চারপাশের উত্তাপে ওষ্ঠাগত জীবন by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

বাংলাদেশকে এখন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির সঙ্গে তুলনা করা যায়। চারদিকের প্রচণ্ড উত্তাপে এ দেশের নাগরিক জীবন সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে। এ উত্তাপ প্রশমিত না হলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠবে। তবে কতিপয় শ্রেণীর লোক আবার লাভবান হবেন। প্রাকৃতিক উত্তাপ হ্রাস না পেলে মানুষের শারীরিক অসুস্থতা বাড়বে। এর ফলে চিকিৎসক, হাসপাতাল ব্যবসা, বৈদ্যুতিক পাখা ও এসি বিক্রেতা এবং ওষুধ কোম্পানিগুলো ভালো ব্যবসা করবে। রাজনীতিতে উত্তাপ কমিয়ে স্থিতিশীলতা আনতে না পারলে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা হামলা-মামলায় জর্জরিত হলেও লাভবান হবেন আইনজীবী এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। জমে উঠবে উকিলদের মামলা-মোকদ্দমা-ব্যবসা আর পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্য। আর বাজারের উত্তাপে সাধারণ মানুষ নাস্তানাবুদ হলেও ফুলে-ফেঁপে উঠবে মজুদদার, মুনাফাখোর ও সিন্ডিকেটবাজ ব্যবসায়ীরা। প্রতিটি ক্ষেত্রের উত্তাপ হ্রাস প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। প্রাকৃতিক দাবদাহ থেকে বাঁচতে যেমন প্রয়োজন মৌসুমি বৃষ্টিপাত, তেমনি রাজনৈতিক উত্তাপ থেকে পরিত্রাণের জন্য দরকার সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা এবং সহমর্মিতার সূচনা। আর বাজারের উত্তাপ কমাতে প্রয়োজন সরকারের দেখভাল এবং নিবিড় তত্ত্বাবধান। উল্লিখিত তিন ক্ষেত্রের উত্তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে দেশ ক্রমান্বয়ে শান্তি ও উন্নয়মুখী হয়ে উঠবে।
মুনাফাখোর ও মূল্যসন্ত্রাসী সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার প্রতিশ্র“তি দিয়ে মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু পাঁচ বছরে ওই সরকার সে কাজটি করতে পারেনি। বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মহাজোট সরকার ব্যর্থ হয়েছিল। আর ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত নড়বড়ে সরকার যে ওই কঠিন কাজটি করতে পারবে এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ এ সরকার তার নৈতিক বৈধতা নির্মাণে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের কাজে মনোযোগ দিতে পারবে না। ফলে বাজারের উত্তাপ সহজে কমবে না। আর কিছুদিন পরই আসছে মুসলমানদের পবিত্র মাহে রমজান মাস। আর এ রমজানকে লক্ষ্য করে মূল্যসন্ত্রাসী সিন্ডিকেটবাজরা এখন থেকে ছোলা, পেঁয়াজু, রসুন, আদা, চিনি প্রভৃতি পণ্য টার্গেট করে অবৈধ মুনাফা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।
মূল্যসন্ত্রাসী সিন্ডিকেটবাজদের মুনাফা করার নানা কৌশল আছে। এর একটি হল- রোজা শুরু হওয়ার আগেই এরা একবার মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে রাখে। পরে রোজা শুরু হলে আরেক দফা স্বল্প মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে দাবি করে, এবার রোজায় খুব বেশি মূল্যবৃদ্ধি ঘটেনি। এ পুরনো কৌশল অবলম্বন করে এখনই বাজারে একদফা মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে। এ কৌশলের অংশ হিসেবে চাল, আদা ও পেঁয়াজের দাম এখনই বেশ কিছুটা বাড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এক কেজি চায়না আদার দাম এখন ২০০ থেকে ২২৫ টাকা। সরু চালের দামও বেড়েছে কেজিতে দু-তিন টাকা করে। বাজারের উত্তাপ এমনই যা সবাইকে স্পর্শ করে। সাধারণ মানুষ এ নড়বড়ে সরকারের অধীনে রোজা আসার আগেই বাজারের উত্তাপে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছেন। আর রোজা আসার পর যে নিত্যপণ্যের মূূল্য আরেকটি লাফ দেবে এবং সিন্ডিকেটবাজরা রোজাদারদের পকেট কেটে ফুলে-ফেঁপে উঠবে তা বলা যায়। পরিস্থিতি বিচার করে বলা যায়, বাজারের উত্তাপ কমাতে সরকার সুবিধা করতে পারবে না।

