ফরমালিন ও রাজনীতি by সৈয়দ আবুল মকসুদ
রাজনীতির সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক
দীর্ঘকালের। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে ফরমালিনের মতো রাসায়নিকের সম্পর্কের
কথা কস্মিনকালেও কেউ শোনেনি। এখন তা শোনা যাচ্ছে। সব দেশের রাজনীতির
সঙ্গে ফরমালিনের কোনো সম্পর্ক নেই। বঙ্গীয় রাজনীতি আজ ফরমালিনমিশ্রিত।
দেশের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী, বড় ও ছোট, ডান ও বাম—সব দলের নেতাদের মুখে
সমস্বরে ধ্বনিত হচ্ছে একটি শব্দ: ফরমালিন।
ফরমালিন রাসায়নিকটি একসময় মৃতদেহের পচন রোধে এবং কোনো নমুনা সংরক্ষণে ব্যবহৃত হতো। চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও রসায়নবিজ্ঞানীরা তা হাসপাতালে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করতেন। একদিন বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের লোকেরা খোঁজ পান এই অমূল্য দ্রব্যটির। এখন খাদ্যসামগ্রীর ভোক্তা ও মাছের বাজারের ক্রেতাদের মুখে মুখে উচ্চারিত ফরমালিন শব্দটি। মাছে ফরমালিন; আম, আঙুর, আপেলে ফরমালিন; আটা, ময়দা, দুধ, সেমাই, রসগোল্লায় ফরমালিন। আজ এমন মানুষ নেই, যার শরীরে ফরমালিন পাওয়া যাবে না। রাজনীতিকেরাও আমাদের মতো মানুষ। মাছ, দুধ, মিষ্টিমণ্ডা, ফলমূল যেহেতু তাঁরা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি খান, তাই তাঁদের শরীরে ফরমালিন যে কিঞ্চিৎ বেশি থাকবে, তা পরীক্ষা না করে অনুমানেই বলা যায়। কিন্তু রাজনীতি কোনো মানুষও নয়, প্রাণীও নয়; তার মুখ নেই, দেহ নেই—তার মধ্যে ফরমালিন ঢুকল কীভাবে?
প্রধানমন্ত্রী জাপান সফর করে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিএনপি পচে গেছে, ‘এখন তো সব জায়গায় ফরমালিন। ফরমালিন দিয়ে তাজা রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা বিএনপিকে ফরমালিন দিয়ে তাজা রাখার চেষ্টা করছি। তা না হলে এত কথা কীভাবে বলছেন।’ [যুগান্তর] বিএনপির নেতারা চুপ থাকতে পারেন না। তাঁরা প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘বিএনপিকে ফরমালিন দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বাঁচিয়ে রাখার কথা বলে তিনিই এখন দেশের বিষাক্ত ফরমালিনে পরিণত হয়েছেন।’ [আমাদের সময়]
ফরমালিন রাসায়নিকটি একসময় মৃতদেহের পচন রোধে এবং কোনো নমুনা সংরক্ষণে ব্যবহৃত হতো। চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও রসায়নবিজ্ঞানীরা তা হাসপাতালে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করতেন। একদিন বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের লোকেরা খোঁজ পান এই অমূল্য দ্রব্যটির। এখন খাদ্যসামগ্রীর ভোক্তা ও মাছের বাজারের ক্রেতাদের মুখে মুখে উচ্চারিত ফরমালিন শব্দটি। মাছে ফরমালিন; আম, আঙুর, আপেলে ফরমালিন; আটা, ময়দা, দুধ, সেমাই, রসগোল্লায় ফরমালিন। আজ এমন মানুষ নেই, যার শরীরে ফরমালিন পাওয়া যাবে না। রাজনীতিকেরাও আমাদের মতো মানুষ। মাছ, দুধ, মিষ্টিমণ্ডা, ফলমূল যেহেতু তাঁরা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি খান, তাই তাঁদের শরীরে ফরমালিন যে কিঞ্চিৎ বেশি থাকবে, তা পরীক্ষা না করে অনুমানেই বলা যায়। কিন্তু রাজনীতি কোনো মানুষও নয়, প্রাণীও নয়; তার মুখ নেই, দেহ নেই—তার মধ্যে ফরমালিন ঢুকল কীভাবে?
