মৃতদেহে পচন, চলছে দোষারোপের খেলা
ইউক্রেনে বিধ্বস্ত মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের
উড়োজাহাজের আরোহীদের মধ্যে গতকাল শনিবার সকাল পর্যন্ত ১৮৬ জনের
ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও শতাধিক ব্যক্তির দেহাবশেষ পড়ে আছে
বিস্তীর্ণ গম ও সূর্যমুখীর খেত আর ঝোপঝাড়ের মধ্যে। কিন্তু সেগুলো
উদ্ধারে সমন্বিত তৎপরতা চালানো সম্ভব হচ্ছে না। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের
নিয়ন্ত্রণে থাকা ওই এলাকাতে উদ্ধারকর্মী, আন্তর্জাতিক তদন্তকারী ও
বিশেষজ্ঞরা ঠিকভাবে কাজ করতে পারছেন না। এ জন্য পাল্টাপাল্টি দোষারোপও
চলছে। খবর এএফপি ও রয়টার্সের।
গত বৃহস্পতিবার সম্ভাব্য ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দোনেৎস্ক এলাকায় ভূপাতিত হয় মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ১৭। ভয়াবহ ওই ঘটনায় ১২টির বেশি দেশের ২৯৮ জন নিহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ছিলেন নেদারল্যান্ডসের নাগরিক। নেদারল্যান্ডসসহ ওই সব দেশে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। দেশগুলোর সরকার চেষ্টা করছে, তাদের নাগরিকদের মৃতদেহগুলো সময়মতো দেশে ফিরিয়ে নিয়ে স্বজনদের হাতে তুলে দিতে।
অন্যদিকে উড়োজাহাজটি কারা ভূপাতিত করল, তা নিয়ে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন,অস্ট্রেলিয়াসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে এখনো চলছে পাল্টাপাল্টি দোষারোপের খেলা। ইউক্রেনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাতে ঘটনাটি ঘটায় ইউক্রেন সরকার এ জন্য তাদেরই দায়ী করছে। কিয়েভ বলছে, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে অত্যাধুনিক ওই ক্ষেপণাস্ত্র তুলে দিয়েছে রাশিয়া। আর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মতো মস্কোও এ জন্য দায়ী করছে ইউক্রেন সরকারকেই।
পাল্টাপাল্টি ওই দোষারোপের খেলায় উদ্ধার তৎপরতা ও ঘটনার তদন্তে বিঘ্ন ঘটছে। রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে অর্গানাইজেশন অব কো-অপারেশন অ্যান্ড সেফটি ইন ইউরোপ বা ওসিএসইর ২১ জনের একটি পর্যবেক্ষক দল গতকাল সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ঘটনাস্থলে যায়। এক ঘণ্টার মধ্যেই তাদের ওই স্থান থেকে চলে যেতে বাধ্য করে বিচ্ছিন্নতাবাদী যোদ্ধারা।
ওসিএসইর মুখপাত্র মিখায়েল বসিউরকিউ বলেন, ‘ভারী অস্ত্রসজ্জিত যোদ্ধারা পাহারা দিয়ে আমাদের ঘটনাস্থলে নিয়ে যায়। দেখে মনে হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধক্ষেত্র এটি।’
দুর্ঘটনাস্থলের ভয়াবহতা চোখে দেখা যায় না। বেশ কয়েক মাইল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষ ও মানুষের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ। কোথাও দেখা যায় খেতের মধ্যে পড়ে আছে একটি মৃতদেহ, বিমানের আসনের সঙ্গে সিটবেল্ট দিয়ে বাঁধা, কানে রয়ে গেছে হেডফোনটি! অনেক মৃতদেহেই গতকাল পচন ধরেছে।
সবকিছুই ঘটনা তদন্তের আলামত, কিন্তু দ্রুত তা উদ্ধারের জন্য সমন্বিত তৎপরতা নেই। ইউক্রেনের জরুরি পরিস্থিতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আন্দ্রেই লেইশেঙ্কো জানান, উদ্ধারকাজের জন্য অন্তত ২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা তল্লাশি করা প্রয়োজন। স্থানীয় সময় শনিবার সকাল সাতটা পর্যন্ত ১৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা খুঁজে দেখা সম্ভব হয়েছে।
লেইশেঙ্কো বলেন, ‘আমরা ১৮৬টি ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ উদ্ধার করতে পেরেছি। সঙ্গে পাওয়া গেছে উড়োজাহাজের ভাঙা অনেক টুকরা।’ তিনি আরও বলেন, যোদ্ধারা (বিচ্ছিন্নতাবাদী) জরুরি উদ্ধারকর্মীদের ওই এলাকায় ঢুকতে দিয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে উদ্ধার করে কোনো কিছু নিয়ে আসতে দিচ্ছে না। যা কিছু পাওয়া যাচ্ছে সব নিয়ে যাচ্ছে তারা।
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এক নেতা বলেছেন, মালয়েশিয়া ও নেদারল্যান্ডসের কর্মকর্তারা তাঁদের বলেছেন কোনো দেহাবশেষ না সরাতে। কিন্তু ওই দেশ দুটি থেকে উদ্ধারকর্মী ও তদন্ত কর্মকর্তারা যাঁরা ইউক্রেনে পৌঁছেছেন, তাঁরা ঘটনাস্থলে নেই। আশপাশের মধ্যে বড় শহর দোনেৎস্ক। ওই শহর থেকে গাড়িতে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে প্রায় ৯০ মিনিট লাগে। তবে যেতে হয় যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে, তল্লাশি ফাঁড়ি পেরিয়ে। সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী যোদ্ধারা সেখানে লড়াই করছে।
