মন্দির, মোদি এবং মধুর ভান্ডারকর
নবনীতা দেব সেন আমাকে বলেছিলেন, জীবনের ঘটনা থেকেই সিনেমা তৈরি হয়৷ কিন্তু সিনেমাটা তৈরি হয়ে যাওয়ার পর লোকে বলে, ধুস, ওটা তো সিনেমা৷ ওসব সিনেমাতেই হয়৷ সকালে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে হঠাৎ কথাটা মনে পড়ল৷ খবর বেরিয়েছে, মুম্বাইয়ের নামকরা পরিচালক মধুর ভান্ডারকর ভাবছেন, নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে একটা বায়োপিক তৈরি করবেন৷ বলিউডে ইদানীং নামকরা ব্যক্তিদের জীবনী-সিনেমা খুব তৈরি হচ্ছে৷ িধরুভাই আম্বানির জীবন নিয়ে গুরু, মিলখা সিংকে নিয়ে ভাগ মিলখা ভাগ, বিপ্লবী ভগত সিংকে নিয়ে দুটো সিনেমা হয়েছে, গান্ধীজি-নেতাজিদের নিয়ে তো আগেই হয়েছে৷ এখন অলিম্পিক পদক জয়ী বক্সার মেরি কমকে নিয়েও তৈরি হচ্ছে সিনেমা৷ মেরি কমের ভূমিকায় আছেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া৷ নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে সে ক্ষেত্রে সিনেমা হলে তাতে অভিনবত্ব নেই৷ তবে প্রশ্ন আছে৷ এত দিন মোদিকে নিয়ে এমন ভাবনা তো কেউ ভাবেননি! এখন তাহলে কেন? সাফল্য? প্রধানমন্ত্রীর সাকসেস স্টোরি? নাকি তাঁর জীবনে এমন সব উপাদান আছে, যা নিয়ে সিনেমা হলে মানুষ হাঁ করে দেখবে? মধুর ভান্ডারকর কী বলবেন জানি না৷ তবে অস্বীকার করা যাবে না, মোদির জীবন ঠিক যেন রূপকথার এক কাহিনি৷ পরতে পরতে বিস্ময়৷ চা-বিক্রেতার ছেলের দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠাকেই তো ইংরেজিতে ‘ফ্রম র্যাগ টু রিচেস স্টোরি’ বলা হয়!
আমরা যারা সাংবাদিকতা করি, অনেকেই সবজান্তা মনে করেন৷ ভোটের সময় তাই তাঁদের অবধারিত প্রশ্ন শুনতে হয়, আচ্ছা, কী হতে চলেছে বলুন তো? এবার সেই প্রশ্ন দিনে অন্তত দশবার শুনতে হয়েছে৷ তিন দফায় ‘মিনি ইন্ডিয়া’ উত্তর প্রদেশ ঘুরেছি৷ যখনই কেউ জানতে চেয়েছেন কী হতে চলেছে, আমি বলেছি, ভোট তো চুকেবুকে গেছে, এখন শুধু ফল ঘোষণা বাকি৷ শুনে অধিকাংশই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন৷ কেউ কেউ ঝগড়া করেছেন৷ আমার অতি ঘনিষ্ঠ মুসলমান বন্ধুরা বলেছেন, এবার সারা দেশেই মুসলমানেরা এক প্যাটার্নে ভোট দেবে৷ বিজেপি প্রার্থীকে যে যেখানে হারাতে পারবে, সেখানে তারা তাকেই ভোট দেবে৷ উদ্দেশ্য একটাই, মোদিকে ঠেকাও৷ আমি সেই বন্ধুদের বলতাম, মোদির উত্তরণের রহস্যটাও এই মনোভাবেই লুকিয়ে থাকছে৷ এবারের ভোটের থিম সং যদি শেষ পর্যন্ত ওটাই হয়, তাহলে শতভাগ নিশ্চিত, ভোটটা হবে মোদির নামে এবং তিনিই জিতবেন৷ কারণ, মুসলমান ভোটের মেরুকরণ হিন্দু ভোটেও মেরুকরণ ঘটাবে৷ বিজেপিও তা-ই চায়৷ কেন চায় সেটাও সহজবোধ্য৷ ভারতে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ ঠিক এ কথাটাই লক্ষ্ণৌয়ে মুসলিম পার্সোনেল ল বোর্ডের সদস্য সমাজবাদী পার্টির ঘনিষ্ঠ জাফরইয়াব গিলানিকে বলতে তিনি যুক্তি ও বাস্তবতা মেনে বলেছিলেন, সেটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি৷ কিন্তু তবু ওই মেরুকরণ ছাড়া মুসলমানদের নাকি উপায় নেই৷ গিলানি হিসাব করে বলেছিলেন, ৩৫ থেকে ৪০টার বেশি আসন বিজেপি উত্তর প্রদেশে পাবে না৷ আমার তখনই মনে হয়েছিল, ওঁর হিসাবেই যদি এত, বাস্তবে তাহলে ৪০-৪৫ তো হবেই! শেষমেশ বিজেপি পেল ৮০-র মধ্যে ৭১, দুটি আসন তার জোটসঙ্গী ‘আপনা দল’৷
এই বিপুল মেরুকরণের রহস্য কী? আশির দশকের শেষ ও নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগ ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে তিনটি ‘ম’ উপহার দিয়েছে৷ মন্দির, মণ্ডল ও মার্কেট৷ রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্ক ঘিরে বিজেপির মন্দিরের রাজনীতি, তা ঠেকাতে মণ্ডল কমিশনকে হাতিয়ার করে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের ‘মণ্ডল রাজনীতি’ এবং প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও ও মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে বাজার অর্থনীতির বিকাশ—তিনটিরই আবির্ভাব প্রায় একই সময়ে৷ বিজেপি মন্দিরের রাজনীতি করেও লোকসভায় ১৮২টির বেশি আসন পায়নি৷ মণ্ডলের রাজনীতি মুলায়ম, মায়াবতী, লালু, নিতীশদের চারধারে গণ্ডি কেটে দিয়েছে, যার বাইরে বেরোনোর ক্ষমতা তাঁরা অর্জন করতে পারেননি৷ তাঁরা সবাই একেকটা জনগোষ্ঠীর নেতা হয়েই থাকলেন৷ বিজেপি এত দিন যা পারেনি, মোদি কিন্তু তা পারলেন৷ মন্দির ও মণ্ডলের সঙ্গে মিশেল দিলেন মার্কেটের৷ গুজরাটিরা জন্মগত ব্যবসায়ী৷ তাদের ডিএনএতেই অর্থনীতি লেপ্টে রয়েছে৷ এই সহজাত বিষয়টিই মোদির উন্নয়নের তাগিদ৷ এটাই তাঁর বহুচর্চিত ‘গুজরাট মডেল’৷ বাজারের ওপর ভর করে মোদি সেটাই হাতিয়ার করলেন প্রশাসনিক অঙ্গ হিসেবে৷
তাহলে কী দাঁড়াল? একেবারে নির্ভেজাল ইচ্ছাপূরণের কাহিনি নিয়ে সিনেমা৷ মোদিকে চমৎকারভাবে তুলে ধরা হলো ‘চা-ওয়ালার ছেলে’ হিসেবে৷ গুজরাটি সমাজে মোদিরা অনগ্রসর জাতির প্রতিনিধি৷ কট্টর হিন্দু হিসেবে তাঁর পরিচিতিও সেই গোধরাকাণ্ডের সময় থেকেই৷ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও তিনি কঠোর ও কঠিন এবং উন্নয়নমুখী ও বাস্তববাদী৷ ফলে কট্টর হিন্দুত্বের সঙ্গে অনগ্রসরতার মিশেল ও উন্নয়নের সোনালি স্বপ্ন দেখিয়ে ‘মার্কেট ফ্রেন্ডলি’ ইমেজ আদায়, ঠিক যেন অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে মনমোহন দেশাইয়ের মারমার