প্রধানমন্ত্রী জাপান সফর করে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিএনপি পচে গেছে, ‘এখন তো সব জায়গায় ফরমালিন। ফরমালিন দিয়ে তাজা রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা বিএনপিকে ফরমালিন দিয়ে তাজা রাখার চেষ্টা করছি। তা না হলে এত কথা কীভাবে বলছেন।’ [যুগান্তর] বিএনপির নেতারা চুপ থাকতে পারেন না। তাঁরা প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘বিএনপিকে ফরমালিন দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বাঁচিয়ে রাখার কথা বলে তিনিই এখন দেশের বিষাক্ত ফরমালিনে পরিণত হয়েছেন।’ [আমাদের সময়]
শব্দটি যদি দুই দলের নেতাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে কোনো কথা ছিল না। কারণ, দুই দলের নেতাদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ওয়াকিবহাল। তাঁদের বাক্য গঠন, শব্দ প্রয়োগ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারের বিষয়ে তাঁরা পরিচিত৷ টেলিভিশনের মাধ্যমে তাঁরা প্রতিদিন হুবহু তা শুনছেন। কিন্তু একই দিনে ফরমালিন শব্দটি প্রয়োগ করলেন প্রখ্যাত সংবিধানবিশেষজ্ঞ রাজনীতিক ড. কামাল হোসেন। নাগরিক ঐক্যের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ফরমালিন দূর করতে হবে। খাবারে ফরমালিন দিয়ে পচা ও নষ্ট জিনিসকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, আমাদের রাজনীতিতেও সেভাবে ফরমালিন দেওয়া হচ্ছে। [প্রথম আলো] কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের কাছে রুশ বিপ্লব ও মাও ঝেদোঙের লংমার্চের চেয়ে কম বিপ্লবী কিছু গ্রহণযোগ্য নয়। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ নিপাতে তাঁরা সোজাসাপটা কথা বলেন। বাক্যে কোনো মেটাফর প্রয়োগ করেন না। তাঁরা পর্যন্ত বলছেন, শাসকশ্রেণি ও তাদের সরকার নিজেই একপ্রকার ফরমালিনে ডুবে থেকে নিজেকে কোনোরকমে রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, পুরো জাতি এখন ফরমালিন সিনড্রোমে আক্রান্ত। ফরমালিন একটি স্লো পয়জন। দেহে গেলে এক দিনেই মানুষ মরে না, ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। এমনভাবে হয় যে হৃষ্টপুষ্ট মানুষটি টেরও পায় না।
রাজনীতিতে ফরমালিনের কোনো আক্ষরিক অর্থ হয় না। ভাবার্থ হলো, রাজনীতি দূষিত হয়ে গেছে, বিষাক্ত হয়ে গেছে। ওই রাজনীতির ফলে জাতি মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে পারে। শুধু সরকারি ও বিরোধী বড় বড় দলের রাজনীতি যে দূষিত হয়েছে তা-ই নয়, ছোট দলগুলোর রাজনীতিও দূষণমুক্ত নয়। তারা সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলের সমালোচনা করে, কিন্তু নিজেদের চেহারার দিকে তাকায় না। জাতির এই দুর্দিনে তারা কী ভূমিকাটা পালন করছে? সারা দেশ ঘুরে এই অবস্থাটা থেকে পরিত্রাণের জন্য কী কাজটা করছে?
এই উপমহাদেশে রাজনীতিতে তরুণদের ভূমিকাই ছিল প্রধান, নেতৃত্বে থাকতেন প্রবীণেরা। সেটা ব্রিটিশ আমলে কংগ্রেসের ক্ষেত্রেও, মুসলিম লীগের ক্ষেত্রেও। পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রেও। তারুণ্যের অংশগ্রহণ ছাড়া আইয়ুব খানের একনায়কত্বের অবসান ঘটানো যেত না উনসত্তরে। তারুণ্যের আত্মত্যাগ ছাড়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সফল হতে পারত না। প্রবীণেরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে খুব বেশি দূর যেতে পারতেন না। বর্তমান ব্যবস্থায় তরুণ-তরুণীরা অনেকেই হতাশ, অধিকাংশই বিরক্ত, কিন্তু তাঁরা জোরালো প্রতিবাদে ফেটে পড়ছেন না। অবশ্য নেতৃত্ব ছাড়া বিদ্রোহ হয় না। নেতৃত্বহীনতার কারণে বিদ্যমান ব্যবস্থাকেই মেনে নিচ্ছেন অনেকে। যদিও বুদ্ধিমান তরুণেরা জানেন, বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাঁদের কোনো সুন্দর ভবিষ্যৎ নেই। বিদ্রোহী না হয়েও এই ব্যবস্থাকে যে ঘৃণা করবেন, তা করছেন না।
অথচ এই রাজনীতি তরুণদের নিয়ে ব্যবসা করছে। শাসকশ্রেণি গুন্ডাপ্রকৃতির তরুণদের বেছে নিচ্ছে। পাস করার আগেই তাঁদের লাখ লাখ টাকা উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। মেধা তাঁদেরও ছিল। কিন্তু মেধার ব্যবহার নয়, তাঁদের পেশিশক্তির ব্যবহার করছে বর্তমান রাজনীতি। দলীয় ক্যাডারদের মধ্যে যারা মারামারিতে অভ্যস্ত নয়, তারা খোশামুদিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। তোষামোদি করে তারা চাকরি বাগিয়ে নিচ্ছে, যোগ্যরা বাদ পড়ছেন। দয়ায় পাওয়া চাকরির লোকদের দিয়ে মানসম্মত ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বেড়েছে ঘুষ-দুর্নীতি।
