবে চললে কোনদিনই এসব অন্যায়-অবিচার বন্ধ হবে না। কিন্তু এমন যদি হতো, পাঁচ টাকা বেশি চাওয়ার পর বেশির ভাগ যাত্রীই সেটি না দিয়ে প্রতিবাদ করছে, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে এমনটি এত সহজে ঘটতো না। আমরা কখনও চেষ্টা করেও দেখিনি, তাই না?
ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কে সারা বছরই খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। ওয়াসার ড্রেনেজ ডিভিশন আন্ডারগ্রাইন্ড সুয়্যারেজ পাইপ বসানের কাজ শেষ করে যাওয়ার পর মিউনিসিপাল করপোরেশন রাস্তার উপরের অংশের বিটুমিনাস কার্পেটিং কাজ সম্পন্ন করবে। এর মাস খানেক পর টেলিফোন কোম্পানী আসবে নতুন ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ লাইনের কাজ করার জন্য। যার ফলস্বরূপ আবারও কেবলই মাত্র নির্মিত রাস্তাটি কাটা হবে। টেলিফোন কোম্পানির কাজ শেষ হবার পর মিউনিসিপাল করপোরেশন আবার রাস্তাটি মেরামত করবে এবং তারও ক’মাস পর আসবে তিতাস গ্যাস কোম্পানি গ্যাস লাইনের কাজ করার জন্য। সমন্বয়হীনতার কথা বলে জনগণ প্রদত্ত ট্যাক্সের টাকা লুটপাট করে এসব দুর্নীতি দিনের আলোয় আমাদের চোখের সামনে ঘটছে বছরের পর বছর। এ রাস্তাটি দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ, আমি-আপনি আসা-যাওয়া করছি। প্রত্যেকে নিজেদের অনেক সচেতন হিসেবে ভাবছি। কিন্তু কোন দিন একজনও কি জিজ্ঞেস করেছি- কি ব্যাপার? পনেরো দিন আগেই না রাস্তাটি মেরামত করা হলো, আবার কেন এটি কাটাকাটি হচ্ছে? প্রথমবার কাটার সময় এক সঙ্গে সব কাজ শেষ হলো না কেন? আমার বিশ্বাস, রাস্তায় চলমান একশ’ জন পথচারীও যদি দৈনিক এ প্রতিবাদটি করতো তাহলে এ অন্যায়টি অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যেতো। কেন সবগুলো কাজ একসঙ্গে হলো না? কর্মরত শ্রমিক কিংবা ঠিকাদার যেই হোক না কেন, প্রতিনিয়ত প্রশ্নের মুখোমুখি হলে এতসব অন্যায়-অবিচার অনায়াসে এভাবে চালাতে পারতো না।
অনেকগুলো বাস্তব উদাহরণের পর এবার একটা অন্যরকম দৃশ্য কল্পনা করা যাক। মি. মফিজ, সামান্য খুচরা ব্যবসায়ী তবে তিনি একজন নিয়মিত করদাতা। তো তার একটি সমস্যা নিয়ে পার্শ্ববর্তী থানায় গেলেন জিডি করতে। থানার অভ্যর্থনা কক্ষে উপস্থিত হতেই ডিউটিরত অফিসারটি অত্যন্ত সুন্দর করে সালাম দিয়ে স্বাগত জানিয়ে বললো- স্যার কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি? -আমি এসেছি একটা জিডি করতে। আমার বাসার পাশের মাঠে গত দু’দিন ধরে রাতভর উচ্চস্বরে মাইক বাজতেছে। পুরো এলাকার মানুষজন বিশেষ করে বয়স্করা ভীষণ বিরক্ত। অনেকেই এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, শব্দ দূষণের ফলে পর্যাপ্ত ঘুমুতে না পারার কারণে। এ বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখবেন? -স্যার, আপনি এখানটায় বসুন। আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। আপনার নাম ঠিকানা কিছুই প্রয়োজন নেই, আপনি শুধু যেখানটায় এমনটা ঘটছে ওখানকার লোকেশন আমাকে বলুন স্যার, আমি এক্ষুণি জিডি এন্ট্রি করছি- বলে অফিসারটি চেয়ার টেনে দিলো। পুলিশ অফিসারটির মুখে বার বার স্যার শুনে এবং চেয়ার এগিয়ে দিচ্ছে দেখে মি. মফিজ কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে- আরে না না ঠিক আছে, আমি সামান্য খুচরা ব্যবসায়ী, আমাকে স্যার বলতে হবে না- বলে নিজেই চেয়ার টেনে বসলেন। অফিসারটি আরও কাঁচুমাচু হয়ে বললো- কি যে বলেন স্যার; আপনাকেই তো স্যার বলতে হবে। আপনি ও আপনার মত আরও অনেক করদাতাদের প্রদত্ত কর থেকেই তো আমার বেতন-ভাতা হচ্ছে। আমি বউ-বাচ্চা নিয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। আপনারাই তো আমার এমপ্লয়ার। আপনাকে স্যার বলে সম্বোধন করাটা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্যের অংশ।
দৃশ্যটি কাল্পনিক কিন্তু এমনটাই তো স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল, নয় কি? সমস্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা তো জনগণকেই দিতে হচ্ছে, কখনও ট্যাক্স বা ভ্যাট বা আয়কর হিসেবে। কোথায় ওরা আমাকে স্যার স্যার করবে, তা না, আমি বোকার মতো আমার নিজের ক্ষমতা ও অবস্থান সম্পর্কে অসচেতন বলেই আমার নিয়োগকৃত কর্মচারীকে স্যার বলে সম্বোধন করছি। স্যার বলাটা কোন খারাপ কিছু না কিন্তু যে ভঙ্গিতে বলা হচ্ছে সেটিতেই আপত্তি। বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি আমাদের বোধগম্য হবে তত দ্রুত আমরা এগিয়ে যেতে পারবো।
বাংলাদেশের জনগণ, আমরা; প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন এলে একবার জাগ্রত হই। অতঃপর পাঁচ বছরের জন্য শীত নিদ্রায় চলে যাই। এই সময়ের মধ্যে কোন ধরনের অন্যায়-অবিচার-রাহাজানিই আমাদেরকে কোন ভাবেই ছুঁয়ে যায় না। গ-ারের চেয়েও বেশি সহনশীল হয়ে গেছি আমরা। অতি মাত্রায় সহনশীলতা আমাদের শুধু পিছিয়েই দেয় নি উপরন্তু, দুর্নীতিবাজ-চোরাগোষ্ঠীর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক বেশি। এ অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নিজেকে জাগ্রত রাখতে হবে প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ। অন্যায়-অবিচার-ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। নিজে সত্যিকার অর্থেই সচেতন ব্যক্তির মতো আচরণ করতে হবে। তবেই কেবল সমৃদ্ধি আসবে, উন্নতি ঘটবে রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গে।
আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে সচেতন হলে, নিকট ভবিষ্যতে একটি উন্নত ও আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ পাওয়া খুব কঠিন কি?
No comments