নিরালাপুঞ্জির আলোকিত জীবন by মুশফিকুর রহমান
অনেক দিন থেকেই যাওয়ার সুযোগ খুঁজছিলাম৷
গত সপ্তাহে সেই সুযোগ আসামাত্র পেঁৗছে গেলাম শ্রীমঙ্গল থেকে প্রায় ২৫
কিলোমিটার দূরবর্তী দুর্গম পাহাড়ি গ্রাম নিরালাপুঞ্জিতে৷ এটি ভারতের
ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী একটি খাসিয়া গ্রাম৷ শ্রীমঙ্গল থেকে বিস্তীর্ণ
চা-বাগানের পথ পাড়ি দিয়ে, উঁচু-নিচু পাহাড়, জঙ্গল পেরিয়ে এ গ্রামে
পৌঁছতে হয়৷ সমতলের লোকালয়ের সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেক দূরের গ্রাম
নিরালাপুঞ্জির জীবন কেবল বহমান নয়, বরং চমৎকার পরিপাটি৷ জীবনটা সুন্দর করে
সাজাতে যে বেশি কিছু লাগে না, নিরালাপুঞ্জিতে গিয়ে সে সত্য আরও একবার
স্পষ্ট হলো৷ পরিশ্রমী ও সাদাসিধে জীবন এই খাসিয়া জনগোষ্ঠীর৷ এরা প্রকৃতির
সঙ্গে বসবাস করে, পরিবেশের মধ্যেই জীবিকার উপাদান খুঁজে নেয়৷
নিরালাপুঞ্জির প্রায় ১০৫টি খাসিয়া পরিবারের বাড়িঘর খুবই পরিচ্ছন্ন৷
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে নিরালাপুঞ্জি যেতে মোটরগাড়িতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে যায়৷ দক্ষিণমুখী রাস্তা ধরে গেলে একের পর এক চা-বাগান৷ সেসব পেরিয়ে শুরু হয় উঁচু-নিচু টিলার ওপর প্রাকৃতিক বনভূমি৷ সেই বনে নানা গাছপালা ও লতাগুল্মের মধ্যে বিরামহীন চলছে বিভিন্ন পাখি আর পোকামাকড়ের ক্লান্তিহীন ডাকাডাকি ও গান৷ এমনই বুনো আর শহর থেকে দূরবর্তী পরিবেশে একঝলক চমক নিয়ে পাহাড়ের ওপর এক গ্রাম নিরালাপুঞ্জি৷ এখানে ঝকঝকে নিকানো উঠোন আর পরিচ্ছন্ন বাড়ির চারপাশে প্রাকৃতিক উদ্যান, সারি সরি বাঁশ, সুপারি, কাঁঠাল, আম ও বিভিন্ন বুনো গাছের সারি৷
এসব গাছগাছালির কাণ্ড আর ডালপালা বেয়ে বুনো লতার মতো বেয়ে উঠেছে পাহাড়ি পানলতা৷ পাহাড়ি ঢালে ঘন গাছপালাগুলো রোদের খোঁজে দ্রুত বেড়ে ওঠার চেষ্টা করেছে৷ বাংলো ধরনের ঘরগুলোর কোনো কোনোটির বারান্দার এক পাশে খাসিয়া পরিবারের মেয়েরা বসে একাগ্রতায় পাহাড়ি পানপাতাগুলো সাজিয়ে রাখছে৷ খানিক পর পর খাসিয়া পুরুষ বা তাদের নিয়োগ করা মজুর পিঠে পানবোঝাই ঝাঁকা এনে ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে৷
গাছে বেড়ে ওঠা পান সংগ্রহ করে নিয়ে আসা খাসিয়া পুরুষদের কাজ৷ মেয়েরা ঘরকন্নার কাজের পাশাপাশি সংগ্রহ করে আনা পানপাতাগুলো যত্নে গোছা বাঁধে৷ এই পান কিনতে সমতলের ব্যাপারীরা আসতে থাকে একের পর এক৷ শ্রীমঙ্গল বাজার ছাড়াও দেশ-বিদেশের বাজারে প্রতিদিন রপ্তানি হয় লাখ লাখ টাকার পান৷ ব্যাপারীরা সন্ধ্যার মধ্যে চলে গেলেও বাড়ির মেয়েরা সংগৃহীত পান গোছানো বন্ধ করে না৷ নিরালাপুঞ্জির প্রায় সব বাড়িতেই রয়েছে সৌরবিদ্যুতের সংযোগ, টাটা স্কাই টিভির ডিশ সংযোগ, রঙিন টেলিভিশন৷ দিন পেরিয়ে রাত আসে, তবু পাহাড়ি এই গ্রামে সৌরবিদ্যুতের আলোয় কাজ, বিনোদন, ঘর-গেরস্থালি—সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকে৷