প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে না থাকলেও সব দেশের রাজনীতিতে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা থাকে। স্বাধীনতার আগে প্রগতিশীল রাজনীতিতে তা দেখা গেছে। আজ আমাদের বিশাল শ্রমিকশ্রেণি৷ পোশাকশিল্প ও অন্যান্য কলকারখানার শ্রমিকেরা তুচ্ছ ব্যাপারে কারখানায় ভাঙচুর করেন, আগুন দেন, মালিকপক্ষের লোকদের মারধর করেন। এসব করেন হতাশা থেকে। সুস্থ রাজনীতি ও ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে এসব হতে পারত না। যা করার বার্গেইনিং এজেন্টরাই করত শ্রমিকদের স্বার্থে।
পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের অধিকাংশই গ্রামের ভূমিহীন পরিবারের সদস্য। গ্রামেও তাঁদের ঠাঁই নেই, শহরেরও তাঁরা কেউ নন। বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য গৃহীত কোনো কর্মসূচি তাঁদের সামনে তুলে ধরা হয়নি। তা ছাড়া সময়সাপেক্ষ কর্মসূচিতে তাঁদের সায় নেই। তাঁরা চান তাৎক্ষণিক সুবিধা। তাতে যদি তাঁদের কারখানা বন্ধও হয়ে যায়, তাতেও তাঁদের দুশ্চিন্তা নেই। কারণ, তাঁরা দেখছেন যে মালিকেরাও নগদ প্রাপ্তিতে বিশ্বাসী। বিদেশে টাকা পাচার করেন। সেখানে বাড়িঘর কেনেন। জাতির দীর্ঘস্থায়ী কল্যাণের চিন্তা তাঁদের মাথায় নেই। ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়ে তাঁরা একদিন সপরিবারে বিদেশে পালিয়ে গেলে রাষ্ট্র তাঁদের লোমটিও ধরতে পারবে না। মালিকদের অধিকাংশই কোনো না কোনো বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। দূষিত রাজনীতি শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করছে, অন্যদিকে তাঁরা বিষাক্ত রাজনীতির সুযোগ নিচ্ছেন। ফলে গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি না হয়ে একটি দূষিত চক্র তৈরি হচ্ছে।
ফরমালিনযুক্ত রাজনীতির আশীর্বাদে ১৯৮৫ সালের ট্রাকের হেলপার ’৮৭ সালে ড্রাইভার হন। সেটা খুবই স্বাভাবিক। বঙ্গীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির বরাতে তিনি ১৯৯১-তে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হন। ২০১২-তে নির্বাচিত হন কাউন্সিলর। তাঁর ‘মালিকানাধীন নারায়ণগঞ্জ-চিটাগাং রোডে চলাচলকারী এবিএস পরিবহনের ৩২টি লাক্সারি বাস রয়েছে। শিমরাইল মৌজায় ৩৭৩ নম্বর দাগে প্রায় ১১ শতাংশ জমির ওপর সাত কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচতলা, ৭২ ও ৭৩ নম্বর দাগে ১০ শতাংশ জমির ওপর পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয়তলা ও ৩১২ নম্বর দাগে ১০ তলা ফাউন্ডেশনের ওপর ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করছেন। রসুলবাগে সাড়ে আট কাঠা জমির ওপর রয়েছে তাঁর সাততলা ভবন। এ জমির অর্ধেকই সরকারি। এ ছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জ মৌজায় ১০ শতাংশ জমির ওপর সাততলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে।...রাজধানীর গুলশান ২-এ রয়েছে দুটি ফ্ল্যাট। গুলশান লেকের বিপরীতে তিন হাজার ৬০০ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে তাঁর। পাশাপাশি বনানী ও ধানমন্ডিতেও দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে চারটি। তিনি কমপক্ষে ৫০ বিঘা জমির মালিক। এর মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ আঁটি মৌজায় রয়েছে দুই বিঘা জমি।’ [বণিক বার্তা]
যাঁর এইটুকু সম্পত্তি রয়েছে, তিনি সাত বা ১৭ জনকে হত্যা করাতে ছয় কোটি কেন, ৬০ কোটিও ব্যয় করতে পারেন। তাঁকে বিদেশে নিরাপদ আস্তানায় জানেসালামতে পাঠানোর দায়িত্ব তো ফরমালিনযুক্ত রাজনীতির। যাঁর অত ধনদৌলত, তাঁকে শুধু কলকাতায় কেন, তিনি যদি এস্কিমোদের দেশে যেতে চান, যেখানে তিনি কুকুরে টানা গাড়িতে ঘুরে বেড়াবেন, ফরমালিনের রাজনীতি ও রাজনীতিক কর্মকর্তারা তাঁকে সেখানেই পাঠাবেন। বাংলাদেশের একটি বালকও বোঝে, ২০ বছরে যিনি এই সম্পত্তি করতে পারেন, তিনি তাঁর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের কী পরিমাণ অর্থ বা অন্য কিছু উপহার দিয়েছেন! তাঁর পাশে রাজনীতি দাঁড়াবে না তো যেসব সৎ সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক ও কলমপেষা সাংবাদিক বাজারে গিয়ে ফরমালিনবিহীন পাবদা মাছের ভাগার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন, কিনতে পারেন না, তাঁদের মতো হতভাগাদের সঙ্গে থাকবে?