কাটকাট অমর আকবর অ্যান্টনি৷ শুধু মন্দির আঁকড়ে বিজেপি যেমন, তেমনই স্রেফ জাত আঁকড়ে মুলায়ম, মায়াবতী, লালু, নিতীশরাও আঞ্চলিক রাজনীতিতে মহিরুহ হয়ে উঠলেও জাতীয় রাজনীতিতে বনসাই হয়ে রইলেন৷ তুলনায় মোদি হয়ে গেলেন একমেবাদ্বিতীয়ম্৷ মায়াবতী-মুলায়মেরা দলিত ও অনগ্রসরদের সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতে পারেননি৷ কিন্তু মোদি সেই বিশ্বাসটা গেঁথে দিতে পেরেছেন৷ রাজনীতিতে ‘পারসেপশন’-ই প্রথম ও শেষ কথা৷ মোদির ক্ষেত্রে একদিকে সেটা যেমন দাঙ্গাবাজ, অন্যদিকে তেমন সুপ্রশাসক, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী উন্নয়নকামী বলিষ্ঠ নেতার৷ দেশের মানুষ অন্যদের বিশ্বাস করেনি৷ মোদিকে তারা বিশ্বাস করেছে৷ ভরসাও৷
মোদি মানুষটা কেমন? যাঁরা তাঁকে জানেন-চেনেন, তাঁরা বলেন, মোদি হলেন একবগ্গা, জেিদ, কাজপাগল, নিষ্ঠুর এবং পিছুটানহীন একজন একলা মানুষ৷ দল বা সংঘ কাউকেই তিনি বিশেষ একটা তোয়াজ কখনো করেননি৷ সরকারে তিনিই ছিলেন এক থেকে এক শ৷ যার ফলে গুজরাটে মোদির মন্ত্রিসভায় বাকি যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সবাই প্রায় অজ্ঞাতকুলশীল৷ প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় পরও তাঁর চরিত্রের যে বিশেষ বদল ঘটবে, তা মনে করা ভুল হবে৷ বিজেপির অন্যরা তো বটেই, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘও (আরএসএস) এ বিষয়ে যথেষ্ট সংশয়ী৷ তাঁর জমানায় আরএসএস ক্রমেই তার প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে বলে কোনো কোনো মহলের ধারণা৷ দল ও সরকারে প্রবীণদেরও তিনি যে ক্রমে কোণঠাসা করে দেবেন, সে ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে৷ তাঁর সরকার একমাত্র তাঁরই৷ সেই সরকারকে সফল করতে তিনি চেষ্টায় খামতি রাখবেন না নিশ্চিত৷ পাঁচ বছর পরে রিপোর্ট কার্ড দেবেন বলে নিজেই যে কথা জানিয়েছেন, সেটাই নিজের কাছে তাঁর চ্যালেঞ্জ৷
মোদির নিন্দুকেরা বলেন, তিনি নাকি প্রতিহিংসাপরায়ণ৷ অপমানের জ্বালা তিনি নাকি ভোলেন না৷ মনস্তত্ত্ববিদেরা মনে করেন, কোনো রকমের তকমা এঁটে যাওয়া মানুষেরা আপ্রাণ চেষ্টা করেন সেই তকমা ঝেড়ে ফেলার৷ কেউ সফল হন, কেউ হন না৷ মোদির তকমাটা হলো দাঙ্গার৷ গোধরার খলনায়ক গুজরাটকে দাঙ্গাহীন রাজ্যে পরিণত করেও ১২ বছরে দাঙ্গাবাজের তকমা কপাল থেকে খুলতে পারেননি৷ এ জন্য তিনি মনস্তাপে ভুগছেন, এমন কথাও অবশ্য কেউ বলে না৷ দাঙ্গার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা বা দুঃখ প্রকাশও আজ পর্যন্ত সেভাবে তিনি করেননি৷ কিন্তু দেশের প্রশাসক হয়ে দাঙ্গাকে কড়া হাতে