সর্বশেষ হিসাবে জানা গেছে, দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ১৯২ জন নেদারল্যান্ডসের নাগরিক। সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রানস টিমারম্যানস গত শুক্রবারই ১৫ জনের একটি বিশেষজ্ঞ দল নিয়ে কিয়েভে পৌঁছেছেন। আর ৬২ জনের একটি দল নিয়ে মালয়েশিয়ার পরিবহনমন্ত্রী লিউ তিয়ং লাইয়ের গতকাল সেখানে পৌঁছার কথা ছিল। এর আগে গতকালই দুর্ঘটনা তদন্তের জন্য দুই মালয়েশীয় বিশেষজ্ঞ কিয়েভ পৌঁছান। তবে ওসিএসইর বিশেষজ্ঞরা গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে বাধা পাওয়ায় নেদারল্যান্ডস ও মালয়েশিয়ার তদন্তকারী ও বিশেষজ্ঞরা সেখানে পৌঁছাতে পারবেন বা ঠিকমতো কাজ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
আলামত ও তথ্য-প্রমাণ যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য ইউক্রেনের প্রতি গতকাল আহ্বান জানিয়েছে মালয়েশিয়া। দেশটি বলেছে, এসব নষ্ট করে ফেলা হলে তা ওই ঘটনায় নিহতদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল হবে।
মালয়েশীয় পরিবহনমন্ত্রী তিয়ং লাই বলেন, ‘উড়োজাহাজ ভূপাতিত হওয়ার স্থলটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে না, এতে মালয়েশিয়া গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’
দুর্ঘটনার পরদিন গত শুক্রবার বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জানিয়েছিল, তারা উড়োজাহাজের দুটি ব্ল্যাক বক্স পেয়েছে। ব্ল্যাক বক্স তারা রাশিয়ার হাতে তুলে দিয়েছে বলে পরে অভিযোগও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু গতকাল তারা জানায়, কোনো ব্ল্যাক বক্স পাওয়া যায়নি। এ সম্পর্কে কিছু তারা জানেও না। ব্ল্যাক বক্সে উড়োজাহাজের উড্ডয়ন-সম্পর্কিত সব তথ্য সঞ্চিত থাকে। দুর্ঘটনার পর ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা গেলে দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা যায়।
এই অবস্থায় ইউক্রেনের সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দুর্ঘটনার সব সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আলামত নষ্ট করে ফেলছে। এর মাধ্যমে কিয়েভ সরকার ঘটনার দায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর চাপাতে চাইছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও একই ইঙ্গিত করেছেন। শুক্রবারই তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত যে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা থেকে ইঙ্গিত মেলে যে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতেই উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছে। আর এটা পরিষ্কার যে, ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাতেই ঘটনাটি ঘটেছে। একদল বিচ্ছিন্নতাবাদী কখনোই যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ বা যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করতে পারে না, যদি না তাদের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ থাকে। ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে এসব তুলে দিয়েছে রাশিয়া।
তবে ইউক্রেন বা মার্কিন সরকারের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে রাশিয়া। মস্কো বলেছে, তারা পশ্চিমা বিশ্বের ‘তথ্য-সন্ত্রাসের’ শিকার হচ্ছে। এ জন্য ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে তারা।
রাশিয়ার উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী আনাতোলি আন্তোনভ গতকাল রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক বক্তব্যে উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করেন। এ ঘটনা সম্পর্কে ১০টি প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘পারলে ইউক্রেন এসব প্রশ্নের জবাব দিক।’
অস্ট্রেলিয়াও অভিযুক্ত করছে রাশিয়াকে। দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ২৮ জন ছিলেন অস্ট্রেলীয় নাগরিক। দেশটিতে গতকাল শোক পালন করা হয়। অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট গতকাল বলেছেন, রাশিয়া এই ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।
No comments