কাউন্সিলর নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণের পর হত্যা- উত্তর নেই, প্রশ্নের পাহাড় by আশীষ-উর-রহমান
শীতলক্ষ্যা এখন প্রায় পুকুরের মতো শান্ত।
স্রোতের টান তেমন নেই। দূর থেকে মনে হচ্ছিল, মাঝনদীতে একটি কলাগাছ। লিকলিকে
ঢেউয়ে এই ডোবে এই ভাসে। মঙ্গলবার দুপুরে বাড়ির উঠানে গেরস্থালি কাজ করার
সময় নদীর দিকে চোখ পড়লে ভাসমান বস্তুটিকে দেখেন জেসমিন বেগম। নারায়ণগঞ্জ
বন্দর উপজেলার মদনগঞ্জের শান্তিনগর গুচ্ছগ্রামের শেষ মাথায় চরধলেশ্বরীর
একেবারে শেষ বাড়িটি জেসমিন বেগমদের। পাশের নদী দিয়ে এটা-ওটা প্রায়ই ভেসে
আসে। দুইদিন আগেও একটি মরা গরু ভেসে এসেছিল। দিন পেরিয়ে গেল।
>>সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী পশ্চিমপাড়ায় গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের বাড়িতে এখন শুধুই কান্না। তাঁর মা (বাঁয়ে) জানেন না, কী কারণে ছেলেকে প্রাণ দিতে হলো। পাশে তাঁর আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শামসুন্নাহার । ছবি: প্রথম আলো
নদীর
বুক ছুঁয়ে আসা যে ঠান্ডা বাতাস গা জুড়িয়ে দেয়, তা যেন ভারী হয়ে গেছে পচা
গন্ধে। বুধবার সেই ভাসমান বস্তুটি ঢেউয়ে ঢেউয়ে সরে এসে আটকে গেল নদীর বাঁকে
জমে থাকা কচুরিপানার মধ্যে। চরের খেতে কাজ করা কৃষকদের সঙ্গে জেসমিন বেগমও
কৌতূহলী হয়ে কিনারে গিয়ে দেখলেন, বস্তুটি কলাগাছ নয়। পাঞ্জাবি গায়ে পচে
ফুলে ওঠা মরা মানুষ। খানিক দূরে দূরে আরও ছয়টি লাশ কখন যেন এসে আটকে আছে।
এত লাশ দেখে তাঁরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এর পরের ঘটনা তো ইতিমধ্যে সবারই
জানা।
নারায়ণগঞ্জ লঞ্চঘাট থেকে শীতলক্ষ্যা নদী সোজা দক্ষিণে এসে মদনগঞ্জ পার হয়ে বিশাল একটি বাঁক নিয়েছে। অনেকটা ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো। পশ্চিমে শাহ সিমেন্ট কারখানা। পূর্ব দিকে বিশাল চর। সেখানে মরিচ, লালশাক, পুঁইশাক, বেগুন, টমেটোর আবাদ। তীর ঘেঁষে ঢলঢল বথুয়াশাক আর বিষকাঁটালের বিস্তার। স্রোতের টানে ভেসে আসা কচুরিপানা বাঁকের খাঁজে এসে যেন বিশ্রাম নিচ্ছে।
সরকারি এই খাসজমিতে ভূমিহীনদের জন্য করা হয়েছে গুচ্ছগ্রাম। বেশ ফাঁকে ফাঁকে মাটি ফেলে টিলার মতো উঁচু করে টিনের ঘর। আরও কিলোমিটার দুয়েক দক্ষিণে মিলেছে পাঁচটি নদী। পশ্চিম থেকে মুন্সিগঞ্জ হয়ে এসেছে বুড়িগঙ্গা। উত্তর-পূর্ব থেকে ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র আর মেঘনা। উত্তর থেকে শীতলক্ষ্যা। নদ-নদীর এই মিলনস্থলটি বিশাল। চরের মানুষদের অনুমান, মৃতদেহগুলো ফেলা হয়েছিল ওই মিলন স্থলটিতে। সেখান থেকে জোয়ারের টানে উজানে এসে এই খাঁড়ির ভেতর আটকে গেছে। কারণ, শীতলক্ষ্যায় এখন এমন স্রোত নেই যে উত্তর থেকে এত দূর অবধি ইট বাঁধা লাশগুলো ভেসে আসতে পারে।
বৃহস্পতিবার আমরা যখন নারায়ণগঞ্জ ঘাট থেকে ট্রলারে মদনগঞ্জের দিকে রওনা দিই, তখন আরও একটি লাশ এসে ভিড়েছে চরধলেশ্বরীর কিনারে। চরের মানুষদের মধ্যে প্রচণ্ড ভয় আর উদ্বেগ। নিরিবিলি শান্ত গ্রামের কিনার ছুঁয়ে যাওয়া নদীতে একের পর এক হাত-পা বাঁধা বীভৎস লাশ ভেসে ওঠায় মনের শান্তি ছুটে গেছে। পুলিশ, ডিবি, গণমাধ্যমকর্মীদের ঘন ঘন যাতায়াতে সবাই সন্ত্রস্ত। কী হতে কী হয়ে যায়—এই ভয়ে কেউ কথাই বলতে চান না। তাঁদের মনের অবস্থার আঁচ পাওয়া গেল এখানকার আশ্রয়ণ দুগ্ধ খামারের প্রবীণ কর্মী আবুল কালামের কথায়। তিনি সোজাসাপটা বলে দিলেন, ‘হুনছি গাঙ্গে লাশ ভাসতাছে। তয় কু-মরা। হ্যার লাইগ্যা দেখতে যাই নাই।’ ‘কু-মরা’ শব্দটি কানে নতুন এল। ব্যাখ্যা পাওয়া গেল তাঁর কাছেই। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে সেটি ‘সু-মরা’। কু-মরা হলো অপঘাতে মৃত্যু।
লাশের কথা উঠলেই গ্রামবাসী নানাভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁদের ভয়, আইনশৃঙ্খলার লোকেরা আবার ধারণা না করে যে এই গ্রামেই অপহূত লোকগুলোকে মেরে নদীতে ফেলা হয়েছে। কথায় আছে, ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে সর্বাঙ্গ’। কে যেতে চায় সেই ঝামেলায়! অপরিচিত লোক দেখলেই তাঁরা এড়িয়ে চলেন। শান্তিনগরে বড়ই অশান্তি সৃষ্টি করেছে ভেসে আসা মৃতদেহগুলো।
তবে ক্ষতিবিক্ষত, প্রায় গলিত মৃতদেহগুলোকেই পরম মমতায় নিজ নিজ বাড়িতে নিয়ে গেছেন তাঁদের স্বজনেরা। মানুষগুলো অপহূত হওয়ার পর যে ভয়ানক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল তাঁদের মনে, লাশ পাওয়ায় তা পরিণত হয়েছে গভীরতম শোকে। কালো মেঘের পরে যেন অঝোরধারার বৃষ্টি। সেই অশ্রুবাণে ভেসে যাচ্ছিল তাঁদের চোখ। আটকে যাচ্ছিল কথা।
সন্ধ্যায় আমরা গিয়েছিলাম সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী পশ্চিমপাড়ায়। সেখানে গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলমের বাড়ি। পৈতৃক ৯ শতাংশ জমিতে চার ভাই মিলে বাড়ি করছেন। দোতলার কাজ চলছে। বাড়িতে কান্নার রোল।
জাহাঙ্গীর আলম আরেক অপহূত মনিরুজ্জামান স্বপনের ব্যক্তিগত গাড়ি চালাতেন। প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনিরুজ্জামানের বাড়িও কদমতলীতেই। গত রোববার মনিরুজ্জামানের গাড়িতে করেই তাঁরা আদালতে হাজিরা দিয়ে ফিরছিলেন। গাড়িতে আরও ছিলেন প্যানেল মেয়রের বন্ধু তাজুল ইসলাম ও লিটন। জানা গেল, নজরুল ইদানীং দূরে কোথাও যেতে স্বপনের গাড়িতেই যেতেন।
মার্চের মাঝামাঝি থেকে স্বপনের গাড়ি চালাতেন জাহাঙ্গীর। তাঁর বড় ভাই শাহাবুদ্দিন জানালেন, জাহাঙ্গীর আগে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের ‘দুরন্ত’ বাস চালাতেন। অনেক পরিশ্রম। তাই বাস চালানো ছেড়ে ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর কাজ নেন। বেতন আট হাজার টাকা। মাত্র দেড় বছর হলো বিয়ে করছেন জাহাঙ্গীর। স্ত্রী শামসুন্নাহার ইপিজেডে পোশাক কারখানায় কাজ করেন। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
শামসুন্নাহারের চোখ জবা ফুলের মতো লাল। অশ্রু ঝরছে। বলছিলেন, ‘আমার স্বামী নিরীহ গরিব মানুষ। তার কী দোষ? জন্মের আগেই আমার সন্তান তার বাপ হারইল...।’ রুদ্ধ হয়ে এল কণ্ঠ। তাঁর মা মিনারা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন মেয়েকে। শোকের সঙ্গে তাঁর হূদয় আরও বেশি ভারাক্রান্ত করে তুলেছে মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তা। আক্ষেপ করছিলেন, ‘এত অল্প বয়সে মাইয়াডা বিধবা হইল। কী হইব এর ভবিষ্যৎ?’
আর জাহাঙ্গীরের বৃদ্ধ মা মেহেরুন্নেসার তো কথা বালার শক্তিই ছিল না। নিথর হয়ে পড়ে ছিলেন বিছানায়। জাহাঙ্গীরের বাবা আগেই গত। তাই তাঁকে অন্তত পুত্রশোক সহ্য করতে হয়নি স্বপনের বাবা হায়দার আলী খাঁর মতো।
বেলা ডোবার পর স্বপনের বাড়িতে গিয়েও দেখা গেল একই রকম শোকার্ত পরিবেশ। স্বপন ঠিকাদারি করতেন। বাড়ির উঠানে বিলাপ করছিলেন স্বপনের বাবা মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আলী খাঁ—‘আমি মুক্তিযোদ্ধা। দ্যাশের জন্য যুদ্ধ করছি। আমার ছেলে অপহরণ হইয়া মইরা যাইব ধারণা করতে পারি নাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই।’
স্বপনের স্ত্রী মোর্শেদা আক্তার নির্বাক। দুই মেয়ে। ১০ বছরের ইশরাত জাহান কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোট মেয়ে নয় মাসের মাহীর তো বোঝারই সাধ্য নেই সে কী হারিয়েছে। মাসুম বাচ্চা দুটি আর কোনো দিন পাবে না বাবার আদর।
নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডের জালকুড়িতে আইনজীবী চন্দন সরকারের দোতলা বাড়ি। বৃহস্পতিবার তাঁর বড় মেয়ে চক্ষুবিশেষজ্ঞ সুস্মিতা সরকার বলছিলেন, ‘আমার বাবার কোনো শত্রু নেই। নিরীহ মানুষ। আইন পেশার ফাঁকে যেটুকু সময় পেতেন কবিতা চর্চা করতেন। অথচ এই মানুষটিকে নির্মমভাবে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হলো। কেন তাঁর এই মর্মান্তিক পরিণতি হলো?’
