নেশা ও সমাজ by প্রফেসর ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক
ঐশীর কথা ভাবতে শরীর শিউরে ওঠে। গা জ্বালা
দিয়ে ওঠে। সে তার মা-বাবাকে নিজ হাতে হত্যা করে। প্রথমে মদ খেয়ে নিজকে
তৈরি করে নেয়। এরপর দু’ধারী ছুরি নিয়ে ঘুমন্ত মায়ের পেটে ছুরিকাঘাত করে। মা
চোখ খুলে যখন দেখলো ঐশী তাকে ছুরি মেরেছে সে করুণ সুরে বললো: ঐশী মা, তুমি
আমাকে ছুরি মারছো, আমি কি তোমার মা নই? মায়ের এ করুণ আকুতি তার ভাল লাগলো
না। সে মায়ের গলায় ছুরি দিয়ে তার কথা বলা বন্ধ করে দিলো। মায়ের দেহ খাট
থেকে নিচে পরে রক্তাক্ত করে দিলো চারদিক। যখন সে নিশ্চিত হলো, তার মা আর
বেঁচে নেই, তখন সে এই ছুরি নিয়ে অন্য কক্ষে তার ঘুমন্ত পিতার কাছে গেল। সে
আর পেটে ছুরি মেরে বিড়ম্বনা বাড়াতে চায়নি। প্রথমেই আঘাত করলো পিতার গলায়।
কেটে দিলো তার শ্বাসনালি। যখন তার বাবার মৃত্যু নিশ্চিত হলো তখন সে আনন্দে
হুইস্কি পান করলো।
ঐশী কেন এটা করলো তা তদন্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে চার্জশিটও দেয়া হয়েছে। তবে ইতিমধ্যে যা বেরিয়ে এসেছে তা হলো এই যে, সে মাদকসেবী ছিল। ইয়াবা গ্রহণ করতো। মদ পান করতো। এ নেশা তার জ্ঞান ও বিবেককে আচ্ছন্ন করে ফেলে। প্রবৃত্তি তার ওপর বিজয়ী হয়। মদের নেশায় বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে সময় কাটাতে তার ভাল লাগে। তার মা বাবা তাকে এসব পথ থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে। কাজেই তার আনন্দের পথের বাধা সে দু’ধারী ছুরি দিয়ে শেষ করে দিলো। জগতে শুধু একজন ঐশী নয়, বরং লাখো ঐশী মানব-সমাজকে বিষাক্ত করে তুলেছে। আর অপরদিকে সর্বত্র নেশার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি হয়ে গেছে। তবে পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সমাজগুলোর আচরণ হাস্যকর। তারা হয়তো কোন এক সমাবেশে নেশার বিরুদ্ধে কথা বলছে, আর সে সমাবেশেই পরিবেশন করা হচ্ছে মদ। এটাই হলো আজকের বিশ্ব সংস্কৃতি।
এখন প্রশ্ন, নেশা ও মদে মানুষের জন্য কি ক্ষতি রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় নেশা ও মদের যেসব ক্ষতি প্রমাণিত হয়েছে তা সংক্ষেপে এখানে বলা হলো: (১) নেশা ও মদ গ্রহণ করতে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পাকস্থলি ক্রমেই দুর্বল ও তার কার্যক্ষমতা দুর্বল হতে থাকে। (২) চেহারার লাবণ্য নষ্ট হয়। (৩) বার্ধক্য ত্বরান্বিত হয়। (৪) চিন্তাশক্তি আচ্ছন্ন হয় এবং বাকশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (৫) নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির সন্তান দুর্বল হয় এবং বিকলাঙ্গ বা প্রতিবন্ধী হতে পারে। (৬) মদ ও নেশায় নানা ধরনের রোগ হয়। বিশেষ করে ক্যানসার ও হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। এগুলো হলো মদ ও নেশার দৈহিক ও শারীরিক ক্ষতি।
যে সব দেশে মদ ও নেশার ছড়াছড়ি আছে তেমন একটি দেশের গবেষণায় নেশা ও মদের কুফল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখানে অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণার কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো। প্রতি বছর সেখানে দুই কোটি মানুষের মধ্যে ৩০০০ ব্যক্তি অতিরিক্ত মদ্য পানে মারা যায়। বছরে ৬৫০০০ লোক অতিরিক্ত মদ-পানের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়। মদের কারণে বছরে ২৫০০ ব্যক্তির মস্তিষ্ক ক্ষরণ হয়। দেশের জঘন্য অপরাধীর ৪৭% নেশাগ্রস্ত। যারা এরূপ জঘন্য অপরাধের শিকার হয় তাদের মধ্যে ৪৩% হলো নেশাগ্রস্ত। দেশে আগুন জনিত জখম বা আঘাতে আহত মানুষের ৪৪% হলো নেশাগ্রস্ত। যারা কোন উঁচু স্থান থেকে পড়ে অথবা পানিতে ডুবে মারা যায় তাদের ৩৪% হলো নেশাগ্রস্ত। সড়কে ৩০% গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটে নেশার কারণে। দেশের ১৬% শিশু-অপরাধ হয় নেশাগত কারণে। দেশে কল কারখানায় যত দুর্ঘটনা হয় তার ৭% হলো নেশাগত কারণে। আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাজ্যে ক্যানসারের যত লোক মারা যায় তার ৬% হলো নেশাগত কারণে। এ পরিসংখ্যান থেকে মদ ও নেশার এক অত্যন্ত করুণ চিত্র ভেসে উঠেছে। বাংলাদেশে গোপনে ইয়াবাসহ নানা ধরনের নেশার প্রচলন দেদার বিস্তার লাভ করছে। আনন্দের বিষয়, সরকার নেশা ও মদের বিরুদ্ধে ভাল অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সর্বত্র রয়েছে অগণিত গডফাদার। তাদের চেলারা অক্টোপাসের মতো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। বিশেষ করে তারা নতুন প্রজন্মকে নিজেদের শিকার বানিয়ে নিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, কোন কোন অনুমোদিত কোমল পানীয়ের মধ্যেও নেশার মিশ্রণ রয়েছে। এগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। ইয়াবাসহ যত প্রকার নেশা জনিত পণ্য আছে তা সমাজ থেকে নির্মূল করা উচিত। আর তা করা উচিত আমাদের জাতির স্বার্থে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে।
No comments