খাসিয়া দম্পতি মারসাল্লো ও ডারলিং ধার আমাদের বলছিলেন, তাঁদের বাড়ি থেকেই ব্যাপারীরা প্রতিদিন প্রায় এক হাজার টাকার পান কিনে নিয়ে যায়৷ এখন পানের দাম কমে গেছে, নইলে আয় আরও বেিশ হয়৷ সুপারি, কাঁঠালও বিক্রি হয়৷ কোনো কোনো পরিবারের লেবুবাগান রয়েছে, পাহাড়ি ঢালে রয়েছে আনারসের বাগান৷ ভাপসা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ঠান্ডা পানি খুঁজছিলাম৷ ঘরের এক পাশে রাখা ফিল্টার থেকে ঝকঝকে কাচের গ্লাসে পানি আর বিস্কুট-চানাচুর পরিবেশন করল গৃহকত্রী৴র ছোট বোন৷ বড় বোনের সঙ্গে ছোট দুই বোন আর মারসাল্লো দম্পতির কিশোরী মেয়েও পান গোছানোর কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল৷
এ দম্পতির বড় ছেলে সিলেটে কলেজে পড়ে৷ মারসাল্লো দম্পতির বাড়ি থেকে কয়েক মিনিটের হাঁটা দূরত্বে নিরালাপুঞ্জি প্রাথমিক বিদ্যালয়৷ সেখানে খাসিয়াপল্লির ছোট ছেলেমেয়েরা সুশৃঙ্খলভাবে পড়ছে৷ এখানকার শিক্ষকেরা এ গ্রামেরই বাসিন্দা৷ তবে কেউ লেখাপড়া করেছেন সিলেটে, কেউবা ঢাকার নটর ডেম কলেজে৷ এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সরকাির না হলেও শিক্ষকদের একজন জানালেন, শিগগিরই স্কুলটি সরকারি হবে৷
নিরালাপুঞ্জির মানুষেরা সবাই নিজেদের ভাষায় অভ্যস্ত হলেও চমৎকার বাংলা বলে৷ সেখানে কথা হলো স্থানীয় ব্যবসায়ী এলভিস পটামের সঙ্গে৷ তাঁর ছোট রেস্টুরেন্টের সামনে৷ এলভিস বলছিলেন, আগে তাঁরা ডিজেল-জেনারেটর ব্যবহার করতেন, কিন্তু এখন নিরালাপুঞ্জির অধিকাংশ বাড়িতেই ৮৫ ওয়াট ক্ষমতার সৌরবিদ্যুতের সংযোগ রয়েছে৷ এই গ্রামে প্রথম সৌরবিদ্যুতের সংযোগ-সুবিধা বিপণন করতে নিয়ে এসেছিলেন ‘গ্রামীণ শক্তি’র দীপাল বড়ুয়া ও তাঁর সহকর্মীরা৷ এখন তিনি ‘ব্রাইট গ্রিন এনার্জি ফাউন্ডেশন’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে নিরালাপুঞ্জিতে সৌরবিদ্যুতের সংযোগ-সুবিধা আরও সম্প্রসারণ করতে আগ্রহী৷
গ্রিড সংযোগের তারের বিদ্যুৎ এমন দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে কবে বিদ্যুতের আলো নিয়ে আসত, কে জানে৷ কিন্তু খাসিয়াপল্লির অধিবাসীরা সে অনিশ্চয়তা নিয়ে অপেক্ষা করতে চায়নি৷ সুতরাং, এখন এই খাসিয়াপল্লির অধিবাসীদের জন্য সৌরবিদ্যুতের ‘মিনি গ্রিড’ সংযোগের সম্ভাবনার কথা দীপাল বড়ুয়া ভাবছেন৷ শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর একটি ‘মডেল পল্লি’ হিসেবে নিরালাপুঞ্জিকে গড়া যায় কি না, তা নিয়ে ভাবছেন৷ সম্প্রতি ‘গ্লোবাল ১০০% রিনিউঅ্যাবল এনার্জি ক্যাম্পেইন’ বাংলাদেশের দীপাল বড়ুয়াকে তাদের দূত মনোনীত করেছে৷ ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালািন ব্যবহারের নানামুখী উদ্যোগ ও প্রচারণা নিয়ে তাঁর উৎসাহ আরও বেড়েছে৷ প্রচলিত বিদ্যুতের সুবিধা থেকে দূরবর্তী, কিন্তু সচ্ছল নিরালাপুঞ্জি সে কারণে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর একটি আধুনিক গ্রাম হিসেবে গড়ে উঠতেই পারে৷
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালািন ও পরিবেশবিষয়ক লেখক৷
No comments