‘নীল বিড়াল’-এর খোঁজে by মিজানুর রহমান খান
মতভিন্নতা কিংবা বোঝার ঘাটতির কারণে
সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল
হকের সঙ্গে একটা টানাপোড়েন টের পাই। তবে এই লেখক তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যে
মুগ্ধ, তাঁর একাধিক মাইলফলক রায়ের উদ্গ্রীব পাঠক। ‘দেশে কে সরকার সেটাই
বুঝতে পারি না’ মর্মে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, সেটা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। এ
লেখার অবতারণা সেটা যে সম্যক বুঝেশুনেই, সেই দাবি করব না। ১৫ মে প্রথম
আলোয় টিআইবির বরাতে শিরোনাম বেরোল প্রধানমন্ত্রীর একনায়কতন্ত্র চলছে। ২৪
মে সিরডাপ মিলনায়তনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন আয়োজিত এক সেমিনারে বিচারপতি
খায়রুল হকের মন্তব্য নজরে এল৷ তাঁর কথায়, ‘প্রথম আলোর মিজানুর রহমান খান
বলেন, প্রধানমন্ত্রী নাকি সরকার। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় প্রশাসনের যুগ্ম
সচিব কিংবা জমির সার্ভেয়ার হলো সরকার। আসলে এ দেশে কে সরকার সেটাই বুঝতে
পারি না।’
বাহাত্তরের সংবিধানপ্রণেতারা পাকিস্তানি অভিজ্ঞতা স্মরণ রেখে ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর হাতে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। তার চেয়েও বড় কথা, সংবিধানপ্রণেতারা জানতেন ব্রিটিশ ধাঁচে সংসদীয় গণতন্ত্র ধারণ করলেও তাঁরা জ্ঞাতসারে বিচ্যুতি ঘটিয়েছেন৷ পাকিস্তানি ভীতিই ছিল না, বঙ্গবন্ধু–বিবেচনাও ছিল। প্রথমটা স্বীকার করা হয়, পরেরটা হয় না। বিচারকসহ অনেক সাংবিধানিক সংস্থার নিয়োগে প্রধানমন্ত্রী একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেন। অথচ তিনি চাইলেই এসব ক্ষেত্রে তাঁর কর্তৃত্ব হ্রাস করে আইন করতে পারেন। যে প্রধানমন্ত্রী এসপি-ডিসির বদলি মুঠোবন্দী রাখেন, তিনি তা করবেন না। ব্রিটেন ও ভারতে কেবিনেট কমিটি সরকারের অনেক কিছু চালায়। বাংলাদেশেও কয়েকটি কেবিনেট কমিটি আছে। তা প্রধানত প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার। তাই যুগ্ম সচিব কিংবা জমির সার্ভেয়ারে আমরা সরকারের রূপ খুঁজে পেতেই পারি।
তবে আজ আমরা সরকার বুঝব বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের আলোকে। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে তিনি লিখেন, ‘সরকার সরকার হয়ে উঠবে যখন তা কতিপয়ের অঙ্গুলি হেলনে চলবে না, চলবে আইনে। কেউ আইনের উপরে নেই। ক্ষমতা জনগণের হাতে, কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে নয়।’ কোনো ঘটনায় নীরবতা, কোনো ঘটনায় গ্রেপ্তারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা ওই ‘অঙ্গুলি হেলন’ দেখি। তিনি আরও লিখেছেন, ‘১৬৮৫ সালে জন লক হবসের লেভিয়াথান নাকচ করেছিলেন। লক বলেছেন, জনগণই সার্বভৌম, কে তাদের শাসন করবে সেটাই কেবল তারা ঠিক করবে না, সরকারের তরিকা কী হবে, তাও তারা বাতলাবে।’
