সংগীতে বিশ্বরেকর্ড জাতিগঠনে কোনো ভূমিকা রাখবে কি? by মাহফুজ আনাম
আবেগ দিয়ে চিন্তা করলে ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’ মনের জন্য প্রশান্তিদায়ক একটি কর্মসূচি। কিন্তু জাতিগঠনে কি এটি কোনো ভূমিকা রাখবে?
আমরা সাংবাদিকেরা একটু রূঢ় প্রকৃতির হয়ে থাকি। আমাদের সঙ্গে তর্ক করা
কিংবা আমাদের কোনো কিছু বোঝানো যেমন একটু কঠিন, তেমনি যেকোনো কিছু বুঝিয়ে
আমাদের সন্তুষ্ট করা আরো বেশি কঠিন। বিশেষ করে যখন কোনো বিষয়ে বিন্দুমাত্র
প্রচারণার আভাস থাকে, তখন আমাদের চরিত্রের ‘অনুসন্ধিৎসু’ দিকটি আরো খানিকটা
প্রখর হয়ে ওঠে।
আর যদি এই প্রচারণা রাষ্ট্র তথা সরকার চালায় তাহলে তো আর কথাই নেই। এক একটি বিষয়কে একাধিক দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করি আমরা। তারপরে বিষয়টি যতই ভালো কিংবা উদ্দীপ্ত হোক না কেন, তার সবচেয়ে খারাপ দিকটা বের করে আনি আমরা। এটাই আমাদের কাজ। কিন্তু এর ফলে অনেক সময়ে অনেকের কাছেই আমাদের কাজ বেশ বিস্বাদ হয়ে ওঠে। ‘নির্ভেজাল’ আশীর্বাদ হিসেবে কোনো কিছুকে যাচাই করতে আমরা ব্যর্থ বলে প্রায়ই অনেকেই সমালোচনা করেন। ঠিক যেমনটা হলো ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা কর্মসূচি’কে ঘিরে।
তবে ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা কর্মসূচি’ নিয়ে কথা বলার আগে আমি চলমান টি-২০ বিশ্বকাপ সিরিজকে কেন্দ্র করে যে বিলবোর্ডগুলো লাগানো হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। আমাদের প্রতিবেশী অঞ্চল কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তার পুরো শহরকে নিজ প্রচারণা সম্বলিত বিশাল আকারের বিজ্ঞাপনী চিত্র দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। সেই তুলনায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনেক বেশিই সংযত আচরণ করেছেন বলে তিনি তার প্রাপ্য প্রশংসাও পেয়ে গেছেন। কিন্তু আর নয়। টি-২০ বিশ্বকাপ উপলক্ষে শহর ছেয়ে গেছে শতাধিক বিলবোর্ডে। প্রতিটি বিলবোর্ডেই দেখানো হয়েছে যে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের খেলোয়াড়দের কত উৎসাহ দিচ্ছেন। (খেলায় আমাদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স, বিশেষ করে হংকংয়ের বিপরীতে আমাদের ক্রিকেটারদের পরাজয়ের পরে এসব বিলবোর্ডের বিষয়ে তার আফসোস করা উচিত ছিল।)
এই ধরনের আত্ম-প্রচারণার উদ্দেশ্য কী, তা কখনো যাচাই করা হয়নি। এগুলো হলো সর্বগ্রাসী মানসিকতারই একটি অংশ ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সাম্যবাদী একনায়কতন্ত্র, যার সর্বশেষ নজির হলো উত্তর কোরিয়া। (গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার সরকারপ্রধান তার দেশের সব পুরুষকে তার হেয়ার স্টাইল অনুসরণ করে ঠিক একইরকম করে চুল কাটার আদেশ দিয়েছেন।)
প্রধানমন্ত্রী যে কারণই দেখান না কেন, সবগুলো বিলবোর্ডে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে বিসিবি প্রধানও নিজের যে ছবিটি লাগিয়ে দিয়েছেন তার আসলেই কোনো অর্থ আমরা পাই না। ঠিক কোন ধরনের সম্ভাব্য উৎসাহ তার কাছ থেকে আমরা পেতে পারি? একইভাবে একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিও, যা আমাদের মতে, তার স্মৃতি-গৌরব-মর্যাদার প্রতি অপমান বৈ আর কিছুই নয়। এই কাজটি যে বা যারাই করে থাকুক না কেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ও অনুগ্রহভাজন হওয়ার উদ্দেশ্যে কাজটি করেছে। কিন্তু এর ফলে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পিতা আমাদের জাতির পিতার।
‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’র প্রসঙ্গে আসছি। বাংলাদেশী হিসেবে আমরা বরাবরই বিশাল জনসমাবেশ করতে যে বেশ পছন্দ করি তা গোপন কিছু নয়। আমার বয়সী লোকেরা বেশ মনে করতে পারবেন, ষাটের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশের উত্থানকালে বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক বৈঠকের কথা যার ফলে জন্ম নিয়েছিল ছয় দফা ও ১১ দফা আন্দোলন কর্মসূচিগুলো। এছাড়াও আছে ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের বিজয় মিছিল, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত সেই ভাষণ, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে তার স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি ঐতিহাসিক ঘটনা যখন সারা দেশের মানুষের ঢল নেমেছিল একটি নির্দিষ্ট জায়গায়।
