ফরমালিন ও রাজনীতি by ড. মাহফুজ পারভেজ
খা দ্যের পচন রোধে অপব্যবহৃত-ক্ষতিকর
ফরমালিন এখন রাজনীতির দরবারেও আলোচিত হচ্ছে। অর্থাৎ কাঁচাবাজার থেকে
ফরমালিন এসে পৌঁছেছে রাজনীতির মহাহাটে। কথাটা এখন খোদ রাজনীতিবিদরাই বলছেন।
বর্ষীয়ান ড. কামাল হোসেন বলেছেন। এমনকি, ফরমালিন ও রাজনীতি নিয়ে স্বয়ং
প্রধানমন্ত্রী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীও মুখ খুলেছেন। বিশিষ্ট সংবিধান
প্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিষাক্ত
ফরমালিন দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে
ফরমালিন দূর করতে হবে। খাবারে ফরমালিন দিয়ে পচা ও নষ্ট জিনিসকে যেভাবে
উপস্থাপন করা হয়, আমাদের রাজনীতিতেও সেভাবে ফরমালিন দেয়া হচ্ছে।’ অন্যদিকে,
‘সরকারকে পচতে সময় দিয়েছি’, খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি
আকর্ষণ করলে শেখ হাসিনা জাপান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আহূত সংবাদ সম্মেলনে
বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপিই পচে গেছে। এখন ফরমালিন দিয়ে আমরাই
বিএনপিকে তাজা রাখছি।’ কাগজে আরও দেখলাম, শিশুদের ফরমালিনের কবল থেকে
বাঁচাতে মানববন্ধন হয়েছে। মনে হচ্ছে, ফরমালিনই এখন দেশের শীর্ষ আলোচ্য
বিষয়।
খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিনের উপদ্রব নতুন নয়। মাছে-মাংসে-ফলে-মূলে-শাকসবজিতে ফরমালিন ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য ফরমালিন শনাক্ত করার পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষের কাছে প্রচার করা হচ্ছে এবং মাঝেমধ্যেই ফরমালিনবিরোধী অভিযানও পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু রাজনীতিতে ফরমালিনের বিষয়টি সদ্য উত্থাপিত হয়েছে। ফলে সেটি শনাক্তকরণ ও প্রতিরোধের বিষয়টি এখনও ব্যাপকতা পায়নি। খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন যেমন শরীর-স্বাস্থ্যের বারোটা বাজাচ্ছে, রাজনীতির ফরমালিনও সমাজ আর রাজনীতির বিরাট ক্ষতি করবে, এতে সন্দেহের কোন কারণ নেই। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, বাজারে ফরমালিনবিরোধী অভিযান যতটা সরব, রাজনীতিতে ততটা নয়।
প্রায়ই রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত করার কথা শোনা যায়। এখন ফরমালিনমুক্ত করার কথাও শোনা যাচ্ছে। এতে যদি রাজনীতির গুণগত মান বৃদ্ধি পায়, তবে তো ভালই। রাজনীতির পাশাপাশি নেতাদেরও ফরমালিনের আওতা থেকে বের করতে হবে। পচা মাছ যেমন ফরমালিন দিলেও স্বাস্থ্যকর হয় না, দূষিত নেতারাও ফরমালিন দিয়ে পাপ ঢাকতে পারবেন না। বরং ফরমালিনযুক্ত খাদ্যের মতোই ফরমালিনযুক্ত রাজনীতি ও নেতৃত্ব সমাজের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বাজার ও রাজনীতির যৌথ বিপদ মানুষ ও সমাজের জন্য বড়ই ভয়ের বিষয়। মানুষকে বাজারে যেতেই হবে; রাজনীতিতেও সংশ্লিষ্ট থাকতেই হবে। আর সেখানেই যদি ওত পেতে থাকে ফরমালিনের প্রলেপ দেয়া ভেজাল, পচা, বাসী মাল, তাহলে তো সবার নাভিশ্বাস।
একদা সুখাদ্যের জন্য বাংলা বিখ্যাত ছিল। বিদেশীরা বলতেন, স্বর্গের মতো দেশ। গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরুর কথাও আছে। অতীত ও ইতিহাসে ভেজাল ও পচা মালের বিবরণ বলতে গেলে নেই। অন্যদিকে, অতীতের ইতিহাসে রাজনীতি ও নেতারা মানুষ ও সমাজের জন্য আদর্শস্বরূপ ছিলেন। তাদের ত্যাগ, পরহিত, কৃচ্ছসাধন ছিল প্রবাদপ্রতিম। তাদের প্রতি রাজনৈতিক কারণে কিছু সমালোচনা ছিল বটে; কিন্তু এমন কোন দুর্গন্ধ ও পচনশীলতা তাদের ছিল না যে, আতর বা ফরমালিন ব্যবহার করে তারা নিজেকে রক্ষা করতেন। এখন ফেনী, নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরে যেসব নেতার কথা শোনা যাচ্ছে এবং যেরূপ রাজনীতি দেখা যাচ্ছে, সেটাকে কি বলা যায়? শেকড় থেকে শীর্ষ পর্যন্ত রাজনীতি ও নেতৃত্বের দুর্গন্ধ ও পচনশীলতার কার্যকারণগত সম্পর্কও মানুষের অজানা নেই। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো, বাজারে বা রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান সমস্যা ও বিপদ নিয়ে এন্তার লেখালেখি, আলাপ-আলোচনা হলেও কর্তৃপক্ষ পারস্পরিক দোষারোপের কাজেই ব্যস্ত। অপরের দিকে দোষ ঠেলে দেয়াই যেন সমস্যার সমাধান! সম্মিলিতভাবে সমস্যা ও বিপদ মোকাবিলার কথা কেউ বলছেন না। ঐক্যে যে লাভ, সেটাই মনে হয় অনেকে বিশ্বাসই করেন না। অথচ বারবার বলা হচ্ছে ঐক্য ও সমঝোতার কথা। সেটা গণতন্ত্র বাঁচানো, বিনিয়োগ বাড়ানো, দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে বা বাজার ও রাজনীতি থেকে ফরমালিন হটাতেও সত্য। এ সত্যটিই এখন বিস্মৃত হয়েছে। বরং মিথ্যাকে ফরমালিন দিয়ে সত্যের মাথায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে। পচা মাছ, পচা রাজনীতি, পচা নেতা, পচা কথা (মিথ্যা) ইত্যাদি যদি ফরমালিনের জোরে জনতা ও সমাজের মাথায় চেপে বসে, তাহলে খাঁটি ও আসলের উপায় কি? রূপকথায় সিন্দাবাদের কাঁধে চেপেছিল দৈত্য। সে আর নামতে চায়নি। আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে ফরমালিন মাখানো ভেজাল, পচা, দুর্গন্ধযুক্ত মালামাল। দৈত্য সিন্দাবাদকে বিব্রত করেছিল, জীবনের হানি করেনি। আজকের ফরমালিনযুক্ত মালামাল শুধু বিব্রতই করছে না, জীবন বিপন্ন করার মতো স্বাস্থ্যগত, সমাজগত, আইনশৃঙ্খলাগত-রাজনৈতিক কারণও ঘটাচ্ছে। সর্বত্র বিরাজমান ও ফরমালিনে চুবানো এই আধুনিক-বীভৎস দৈত্যকুলের কবল থেকে মানুষ ও সমাজের মুক্তির উপায় কি?
No comments