দমনের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে দাঙ্গাবাজের তকমা ঝেড়ে ফেলার সুযোগটা তিনি পাবেন৷ এটাই তাঁর মূল চ্যালেঞ্জ৷ সুশাসনের সঙ্গে উন্নয়ন ও প্রগতি তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হলে দেশে শান্তি ও সুস্থিতি বজায় রাখা খুবই জরুরি৷ গুজরাটি হয়ে তিনি নিশ্চয় তা অনুধাবন করবেন৷ পাঁচ বছর পরে রিপোর্ট কার্ড মেলানোর সময় লোকে কিন্তু ওই দিকটাই আতশ কাচের তলায় রাখবে৷ মধুর ভান্ডারকরের সিনেমায় কোন নরেন্দ্র মোদিকে দেখা যাবে, সেই আগ্রহ গুজরাটি প্রধানমন্ত্রীরও নিশ্চয় রয়েছে৷ আশা করি, তাঁর জানা আছে, কলিঙ্গ যুদ্ধের পর চণ্ডাশোকও ধীরে ধীরে ধর্মাশোকে রূপান্তরিত হয়েছিলেন৷
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিিল্ল প্রতিনিধি।
আমরা যারা সাংবাদিকতা করি, অনেকেই সবজান্তা মনে করেন৷ ভোটের সময় তাই তাঁদের অবধারিত প্রশ্ন শুনতে হয়, আচ্ছা, কী হতে চলেছে বলুন তো? এবার সেই প্রশ্ন দিনে অন্তত দশবার শুনতে হয়েছে৷ তিন দফায় ‘মিনি ইন্ডিয়া’ উত্তর প্রদেশ ঘুরেছি৷ যখনই কেউ জানতে চেয়েছেন কী হতে চলেছে, আমি বলেছি, ভোট তো চুকেবুকে গেছে, এখন শুধু ফল ঘোষণা বাকি৷ শুনে অধিকাংশই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন৷ কেউ কেউ ঝগড়া করেছেন৷ আমার অতি ঘনিষ্ঠ মুসলমান বন্ধুরা বলেছেন, এবার সারা দেশেই মুসলমানেরা এক প্যাটার্নে ভোট দেবে৷ বিজেপি প্রার্থীকে যে যেখানে হারাতে পারবে, সেখানে তারা তাকেই ভোট দেবে৷ উদ্দেশ্য একটাই, মোদিকে ঠেকাও৷ আমি সেই বন্ধুদের বলতাম, মোদির উত্তরণের রহস্যটাও এই মনোভাবেই লুকিয়ে থাকছে৷ এবারের ভোটের থিম সং যদি শেষ পর্যন্ত ওটাই হয়, তাহলে শতভাগ নিশ্চিত, ভোটটা হবে মোদির নামে এবং তিনিই জিতবেন৷ কারণ, মুসলমান ভোটের মেরুকরণ হিন্দু ভোটেও মেরুকরণ ঘটাবে৷ বিজেপিও তা-ই চায়৷ কেন চায় সেটাও সহজবোধ্য৷ ভারতে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ ঠিক এ কথাটাই লক্ষ্ণৌয়ে মুসলিম পার্সোনেল ল বোর্ডের সদস্য সমাজবাদী পার্টির ঘনিষ্ঠ জাফরইয়াব গিলানিকে বলতে তিনি যুক্তি ও বাস্তবতা মেনে বলেছিলেন, সেটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি৷ কিন্তু তবু ওই মেরুকরণ ছাড়া মুসলমানদের নাকি উপায় নেই৷ গিলানি হিসাব করে বলেছিলেন, ৩৫ থেকে ৪০টার বেশি আসন বিজেপি উত্তর প্রদেশে পাবে না৷ আমার তখনই মনে হয়েছিল, ওঁর হিসাবেই যদি এত, বাস্তবে তাহলে ৪০-৪৫ তো হবেই! শেষমেশ বিজেপি পেল ৮০-র মধ্যে ৭১, দুটি আসন তার জোটসঙ্গী ‘আপনা দল’৷
এই বিপুল মেরুকরণের রহস্য কী? আশির দশকের শেষ ও নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগ ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে তিনটি ‘ম’ উপহার দিয়েছে৷ মন্দির, মণ্ডল ও মার্কেট৷ রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্ক ঘিরে বিজেপির মন্দিরের রাজনীতি, তা ঠেকাতে মণ্ডল কমিশনকে হাতিয়ার করে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের ‘মণ্ডল রাজনীতি’ এবং প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও ও মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে বাজার অর্থনীতির বিকাশ—তিনটিরই আবির্ভাব প্রায় একই সময়ে৷ বিজেপি মন্দিরের রাজনীতি করেও লোকসভায় ১৮২টির বেশি আসন পায়নি৷ মণ্ডলের রাজনীতি মুলায়ম, মায়াবতী, লালু, নিতীশদের চারধারে গণ্ডি কেটে দিয়েছে, যার বাইরে বেরোনোর ক্ষমতা তাঁরা অর্জন করতে পারেননি৷ তাঁরা সবাই একেকটা জনগোষ্ঠীর নেতা হয়েই থাকলেন৷ বিজেপি এত দিন যা পারেনি, মোদি কিন্তু তা পারলেন৷ মন্দির ও মণ্ডলের সঙ্গে মিশেল দিলেন মার্কেটের৷ গুজরাটিরা জন্মগত ব্যবসায়ী৷ তাদের ডিএনএতেই অর্থনীতি লেপ্টে রয়েছে৷ এই সহজাত বিষয়টিই মোদির উন্নয়নের তাগিদ৷ এটাই তাঁর বহুচর্চিত ‘গুজরাট মডেল’৷ বাজারের ওপর ভর করে মোদি সেটাই হাতিয়ার করলেন প্রশাসনিক অঙ্গ হিসেবে৷
তাহলে কী দাঁড়াল? একেবারে নির্ভেজাল ইচ্ছাপূরণের কাহিনি নিয়ে সিনেমা৷ মোদিকে চমৎকারভাবে তুলে ধরা হলো ‘চা-ওয়ালার ছেলে’ হিসেবে৷ গুজরাটি সমাজে মোদিরা অনগ্রসর জাতির প্রতিনিধি৷ কট্টর হিন্দু হিসেবে তাঁর পরিচিতিও সেই গোধরাকাণ্ডের সময় থেকেই৷ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও তিনি কঠোর ও কঠিন এবং উন্নয়নমুখী ও বাস্তববাদী৷ ফলে কট্টর হিন্দুত্বের সঙ্গে অনগ্রসরতার মিশেল ও উন্নয়নের সোনালি স্বপ্ন দেখিয়ে ‘মার্কেট ফ্রেন্ডলি’ ইমেজ আদায়, ঠিক যেন অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে মনমোহন দেশাইয়ের মারমার কাটকাট অমর আকবর অ্যান্টনি৷ শুধু মন্দির আঁকড়ে বিজেপি যেমন, তেমনই স্রেফ জাত আঁকড়ে মুলায়ম, মায়াবতী, লালু, নিতীশরাও আঞ্চলিক রাজনীতিতে মহিরুহ হয়ে উঠলেও জাতীয় রাজনীতিতে বনসাই হয়ে রইলেন৷ তুলনায় মোদি হয়ে গেলেন একমেবাদ্বিতীয়ম্৷ মায়াবতী-মুলায়মেরা দলিত ও অনগ্রসরদের সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতে পারেননি৷ কিন্তু মোদি সেই বিশ্বাসটা গেঁথে দিতে পেরেছেন৷ রাজনীতিতে ‘পারসেপশন’-ই প্রথম ও শেষ কথা৷ মোদির ক্ষেত্রে একদিকে সেটা যেমন দাঙ্গাবাজ, অন্যদিকে তেমন সুপ্রশাসক, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী উন্নয়নকামী বলিষ্ঠ নেতার৷ দেশের মানুষ অন্যদের বিশ্বাস করেনি৷ মোদিকে তারা বিশ্বাস করেছে৷ ভরসাও৷
