শেখ হাসিনা-কামাল হোসেন বিতর্ক
শেখ হাসিনাঃ প্রধানমন্ত্রী, ড. কামাল হোসেনঃ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী |
গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক বিষয়ে বিতর্ক অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর কার্যালয় এবং ড. কামাল হোসেনের মধ্যে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে, তা পীড়াদায়ক ও দুর্ভাগ্যজনক। সরকারি বিবৃতিগুলোতে স্ববিরোধিতা অস্পষ্ট নয়। বিশেষ করে এ বিতর্ক দিয়ে ভিন্নমতের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ পরিমাপ করা চলে। ড. কামাল হোসেন শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে ভিন্নমতাবলম্বী হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মতামত ও যুক্তিগুলো ঠিক কি বেঠিক ছিল, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু এটা সন্দেহাতীত যে, নেতৃত্বজনিত তর্ক-বিতর্কের একটি প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের হাল ধরতে অনুরোধ করা হয়। ড. কামাল এর অন্যতম কুশীলব ছিলেন বলেই দেশবাসী এতকাল জেনে এসেছে। জোহরা তাজউদ্দীন যার যোগ্যতম সাক্ষী। এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বলছে, শেখ হাসিনাকে আনতে তিনি লোক দেখানো মনোভাব নিয়ে দিল্লি গিয়েছিলেন। লোক দেখানোর বিষয়টি ঘটনা নয়, ব্যাখ্যা৷ তা ছাড়া কামাল হোসেনের পঁচাত্তর-পরবর্তী অর্থাৎ খন্দকার মোশতাক সরকারের বিরোধিতার যে তথ্য আমরা জানি, তা কী করে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে? ড. হাছান মাহমুদ ২১ মে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, জাতিকে সত্য তথ্য জানতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনটি সত্য আর কোনটি নয়? প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের যাঁরা দুটি বিবৃতির খসড়া তৈরি করেছেন, তাঁরা যুক্তির চেয়ে আবেগ দ্বারা বেশি চালিত হয়েছেন বলে মনে হয়। তাঁরা আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর একটি প্রশ্নজাগানিয়া ভাবমূর্তি তুলে ধরছেন। যেমন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ‘উদারতা ও মহানুভবতা’র কারণে ড. কামাল ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হয়েছিলেন। ব্যক্তির উদারতায় একটি দলের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী নির্বাচন গণতান্ত্রিক নয়। যদি হয়েও থাকে, তাহলে তা এভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে, বিশেষ করে একজন কর্মরত সংসদীয় ধাঁচের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের বিবৃতিতে তা প্রকাশ করা সমীচীন নয়। আর সত্য হলো, বাস্তবে ড. কামালই ছিলেন তখনকার দলের সবেধন নীলমণি প্রার্থী৷ তদুপরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর কামাল-হাসিনার যে অন্তরঙ্গ চিত্রটি আঁকল, সেটা কেন ড. কামালের ১৯৮১ সাল-পরবর্তী ভূমিকার জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আর যদি সেটা ঐতিহাসিক তথ্য হবে, তাহলে নতুন কোনো নথিপত্র প্রকাশ পেলে তবে তার ভিত্তিতে নতুন করে প্রশ্ন তোলা যুক্তিসংগত। তাঁরা যে যেমনই বলছেন,
তার সপক্ষে অন্তত কিছু উপযুক্ত দলিলপত্র জোগাড় এত বছর পরে দুরূহ হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৭ মে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে স্মরণ করেছেন যে, ‘জার্মানিতে নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সরকারি কর্মকর্তা হয়েও সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু আব্বার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশে ছিলেন। তাঁর কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি। একটা বিবৃতি দিতে অনুরোধ করলেও রাজি হননি’ (প্রথম আলো, ১৮ মে ২০১৪)। পরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে নির্দিষ্টভাবে একটি সংবাদ সম্মেলনের কথাও এসেছে। বাকি সব বলা হয়েছে সাধারণভাবে। কামাল হোসেনের যতটা করা উচিত ছিল, তিনি তা করেননি। এটা আপেক্ষিক। কেউ বলতেই পারেন যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বিদ্রোহের ছাপ হয়তো আরও বেশি শাণিত হতে পারত। কেউ বলবেন, বাস্তবতা তা সমর্থন করে কি করে না। ওই সময়ে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জার্মানি বা বিদেশের মাটিতে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন বলে জানি না। এটা তিনি করে থাকলে অর্চার ব্লাড যা করে অমরত্ব লাভ করেছেন, তেমন ধরনের একটা বিজয়তিলক হুমায়ুন ললাটে অঙ্কনের দাবি রাখে। রাজনীতিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা পারেননি, একজন আমলা রাষ্ট্রদূত ‘অসীম সাহসিকতায়’ তা করে দেখিয়েছেন। এই রেকর্ড যাচাইসাপেক্ষ। কারণ, জার্মানরা তা নিশ্চয়ই মুছে ফেলেনি। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর অটোবায়োগ্রাফার বলা যায় মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে। ২০১২ সালে প্রকাশিত তাঁর কূটনীতির অন্দরমহলে এ তথ্য নেই। ধানমন্ডির ‘মাহজাবীনে’ এই লেখক নিজেও বহু বিকেল হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর কাছ থেকে জার্মানির বিবরণ শুনেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনের কথা তিনি বলেননি।
পঁচাত্তরের সেপ্টেম্বরে লন্ডনে ড. হোসেনের সঙ্গে হুমায়ুন সাক্ষাৎ করেছিলেন, তখনো তিনি তাঁকে এমন কিছু বলেননি৷ এখানে উল্লেখ্য যে, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও ড. হোসেন ওই সময়ে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করতেন৷ তিনি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি কী করে ঢাকার নির্দেশ এড়িয়ে জার্মানিতে তাঁর অবস্থান দীর্ঘায়িত করতে পারেন৷ রোমের পোপের কাছে বাংলাদেশের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি সাক্ষাৎ চেয়েছিলেন ড. হোসেনের পরামর্শেই৷ ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার খণ্ডচিত্রে ড. কামাল মুজিব দুহিতাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ অকপট অকৃত্রিম। তিনি তাঁর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, ‘১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমরা বনের উদ্দেশ্যে ব্রাসেলস ত্যাগ করি। পথে রেহানা ও হাসিনা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমরা বনে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের বাসায় পৌঁছাই। সেদিন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন যুগোস্লাভিয়ায় সফর শেষে বাংলাদেশে ফেরার পথে [এ তথ্য ঠিক নয়] ফ্রাঙ্কফুর্টে যাত্রাবিরতি করে হুমায়ুন চৌধুরী সাহেবের বাসায় উঠেছেন। হুমায়ুন চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী, ড. কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তিনজন মিলে কান্নায় ভেঙে পড়া রেহানা ও হাসিনাকে ধরাধরি করে বাসার ভেতর নিয়ে যান। ড্রয়িংরুমে এভাবে কিছুক্ষণ কাটানোর পর হুমায়ুন রশীদ সাহেবের স্ত্রী হাসিনাদের উপর তলায় নিয়ে যান।’ (পৃষ্ঠা ২৬৬)। একই পৃষ্ঠায় ড. ওয়াজেদ আরও লিখেছেন, ‘পরদিন অর্থাৎ ১৬ আগস্ট, (১৯৭৫) সকাল আটটার দিকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য ড. কামাল হোসেন বনস্থ বিমানবন্দরে যাবেন বলে আমাকে জানানো হয়। ড. কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে আমিও গািড়তে উঠে বসি। বিমানবন্দরে ড. কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দুজনই একত্রে কিছু গোপন আলাপ করেন। অতঃপর আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে আমি ড. কামাল হোসেন সাহেবের হাত ধরে তাঁকে বললাম, খন্দকার মোশতাক আহমদ খুব সম্ভবত আপনাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখার চেষ্টা করবেন।
অনুগ্রহ করে আমার কাছে ওয়াদা করুন যে, আপনি কোনো অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে আপস করে তাঁর মন্ত্রিপরিষদে যোগদান করবেন না। আমার এই প্রশ্নের জবাবে ডা. কামাল হোসেন আমাকে বললেন, ড. ওয়াজেদ, প্রয়োজন হলে বিদেশেই মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছি। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আপস করে আমি দেশে ফিরতে পারি না।’ ওই সময়ে লন্ডনে ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা ফারুক চৌধুরী। তাঁর কাছ থেকে শোনা: ড. কামালকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তিনি কিছুতেই আসেননি। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যান। তাঁকে ফেরাতে ঢাকা থেকে গোপন বার্তা গিয়েছিল।ড. কামাল হোসেন ও হামিদা হোসেনের কাছ থেকেও নানা সময়ে এ-সংক্রান্ত বিবরণ শুনেছি। পঁচাত্তরের মধ্য সেপ্টেম্বরে হামিদা হোসেন, তাঁর দুই মেয়ে ও শাশুড়ি লন্ডনে যাচ্ছিলেন। সেখানে তাঁদের বিদায় জানাতে হাজির ছিলেন ড. তৌফিক আলী। বিমানের যাত্রীরা অবাক হয়েছিলেন। কারণ দর্শানো ছাড়াই বিমানটি তিন ঘণ্টা বিলম্ব করেছিল। ‘সামরিক ছাড়পত্র’ মিলছিল না৷ কামাল দম্পতি পরে অক্সফোর্ডে থাকতেন। মোশতাক তাঁদের ফেরাতে সেখানেও লোক পাঠিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের পরপরই আবু সাঈদ চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন প্রমুখ লন্ডনের কনওয়ে হলে একটি সভার আয়োজন করেছিলেন। সেই সভা আওয়ামী লীগবিরোধী একটি ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী পণ্ড করার চেষ্টা করেছিল। ১৫ আগস্ট ও জেলহত্যার শোকাবহ পটভূমিতে অন্যদের মধ্যে ড. হোসেনও বক্তব্য দিয়েছিলেন৷ কনওয়ে হল লন্ডনের স্বাধীন বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতীক। সেখানকার সভায় বাংলাদেশ স্টাইলে হামলা যারা করেছিল, তারা কম জঙ্গি ছিল না। সাবেক সচিব (পররাষ্ট্র) ও কলাম লেখক মহিউদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে শুনেছিলাম যে, তিনি ওই গোষ্ঠীর তাণ্ডব টিভিতে দেখেছিলেন।
লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভাঙচুর চলেছে। বঙ্গবন্ধুর ছবি চুরমার করা হয়েছে। তখন টিভি ক্রু ছিল না। পরে ক্যামেরা পৌঁছাতে তারা আবারও হামলা চালায়, আর সেটা টিভিতে দেখানো হয়। সুতরাং ড. কামালরা বাধার আশঙ্কা সত্ত্বেও কনওয়ে হলে সভা করতে গিয়েছিলেন। ফারুক চৌধুরীর মন্তব্য: ‘আমি এই সাক্ষ্য দিতে পারি যে, ড. কামাল হোসেন কখনো ওই শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকতে পারতেন। প্রবাস জীবনে ওই শক্তির বিরুদ্ধে তিনি অত্যন্ত দৃঢ় ভূমিকা নিয়েছিলেন।’ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের বিবৃতি আরেকটি ঐতিহাসিক তথ্য চ্যালেঞ্জ করেছে। কামাল হোসেন কখন যুগোস্লাভিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন? অনেকেই ভ্রু কুঁচকে বলবেন, কেন, আলাপ করতে কতটুকু সময় লাগে? ড. কামাল হোসেন ২০১৩ সালের মার্চে প্রকাশিত তাঁর বাংলাদেশ কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘যুগোস্লাভিয়া সফর শেষ হতে সেখানেরই এক কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর জঘন্য হত্যাকাণ্ডের খবরটি দিলেন৷ এর কয়েক মিনিটের মধ্যে সে দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা টেলিপ্রিন্টারে প্রাপ্ত একটি কপি নিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় আমার কাছে আসেন। বেলগ্রেড থেকে আমার ঢাকায় ফেরার কথা ছিল। আমি ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে বনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবিত সন্তান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ... রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাড়িতে আমি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করি। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম যে তাদের নিরাপত্তার জন্য সম্ভব সবকিছু করা হবে। তারপর লন্ডনে চলে গেলাম।’ সেখানে গিয়ে তিনি ত্বরিত লাল পাসপোর্ট ফেলে সবুজ পাসপোর্ট নিয়েছিলেন৷ যুগোস্লাভিয়া আজ নেই। কিন্তু তাদের পঁচাত্তরের রেকর্ডপত্র ধ্বংস হয়ে গেছে, ভাবার কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিবৃতি পড়ে নতুন প্রজন্ম ভাবতে পারে,
ড. কামাল বিদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে কোনো বক্তব্য দেননি। শুনেছিলাম, স্ক্যান্ডেনেভীয় একটি দেশে (সম্ভবত স্টকহোম) বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে অ্যামনেস্টি সভায়, সম্ভবত বুদাপেস্টে বিশ্ব শান্তি পরিষদ সম্মেলনে এবং হাউস অব কমন্সে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন। পূব৴ ইউরোপে তিনি রেডিও সাক্ষাৎকারও দিয়েছিলেন। এসবের রেকর্ড খোঁজা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিবৃতি স্বীকার করেছে যে, ব্রিটিশ এমপি টমাস উইলিয়ামসের তদন্ত কমিশনে ড. কামাল হোসেন অন্যদের সঙ্গে ‘সক্রিয়’ হন। অবশ্য আমি শুনেছিলাম, তাঁর গাড়িতেই চেপে ‘অক্লান্ত পরিশ্রমীদের’ অনেকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি কখন যুগোস্লাভদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেটা প্রশ্ন করার আগে পিএমওর খসড়া প্রস্তুতকারীরা হয়তো এটা ভুলে গিয়েছিলেন যে, দেশটি ছিল মার্শাল টিটোর। টিটোর আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু ও কামাল দম্পতি যুগোস্লাভিয়া সফর করেছিলেন। ওই সফরেও তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিনিচের সঙ্গে কথা বলেন৷ বেলগ্রেডে আরও কিছুদিন থাকতে তাঁকে অনুরোধ করা হেয়ছিল৷ ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ভারত সফরে যাওয়ার কম৴সূচি চূড়ান্ত ছিল৷ তাই এটা সন্দেহাতীত যে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের খবর পেয়েই তিনি সুচিন্তিতভাবে পূব৴নিধ৴ারিত বেলগ্রেড–ঢাকা সফর বাতিল করেন৷ রওনা দেন বনের পথে৷ অথচ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের বিবৃতিতে ড. কামালের বন আগমনকে কেবল ‘যাত্রাবিরতি’ হিসেবে দেখা হয়েছে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বর্ণনায়, ‘১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় ওরা (হাসিনা-রেহানা) জার্মানি পৌঁছাল। এদিনই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের জার্মানি পৌঁছানোর কথা। সঙ্গে থাকবেন পররাষ্ট্র দপ্তরের পরিচালক রেজাউল করিম। বেলগ্রেড থেকে কামাল হোসেন আসছেন। আমি বিমানবন্দরে গিয়ে তাঁকে স্বাগত জানালাম। কামাল হোসেন খুবই অস্থির। কথা বলতে পারছেন না। হাসিনা-রেহানাদের আগেই ড. কামাল হোসেন জার্মানি পৌঁছেছেন।
... রাতে ড. কামাল হোসেন ও ড. ওয়াজেদকে জানালাম শেখ কামাল, শেখ জামালও মারা গেছে।’ কূটনীতির অন্দরমহল, সূচীপত্র ২০১২৷ একজন ব্যক্তির সাড়ে তিন দশক আগের ভূমিকা ২০১৪ সালের বাংলাদেশ রাজনীতিতে কেন প্রাসঙ্গিক, সেই প্রশ্নের নির্মোহ জবাব পাওয়াও জরুরি। ড. হোসেনের অনেক বক্তব্য ও অবস্থানের সঙ্গে যে কেউ ভিন্নমত দিতে পারেন। সমালোচনা করার অধিকার রাখেন। তাই বলে সমকালীন ভিন্নমত ও পথকে অতীত টেনে অনাবশ্যক আক্রমণ অনভিপ্রেত নয়। ইতিহাসচর্চাও নয়৷ ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতার ঋণ একজন ব্যক্তি তার নিজের মানবিক সত্তা তথা জাতীয় স্বার্থ (অবশ্যই ব্যক্তির বিবেচনায়) বিসর্জন দিয়ে শোধ করতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কামাল হোসেনের ঐতিহাসিক সম্পর্কের বিভাজন সহজ নয়৷ বাকশালের প্রতি তাঁর জোরালো ভিন্নমতের প্রতি মুজিব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন৷ কামাল হোসেনের প্রতি মুজিবের এই ঔদার্য অনন্যসাধারণ৷ বাকশালের সঙ্গে থাকবেন না, তাই তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েও সপরিবারে দীর্ঘ ছুটি চাইলেন৷ মুজিব তা মঞ্জুরও করলেন৷ বাকশাল মন্ত্রিসভার শপথের দিনটিতে তিনি লন্ডনে মুজিবের ফোন পান৷ মুজিবের অনুরাগসিক্ত কামাল হোসেন সেদিন টেলিফোনে শপথ নেওয়ার অনুরোধ পেয়েছিলেন৷ এর কিছুদিন পর তিনি ঢাকায় ফেরেন৷ বত্রিশ নম্বরের বাড়ির ছাদে তখন তিনি মুজিবের স্নেহের ফল্গুধারায় ভাসছেন৷ মুজিব বলছেন: তুমি অপ্রিয় সত্য বলতে দ্বিধা করো না, তাই তোমাকে এত পছন্দ৷ ড. হোসেন মনে করেন, এটা তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সার্টিফিকেট৷ তাই আমরা বলি, যে যে মতেরই হোক না কেন, যার যা প্রাপ্য, সমাজ বা রাষ্ট্রের উচিত তাঁকে তা দেওয়া৷ ‘অপ্রিয় সত্য’ বলার কারণে তাঁকে দল ছাড়তে হয়েছিল৷ এর দু’দশকের বেশি সময় পরে কেন এই প্রশ্ন, সেটাই বড় জিজ্ঞাসা৷ আর তাঁর পঁচাত্তরের ভূমিকা ঘাঁটা হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন পঁচাত্তরের খুনিদের পুনর্বাসনকারী ও অভিনন্দন জ্ঞাপনকারীদের কেউ বিশেষ রাষ্ট্রদূত, কেউ মন্ত্রী৷ তবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের দ্বিতীয় বিবৃতির শেষ বাক্য প্রশংসনীয়। যেখানে লেখা আছে, ‘কিছু সময়ের জন্য সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব হলেও সত্য একদিন তার আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হবে।’ হাউস অব কমন্সের পাশেই কুন্দন রেস্টুরেন্ট। ৩ নম্বর হর্সফেরি রোড। ড. কামাল হোসেন সেখানে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। এসব সত্য উদ্ভাসিত হোক।
মিজানু�
মিজানু�
No comments