নানা উৎপাতে বিপন্ন শিক্ষাঙ্গন by আলী ইমাম মজুমদার

২৩ মার্চ প্রথম আলো পাশাপাশি পৃষ্ঠায় দুটি সচিত্র প্রতিবেদন ছেপেছে। একটি একজন প্রতিমন্ত্রীকে সংবর্ধনা জানাতে একই উপজেলার চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে চৈত্রের খরতাপে শিক্ষার্থীদের রাস্তার দুই পাশে দাঁড় করিয়া রাখা। অপরটি একজন সাংসদ তাঁর নির্বাচনী এলাকায় একটি অঞ্চলে গেলে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের রোদে একইভাবে দাঁড়িয়ে রাখার দৃশ্য। এ বিষয়ে বহু খবর হয়েছে। পাঠকেরাও হয়তো ক্লান্ত হয়ে গেছেন এসব পড়ে পড়ে। তাও সংবাদপত্র নাছোড়বান্দার মতো পিছু লেগে রয়েছে। প্রত্যাশা, একসময় টনক নড়বে। অবসান ঘটবে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত উৎপাতের।

আর ঘটনাগুলো হচ্ছে মন্ত্রী-সাংসদসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের শুভেচ্ছা জানাতে রাস্তার পাশে ছাত্রছাত্রীদের দাঁড় করিয়ে রাখা, স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখে এ ধরনের কারও সংবর্ধনায় ছাত্র-শিক্ষকদের যোগদান আর শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন প্রয়োজনে এর স্থাপনা ব্যবহার ইত্যাদি। এ ধরনের অবস্থার শুরু এখন বা এ সরকারের সময়েও নয়, অনেক আগে থেকে তা চলছে। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না সচেতন মানুষ এ পরিস্থিতির অবসান চায়। অপেক্ষায় আছে কবে তা ঘটবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা নিষপ্রয়োজন। আর সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যখন মূল উদ্দেশ্যের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ক্রমান্বয়ে ভিন্ন কাজে ব্যবহূত হতে থাকে, তখন ব্যথিত হয় অনেকে। কেউ কোথাও ক্ষীণ কণ্ঠে প্রতিবাদ হয়তো করে। কিন্তু তা তলিয়ে যায় পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষের চাপে। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের থাকে ভূমি আর তার ওপর স্থাপনা ও আসবাব। অনেক ক্ষেত্রে খেলার মাঠও থাকে শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশের জন্য। আর থাকেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।
যে দুটি সচিত্র প্রতিবেদনের কথা শুরুতেই আলোচিত হলো, সেখানে শিক্ষার্থীদের মূল কাজ পড়াশোনা ফেলে রেখে কারও সন্তুষ্টির জন্য দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এরূপ হওয়ার কথা না থাকলেও প্রায়ই হয়। আর নতুন সংসদ নির্বাচন বা সরকার গঠনের পর তার হিড়িক পড়ে যায়। এবারেও তা-ই ঘটে চলছে। জানুয়ারির সূচনায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনটির শুদ্ধতা সম্পর্কে যত প্রশ্নই থাকুক না কেন, সাংসদ ও মন্ত্রীরা এ ধরনের সংবর্ধনা নিতে আদৌ কুণ্ঠিত নন। নাই বা হলেন। আর সংবর্ধনা তাঁরা নিতে থাকুন। ছাত্রছাত্রীদের কেন রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে, এর জবাব কি তাঁরা দেবেন? এ বিষয়ে তো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তা তাঁরা অব্যাহতভাবে অমান্য করে চলছেন কীভাবে?
বলার অপেক্ষা রাখে না, এখানে স্থানীয় ব্যক্তিরা অসহায়। অবশ্য তাদেরই একটি সুবিধাভোগী অংশ এ ধরনের আয়োজন করতে উঠেপড়ে লাগে। নেতৃত্বের নিকট থেকে সুবিধা আদায় করাই তাদের উদ্দেশ্য। আর এর মাশুল দিতে হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থাকে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়? যদি তা হতো, তবে এত ব্যাপক হারে এ মন্দ সংস্কৃতি বিকাশমান হতো না।
এরপর আসে শিক্ষকদের প্রসঙ্গ। শিক্ষাদান কার্যক্রম ছাড়াও অনেক কাজের সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্ট করা হয়। ভোটার তালিকা তৈরি, জনগণনা থেকে শুরু করে সরকারি অনেক কর্মসূচিতেই নির্বিচারে ব্যবহার করা হয় শিক্ষকদের। এতেও ব্যাহত হয় শিক্ষাদান কার্যক্রম। একসময় যখন শিক্ষিত লোক অপ্রতুল ছিল, তখন শিক্ষকদের এ ধরনের কাজে ব্যবহারের হয়তো প্রয়োজন ছিল। এখন বেকার শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা বসে আছে সর্বত্র। তাদের কিছু ভাতা আর প্রশিক্ষণ দিয়ে এসব অস্থায়ী কাজে নিয়োগ করা হলে শিক্ষকেরা রেহাই পান। জেলা-উপজেলায় কোনো সভা-সমাবেশ ও মিছিল করতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে যোগ দিতে অনেকটা বাধ্য করা হয়। আর সুধী সমাবেশের নামে আয়োজিত অনুষ্ঠানটিতে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হয় সেখানকার শিক্ষকদের। কারা এলেন না, এর তল্লাশিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে করা হয় বলে জানা যায়। এ ক্ষেত্রে আয়োজক থাকে একই মহল। আর এতে অধিকাংশ শিক্ষক মনে মনে ক্ষুব্ধ হন বটে, তবে তাঁদের একটি অংশও প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদ কুড়াতে এ ধরনের কাজে আয়োজকের ভূমিকায় থাকেন। ভেবে বিস্মিত হতে হয়, কী বিচিত্র অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে আমাদের শিক্ষাদান কার্যক্রম।
স্কুলের ভূমি, স্থাপনা ও আসবাব ব্যবহার করে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করার ঘটনাও কম নয়। স্কুল-কলেজের খেলার মাঠটি কোরবানির পশুর হাট হিসেবে ব্যবহূত হয় বেশ কিছু ক্ষেত্রে। স্থায়ীভাবেও কোনো প্রতিষ্ঠানের মাঠে এ ধরনের পশুর হাট বা সবজির আড়ত বসে—এমন ঘটনাও সংবাদপত্রের এসেছে। কখনো বা অনুমতি দেওয়া হয় মাসব্যাপী যাত্রাপালা বা আনন্দমেলা অনুষ্ঠানের।
দুর্ভাগ্য যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এর মধ্যেই চালিয়ে যেতে হয় পাঠ কার্যক্রম। এসব খালি মাঠে, এমনকি সময়ে সময়ে প্রতিষ্ঠানের ভবনে রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ বা কর্মিসভার খবরও আমরা গণমাধ্যমের কল্যাণে পাই। আবার ইদানীং স্থানীয় কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি ভোজের মহা আয়োজন করেন নিকটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। হয়তো বা ভোজে শরিক হয় স্থানীয় জনগণও। তবে প্রশ্ন আসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থাপনা ও আসবাব এতে ব্যবহার করা হয় কোন অধিকার বলে? তাদের আয়োজিত সেসব ভোজে চার-পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবহূত হওয়ার খবরও পাওয়া যায়।
এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলছে অনেক। কটাই বা খবরের কাগজে আসে। আর গণমাধ্যমের স্থানীয় কর্মীরাও এসব খবর পাঠাতে শঙ্কিতই থাকেন। তাঁদেরও তো সে সমাজে বসবাস করতে হবে। জানা যায়, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা সাময়িকভাবে ভাড়াও দেওয়া হয়। এমনকি রাজধানীতে সংসদ ভবনের সামনে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খেলার মাঠ ও চমৎকার স্থাপনা মূল উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হয় খুব কমই। ইমারতটিও বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। আর মাঠটি তো স্থায়ীভাবেই সপ্তাহে অন্তত এক দিন পুরোনো গাড়ি বিক্রির হাট হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমি বা ভবন বেদখল হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে কোনো না কোনো সরকারের সময়ে। আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের নজির আনার আবশ্যকতাই বা কোথায়? রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পুরোনো স্থাপনা বেদখল হওয়ার খবরটি তো সাম্প্রতিক কালে পাঠকের নজরে আসছে। অপব্যবহার থেকে বেদখল—সবই হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমি ও স্থাপনা। যেকোনো সচেতন ব্যক্তি দ্বিমত করবেন না যে একমাত্র বড় রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে কিংবা অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে অতি অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার ব্যতীত অন্য কোনো কাজে এসব ব্যবহূত হতে পারে না। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।
আলোচনা আবশ্যক, এ ধরনের অনিয়ম প্রতিরোধের দায়িত্ব কার? বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কাঠামো ভিন্ন। স্কুল-কলেজের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান আর এর ব্যবস্থাপনা কমিটিকেই প্রাথমিকভাবে দায়ী করা যায় এ ধরনের অনিয়মের জন্য। তারা চাপের মুখে তা করলে কিংবা ইচ্ছাকৃত অংশীদার হলে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা। কিন্তু সবাই নীরবে সহায়তা বা সহ্য করে যাচ্ছে—এটাই আমরা দেখে যাচ্ছি।
আসলে আমাদের গোড়ায় গলদ। দুই যুগেরও অধিক সরকারি চাকরি ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা কমিটিও সর্বাংশে দলীয়করণ করা হয়েছে। যখন যে দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে সেই অঞ্চলের সব স্কুল আর কলেজ; আর সেগুলো সরকারি ও বেসরকারিনির্বিশেষে। তাই যাঁদের দায়িত্ব নিয়ে এ ধরনের অনিয়ম রোধ করার কথা, তাঁদের কেউ আজ্ঞাবহ আর কেউ বা শঙ্কিত মনে নীরবে সহ্য করে যাচ্ছেন। আরও দুঃখজনক যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় নিরপেক্ষ সত্তা প্রতিষ্ঠিত করতে ইচ্ছুক নয় সরকারি কিংবা বিরোধী দল কোনোটিই। প্রধান বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকাকালে একই সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। আবারও ক্ষমতায় গেলে তা করার অভিপ্রায়ও হয়তো বা রয়েছে।
বিষয়টি হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ। এ খাতে আমরা অকাতরে ব্যয় করছি জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ। একমাত্র উদ্দেশ্য শিক্ষাদান। এরই অংশ হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলা আর সহশিক্ষা কার্যক্রম। চলমান অনাকাঙ্ক্ষিত উৎপাত রোধ করতে প্রয়োজন এ ব্যপারে সরকারের কঠোর নীতি এবং এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.