মোদি মানুষটা কেমন? যাঁরা তাঁকে জানেন-চেনেন, তাঁরা বলেন, মোদি হলেন একবগ্গা, জেিদ, কাজপাগল, নিষ্ঠুর এবং পিছুটানহীন একজন একলা মানুষ৷ দল বা সংঘ কাউকেই তিনি বিশেষ একটা তোয়াজ কখনো করেননি৷ সরকারে তিনিই ছিলেন এক থেকে এক শ৷ যার ফলে গুজরাটে মোদির মন্ত্রিসভায় বাকি যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সবাই প্রায় অজ্ঞাতকুলশীল৷ প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় পরও তাঁর চরিত্রের যে বিশেষ বদল ঘটবে, তা মনে করা ভুল হবে৷ বিজেপির অন্যরা তো বটেই, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘও (আরএসএস) এ বিষয়ে যথেষ্ট সংশয়ী৷ তাঁর জমানায় আরএসএস ক্রমেই তার প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে বলে কোনো কোনো মহলের ধারণা৷ দল ও সরকারে প্রবীণদেরও তিনি যে ক্রমে কোণঠাসা করে দেবেন, সে ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে৷ তাঁর সরকার একমাত্র তাঁরই৷ সেই সরকারকে সফল করতে তিনি চেষ্টায় খামতি রাখবেন না নিশ্চিত৷ পাঁচ বছর পরে রিপোর্ট কার্ড দেবেন বলে নিজেই যে কথা জানিয়েছেন, সেটাই নিজের কাছে তাঁর চ্যালেঞ্জ৷
মোদির নিন্দুকেরা বলেন, তিনি নাকি প্রতিহিংসাপরায়ণ৷ অপমানের জ্বালা তিনি নাকি ভোলেন না৷ মনস্তত্ত্ববিদেরা মনে করেন, কোনো রকমের তকমা এঁটে যাওয়া মানুষেরা আপ্রাণ চেষ্টা করেন সেই তকমা ঝেড়ে ফেলার৷ কেউ সফল হন, কেউ হন না৷ মোদির তকমাটা হলো দাঙ্গার৷ গোধরার খলনায়ক গুজরাটকে দাঙ্গাহীন রাজ্যে পরিণত করেও ১২ বছরে দাঙ্গাবাজের তকমা কপাল থেকে খুলতে পারেননি৷ এ জন্য তিনি মনস্তাপে ভুগছেন, এমন কথাও অবশ্য কেউ বলে না৷ দাঙ্গার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা বা দুঃখ প্রকাশও আজ পর্যন্ত সেভাবে তিনি করেননি৷ কিন্তু দেশের প্রশাসক হয়ে দাঙ্গাকে কড়া হাতে দমনের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে দাঙ্গাবাজের তকমা ঝেড়ে ফেলার সুযোগটা তিনি পাবেন৷ এটাই তাঁর মূল চ্যালেঞ্জ৷ সুশাসনের সঙ্গে উন্নয়ন ও প্রগতি তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হলে দেশে শান্তি ও সুস্থিতি বজায় রাখা খুবই জরুরি৷ গুজরাটি হয়ে তিনি নিশ্চয় তা অনুধাবন করবেন৷ পাঁচ বছর পরে রিপোর্ট কার্ড মেলানোর সময় লোকে কিন্তু ওই দিকটাই আতশ কাচের তলায় রাখবে৷ মধুর ভান্ডারকরের সিনেমায় কোন নরেন্দ্র মোদিকে দেখা যাবে, সেই আগ্রহ গুজরাটি প্রধানমন্ত্রীরও নিশ্চয় রয়েছে৷ আশা করি, তাঁর জানা আছে, কলিঙ্গ যুদ্ধের পর চণ্ডাশোকও ধীরে ধীরে ধর্মাশোকে রূপান্তরিত হয়েছিলেন৷
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিিল্ল প্রতিনিধি।
No comments