লন্ডনে প্রেমোপাখ্যান
সেঞ্চুরির
দুয়ারে এসে থেমে গেলেন খুশবন্ত সিং। জন্ম ২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫, মৃত্যু ২০
মার্চ ২০১৪। পাঞ্জাবের পাকিস্তান অংশে হাদালিতে তার জন্ম। বাবা স্যার শোভা
সিং প্রখ্যাত ভবন নির্মাতা, চাচা সর্দার উজ্জ্বল সিং পাঞ্জাব ও তামিলনাড়ুর
গভর্নর। ভারতীয় ইংরেজি লিখেয়েদের মধ্যে খুশবন্ত সিংয়ের জনপ্রিয় আর যে কেউ
ছিলেন না তা জোর দিয়েই বলা যায়। তিনি পাঞ্জাবি ভাষায়ও লিখেছেন, তার
সুখপাঠ্য কলাম অনেক খবরের কাগজের প্রচারসংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি যখন
ইলাসট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া সম্পাদনার দায়িত্ব নিলেন এর প্রচারসংখ্যা ৬০
থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজারে পৌঁছে। বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব খুশবন্ত সিং যে দায়িত্বই
নিয়েছেন তাতেই সুফল ফলেছে। ১৯৫০-এ প্রকাশিত হয় তার প্রথম বই ‘বিষ্ণুর
চিহ্ন ও অন্যান্য গল্প’, শেষ বই ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘অভেয়বাদী খুশবন্ত সিং,
কোনো ঈশ্বর নেই’; তার আত্মজীবনী ‘সত্য, ভালোবাসা ও একটুখানি ঈর্ষা’
প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে। ভারত বিভাজনের রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক অধ্যায় নিয়ে
রচিত উপন্যাস ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ দাঙার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর
একটি। এ উপন্যাসটির চলচ্চিত্রায়নও সফল হয়েছে বলে মনে করা হয়। খুশবন্ত
সিংয়ের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : এ্যা হিস্ট্রি অব শিখ,
দ্যা ট্র্যাজেডি অব পাঞ্জাব, দ্য ভয়েস অব গড অ্যান্ড আদার স্টোরিজ, ওমেন
অ্যান্ড মেন ইন মাই লাইফ, দিল্লি, ব্ল্যাক জ্যাসমিন, দ্য সানসেট ক্লাব।
খুশবন্ত সিং দীর্ঘজীবন প্রাপ্তির রেসিপিও লিখে গেছেন ৯৮ বছর বয়সে- মেজাজ
খারাপ করবেন না, মিথ্যাচার করবেন না। অন্যের সমালোচনার গুরুত্ব দেবেন না।
শুকনো রুটি ও ঠাণ্ডা পানি খাবেন। নিজের মৃত্যু নিয়েও অসাধারণ রসিকতা করে
গেছেন খুশবন্ত সিং। ‘লন্ডনে প্রেমোপাখ্যান’ অনূদিত গল্পটি প্রকাশ করে
প্রয়াত এই লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে। বি.স.
‘‘আমি আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। আর পনের মিনিটের মধ্যে আমরা লন্ডন এয়ারপোর্টে অবতরণ করতে যাচ্ছি। দয়া করে সিটবেল্ট বাঁধুন এবং ধূমপান থেকে বিরত থাকুন। ধন্যবাদ।”
দরজার উপরের প্যানেলে আরও বেশি সতর্কবার্তা। লাল হরফে জ্বলছে : ‘সিটবেল্ট বাঁধুন, ধূমপান নিষেধ।’
কামিনী জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। এখনও মেঘের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে আর নিচে তুলতুলে তুলার বিশাল সাগরের মতো বিছিয়ে আছে মেঘ। আর সিকিঘণ্টার মধ্যে সে ইংল্যান্ডে পৌঁছবে, এটা বিশ্বাসই হতে চাচ্ছে না- যে ইংল্যান্ডের কথা সে বইয়ে পড়েছে বন্ধু ও আত্মীয়দের কাছে শুনেছে, ছবিতে দেখেছে, সেই ইংল্যান্ডে নিজে কখনও আসবে বিশ্বাসই হয়নি। অলৌকিক ঘটনার দিন ফুলিয়ে যায়নি। আর বৃত্তি নিয়ে মাসভর বড্ড পীড়াদায়ক সিদ্ধান্তহীনতা, পাসপোর্ট, ভিসা, বিদেশী মুদ্রা, আয়কর ছাড়পত্র ও হেলথ সার্টিফিকেট সবার ঝামেলা চুকিয়ে সে সত্যিই লন্ডন যাচ্ছে।