বাংলাদেশে দুদক নামের একটি প্রতিষ্ঠান আছে। তা যে আছে তা প্রতিদিন সন্ধ্যার সংবাদে আমরা দেখতে পাই। তার কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ওই কৃতী পুরুষের ‘সম্পদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি’। বলেছেন খুব নরম গলায়। আরও আশ্বস্ত করেছেন জাতিকে এই বলে যে ‘হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন হলে তা অবশ্যই খতিয়ে দেখবে দুদক।’ সম্পদ এত বেশি যে ওসব খতিয়ে দেখতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। তা ছাড়া দুদকের আরও বহু জরুরি কাজ রয়েছে। সেসব আশু কাজের আভাসও দিয়েছেন। দুদক এখন দুর্নীতির তথ্য অনুসন্ধানের চেয়ে ‘মুখোশ’ উন্মোচনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সে জন্যই গত হপ্তা থেকে রাস্তার লোকজন বলছে, দুদক ওরফে মুউক (মুখোশ উন্মোচন কমিশন)।
চেয়ারম্যান গোলাম রহমান চলে যাচ্ছিলেন মেয়াদ শেষে। নতুন কারও নিয়োগ হবে। টিভি স্ক্রলে দেখলাম একজন কমিশনারের নাম। পরদিন জানা গেল, মো. সাহাবুদ্দিন সাহেব নন, বদিউজ্জামান সাহেব নিয়োগ পেয়েছেন। সাহাবুদ্দিন সাহেবের মতো কঠোর মানুষেরই চেয়ারম্যান পদটি প্রাপ্য ছিল। বুধবার দেখলাম তাঁর রুদ্রমূর্তি। টিআইবির অর্থের উৎস ও গবেষণা নিয়ে গবেষণা করছে দুদক। কটমট করে তাকিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বিদেশ থেকে টাকা এনে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে তথাকথিত গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের এসব কাজের স্বচ্ছতা কী? এমন একদিন আসবে, যেদিন টিআইবির মুখোশ উন্মোচন করতে দ্বিধা করা হবে না।’ [কালের কণ্ঠ]
দ্বিধা করা একেবারেই উচিত নয়। বিদেশ থেকে গবেষণার নামে আনা টাকায় এম হাফিজউদ্দিন খান, সুলতানা কামাল, ইফতেখারুজ্জামান গুলশান লেকের পারে দুটো করে ফ্ল্যাট কিনেছেন কি না। উত্তরার আশপাশে জমি কিনেছেন কি না। এবং বাজারে গিয়ে হালি হিসেবে মেঘনার বড় ইলিশ কেনেন কি না। এসব তথ্য উদ্ঘাটন করে তঁাদের ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা দরকার বৈকি৷ ওই অনুষ্ঠানেই সাহাবুদ্দিন সাহেব জনাব কোকোর ফিরিয়ে আনা টাকা দুদক ফান্ডে জমা দেননি বলে বর্ষীয়ান ও শ্রদ্ধেয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকেও ধমক মেরেছেন। তাঁর ওই রুদ্রমূর্তি খুব শোভন মনে হয়নি। বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদের বাড়ির মামলার দিনও তাঁর রুদ্রমূর্তি দেখেছি। পারলে তক্ষুনি তাঁকে বাড়ি থেকে ঠেলে বের করে দেন।
রাজনীতি-অর্থনীতি যাতে ফরমালিনমুক্ত থাকে, সে জন্য টিআইবি, সুজন, সিপিডি প্রভৃতি তাদের সাধ্যমতো গবেষণা করে। রেহমান সোবহান, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদাররা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো চক্রান্ত করেন, এমন প্রমাণ নেই। তাঁদের গবেষণায় দুদকের মতো সংস্থা বরং উপকৃত হতে পারে। আমরা যে যেখানে আছি, সরকারের অথবা সরকারের বাইরে, চেষ্টা করলে রাজনীতিতে ফরমালিন কমিয়ে আনা সম্ভব।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments