বিহারি ক্যাম্প কালশী বস্তি: আমাদের জীবন, তোমাদের জীবন by ফারুক ওয়াসিফ

ওরা এখন কী করবে? ওদের ১০ জন মানুষ নিহত হয়েছে৷ জীবিতদের অনেককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে৷ বাকিরা পুলিশ-সাংবাদিক সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করছে, তারা পরিস্থিতির শিকার৷ এক প্রৌঢ় নারী পুলিশের কানে ঢোকাতে চাইছেন মানবতার সবচেয়ে পুরোনো বাণী, ‘আমাদের শরীরে যে রক্ত আপনাদের শরীরেও তো সেই রক্ত!’ প্রিজন ভ্যানে আটক আরিফ নামের এক যুবক লোহার শিকের খুপরির পেছন থেকে কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘আমি কিছু করি নাই, বাচ্চারে খুঁজতে আসছিলাম ভাই৷’ এক সাংবাদিক মুখ খিঁচিয়ে জবাব দিলেন, ‘বাচ্চারে খুঁজতে আসছ, নাকি পাকিস্তান থাইক্যা আসছ?’ এসব পোড়া ও রক্তাক্ত লাশ, পোড়ানো ঘর, ভাঙা দোকানপাট আর বৈরী বাঙালিদের বিদ্বেষ আর রাষ্ট্রের পুলিশের টিয়ার-গুলির সামনে তারা কী করবে? কালশীর মানুষেরা যদি প্রতিরোধ না করত, তাহলে হয়তো পুরো বস্তিটাই আগুনে ছাই হতো৷ উচ্ছেদ–আক্রমণ প্রতিরোধ করলে তারা হয় সন্ত্রাসী, না করলে পুড়ে মরে, তাহলে তারা কী করবে?
কেবলার চর থেকে কালশী বস্তি
১০ জনের সাতজন পুড়ে কয়লা হয়েছে৷ এরা বেঁচে থাকা ইয়াসিনের স্ত্রী বেবী (৪০), তিন মেয়ে শাহানা (২৬), আফসানা (১৯) ও রোকসানা (১৬), যমজ দুই ছেলে লালু (১৪) ও ভুলু (১৪) এবং মেয়ে শাহানার ছেলে মারুফ (২)। এরা আগুনে পুড়ে মারা গেছে নিজ ঘরে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেওয়া অবস্থায়৷ এই নারী ও শিশুরা কেউই কোনো গোলমালে ছিল না৷ যে বহিরাগত যুবকেরা পেট্রল ঢেলে আগুন লাগায়, তারা ছিল অপ্রতিরোধ্য৷ পুলিশি পাহারায় এ কাজ হয়েছে বলে ক্যাম্পবাসীদের অভিযোগ৷ যত বড় আগুনই হোক, পোড়াতে তো সময় লাগে৷ তাহলে আগুন লাগানো থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তারা কেন কেউ বেরতে পারল না? শত শত প্রতিবেশীই বা কেন তাদের বাঁচাতে ব্যর্থ হলো? ইয়াসিন বলেছেন, খবর পেয়ে দৌড়ে এসে তিনি দেখেন দাউদাউ জ্বলা ঘরটায় বাইরে থেকে তালা দেওয়া৷ পুলিশের লাঠি-টিয়ার-গুলির কারণে কারও সাধ্য ছিল না হতভাগ্যদের ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ আর্তনাদে সাড়া দেওয়ার৷ কালশীর বিহারি ক্যাম্পের আরিফ, আসিফ, সুমনসহ যতজনের সঙ্গে কথা হয়েছে, সবারই অভিযোগ একটাই: এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড৷ দুই বছর আগে রাজধানীর আমিনবাজারের কেবলার চরে নিহত ছয় ছাত্রের দুজনকে হত্যা করা হয়েছিল পুলিশের উপস্থিতিতেই৷ সেটাও ছিল এ রকমই এক শবে বরাতের পবিত্র রাত৷ এবারের শবে বরাতের রাত শেষের ভোরে কালশীতে যখন হত্যা-আগুন-ভাঙচুর চলে, তখনো পুলিশ ছিল জীবনের বিপক্ষে৷ নৈরাজ্যের দেশের আনাচকানাচে এভাবে কত কত গণমৃত্যুর কেবলার চর জেগে উঠছে, তার খোঁজ কি সরকার রাখে?