এয়ার হোস্টেস বিনীতভাবে স্মরণ করিয়ে দিল, ‘আপনার সিটবেল্ট ম্যাডাম।’ কোমর ঘিরে সিটবেল্ট লাগাতে গিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘হ্যাঁ, তাই তো, দুঃখিত।’ ইংল্যান্ডে থাকাটা আনন্দদায়ক হবে কি-না ভাবছিল। যতটুকু পড়েছে, যা শুনেছে এ এক সুন্দর দেশ। তবে মানুষের ব্যাপারে তার সন্দেহ ছিল। তাদের হাতে তার পরিবার অনেক ভুগেছে। অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় তার বাবা ও ভাইয়েরা জেলে গিয়েছে, জেলখানায় তাদের পেটানো হয়েছে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষের ছাত্রী সে তখন নিজেও সাত দিনের ডিটেনশন খেটেছে। কোনো ইংরেজের সঙ্গে দেখা হওয়া বলতে যা বোঝায় ম্যাজিস্ট্রেট রবার্ট স্মিথ ছাড়া আর কারও সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি।
এ এক দুর্বোধ্য ঘটনা।
ঘটনাটি ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সময়কার। কলেজছাত্রীদের দলের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সেও দেশাত্মবোধক গান গেয়েছে, কোনো বিদেশীকে দেখামাত্রই চেঁচিয়ে ‘ভারত ছাড়’ স্লোগান দিয়েছে। পুলিশ তাদের পাকড়াও করে এবং তাদের দ্রুত বিচারের জন্য সোপর্দ করার প্রস্তুতি নেয়া হয়। সে ছাড়া মেয়েদের আর সবাই দোষ স্বীকার করে এবং তাদের সতর্ক করে ছেড়ে দেয়া হয়। তাকে থানা হাজতে নেয়া হয়। পরদিন তাকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রবার্ট স্মিথ, আইসিএস এর এজলাসে হাজির করানো হয়।
দৃশ্যটি কামিনী বেশ ভালোই স্মরণ করতে পারছে। বর্ষাকাল তখন প্রবল দাপট দেখাচ্ছে। খাম, কাগজ আর কালির ভ্যাপসা গন্ধ আদালতে ছড়িয়ে আছে। ম্যাজিস্ট্রেটের টেবিলে আলোর বৃত্তাকার ছায়া, আর একটি আলো একদিকে হলদে কাগজের ফাইলের স্তূপের পাশে বসা পেশকারের টেবিলে- এ ছাড়া আর সব অন্ধকার। ম্যাজিস্ট্রেট হালকা লাল চুলের এক যুবক। পরনে ছোট-হাতা শার্ট, আর ঢিলে টাইয়ের গিঁটটা বুকের মাঝামাঝি টেনে নামানো। বিশ্ববিদ্যালয়, নৌকাবাইচ আর রাগবি ম্যাচের একটি আভা তখনও তাকে ঘিরে আছে। তিনি তখন একটি বইয়ে ডুবে আছেন। যাদের বিচার হচ্ছে তাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না।
পেশকার কামিনীর নাম, তার বাবার নাম এবং তার অপরাধের ধরন পড়ে শোনায়।
হিন্দুস্তানি ভাষায় পেশকার জিজ্ঞেস করে, ‘দোষী না নির্দোষ?’
‘নির্দোষ।’
তার দিকে না তাকিয়ে টেনে টেনে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ‘তার বয়স কত জিজ্ঞেস কর।’
দোভাষীর অনুবাদের অপেক্ষা না করে কামিনী নিজেই বলল, ‘সেভেনটিন-সতর। আর তাকে বলুন, ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে তার নিজ দেশের জন্য কাজ করুন!
ম্যাজিস্ট্রেট চোখ তুলে তাকান। ম্যাজিস্ট্রেটের স্ফাত-ধূসর চোখ কাক-কালো চুলঘেরা মুখমণ্ডল থেকে নেমে চুলের গোছা যেখানে পড়েছে সেই খোলা কাঁধ ও লম্বা গলা বেয়ে তার তারুণ্যভরা দেহ পরিক্রমণ করে আর চোখে এসে মিলিত হয়।
তিনি বিড়বিড় করে বলেন, ‘অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য মিল।’ তার চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে তিনি পেশকারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী যেন তার নাম।’
‘কামিনী... কামিনী গার্ভে।’
‘মিস গার্ভে, তোমার স্কুলে কি কোনো কবিতা পড়ায়?’
