রাজনীতি কাদের হাতে
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রী রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতে নেই বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ জন্য তিনি পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক শাসন ও শাসকদের দায়ী করে বলেছেন, তাঁদের কারণেই রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। স্বীকার করতে হবে যে তাঁর এই বক্তব্যে মুদ্রার এক পিঠই উঠে এসেছে। অন্য পিঠে দেখা যাচ্ছে, সেই সামরিক শাসকদের উর্দি খুলে রাজনীতিতে নিয়ে আসায় ‘বনেদি’ রাজনীতিকেরাও কম ভূমিকা রাখেননি। সামরিক শাসকদের পুনর্বাসন করার কাজটি কি বর্তমানে যাঁরা বিরোধী দলে আছেন, শুধু তাঁরাই করেছেন? ক্ষমতাসীনদের কোনোই ভূমিকা ছিল না? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আওয়ামী লীগের বহু নেতা ও কর্মী অতীতে দলীয় আদর্শ বিসর্জন দিয়ে সামরিক শাসকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। কেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত দলটি ‘বনেদি’ নেতা-কর্মীদের ধরে রাখতে পারল না, সেই প্রশ্ন না এসে পারে না। গভীর দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে মহৎ মানুষেরা নির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখেন বা রাখতে সচেষ্ট হন, তাঁদেরই আমরা রাজনীতিক বলে অভিহিত করি। আমাদের দেশেও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো রাজনীতিকেরা রাজনীতিতে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তাঁরা দেশ ও জনগণের স্বার্থকে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখতেন। কিন্তু বর্তমানে সরকারি ও বিরোধী দলের রাজনীতিকদের মধ্যে কজন সত্যিকারভাবে তাঁদের অনুসরণ করছেন?
যাঁরা এখন রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতে নেই বলে আক্ষেপ করছেন, তাঁদেরই দেখা গেছে সামরিক–বেসামরিক সাবেক আমলা ও ব্যবসায়ীদের দলে নিয়ে আসার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে। তাই, বনেদি রাজনীতিক এবং ভুঁইফোড় রাজনীতিকের সীমারেখাটি কেবল রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেওয়ার দিনক্ষণ দিয়ে না মেপে কাজ দিয়ে পরিমাপ করাই সমীচীন বলে মনে করি। সব পেশায়ই পরিচ্ছন্ন চরিত্রের মানুষ যেমন আছেন, তেমনি কলুষিত চরিত্রের মানুষও আছেন। রাজনৈতিক দলগুলো কঠোরভাবে নীতি ও আদর্শ মেনে চললে দুষ্ট প্রকৃতির লোকদের পরিশুদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টোটিই ঘটে চলেছে। রাজনীতিতে বহিরাগত সমস্যার চেয়েও রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্রচর্চা না হওয়া এবং নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধ বিসর্জন দেওয়াই বড় সমস্যা। বিশেষ করে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে বিভিন্ন দলে একশ্রেণির মাস্তান ও সন্ত্রাসী পোষা হয়; যারা নিজেদের আইনকানুনের ঊর্ধ্বে মনে করেন। সবাই চায় রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতেই থাকুক। কিন্তু সেটি কীভাবে সম্ভব, যেখানে আড়াই দশক ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ তথা ছাত্র নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রথাটিকেই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। বনেদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব আকাশ থেকেও পড়বে না আর মাটি ফুঁড়েও বের হবে না। এর জন্য একটি প্রক্রিয়া থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই প্রক্রিয়া শুরু না করে অন্ধকারেই ঢিল ছুড়ে চলেছেন।
No comments