চন্দন সরকারের গাড়ির চালক ইব্রাহিমও কোনো দোষ করেননি। তাঁকেও বরণ করতে হয়েছে একই পরিণতি। শীতলক্ষ্যার পাড়ে বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া গ্রামে এক আত্মীয় বাড়িতে থাকেন। একেবারেই সহায়সম্বলহীন মানুষ। তাঁর মৃত্যুতে পথে বসেছে পরিবার। লাশ দাফন হয়েছে বৃহস্পতিবারেই। একই প্রশ্ন তাঁর স্বজনদেরও, ‘কেন এই পরিণতি? কী হবে তাঁদের ভবিষ্যৎ? দেশে কি আইনকানুন বলে কিছু নেই?’ উত্তর নেই, শুধু প্রশ্নের পাহাড়।
ফিরছিলাম শীতলক্ষ্যার পাড় দিয়ে। যে শীতলক্ষ্যা নারায়ণগঞ্জ শহরকে দিয়েছে প্রাচ্যের ড্যান্ডির খ্যাতি। দিয়েছে সমৃদ্ধি। এখন তার বুকে ভেসে ওঠে মেধাবী ছাত্র তানভীর মোহাম্মদ ত্বকীর লাশ। হাত-পা বাঁধা নজরুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, জাহাঙ্গীর আলম, চন্দন সরকার, ইব্রাহীমের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ। নরঘাতকেরা তাকে পরিণত করেছে লাশ গুম করার নিরাপদ ক্ষেত্র।
অনিবার্য সত্য হয়ে মৃতদেহগুলো একসময় ভেসে ওঠে। নদীর পাড়ে ভিড় করেন স্বজনহারা মানুষেরা। তাঁদের অশ্রুধারা মিশে যায় শীতলক্ষ্যার স্রোতে। শীতলক্ষ্যা আজ এক অশ্রুনদী।
নারায়ণগঞ্জ লঞ্চঘাট থেকে শীতলক্ষ্যা নদী সোজা দক্ষিণে এসে মদনগঞ্জ পার হয়ে বিশাল একটি বাঁক নিয়েছে। অনেকটা ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো। পশ্চিমে শাহ সিমেন্ট কারখানা। পূর্ব দিকে বিশাল চর। সেখানে মরিচ, লালশাক, পুঁইশাক, বেগুন, টমেটোর আবাদ। তীর ঘেঁষে ঢলঢল বথুয়াশাক আর বিষকাঁটালের বিস্তার। স্রোতের টানে ভেসে আসা কচুরিপানা বাঁকের খাঁজে এসে যেন বিশ্রাম নিচ্ছে।
সরকারি এই খাসজমিতে ভূমিহীনদের জন্য করা হয়েছে গুচ্ছগ্রাম। বেশ ফাঁকে ফাঁকে মাটি ফেলে টিলার মতো উঁচু করে টিনের ঘর। আরও কিলোমিটার দুয়েক দক্ষিণে মিলেছে পাঁচটি নদী। পশ্চিম থেকে মুন্সিগঞ্জ হয়ে এসেছে বুড়িগঙ্গা। উত্তর-পূর্ব থেকে ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র আর মেঘনা। উত্তর থেকে শীতলক্ষ্যা। নদ-নদীর এই মিলনস্থলটি বিশাল। চরের মানুষদের অনুমান, মৃতদেহগুলো ফেলা হয়েছিল ওই মিলন স্থলটিতে। সেখান থেকে জোয়ারের টানে উজানে এসে এই খাঁড়ির ভেতর আটকে গেছে। কারণ, শীতলক্ষ্যায় এখন এমন স্রোত নেই যে উত্তর থেকে এত দূর অবধি ইট বাঁধা লাশগুলো ভেসে আসতে পারে।
বৃহস্পতিবার আমরা যখন নারায়ণগঞ্জ ঘাট থেকে ট্রলারে মদনগঞ্জের দিকে রওনা দিই, তখন আরও একটি লাশ এসে ভিড়েছে চরধলেশ্বরীর কিনারে। চরের মানুষদের মধ্যে প্রচণ্ড ভয় আর উদ্বেগ। নিরিবিলি শান্ত গ্রামের কিনার ছুঁয়ে যাওয়া নদীতে একের পর এক হাত-পা বাঁধা বীভৎস লাশ ভেসে ওঠায় মনের শান্তি ছুটে গেছে। পুলিশ, ডিবি, গণমাধ্যমকর্মীদের ঘন ঘন যাতায়াতে সবাই সন্ত্রস্ত। কী হতে কী হয়ে যায়—এই ভয়ে কেউ কথাই বলতে চান না। তাঁদের মনের অবস্থার আঁচ পাওয়া গেল এখানকার আশ্রয়ণ দুগ্ধ খামারের প্রবীণ কর্মী আবুল কালামের কথায়। তিনি সোজাসাপটা বলে দিলেন, ‘হুনছি গাঙ্গে লাশ ভাসতাছে। তয় কু-মরা। হ্যার লাইগ্যা দেখতে যাই নাই।’ ‘কু-মরা’ শব্দটি কানে নতুন এল। ব্যাখ্যা পাওয়া গেল তাঁর কাছেই। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে সেটি ‘সু-মরা’। কু-মরা হলো অপঘাতে মৃত্যু।