সরকার কী করে চলবে, সে বিষয়ে চার পণ্ডিত স্মরণীয়৷ থমাস হবস (১৫৮৮–১৬৭৯), জন লক (১৬৩২–১৭০৪), চাল৴স মঁতেস্কু (১৬৮৯–১৭৫৫) ও জাঁ জ্যাক রুশো (১৭১২–১৭৭৮)৷ লেভিয়াথান –এর রচনা ইংলিশ গৃহযুদ্ধের (১৬৪২–১৬৫১) পটভূমিতে৷ ওই সময়ের ইংল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির কিছু মিল আমরা পাই৷ সংসদ গঠন ও সরকার কী উপায়ে চলবে, তা নিয়েই ছিল ওই যুদ্ধ৷ ইংল্যান্ড এ সময়টাতেই রাজতন্ত্র হটিয়ে প্রজাতন্ত্রের উত্থান, সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রে উত্তরণ প্রত্যক্ষ করে৷ প্রথম চার্লস, যাঁর শিরশ্ছেদ ঘটেছিল, তাঁকে মনে পড়ে৷ সংসদ চেয়ো না, সুশাসন নাও—এমনই বুলি ছিল তাঁর৷ সংসদ ডাকলেন না ১০ বছর৷ ইতিহাসে তাঁর শাসন ‘১১ বছরের জুলুমশাহি’ হিসেবেও খ্যাত৷ নাগরিক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী থেকেও হবস তত্ত্ব দিয়েছিলেন, ‘রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার জনগণের নেই৷ রাজার সার্বভৌমত্ব নিরঙ্কুশ৷’ লক সেটাই নাকচ করলেন৷ জেফারসন লককে নিলেন৷ বঙ্গবন্ধুও নিলেন৷ তবে লক বলেছিলেন, ‘একটি রাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ ও নিষ্ঠুর ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে হলে শক্তিশালী অবিভক্ত সরকার দরকার৷ তবে সরকারের শাসন হতে হবে মৃদু৷’ বাংলাদেশ মৃদু শাসন দেখে না৷ দেখে ‘মৃদু লাঠিপেটা’–এর শাসন৷
২০১৪ সালের বাংলাদেশে আমরা তো হবস দেখি। ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব দেখি৷ লক দেখি না। মঁতেস্কু ও রুশো আরও গণমুখী৷ ক্ষমতার পৃথক্করণ, বিচার বিভাগ পৃথক্করণ ওঁদেরই মন্ত্র৷ মাসদার হোসেনের রায় মঁতেস্কুর ওপর দাঁড়িয়ে৷ আমাদের সরকারগুলো তা চোখ বুজে নাকচ করে চলেছে৷ সংবিধানের শুরুতেই ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ’– কথাটি রুশো থেকে নিয়েছি৷ কিন্তু রুশো প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, সেটা নিইনি৷ গণভোট হয়তো তাঁরই দর্শন৷ কারণ, রুশো বলেছেন, ‘জনগণের অভিপ্রায় কী, সে বিষয়ে তাদের দ্বারা নির্বাচিতরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না৷’ বাংলাদেশের বর্তমান টেকনিক্যাল গণতন্ত্র দেখলে রুশো নিশ্চয় মূর্ছা যেতেন৷ বিচারপতি খায়রুল হক যথার্থ লিখেছেন, ‘সরকার মূলগতভাবে একটি মোরাল ট্রাস্ট। সেটা ট্রাস্টি (সরকার) যদি রক্ষা করতে না পারে তাহলে ওই ট্রাস্ট বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে।’ বাংলাদেশের সরকারগুলো হামেশা ওই বাজেয়াপ্তের সংজ্ঞায় পড়ে।
বিচারপতি খায়রুল হককে সমর্থন করতে আমরা একেবারেই নিরুপায় হয়ে পড়ি, যখন তিনি মন্তব্য করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতোই বাংলাদেশ সংবিধান রাষ্ট্রীয় তিন স্তম্ভের সকল ক্ষমতা ও কার্যাবলির সন্দেহাতীত উৎস।’ এটা উৎস, কিন্তু তা সরকারের নিজের মতো করে। ওই দুটি দেশের সঙ্গে কিছুতেই তা তুলনীয় নয়। দুই দেশেই নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে৷
ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ের ১১৭৯ অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেন, ‘প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার ওপর ন্যস্ত।’ এটা তাঁর সৃজনশীল ব্যাখ্যা৷ আমরা সমর্থন করি৷ কিন্তু সংবিধানে তা লেখা নেই৷ এবং আমাদের কাছে উপযুক্ত দলিল আছে যেখানে আমরা দেখি, বাহাত্তরে এটা সুচিন্তিতভাবে বর্জন করা হয়েছিল৷ সংবিধানপ্রণেতারা নির্বাহী ক্ষমতাটা একা প্রধানমন্ত্রীর কবজায় দিতে চাননি৷ বুঝতে পারি কিংবা বুঝতে চাই যে, বিচারপতি খায়রুল প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে ব্যক্তিনির্ভর নয়, সমষ্টিগত করার প্রশংসনীয় অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। তবে সরকার কেবল তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের অংশটুকু পড়েই তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে৷ অথচ এটাও তার অবশ্যপাঠ্য৷ এর আলোকে সংবিধান শোধরাতে হবে।
সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা ২০১০ সালে দেওয়া ওই রায়ের আগে ও পরে একই থাকার কথা নয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার যে সংকোচন ঘটেছে, সেটা মানতে হবে৷ আলোচনা করতে হবে। তবে সংবিধানের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ একটি সমাজের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগপত্রটা হাতে নিলেন৷ রাষ্ট্রপতিকে সার্কনেতাদের আমন্ত্রণ পরিকল্পনা খুলে বললেন৷ রাষ্ট্রপতি মুগ্ধ৷ কারণ, তিনি জানলেন এ নিয়ে মোদি কংগ্রেস সরকারের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছেন৷ এসব সংবিধানে লেখা থাকবে না৷
বিচারপতি খায়রুল হক লিখেছেন, ‘একটি সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকেন।...মন্ত্রিসভা হচ্ছে একটি সংসদীয় সরকার, প্রধানমন্ত্রী যার প্রধান, আর তারাই চূড়ান্ত নীতিনির্ধারণী এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়ামক।...সুতরাং এই সংসদীয় গণতন্ত্র সংবিধানের একটি মৌলিক কাঠামো, যা সংসদ সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যও হ্রাস বা পরিবর্তন করতে পারে না।’ এই যুক্তিতেই ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিলোপ ঘটল। এত সব কাণ্ড ঘটল। কিন্তু তার বিনিময়ে কী পেলাম। যে সংসদীয় গণতন্ত্র ‘মৌলিক কাঠামো’, সেটা কোথায়? কোথায় খুঁজি তারে।
সুতরাং মানছি তাঁকেই, একটি মন্ত্রিসভা সরকার পরিচালনার নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠলে তবে বাংলাদেশ বিচারপতি খায়রুল হক বর্ণিত মৌলিক কাঠামোতে উন্নীত হবে। এখন এটা পোকায় খাওয়া। তাঁরই বাতলানো পথে আমরা হাঁটব: ‘আমাদের সংবিধান এমন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিষ্ঠা করেছে যে, যা কিনা একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার নিশ্চিত করেছে। আর সেটা মৌলিক ব্যক্তিস্বাধীনতার সুরক্ষা দিচ্ছে। ক্ষমতাকে বিভক্ত ও পৃথক করেছে। যাতে করে কোন ব্যক্তি কিংবা বিশেষ পদাধিকারী যথেষ্ট শক্তিশালী না হয়ে ওঠে।’
বাস্তবে এটা আমরা অর্জন করিনি, করতে হবে৷ ওই ব্যক্তিই শক্তিমান, প্রধানমন্ত্রী সর্বত্র বিরাজমান। তাই বলি, এ দেশে প্রধানমন্ত্রীই সরকার। তবে বিচারপতি খায়রুল হকের কথা দিয়েই শেষ করি। গত ২৫ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের পুনর্মিলনীতে তিনি একটি চমৎকার সুলিখিত ভাষণ দিয়েছেন। বলেছেন, প্রায় ৫০ বছর আগে অধ্যাপক সাইদুর রহমান তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমরা অন্ধকারে একটি নীল বিড়াল খুঁজে বেড়াচ্ছি।’ ৫০ বছর পরে তিনি সেখানে জুতসই সংশোধনী এনেছেন যে ‘আমরা সকলেই অন্ধকারে নীল বিড়াল খুঁজি, তবে কথা হলো বিড়ালটা সেখানে নেই।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments