প্রথম গুলি করে এমপির ভাই by তোহুর আহমদ
ফেনীর উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হককে
প্রথম গুলিটি করে ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীর মামাতো ভাই
আবিদুল ইসলাম ওরফে আবিদ। একরামকে বহনকারী গাড়ির সামনে ব্যারিকেড দেয়ার পর
একজন সন্ত্রাসী লোহার রড দিয়ে গাড়ির সামনের বামদিকের কাচ ভেঙে ফেলে। এর
পরপরই গুলি চালায় আবিদ। কিলিং মিশনে ব্যবহৃত হয় পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র।
একরাম হত্যার ঘটনাটি ছিল সুপরিকল্পিত। এজন্য কিলাররা ১৯ মে গভীর রাত থেকেই ফেনী শহরের একাডেমি সড়কের আশপাশে অবস্থান নেয়। রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা বলে সকাল ৬টার পর থেকেই কিলাররা বিলাসী সিনেমা হলের বিভিন্ন স্থানে উপস্থিত হয়। এর আগের এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণে রাখা হয় একরামের গতিবিধি। এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় কথিত ক্লিন ইমেজধারী ফেনীর সরকারদলীয় একজন নেতাকে। একরাম কখন কোথায় যান তার যাবতীয় তথ্য নিয়মিতভাবে আবিদকে জানাতেন এই নেতা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্র এবং হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ থেকে জানা গেছে উল্লেখিত সব তথ্য।
ইতিমধ্যেই ‘কিলিং মিশন’-এ অংশ নেয়া পাঁচ অস্ত্রধারীসহ সাতজনকে আটক করেছেন সরকারের একটি বিশেষ সংস্থা। হত্যা মামলায় তাদের যে কোনো সময় গ্রেফতার দেখানো হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ওই সংস্থার একজন কর্মকর্তা।
আলোচনায় ভিডিওচিত্র : একরামকে গুলি করে ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে প্রকাশ্য রাজপথে। শত শত মানুষের সামনে নির্মমভাবে হত্যার পর গাড়িতে আগুন দিয়ে লাশ পুড়িয়ে দেয়া হয়। ঘটনার সময় গুলি ও সন্ত্রাসীদের হুংকারে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দিগি¦দিক ছুটে পালান অনেকে। ঘটনাস্থলের পাশের কয়েকটি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা তাৎক্ষণিক দোকানের সাটার ফেলে দোকানের ভেতরেই লুকিয়ে থাকেন। এর মধ্যেও বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ঘটনার পুরো দৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করেন। এসব ভিডিও’র একাধিক ফুটেজ পুলিশের হাতে পৌঁছেছে। শুক্রবার যুগান্তরে প্রকাশিত ভিডিওচিত্র উদ্ধার ও পাঁচ খুনি শনাক্ত সংক্রান্ত খবরটি ছিল ‘টক অব দ্য ফেনী’। দিনভর আলোচনার বিষয় ছিল এই ভিডিওচিত্র। এই পাঁচজন ছাড়া আর কেউ কিলিং মিশনে ছিল কিনা তা নিয়ে মানুষের মধ্যে ছিল ব্যাপক কৌতূহল। অনেকে মন্তব্য করেছেন, ভিডিওতে যাদের দেখে গেছে তাদের সবার নাম পুলিশ কেন প্রকাশ করছে না। প্রভাবশালীদের আড়াল করতেই সন্ত্রাসীদের নাম গোপন করা হচ্ছে বলেও আশঙ্কা তাদের।
শুক্রবার জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা পুলিশ সুপারকে ভিডিওচিত্রের বিষয়ে প্রশ্ন করেন। ওই সময় পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ বলেন, ঘটনার রহস্য উন্মোচনের জন্য পুলিশের একাধিক সংস্থা কাজ করছে। কোন সংস্থার কাছে ভিডিওটি আছে তা তার জানা নেই। তবে নিশ্চয় কোনো কিছুর মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েই আসামিদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, পুলিশের কাছে ভিডিওচিত্র আছে এটিও যেমন বলব না, আবার নেই এটাও বলা যাচ্ছে না।
আটক সাত : তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন, একরাম হত্যার সঙ্গে জড়িত সাতজন কিলারকে আটক করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা হলেন- রুটি সোহেল, শাহনান, সৈকত, শিপন, শিফাত, অনিক ও জাহিদ চৌধুরী। এদের কয়েকজনকে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে এবং কয়েকজনকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করা হয়েছে। যে কোনো সময় এদের গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে উপস্থাপন করা হতে পারে।
ওদিকে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, আটককৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সঙ্গে জড়িত আরও কয়েকজনের নাম বলেছে। এরা হল- রাকিব, কাউসার, আসিফ, তুষার, বাপ্পি ও গোলাপ। ঘটনার পর এদের কাউকেই এলাকায় দেখা যাচ্ছে না।
ফেনী জেলার পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ জানিয়েছেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে এমন দু’জনকে শুক্রবার গ্রেফতার করা হয়েছে। এ দু’জন হলেন আনোয়ার ও আলাউদ্দীন। এদের মধ্যে আনোয়ারকে ফেনী পৌর এলাকার মদুয়াই ও আলাউদ্দীনকে শশ্যাদী ইউনিয়ন থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে ২১ মে ইকবাল ও শাখাওয়াত নামের যুবককে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ। এদের সবাইকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা : সূত্র জানিয়েছে, ২০ মে ঘটনার আগে কিলারদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে উপস্থিত থেকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও দেন ফেনীর কয়েকজন রাজনীতিক নামধারী দুর্বৃত্ত। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কিলাররা ২০ মে সকাল ৬টার দিকে একাডেমি রোডের বিলাসী সিনেমা হলের আশপাশে অবস্থান নেয়। একাডেমি সড়কের ওই অংশটির পেছনে রেললাইন থাকায় কৌশলগত কারণে এ জায়গাটি বেছে নেয় কিলাররা। একাডেমি রোডের একজন ব্যবসায়ী যুগান্তরের কাছে কিলারদের অবস্থান নেয়া ও হামলার পুরো বিষয়টির বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, সকাল ৭টার দিকে তিনি দোকান খোলেন। তখন তার দোকানের কর্মচারীরা তাকে জানান, আশপাশে বেশ কিছু অপরিচিত ছেলেকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। তাদের কয়েকজনের হাতে রয়েছে ধারালো ছোরা। ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বহিরাগত কয়েকজন যুবক একটি হোটেলে সকালের নাস্তা করতে ঢোকে। হোটেলের কর্মচারীরা তাদের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে পরিচয় জানতে চাইলে তারা নিজেদের রাজনৈতিক কর্মী পরিচয় দিয়ে বলে আজ এখানে একটা দলীয় সমাবেশ হবে। এ কারণে নেতাকর্মীরা জমায়েত হচ্ছে। সকাল থেকে কয়েক দফায় বিভিন্ন গাড়িতে করে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা আসেন। তারা অস্ত্রধারীদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেন। ভোর থেকে ঘটনার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ৪০/৫০ জন যুবক বিলাসি সিনেমা হলের সামনে জমায়েত হয়। সূত্র জানায়, ফেনী দুই আসনের এমপি নিজাম হাজারীর মামাতো ভাই আবিদুল ইসলামের ওপর কিলিং মিশনের মূল দায়িত্ব ছিল। সিদ্ধান্ত ছিল তিনিই প্রথম আক্রমণ করবেন। সে অনুযায়ী বেলা পৌনে ১১টার দিকে ফেনীর ডায়াবেটিক হাসপাতাল থেকে নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক গাড়িতে করে রওনা দেয়ার খবর মোবাইল ফোনে আবিদকে জানিয়ে দেয় ফেনীর সরকারদলীয় একজন রাজনৈতিক নেতা। এরপরই কিলাররা রাস্তায় বেরিকেড দেয়। বাপ্পি নামের এক কিলার রাস্তার উপর একটা অটোরিকশা দাঁড় করিয়ে দেয়। একরামকে বহনকারী গাড়িটি বেরিকেড ভেঙে চলে যেতে চাইলে দুর্ঘটনাবশত গাড়ির একটি চাকা রোড ডিভাইডারের উপর উঠে দাঁড়িয়ে যায়। ঠিক এই সময় কিলাররা দু’ভাবে বিভক্ত হয়ে গাড়ির উপর হামলে পড়ে। রাকিব নামের এক সন্ত্রাসী লোহার রড দিয়ে প্রথমেই গাড়ির বাম দিকের জানালার কাচ ভেঙে ফেলে। এরপর পরই ভাঙা কাচের অংশ দিয়ে অস্ত্র ঢুকিয়ে খুব কাছে থেকে গুলি করেন এমপি নিজাম উদ্দীন হাজারীর মামাতো ভাই আবিদুল ইসলাম আবিদ। গুলি খেয়ে একরাম তার গাড়ি চালক মামুনের ওপর ঢলে পড়েন। এরপর আরেক কিলার শিপন গাড়ি ভাংচুর করতে করতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে একরামকে কোপাতে থাকে। এ সময় একটু দূর থেকে পিস্তল দিয়ে গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে ফেনীর কুখ্যাত সন্ত্রাসী সোহেল ওরফে রুটি সোহেল। আরেক সন্ত্রাসী আসিফও গাড়ির ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে একরামকে কোপায়। কিলিং মিশনে অংশ নেয়া সন্ত্রাসী কাউসার পেট্রল ঢেলে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
সূত্র জানায়, হামলার আগে ২০ মে খুব ভোরে আনন্দপুর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহিদ চৌধুরী একাডেমি রোডস্থ ফেনী স্টেডিয়ামের কাছে আবিদের সঙ্গে দেখা করে। এ সময় জাহিদ চৌধুরী আবিদকে অস্ত্র ও টাকা দিয়ে চলে যায়।
শিবলু কমিশনারের দিকে সন্দেহের তীর : ফেনী পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুল্লাহিল বাকি শিবলুর দিকে এখন অনেকেরই সন্দেহের তীর। ফেনী শহরের বিভিন্ন জনের অভিযোগ, শিবলু ঘটনার সঙ্গে জড়িত। সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার দিন কাউন্সিলর শিবলু ঘটনাস্থলের খুব কাছের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে সেটি দ্রুত ফাঁকা করতে বলেন। ঘটনার পর হামলাকারীরা যাতে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে সে জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফাঁকা করেন শিবলু। কাউন্সিলর শিবলুর দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুলের পরিবারের সদস্যরাও। তবে একরামুলের পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, তারা ভয়ে নাম প্রকাশ করে শিবলুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারছেন না। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, এখন গরম হাওয়ার মধ্যে শিবলু কাউকে কিছু না বললেও পরে এ বিষয়ে তার রোষাণলে পড়তে হতে পারে। তবে কাউন্সিলর শিবলু ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। বৃহস্পতিবার রাতে তিনি যুগান্তরকে বলেন, তিনি পর পর দু’বার ফেনী পৌরসভার নির্বাচিত কাউন্সিলর। জনগণের কল্যাণে তিনি নিরলসভাবে কাজ করছেন। এ কারণে আগামীতেও তার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার জনপ্রিয়তায় ক্ষুব্ধ হয়ে তার বিরোধী পক্ষের রাজনীতিকরা তাকে ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। তিনি পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, একরামুলকে যেখানে হত্যা করা হয়েছে তার অদূরেরই তার বাড়ি। আপনারাই বলেন কেউ কি নিজের বাড়ির কাছে এত বড় অপরাধ ঘটাবে। নিশ্চয় না। কাউন্সিলর বলেন, তার সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুলের সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনিও চান দোষারোপের রাজনীতি বন্ধ হোক। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার করা হোক।
>>তোহুর আহমদ @যুগান্তর
No comments