জিয়াউর রহমানের জানাজা কিংবা এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সাক্ষী আমি ছিলাম না, তাই বঙ্গবন্ধুর সময়ের তুলনায় এসব সময়ে জনতার ঢল কীরকম ছিল তা বলতেও পারছি না। তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন পড়ে জেনেছি যে, এসব সময়েও বিশাল জনসমাবেশ ঘটেছিল।
তারপর থেকে সময়ের সঙ্গে আমাদের রাজনীতি ক্রমাগত ভঙ্গুর হতে শুরু করায় জাতীয় প্রয়োজনেও আমাদের জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও একত্রিত করার ক্ষমতা হারিয়েছি আমরা।
এই বিষয়টি মাথায় রেখে গত বুধবার স্বাধীনতা দিবস উদযাপন ও আমাদের জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার জন্য যে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের জনসমাবেশের বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। এর অনুপ্রেরণার দিকটি ভেবে দেখলে এই ঘটনাটি অবশ্যই অনন্য সাধারণ একটি ঘটনা। এটা কল্পনা করা বেশ কঠিন যে, বিশ্বের যেকোনো দেশের নাগরিকদের একটি অংশ সম্মিলিতভাবে তাদের সবচেয়ে প্রিয় গান, তাদের জাতীয় সঙ্গীত গাইবেন আর তখন তাদের সমর্থন দিতে সে সময় আরো লাখো মানুষ ছুটে যাবেন না। একই ঘটনা ঘটেছে আমাদের ক্ষেত্রেও। আর আবেগপ্রবণ জাতি হিসেবে আরো অনেক জাতির তুলনায় সম্ভবত এক্ষেত্রে আমাদের প্রতিক্রিয়া কিছু বেশিই ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যে লক্ষাধিক ব্যক্তিরা দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদেরই মধ্য থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই ঘটনাটি আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মুক্তিযুদ্ধের কারণেই আজ বিশ্বের সামনে আমাদের একটি স্বতন্ত্র পরিচয় আছে। আমাদের জীবনের সেই যৌবনোদ্দীপ্ত সময়ে যখন আমাদের তারুণ্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর ছিল, তখন লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং সে লক্ষ্যে কিভাবে পৌঁছাতে হবে কিংবা আমাদের ভবিষ্যৎ কী তা না জেনেই আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। বুধবারের স্বাধীনতা দিবসে জনতার ঢল সেই সময়ের স্মৃতিতেই আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। সে সময়ে গান ও কবিতা আমাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল, বিশেষ করে ‘সোনার বাংলা’ গানটি।
আমার মনে আছে, যুদ্ধের সময় ক্যাম্পে থাকাকালীন যখন আমরা আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় বা গৃহস্থালি কাজগুলো করতাম তখন এই গানটি গুনগুন করে গাইতাম। আর গানটি গাওয়ার সময় ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’ যখন গাইতাম, তখন আমাদের মধ্যে ঠিক সেই অনুভূতিই কাজ করতো যে অনুভূতিটি কাজ করতো যখন আমরা আমাদের ‘প্রিয় মানুষটিকে’ কথাটি বলতাম।
নিজেদের মুক্ত করার জন্য, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলে যাদেরকেই যুদ্ধ করতে হয়েছিল, তাদেরই মতো আমাদেরও ছিল নিজস্ব জাতীয়তাবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম। চিন্তা করতে গেলেই চিন্তার মুহূর্তটিতে এই জাতীয়তাবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম আমাদের সবচেয়ে ভালোবাসার সম্পর্কে পরিণত হয়- দেশের জন্য ভালোবাসা, জনমানুষের জন্য ভালোবাসা, সংস্কৃতির জন্য ভালোবাসা, আমাদের ঋতু-নদীর জন্য ভালোবাসা, বৃষ্টির জন্য ভালোবাসা (উফ্, সে সময়ে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য কী আকুল আকাঙ্ক্ষা ছিল আমাদের!), এবং অবশ্যই আমাদের শিল্পকলা-বিশেষ করে গানের জন্য ভালোবাসা। সেই দিনগুলোতে আনন্দ-উল্লাসের সময় ‘আমরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানটি সত্যিই আমাদের অনুভূতিকেই প্রকাশ করতো।