প্রাকৃতিক উত্তাপ না কমলে সে দায় সরকারকে দেয়া যায় না। কারণ এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় নেই। বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়ন বৃদ্ধির প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। জলবায়ুর আমূল পরিবর্তনে ঋতুবৈচিত্র্যে এসেছে নতুনত্ব। এখন আর আগের মতো শীত পড়ে না। হয় না আগের মতো অধিক হারে বৃষ্টিপাতও। বার্ষিক সার্বিক বৃষ্টিপাত হ্রাস পাওয়ায় মানব আচরণে এবং প্রকৃতির চরিত্রেও তার প্রভাব পড়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে দায়ী না করা গেলেও সরকারের উচিত নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে দেশবাসী যাতে মানিয়ে নিয়ে সম্পৃক্ত হতে পারেন, তেমনভাবে তাদের উদ্বুদ্ধ করা। ষড়ঋতুর দেশে এখন গ্রীষ্মের প্রভাবই যেন সবচেয়ে বেশি। জীবন-সংগ্রামে নিয়োজিত সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষণস্থায়ী বসন্ত কখন আসে বা যায়, তা খুব একটা স্পষ্ট হয় না। হেমন্ত আর বসন্তের অস্তিত্ব জনসাধারণের জীবন থেকে হারিয়ে যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
রাজনীতির উত্তাপ নিয়ে অনেক কিছু বলার আছে। এ উত্তাপের হ্রাস-বৃদ্ধিতে সরকারের, বিরোধী দলের এবং সর্বোপরি জনগণের করণীয় আছে। দেশে রাজনৈতিক উত্তাপ-উত্তেজনা বেশি হলে সে দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে না। এজন্য দেশের উন্নয়নের জন্য রাজনীতির স্থিতিশীলতা খুবই প্রয়োজন। আর এ স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা জরুরি। তবে যে কোনো সরকারই কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে একই রকম ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে না। অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের পক্ষে এ কাজ করা যতটা সহজ, জনগণের ম্যান্ডেট না নিয়ে সংকট ধামাচাপা দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে সচেষ্ট সরকারের পক্ষে সে কাজ করা ততটা সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে রাজনীতির উত্তাপ কমানোর কাজটি কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে সরকার যদি সত্যিই রাজনৈতিক উত্তাপ কমাতে চায়, তাহলে তাকে বিরোধী দলের সঙ্গে সহমর্মিতা ও সমঝোতা সৃষ্টির পথে অগ্রসর হতে হবে। এছাড়া একতরফাভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টির কোনো বিকল্প পথ নেই। কিন্তু সরকারি কাজে সমঝোতা সৃষ্টির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সমালোচনা ও বিরোধিতা দমিয়ে রেখে বা হামলা-মামলা এবং গ্রেফতার, খুন-গুম ও আতংক সৃষ্টি করে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা যায় না।
বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে লক্ষ্য করলে স্থিতিশীলতা সৃষ্টির উদ্যোগ চোখে পড়ে না। রাজনৈতিক সমঝোতার পরিবর্তে রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ব্যক্তিদের খুন, গুম ও অপহরণের নৈমিত্তিক খবর দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকে রাজনৈতিক পরিচয়ধারীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় চলমান রাজনীতি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার যদি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করত, তাহলে দ্রুতই রাজনৈতিক উত্তাপ হ্রাস পেত। এ কাজ করার পরিবর্তে সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার উপায় খুঁজতে ব্যস্ত। এ লক্ষ্যে সরকারপ্রধান বিরোধী দলকে এর অন্যতম মিত্র জামায়াত থেকে দূরে রাখার পরিকল্পনায় অনেকটা এগিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। দশম সংসদ নির্বাচনপরবর্তী সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার ‘ধীরগতি’ এবং দেশের কতিপয় অঞ্চলে জামায়াত নেতাদের জোট বেঁধে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘটনায় সাধারণ মানুষ মনে করছেন, সরকার বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করার লক্ষ্যে বিএনপি থেকে জামায়াতকে সরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় অনেকটাই সফল হতে যাচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনের সময় সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা অনেক উপজেলায় টেবিলকাস্ট, ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরা ও ভোট কাটাকাটি করতে পারলেও জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলেকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বিশাল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভে বাধা দেয়নি।