মহাসড়ক বনাম দুটি পোড়া ঘর
পোড়া দুটি ঘরই মহাসড়কের পাশে৷ ফলে বলা যাবে না গোলমালের মধ্যে বস্তির অলিগলি পেরিয়ে আগুন নেভাতে যাওয়া সম্ভব হয়নি৷ আর একে যদি আতশবাজির ‘উৎপাত’ থামাতে কারও ক্রোধের প্রকাশ বলা হয়, তাহলে দোকানপাটে লুটপাট-ভাঙচুর করা হলো কেন? আর পুলিশই বা কেমন পুলিশ, তাদের গুলি-টিয়ার আর ধরপাকড়ে কেবল বিহারিরাই পড়ল, হামলাকারী বহিরাগতদের কাউকে তারা আটকাতে পারল না?
ভোর ছয়টায় যারা মাস্তানদের আক্রমণ রুখে দাঁড়িয়েছিল ইটপাটকেল হাতে, বেলা ১১টা-দুপুর ১২টা নাগাদ তারা হাল ছেড়ে দিয়েছে৷ পুলিশ যাকে–তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে৷ ওদিকে নয়জনের লাশ রাখা হয়েছে বিহারি ক্যাম্পের ভেতরের আটকে পড়া পাকিস্তানিদের কার্যালয়ে। শত শত মানুষ ঘরটা ঘিরে রেখেছে৷ মাইকে একজন চিৎকার করে বাংলা আর উর্দুতে বলছে, ‘আলোচনা চলছে, আপনারা বিশৃঙ্খল হবেন না৷’ কথা শুনে মনে হলো, কী করা উচিত, কী করতে হবে, কী করা সম্ভব তার কিছুই তারা বুঝতে পারছে না৷ শুধু দুটি দাবি তাদের: আটক ব্যক্তিদের ছেড়ে দিতে হবে আর হত্যার বিচার করতে হবে৷
ওদিকে পুলিশ আইন মোতাবেক অপঘাতে নিহত ব্যক্তিদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যেতে চায়৷ কিন্তু লোকজন কোনোভাবেই লাশ দেবে না৷ এরই মধ্যে মহিলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক বিহারিদের লাশ দিতে রাজি করাতে এসেছেন৷ অবশেষে ঢাকার জেলা প্রশাসকের মধ্যস্থতায় লাশ হস্তান্তরিত হয়৷ প্রশ্ন জাগে, এলাকার নির্বাচিত সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ কেন আসেননি?

বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার ও একজন সাংসদ
ঘটনার শুরু তিন দিন আগে৷ কালশী ক্যাম্পের মধ্যে দিয়ে নতুন রাস্তা করতে গিয়ে অনেকে উচ্ছেদ হয়৷ তাদের জায়গা দেওয়া হয় একটু দূরের পাকা বস্তিতে৷ সেখানে বিদ্যুৎ ছিল না৷ দিন তিনেক আগে এলাকার সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ কালশীতে গিয়ে বলেন ওই বস্তিতে বিদ্যুৎ দিতে হবে৷ কিন্তু কালশীবাসীর ভয়, তাঁদের ৪১২ পরিবারের জন্য একটি মাত্র ট্রান্সফরমার এত চাপ নিতে পারবে না৷ তাই তঁারা সাংসদকে বলেন, ট্রান্সফরমার ঠিক রাখার দায়িত্ব তিনি নিলে তাঁরা নতুন বিদ্যুৎ-সংযোগ নিতে দেবেন৷ ওয়াসা তাঁদের পানি দেয় না, তিতাস তাঁদের গ্যাস দেয় না৷ এই বিদ্যুৎটুকুই তাঁরা সরকারের কাছ থেকে পান৷ সেটুকু তাঁরা হারাতে চান না৷ এদিকে রহস্যময় কিছু লোক তাঁদের বুঝিয়েছেন, বিদ্যুৎ নিয়ে আপসহীন থাকলে কালশী বস্তিরই লাভ৷ এ নিয়ে বাদ-বিবাদের মধ্যে সাংসদ এলাকাবাসীর তোপের মুখে পড়েন, বকাবাদ্যও শুনতে হয় তাঁকে৷ ক্যাম্পবাসীদের অভিযোগ, সাংসদের লোকজন এ জন্যই আতশবাজির অছিলায় তাঁদের ওপর হামলা চালায়৷ এ ঘটনায় স্ট্র্যান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটির প্রধান আবদুর জব্বার খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যাম্প থেকে আটকে পড়া বিহারিদের উচ্ছেদের জন্য এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এ ঘটনা আজই প্রথম নয়। আগেও এ ধরনের ঘটনা ছোট ছোটভাবে ঘটেছে।’ সুতরাং একদিকে পটকা ফোটানো নিয়ে দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের গল্প, অন্যদিকে জমির প্লট, বিদ্যুতের টানাটানি, আগ্রাসী নগরায়ণের মুখে বস্তি উচ্ছেদের পরিকল্পনার গল্প; কোনটা বিশ্বাস করব?

