এক ভাগ্যবিড়ম্বিত নায়কের প্রস্থান by সাজেদুল হক
প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয়
মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কি? তাকে দেয় দাহ। শনিবারের রাত এক
ভাগ্যপ্রবঞ্চিত নায়কের জন্য শেষ পর্যন্ত তাহলে দাহই লিখে রেখেছিল। খেলা
শুরু আর শেষের দৃশ্য আপনি কিভাবে মেলাবেন? ফুটবল কখনও কখনও খুবই নিষ্ঠুর?
কান্না আর অশ্রুও বিশ্বকাপ কম দেখেনি। তাই বলে খেলা শেষে দুই দলের
খেলোয়াড়রাই যোগ দেবেন একই স্রোতে? ভেঙে পড়বেন কান্নায়? তাও কি আবার হয়?
যদিও দুই দলের কান্নার উৎস আলাদা। ক্রসবারে লেগে ইতিহাস থেকে দুই ইঞ্চি
দূরে আটকে যাওয়ার শোকে মূহ্যমান চিলির খেলোয়াড়রা। আর ব্রাজিলিয়ানদের
কান্না? এতো মুক্তির আনন্দ অশ্রু। বেলো হরিজন্তের মিনেইরো স্টেডিয়ামে যে
ট্র্যাজেডি হতে হতেও হলো না।
ব্রাজিল তো ব্রাজিলই। ইতিহাস বলছে, বিশ্বকাপে বারবার ব্রাজিলের কাছে পর্যুদস্ত হয়েই বিদায় নিতে হয়েছে চিলিকে। তবে এবার নতুন করে ইতিহাস লেখার পণ করেছিল চিলি। বিশেষ করে আলেক্সিস সানচেজ। চিলির ইতিহাসে সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় তিনি। রেকর্ড দামে বার্সোলোনায় নাম লেখানো সানচেজ যদিও লিওনেল মেসি অথবা পাবলো নেইমারের মতো অতো প্রচারের আলোয় আসতে পারেননি। শনিবার রাতে খেলতে নামার আগে কিছুক্ষণ খোশগল্পে মেতে উঠেছিলেন বার্সা সতীর্থ নেইমার আর দানি আলভেজের সঙ্গে। তবে সানচেজ জানতেন প্রবল-প্রমত্ত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কিছু করতে হলে ম্যাজিক তাকেই দেখাতে হবে। খেলা শুরুর পরপরই অবশ্য ঢেউয়ের মতো চিলির রক্ষণদুর্গে একে একে হামলে পড়ছিলো ব্রাজিলের আক্রমণ। শুরুতেই গোলের দেখা পেয়ে যায় ব্রাজিল। প্রথমার্ধের ১৮ মিনিটের সময় ডেভিড লুইস গোল করে এগিয়ে দেন ব্রাজিলকে। হলুদ উৎসবে মেতে ওঠে মিনেইরো স্টেডিয়াম। এ গোলের পরই মরিয়া হয়ে ওঠেন সানচেজ। ৩২ মিনিটে সে সুযোগ এসে যায়। ব্রাজিলের রক্ষণের ভুলে বল পেয়ে যান চিলির ভারগাস। তার থ্রু ধরে অসম্ভব ঠা-ামাথায় বল ব্রাজিলের জালে পাঠান সানচেজ।
গোলই ফুটবলে শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গোলই সব নয়। অন্তত ফুটবল রোমাঞ্চ পিপাসুদের কাছে তো নয়ই। আর স্কিল বলুন, প্রতিভা বলুন, জিনিয়াস বলুন তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হয় সবচেয়ে কঠিন সময়ে, সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই। ব্রাজিল-চিলির ম্যাচটিকে অনেকেই অভিহিত করেছিলেন নেইমার বনাম সানচেজ ম্যাচ হিসেবেও। যদিও ম্যাচের প্রায় প্রতিটি ক্ষণেই উজ্জ্বলতার দিক থেকে নেইমার ম্লান ছিলেন সানচেজের কাছে। দুই-তিনজন ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডারকে ড্রিবলিং করেও বল নিয়ে এগিয়ে যেতে দেখা গেছে সানচেজকে। এ যেন বলকে পোষ মানানো এক শিল্পীর মায়ার প্রদর্শনী। যদিও এটা সত্য নেইমারের মতো ওতো ট্যাকল তাকে সহ্য করতে হয়নি। নকআউট পর্বের এ ম্যাচে যখনই নেইমারের পায়ে বল গেছে তখন তাকে ট্যাকল করে সামলানোর চেষ্টা করেছেন চিলির ফুটবলাররা। বেশ কয়েকবারই অসহ্য যন্ত্রণায় কোকড়াতে দেখা গেছে এই তারকাকে। তবে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটাইতো গ্রেটদের কাজ। শনিবার রাতে চিলির প্রায় প্রতিটি আক্রমণেরই উৎস ছিলেন সানচেজ। যেন যেখানে বল সেখানেই এই প্লে-মেকার। সানচেজ হয়তো জানতেন একমাত্র তিনিই পারেন ব্রাজিলিয়ানদের চ্যালেঞ্জ করতে। তবে দুর্ভাগ্য তাকেও তাড়া করে ফিরেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে কখনও কখনও দেরিও করেছেন। যদিও গোলের সুযোগ ব্রাজিলিয়ানরাই পেয়েছিলেন বেশি। ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল আথারটন। ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি যতটা বিরক্তিকর ছিলেন সাংবাদিক হিসেবে ততটাই আকর্ষণীয়। আত্মজীবনী ‘ওপেনিং আপ’-এ তিনি লিখেছেন, তার সময়ে শুধু দু’জন খেলোয়াড়ের মধ্যে তিনি টাচ অব জিনিয়াস খুঁজে পেয়েছেন। তাদের একজন ব্রায়ান লারা, আরেকজন মোহাম্মদ আজহার উদ্দিন। রেকর্ডবুক নিশ্চিতভাবেই ব্রায়ান লারার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে, মোহাম্মদ আজহার উদ্দিনের পক্ষে নয়। কিন্তু যারা আজহারউদ্দিনের খেলা দেখেছেন তারা মানবেন, রেকর্ডই সব নয়। ব্যাটসমান পরিচয় ছাপিয়ে আজহার উদ্দিন পরিণত হয়েছিলেন একজন ব্যাটিং শিল্পীতে। যার ব্যাটিং দেখে মনে হতো তিনি বলকে আদর করছেন।
আলেক্সিজ সানচেজ অবশ্যই আজহার উদ্দিন নন। কিন্তু ফুটবল বলুন আর ক্রিকেট বলুন, খেলাতো খেলাই। শেষ পর্যন্ত রেকর্ড ছাপিয়ে খেলার নান্দনিক সৌন্দর্যই মনে রাখে মানুষ। যে কারণে শনিবার রাতে সানচেজের খেলায় ফোটে টাচ অব জিনিয়াসের সৌন্দর্য। ২৫ বছর বয়সী এ বার্সোলোনা তারকাকে নিয়ে এরই মধ্যে আর্সেনালসহ ইংলিশ ক্লাবগুলো টানাটানি শুরু করেছে। চিলি-ব্রাজিল ম্যাচে রাতভর মাঠ মাতিয়ে রাখলেও শেষ পর্যন্ত সানচেজ এক ট্র্যাজিক হিরোর নাম। পেনাল্টি স্পেশালিস্ট হওয়ার পরও কাল টাইব্রেকারে গোল মিস করে বসলেন তিনি। এ যেন এক নান্দনিক ফুটবলারের সঙ্গে নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস। ২৮শে জুন রাতটি অন্যরা যেভাবেই মনে রাখুন না কেন, চিলির মানুষ একে মনে রাখবে ইতিহাস থেকে দুই ইঞ্চি দূরত্বে থেমে যাওয়ার রাত হিসেবে। কিন্তু কেন? অতিরিক্ত সময় শেষ হতে তখন আর দুই মিনিট বাকি। চিলির পিনিলার শটটি বারে না লাগলে তো ব্রাজিলিয়ান ট্র্যাজেডি কাল লেখাই হয়ে যেতো। এক ভাগ্যবিড়ম্বিত নায়ক সানচেজের বিদায়ে রাতে ব্রাজিল ট্র্যাজেডি আর লেখা হয়নি। লেখা হয়েছে এক ট্র্যাজিক হিরোর প্রস্থানের গল্প।
No comments