এমপি ইলিয়াস মোল্লাকে অপমানের জেরে বিহারি ক্যাম্পে আগুন!

কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পে আগুনের ঘটনার তিন দিন আগে অপমানিত হয়েছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। সবাইকে দেখে নেবে- এই মর্মে হুমকি দিয়ে ক্যাম্প ত্যাগ করেছিলেন এমপি। ওই ঘটনার বদলা নিতেই শনিবার ভোরে আতশবাজির ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে রাজু বস্তি এবং স্থানীয় যুবলীগ নেতারা আইনশৃংখলা বাহিনীর সহায়তায় কুর্মিটোলা ক্যাম্পে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। দীর্ঘদিনের বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে সৃষ্ট রাজু বস্তিবাসীর ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েছেন স্থানীয় এমপি ও তার ক্যাডাররা। এছাড়া নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে আছে ক্যাম্পের জমি দখলের ষড়যন্ত্রও।
এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করেছেন কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পবাসী। আগুন ও নিহতের ঘটনায় স্থানীয় এমপির জড়িত থাকার অভিযোগ এনে রোববার ক্ষুব্ধ ক্যাম্পবাসী তার কুশপুত্তলিকা দাহ করে। পাশাপাশি এমপির ফাঁসি দাবি করে বিভিন্ন স্লোগান দেন বিহারিরা। এদিকে ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও স্থানীয় এমপি ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করায় তার দিকে সন্দেহের তীর আরও ঘনীভূত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বিহারিদের নেতা মোস্তাক আহমেদ অভিযোগ করেন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও মাস্তানরা বিহারিদের জমি দখলের পাঁয়তারা করছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের পল্লবী জোনের পুলিশ কর্মকর্তা এসি কামাল অতি উৎসাহী হয়ে কাজ করেছেন। তার বিরুদ্ধে দখল অপরাধী চক্রকে শেল্টার দেয়ার অভিযোগ করেছেন আরও অনেকে। তবে এ অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন এসি কামাল। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমপিকে যে রাতে অপমান করা হয়, ওই রাতের পরদিন রাজু বস্তির নেতা মোঃ নিয়াজ বাদী হয়ে ২০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। বৃহস্পতিবার এ মামলা দায়েরের পর শুক্রবার বিকালে পুলিশ গিয়ে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সতর্ক করে। এ সময় পুলিশ জানায়, ‘রাজু বস্তির বিদ্যুৎ লাইন সংযোগ নিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করলে তার খবর আছে। এমপি সাহেবের নির্দেশে এখানে তারা এসেছেন বলেও পুলিশ জানায় বাসিন্দাদের।’
বিহারি ক্যাম্পের রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন ভল্টু বলেন, এ ঘটনার পেছনে ইলিয়াস আলী মোল্লা ও তার লোকজন জড়িত। তিনি প্রতিশোধের বদলা নিতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটান। এতে তার সন্ত্রাসী বাহিনী ও যুবলীগের কতিপয় নেতা জড়িত রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘটনার রহস্য বেরিয়ে আসবে। ভল্টু বলেন, রাজু বস্তির বিদ্যুৎ লাইন সংযোগ দেয়ার জন্য এমপি আমাকে ডেকেছিলেন। আমি মিটিংয়ের কারণে যেতে পারিনি। এর জন্য আমাকেসহ ২০ জনকে মামলায় ফাঁসানো হয়।
ক্যাম্পের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, রাজু বস্তিতে বিদ্যুৎ লাইন ছিল না। তাই স্থানীয় যুবলীগ নেতা জুয়েল রানা ও রাজু বস্তির লোকজন স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার প্রভাব খাটিয়ে পাশের মূল বিহারি ক্যাম্প থেকে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগ নেয়। চাঞ্চল্যকর তথ্য হল, রাজু ক্যাম্পের লোকেরা বিদ্যুৎ সুবিধে নিলেও বিহারি ক্যাম্প থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়ার কারণে তাদের বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করতে হতো না। কিন্তু এমপির লোকজন রাজুর বস্তির প্রতিটি বাড়ি থেকে বিদ্যুৎ বিলের টাকা নিত। এ টাকা অনেকের মাঝে ভাগ-ভাটোয়ারা হতো।