সমাজ যখন মাইনফিল্ড
দেশে এখন নতুন খলনায়ক গজিয়েছে৷ তাদের নাম ‘দুর্বৃত্ত’৷ বেশির ভাগ সময় সেই দুর্বৃত্তদের গোড়াটা আমরা ধরতে পারি না৷ নারায়ণগঞ্জে বিপথগামী একদল র৵াব কর্মকর্তার নামে ‘দুর্বৃত্ত’দের পরিচয় ফাঁস হওয়া বিরল ঘটনা৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তদের নাম–ধাম জানা যায় না৷ এখানে-সেখানে কেবল আমরা ‘দুর্বৃত্ত’দের কার্যকলাপের কথা শুনতে পাই৷ কিন্তু তাদের পরিচয়, তাদের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা ধরতে পাির না৷ একটি দেশে যদি জমি, ক্ষমতা ও বিত্তের ‘আগ্রাসন’ চলতে থাকে, যদি আইনের হাত দুর্বলকে পরিত্যাগ করে, যদি রাজনৈতিক নেতারা সম্পদ অর্জনের জন্য যেকোনো কিছু করতে রাজি থাকেন, মাফিয়াতন্ত্র যদি রাজনৈতিক দস্যুতন্ত্র চালু করে প্রশাসন ও আইনকে কবজা করে; তখনই দেশটা হয়ে ওঠে যুদ্ধের মাইনফিল্ডের মতো৷ তখন কারও না কারও পা সেসব মাইনের ওপর পড়বে আর আচমকা বিস্ফোরণে অনেকের প্রাণ যাবে৷ এটা ঘটছে এবং ঘটবে কিন্তু প্রতিকারের আশা থাকবে না এ কেমন দেশ!

উন্নয়নের সোনালি গল্প আর কিছু পতঙ্গ
যখন ফিরছি তখন দুপুর৷ পল্লবী পার হলে কালশী৷ এদিকে বনানী-গুলশান-সেনানিবাস৷ জলাভূমি ভরাট হয়ে বিলাসী ভবন-আবাসন তৈরি হচ্ছে৷ ফ্লাইওভার হওয়ার পর শৌখিন খাবারের দোকান, শপিং মল ইত্যাদি জমে উঠছে৷ চারদিকে উন্নয়নের দাপটের মধ্যে এক ছোট্ট দ্বীপের মতো বিহারিদের বস্তি৷ চোখ বন্ধ করে বলা যায়, এরকম বস্তি কিছুতেই টিকতে পারবে না৷ তারা গরিবদের মধ্যে গরিবতর, তারা বস্তিবাসীদের মধ্যেও দুর্বলতর, তারা দুর্বল অবাঙালি বিহারি, তাদের ওপর একাত্তর-পূর্ব পাকিস্তানি শাসকদের অভিশাপ৷ তাদের জীবন পতঙ্গের জীবন, ভাসমান, উড়ন্ত এবং খরচযোগ্য৷
কিন্তু আইনের স্বার্থে, সত্যের খাতিরে, মানবিকতার প্রয়োজনে সত্য প্রকাশ ও ন্যায়বিচার তবু প্রয়োজন৷ কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে, কারা ঘটিয়েছে—এটা যদি আমরা না জানতে পারি, তাহলে আরও অনেক ‘দুর্বৃত্তের’ বেপরোয়া আক্রমণের বিরুদ্ধে আসলেই কি কিছু করার থাকবে আমাদের?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.