লাশের কথা উঠলেই গ্রামবাসী নানাভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁদের ভয়, আইনশৃঙ্খলার লোকেরা আবার ধারণা না করে যে এই গ্রামেই অপহূত লোকগুলোকে মেরে নদীতে ফেলা হয়েছে। কথায় আছে, ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে সর্বাঙ্গ’। কে যেতে চায় সেই ঝামেলায়! অপরিচিত লোক দেখলেই তাঁরা এড়িয়ে চলেন। শান্তিনগরে বড়ই অশান্তি সৃষ্টি করেছে ভেসে আসা মৃতদেহগুলো।
তবে ক্ষতিবিক্ষত, প্রায় গলিত মৃতদেহগুলোকেই পরম মমতায় নিজ নিজ বাড়িতে নিয়ে গেছেন তাঁদের স্বজনেরা। মানুষগুলো অপহূত হওয়ার পর যে ভয়ানক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল তাঁদের মনে, লাশ পাওয়ায় তা পরিণত হয়েছে গভীরতম শোকে। কালো মেঘের পরে যেন অঝোরধারার বৃষ্টি। সেই অশ্রুবাণে ভেসে যাচ্ছিল তাঁদের চোখ। আটকে যাচ্ছিল কথা।
সন্ধ্যায় আমরা গিয়েছিলাম সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী পশ্চিমপাড়ায়। সেখানে গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলমের বাড়ি। পৈতৃক ৯ শতাংশ জমিতে চার ভাই মিলে বাড়ি করছেন। দোতলার কাজ চলছে। বাড়িতে কান্নার রোল।
জাহাঙ্গীর আলম আরেক অপহূত মনিরুজ্জামান স্বপনের ব্যক্তিগত গাড়ি চালাতেন। প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনিরুজ্জামানের বাড়িও কদমতলীতেই। গত রোববার মনিরুজ্জামানের গাড়িতে করেই তাঁরা আদালতে হাজিরা দিয়ে ফিরছিলেন। গাড়িতে আরও ছিলেন প্যানেল মেয়রের বন্ধু তাজুল ইসলাম ও লিটন। জানা গেল, নজরুল ইদানীং দূরে কোথাও যেতে স্বপনের গাড়িতেই যেতেন।
মার্চের মাঝামাঝি থেকে স্বপনের গাড়ি চালাতেন জাহাঙ্গীর। তাঁর বড় ভাই শাহাবুদ্দিন জানালেন, জাহাঙ্গীর আগে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের ‘দুরন্ত’ বাস চালাতেন। অনেক পরিশ্রম। তাই বাস চালানো ছেড়ে ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর কাজ নেন। বেতন আট হাজার টাকা। মাত্র দেড় বছর হলো বিয়ে করছেন জাহাঙ্গীর। স্ত্রী শামসুন্নাহার ইপিজেডে পোশাক কারখানায় কাজ করেন। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
শামসুন্নাহারের চোখ জবা ফুলের মতো লাল। অশ্রু ঝরছে। বলছিলেন, ‘আমার স্বামী নিরীহ গরিব মানুষ। তার কী দোষ? জন্মের আগেই আমার সন্তান তার বাপ হারইল...।’ রুদ্ধ হয়ে এল কণ্ঠ। তাঁর মা মিনারা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন মেয়েকে। শোকের সঙ্গে তাঁর হূদয় আরও বেশি ভারাক্রান্ত করে তুলেছে মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তা। আক্ষেপ করছিলেন, ‘এত অল্প বয়সে মাইয়াডা বিধবা হইল। কী হইব এর ভবিষ্যৎ?’
আর জাহাঙ্গীরের বৃদ্ধ মা মেহেরুন্নেসার তো কথা বালার শক্তিই ছিল না। নিথর হয়ে পড়ে ছিলেন বিছানায়। জাহাঙ্গীরের বাবা আগেই গত। তাই তাঁকে অন্তত পুত্রশোক সহ্য করতে হয়নি স্বপনের বাবা হায়দার আলী খাঁর মতো।
বেলা ডোবার পর স্বপনের বাড়িতে গিয়েও দেখা গেল একই রকম শোকার্ত পরিবেশ। স্বপন ঠিকাদারি করতেন। বাড়ির উঠানে বিলাপ করছিলেন স্বপনের বাবা মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আলী খাঁ—‘আমি মুক্তিযোদ্ধা। দ্যাশের জন্য যুদ্ধ করছি। আমার ছেলে অপহরণ হইয়া মইরা যাইব ধারণা করতে পারি নাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই।’
স্বপনের স্ত্রী মোর্শেদা আক্তার নির্বাক। দুই মেয়ে। ১০ বছরের ইশরাত জাহান কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোট মেয়ে নয় মাসের মাহীর তো বোঝারই সাধ্য নেই সে কী হারিয়েছে। মাসুম বাচ্চা দুটি আর কোনো দিন পাবে না বাবার আদর।
নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডের জালকুড়িতে আইনজীবী চন্দন সরকারের দোতলা বাড়ি। বৃহস্পতিবার তাঁর বড় মেয়ে চক্ষুবিশেষজ্ঞ সুস্মিতা সরকার বলছিলেন, ‘আমার বাবার কোনো শত্রু নেই। নিরীহ মানুষ। আইন পেশার ফাঁকে যেটুকু সময় পেতেন কবিতা চর্চা করতেন। অথচ এই মানুষটিকে নির্মমভাবে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হলো। কেন তাঁর এই মর্মান্তিক পরিণতি হলো?’
চন্দন সরকারের গাড়ির চালক ইব্রাহিমও কোনো দোষ করেননি। তাঁকেও বরণ করতে হয়েছে একই পরিণতি। শীতলক্ষ্যার পাড়ে বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া গ্রামে এক আত্মীয় বাড়িতে থাকেন। একেবারেই সহায়সম্বলহীন মানুষ। তাঁর মৃত্যুতে পথে বসেছে পরিবার। লাশ দাফন হয়েছে বৃহস্পতিবারেই। একই প্রশ্ন তাঁর স্বজনদেরও, ‘কেন এই পরিণতি? কী হবে তাঁদের ভবিষ্যৎ? দেশে কি আইনকানুন বলে কিছু নেই?’ উত্তর নেই, শুধু প্রশ্নের পাহাড়।
ফিরছিলাম শীতলক্ষ্যার পাড় দিয়ে। যে শীতলক্ষ্যা নারায়ণগঞ্জ শহরকে দিয়েছে প্রাচ্যের ড্যান্ডির খ্যাতি। দিয়েছে সমৃদ্ধি। এখন তার বুকে ভেসে ওঠে মেধাবী ছাত্র তানভীর মোহাম্মদ ত্বকীর লাশ। হাত-পা বাঁধা নজরুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, জাহাঙ্গীর আলম, চন্দন সরকার, ইব্রাহীমের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ। নরঘাতকেরা তাকে পরিণত করেছে লাশ গুম করার নিরাপদ ক্ষেত্র।
অনিবার্য সত্য হয়ে মৃতদেহগুলো একসময় ভেসে ওঠে। নদীর পাড়ে ভিড় করেন স্বজনহারা মানুষেরা। তাঁদের অশ্রুধারা মিশে যায় শীতলক্ষ্যার স্রোতে। শীতলক্ষ্যা আজ এক অশ্রুনদী।
No comments