বিএনপির আরেক মিত্র হেফাজতে ইসলামকেও সরকার কাছে টানতে পেরেছে বলে আপাতত প্রতীয়মান হচ্ছে। উল্লেখ্য, হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে এ সংগঠনটির সরকার ঘনিষ্ঠতা প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। হেফাজতের প্রতি সরকারের ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের নির্দয় আচরণের বর্ষপূর্তিতে এ বছর সংগঠনটি কোনো বড় রকমের কর্মসূচি না দিয়ে যতদূর জানা যায়, তাদের কর্মসূচি নীরব ও শান্তিপূর্ণ এবং দোয়া মাহফিলে সীমাবদ্ধ রেখেছে। হেফাজতের আমীরের সঙ্গে এ বছর ১৭ মার্চ সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সাক্ষাৎ করেন। ২২ এপ্রিল বৈঠক করেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক এবং ১১ ও ১২ এপ্রিল চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে শানে রেসালত সম্মেলনের একদিন আগে এক ঘণ্টার বৈঠক করেন সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। মন্ত্রী মহোদয়ের উল্লিখিত বৈঠকের পরদিন লালদীঘির সম্মেলনে মাওলানা আহমদ শফী আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে বন্ধু হিসেবে অভিহিত করে বক্তব্য দেন। হেফাজতের এ আচরণে অনেক হেফাজত অনুসারী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে একে ‘তৌহিদি জনতার রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে বিবেচনা করেন।
খেলাফত আন্দোলনের প্রচার সম্পাদক ৫ মে’র বর্ষপূর্তিতে হেফাজতের নীরবতা ও ম্রিয়মাণ কর্মসূচির সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সেদিনের মর্মান্তিকতাকে ভুলতে পারছি না। ভুলতে পারবও না। তারা কিভাবে ভুলে থাকত পারেন তা বোধগম্য নয়।’ তবে রাজনৈতিক কূটকৌশলে অনভিজ্ঞ হেফাজতে ইসলামকে এখনই বিশ্বাসঘাতক মনে করা যথার্থ হবে না। ৫ মে’র সমাবেশ চলাকালে যে বিএনপি চেয়ারপারসন ঢাকাবাসীকে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে বলেছিলেন, সে দলটির সঙ্গে না থেকে নিজ ক্ষতস্থানে সরকার কিছু সান্ত্বনা ও প্রলোভনের মলম লাগালেই যে হেফাজত বিএনপির বিরুদ্ধে গিয়ে স্থায়ীভাবে সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়বে এমনটি বিশ্বাস্য নয়। মামলা ও সরকারি হুমকি-নিপীড়নের চাপে হয়তো সংগঠনটি এখন সরকারের শেখানো সুরে বক্তব্য দিতে বাধ্য হচ্ছে, কিন্তু সময় এলে হয়তো এরাই আবার ভিন্ন সুরে বক্তব্য প্রদানে দ্বিধাগ্রস্ত হবে না।
সরকারের মনে রাখা ভালো, বিভিন্ন রাজনৈতিক কূটকৌশলের খেলার মধ্য দিয়ে প্রতিশ্র“ত মধ্যবর্তী একাদশ সংসদ নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার বিষয়টি জনসাধারণ মোটেও ভালো চোখে দেখছেন না। এর ফলে সরকারের কট্টর সমর্থক নাগরিকরা বাদে বাকি সবাই সরকারের সমালোচনা করছেন এবং ক্রমান্বয়ে সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছেন। সরকারের উচিত ছিল বেশি চালাকি না করে জনসেবামূলক কাজ বাড়িয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে ভাসমান ভোটারদের নিজ পক্ষে রাখার চেষ্টা করা। এ পথে এগোলে একদিকে সরকার নিজের পক্ষের সমর্থক হারাতো না এবং অন্যদিকে দেশে প্রবহমান রাজনৈতিক উত্তাপ কমে আসত। সরকার কিছু না করলেও আর মাসখানেকের মধ্যে নিয়মিত বৃষ্টিপাত শুরু হলে প্রাকৃতিক উত্তাপ কমে আসবে। কিন্তু বাজার আর রাজনীতির উত্তাপ কমাতে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। সরকারের উচিত হবে এ ক্ষেত্রে জনগণের সঙ্গে বেশি রাজনীতি করে এবং তাদের বোকা মনে করে হাইকোর্ট দেখানোর চেষ্টা না করে গঠনমূলক পথে অগ্রসর হওয়া। তা না হলে বিরোধী দল ও জনগণের বিরাগভাজন হয়ে এককভাবে সরকারের পক্ষে চলমান রাজনৈতিক উত্তাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.