স্বাভাবিকভাবেই সে সময় সবগুলো গানের মধ্যে ‘সোনার বাংলা’ গানটিকেই আমরা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, সে সময় এই গানটিই আমাদের সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করেছিল। আর সে সময় যেকোনো একজন গানটি গাইতে শুরু করলেই তার আশপাশে আমরা সবাই একত্রিত হয়ে গানটি গাইতাম এবং যেকোনো বিষয়েই যেকোনো দিক থেকে আমরা এভাবেই ঐক্যবদ্ধ থেকে যা ভাবার ভাবতাম।
তাই গত বুধবার যখন একসঙ্গে আড়াই লাখ মানুষ ‘সোনার বাংলা’ গাইলো, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমার হৃদয় ভরে উঠেছিল, আর আমার সঙ্গে সঙ্গে আরো লাখো-কোটি মানুষের হৃদয় ভরে উঠেছিল আনন্দোচ্ছ্বাস আর গৌরবে।
অবশ্য, (এখান থেকেই একজন মুক্তিযোদ্ধার পরিবর্তে একজন সাংবাদিক হিসেবে কথা বলতে শুরু করছি আমি, এবং আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে কথা বলছি), এই পুরো ঘটনাটির সবচেয়ে দুঃখজনক অংশ হলো- এই ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে শুধুই বিশ্ব রেকর্ড হিসেবে গিনেস বুকে বাংলাদেশের নাম ওঠানোর জন্য, আর তা জনসম্মুখে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে ঘোষণাও করা হয়েছে।
একটু ভাবুন তো, আক্ষরিক অর্থেই একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সরকারসহ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র তো বটেই, এমনকি সামরিক বাহিনীও পুরোপুরি থেমে গিয়েছিল শুধু ক্ষণিকের একটি রেকর্ডের জন্য। একটি বইতে যেন আমরা কয়েকটি লাইন ওঠাতে পারি সেজন্য। অথচ বিশ্বের যেকোনো দেশ একই উদ্দেশ্যে তার নিজস্ব জনবল ব্যবহার করে পরমুহূর্তেই আমাদের রেকর্ড ভেঙে দিয়ে সেই বইটি থেকে আমাদের নাম মুছে ফেলতে পারে, ঠিক যেমনটা হয়েছিল যখন আমরা সবচেয়ে বড় মানবপতাকা তৈরির রেকর্ড করেছিলাম। ভারতের বেসরকারি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সাহারা গ্রুপের আয়োজনে ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীতের এমনই একটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গত বছরের মে মাসে লখনৌ-তে একত্রিত হয়েছিলেন এক লাখ ২১ হাজার ৬৩৫ জন ব্যক্তি।
এই ক্ষুদ্র বিষয়টিকে পেছনে ফেলে কী আরো বড় কোনো জাতীয় উদ্দেশ্যে থাকতে পারে না, যেখানে সরকার-বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীসহ আমাদের পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবে? যেমন- বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দেশে ঘটে বলে যে কুখ্যাতি আছে তা মুছে ফেলার সম্মান অর্জন করতে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ; আমাদের নদী ও বন বাঁচানো; দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই-এসব কারণে কি হঠাৎ করে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেতে পারেন না?
সরকারসংশ্লিষ্ট লক্ষাধিক ব্যক্তি, যাদের বেতন বাবদ সরকারের নিয়মিত খরচ আছে কয়েক কোটি টাকা, তারা এই বিশ্বরেকর্ডের পেছনে সময় ও শ্রম দিয়েছেন যার আর্থিক মূল্য দাঁড়াবে আরো কয়েক কোটি টাকা। এছাড়াও এই রেকর্ডসংশ্লিষ্ট আরো বিভিন্ন খাতে খরচ হয়েছে আরো অনেক কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এই রেকর্ড গড়ার পেছনে খরচ হয়েছে একশ’ কোটি টাকারও বেশি।
এই খরচের যোগান পেতে যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় বেসরকারি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়েছে, তাতে এই সরকারকে সর্বগ্রাসী মানসিকতার সরকারেরই একটি ছোট্ট রূপ বলা যেতে পারে। গত ৯ মার্চ অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন যে সরকার একশ’ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে- ৫০ কোটি টাকা টি-২০ বিশ্বকাপের জন্য এবং বাকিটা ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’র জন্য। এই ‘চাঁদা’ তোলাকে খুবই সাধারণ বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করে মন্ত্রী বলেছিলেন, “সরকারের জন্য আমি অনেক চাঁদা তুলি।”
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পৃথক পৃথকভাবে কত টাকা করে দেবে তার একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘোষণা করে একটি বার্তা দেয়া হয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ন্যূনতম এক কোটি টাকা চাঁদা দিতে হবে। সরকারের এই কাজে সহযোগিতা না করলে এর ফলাফল হিসেবে আশাতীত পরিণতির একটি ‘অঘোষিত’ বার্তাও মূল বার্তার সঙ্গে দেয়া হয়েছিল।
ন্যূনতম আর্থিক পরিকল্পনা ও নীতি অনুসরণ করে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানেরই কোটি টাকার কোনো প্রকাশ্য তহবিল থাকে না। কাজেই একথা বলাই বাহুল্য যে অর্থমন্ত্রী যে ‘চাঁদা’ তুলেছেন, তার টাকা এসেছে সিএসআর তহবিল থেকে। এর ফলে এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য যে কাজগুলো করতো তা থেকে বঞ্চিত হবেন এদেশের হতদরিদ্র মানুষগুলো।
‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’র জন্য বিভিন্ন বিদ্যালয়ে কঠোর নির্দেশনা পাঠানো হয়েছিল এই বলে যে- বিদ্যালয়গুলো যেন নিজ নিজ শিক্ষার্থীদের সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বাসে তুলে নিয়ে ৭টার মধ্যে অনুষ্ঠানকেন্দ্রে পৌঁছে দেয়। অনুষ্ঠানটি শুরু হওয়ার কথা ছিল বেলা ১১টা ২০ মিনিটে।
ছুটির দিনেও সাতসকালে সন্তানদের ঘুম থেকে ওঠানো, ঘণ্টা পেরিয়ে বাসের জন্য তাদের ধৈর্য ধরিয়ে অপেক্ষা করানো, কোথা থেকে শিশুগুলো বাসে উঠবে তা নিয়ে দ্বিধা-সব মিলিয়ে বাবা-মায়েরা পার করেছেন একটি ভয়াবহ সময়। এমনকি অনুষ্ঠান কখন শেষ হবে তা না জানা থাকায় কতক্ষণ সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ হবে না তাও জানতেন না বাবা-মায়েরা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সন্তানরা কখন ফিরবে তা নিয়েও ছিল না কোনো নিশ্চয়তা এবং সময়সূচি না জেনেই সন্তানদের জন্য অভিভাবকদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘক্ষণ। তার ওপর ছিল অপর্যাপ্ত পানি ও খাবার এবং অসুস্থ শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল না কোনো পৃথক ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে দিনটিকে নিয়ে ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতা তাই অনায়াসেই জানা যাবে অভিভাবকদের কাছ থেকে।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় এই চিত্র অবশ্য খুব একটা আলাদা কিছু নয়। এখানকার বিদ্যালয়গুলো এবং তাদের শিক্ষার্থীরা যত বেশি দরিদ্র হয়, ততই তাদের উপর বেশি বেশি দুঃসাধ্য কাজগুলো চাপিয়ে দেয়া হয়। কাজগুলো করিয়ে নেয়ার বিষয়ে ততটাই কঠোরপন্থা অবলম্বন করা হয়। আর বেশ কিছু ক্ষেত্রে যখন দেখা যায় যে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক-অধ্যক্ষরা উচ্চ পর্যায়ের অনুগ্রহভাজন হতে কিংবা ঘনিষ্ঠ হতে চান, তখন এই শিক্ষার্থীদের ওপর দিয়ে যে কী বয়ে যায় তা বলাই বাহুল্য।
অত্যন্ত সাদামাটাভাবে আমরা যদি বলি, পুরো আয়োজনটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণকারী মানুষের ওপর ছেড়ে দেয়া যেতে পারতো তাহলে কী খুব ভুল বলা হবে? আমরা মনে করতে পারি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে কোনো দৌড়-ঝাঁপ ও ন্যূনতম খরচ ছাড়াই এবং জনগণের স্বেচ্ছায় তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে কিছুদিন আগেই সারা দেশে একসঙ্গে কত সুন্দরভাবে ‘মোমবাতি প্রজ্জ্বলন’ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছিল!
যত লাখ মানুষই জাতীয় সঙ্গীতটি গেয়ে থাকুন না কেন, এর মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি গঠনের জন্য এই কর্মসূচিটি কতটা কাজে দিয়েছে সেটাই প্রশ্ন। নিজেদের আত্ম-প্রশংসার জন্য বরাবরই আমরা অনেক আড়ম্বরপূর্ণ ও জাঁকজমক ঘটনাই ঘটাই এবং এসব কাজের পেছনে আসলে মূল উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত সেটা নিয়েই দ্বিধায় থাকি।
ন্যূনতম আত্ম-সমালোচনা তো আমরা করিই না, বরং এত বেশি আত্ম-প্রশংসা করাতে ব্যস্ত থাকি যে নিজেদের নিয়ে ভাবার জন্য ন্যূনতম সময়টুকুও আমরা পাই না। এই সবকিছুই যতটা জাতিগঠনের পরিপন্থী, তার থেকেও এই বিষয়গুলো বেশি ক্ষতি করে গণতন্ত্রের।
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন: নুজহাত কামাল।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার।
No comments