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইলিয়াস মোল্লার ক্যাডার বাহিনীর অন্যতম ৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা জুয়েল রানা এ রাজু বস্তিতে বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে অবৈধভাবে টাকা উত্তোলন করে। এ নিয়ে বিহারি নেতাদের মাঝে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারা বিদ্যুৎ কোনোভাবেই রাজু বস্তিতে দেবে না বলে কঠোর অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে তারা রাজু বস্তিতে দেয়া বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরে এমপির লোকজন কুর্মিটোলা ক্যাম্পের বিদ্যুৎ ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করে। এ ঘটনায় রাস্তায় নেমে পড়েন ক্যাম্পের লোকেরা। শনিবারের অগ্নিসংযোগের ঘটনার তিন দিন আগে বিহারিরা বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দাবি করে। সেই দিন পুলিশের কাছে খবর পেয়ে এমপি ইলিয়াস আলী মোল্লা সেখানে গেলে তার সঙ্গে অনেকের তর্কাতর্কি হয়। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে গভীর রাত পর্যন্ত এমপি সেখানে অবস্থান করেন। পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ায় ক্যাম্পবাসীকে দেখে নেয়া হবে- এই মর্মে হুমকি দিয়ে চলে আসেন। এরই জের হিসেবে শনিবার ভোরে কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পে আগুন লাগানো হয় বলে ক্যাম্পবাসীর অভিযোগ।
বিহারি ক্যাম্পের মুন্না হোসেন অভিযোগ করেন, অগ্নিকাণ্ডের তিন দিন আগে রাতে এমপি ইলিয়াস আলী মোল্লা ক্যাম্পের সামনে হাজির হন। তিনি সেখানে এলাকার লোকদের উদ্দেশে বলেন, ‘রাজু বস্তিতে বিদ্যুৎ লাইন থাকবে। এ লাইন বৈধ না অবৈধ এবং কোথা থেকে এসেছে এটি দেখার দরকার নেই। তিনি আরও বলেন, কে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করার আদেশ দিলেন সেটিও বিবেচনায় আনার দরকার নেই। শেখ হাসিনার সরকার জনগণের সরকার। তাই জনগণের জন্য যেটি মঙ্গল হবে সেটিই করা হবে।’ ওই সময় লোকজন বলাবলি করে রাজু বস্তি থেকে আপনার নেতারা বিদ্যুতের বিল তুলছে এ বিষয়ে ইলিয়াস মোল্লা কোনো ধরনের কর্নপাত করেননি। এমপির বক্তব্যের পর ক্যাম্পের লোকজনের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। মুন্না আরও দাবি করেন, ওই রাতে বিক্ষুব্ধ লোকজন ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার পাঞ্জাবির কলার ছিঁড়ে ফেলে। ধাক্কাধাক্কিতে ইলিয়াস মোল্লা পড়ে যান।
এ ঘটনার পর রাজু বস্তির বাসিন্দা মাদক ব্যবসায়ী মোঃ রিয়াজ বাদী হয়ে বিহারি ক্যাম্পের লোকজনের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ৫। এ মামলায় কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের সভাপতি জালাল উদ্দীন আহমেদ ভল্টু ও সেক্রেটারি মোঃ ফিরোজসহ ২০ জনকে আসামি করা হয়। জানতে চাইলে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা এ বিষয়ে যুগান্তরকে জানান, তিনি ভল্টুকে ডেকে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করেন। কিন্তু সে ঘটনাস্থলে আসেন না। পরে তিনি সেখান থেকে চলে যান। তিনি দাবি করেন, ‘আমি রাজনীতি না করলেও এ ধরনের পচা নির্দেশ দিই না। তদন্ত করে দেখা হোক আমার লোক জড়িত থাকলে তাদের আইনের আওতায় নেয়া হোক।’
বিহারিদের নেতা স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটির (এসপিজেআরসি) কুর্মিটোলা ক্যাম্পের সভাপতি নিজামুদ্দিন বলেন, বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে একই পরিবারের ৯ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ গুলি করে মেরেছে একজনকে। তাদের লাশ মর্গ থেকে ক্যাম্পে নেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদের ক্যাম্পে আমাদের দুঃখের কথা শুনতে না আসেন, স্থানীয় এমপি আমাদের ওপর কি অত্যাচার শুরু করেছেন তা জানতে না আসেন তাহলে আমরা লাশগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে বিক্ষোভ করব। একই কমিটির প্রচার সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, আগুনে পুড়িয়ে আমাদের ক্যাম্পের লোকদের হত্যার দায়ে এমপি ইলিয়াস মোল্লার যথাযথ বিচার করে ফাঁসির দড়িতে ঝুলাতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.