‘হ্যাঁ... না’ কামিনী তোতলায়। তারপর আক্রমণাÍক কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘এর সাথে এই মামলার কি সম্পর্ক? ওরা কি আদালতে বসে উপন্যাস পড়ার জন্য আপনাকে বেতন দেয়?’
‘উপন্যাস নয়, ইয়ং লেডি, কবিতা। জেলখানায় পড়ার জন্য বইটা তোমাকে ধার দেব। দণ্ড ৭ দিন, এ ক্লাস। তারপরও যদি রূঢ় আচরণ করতে থাকো তাহলে আদালত অবমাননার দায়ে আরও সাত দিন বেশি খাটতে হবে।’
পরদিন কামিনী চমৎকার বাঁধাই হিলারি বেলকের সংগৃহীত কবিতার একটি খণ্ড হাতে পেল। তাতে লিখা : জেলখানায় সুখকর পাঠ। যে মানুষটি তোমাকে এখানে পাটিয়েছে তার শুভেচ্ছাসহ।
এক চিলতে কাগজে পৃষ্ঠা চিহ্নিত করা, সেখানে একটি কবিতার দুটি পঙ্ক্তি, নিচে লাল কালিতে দাগানো। পাশে কামিনীর নামের দুটি আদ্যক্ষর ‘কে জি’। সেই লাইন দুটি :
তার মুখ যেন রাজার আদেশ
কখন একসাথে সব তরবারি বেরিয়ে আসে।
কামিনী ঠিক করল স্মিথের এ আচরণের কথা সংবাদপত্রগুলোকে জানাবে। সে নিশ্চিত, এতে তার চাকরি যাবে। কিন্তু সাত দিন পেরোবার আগে তার নিজের সম্পর্কে নিশ্চয়তাই কমে গেল। যখন বাড়ি ফিরে এলো, শুনল স্মিথ পদত্যাগ করেছেন। ক’দিন পর তিনি ইংল্যান্ড ফিরে গেলেন।
কবিতার পঙ্ক্তি দুটির মানে যে খুব বুঝতে পেরেছে তা নয়, তবে এতে যে তার চেহারার প্রশংসা করা হয়েছে এটা ঠিক। আর এ প্রথম কেউ একজন এমন প্রশংসা করল। এরপর যতবারই সে আয়নার দিকে তাকিয়েছে, ততবারই শব্দগুলো তার কাছে ফিরে এসেছে : তার মধ্যে এমন একটা অনুভূতি কাজ করেছে যেন স্মিথ তার দিকে তাকিয়ে আছেন, যা তার উদীয়মান দায়িত্ব সম্পর্কে বিব্রতকর সচেতনতার সৃষ্টি করছে। এ ঘটনাটি ইংরেজদের সম্পর্কে তার মনোভাবের পরিবর্তন ঘটায়নি, তবে তাদের যে লাজুক মনে করা হতো, এ বিশ্বাস তার আর রইল না।
বায়ুস্তরে উড়োজাহাজের লাগাতার ঝাঁকুনিতে কামিনী তার দিবাস্বপ্ন থেকে ছিটকে পড়ল। মেঘের স্তর কেটে বহু লাল ছাদের বাড়ি আর টারমাকের কাটাকাটি করে যাওয়া রাস্তা এবং গুবরে পোকার মতো হামাগুঁড়ি দিয়ে চলা সারি সারি গাড়ির উপর দিয়ে উড়োজাহাজ নেমে আসছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে রানওয়ে স্পর্শ করল এবং চাকার ওপর ভর করে শুল্ক বিভাগের শেডের কাছে গিয়ে থামল।
জাহাজের জানালার পাশে বসে দীর্ঘ সময় ধরে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ড দেখল। শরতের উষ্ণ অপরাহ্নে তার হোটেলের উল্টোদিকের পার্কভর্তি মানুষ লালচে সূর্যালোকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আগে যত সবুজ দেখেছে তার চেয়েও সবুজ পার্কের ঘাস আর বেষ্টনী ধরে বহু বিচিত্র গ্ল্যাডিওলাস ফুল ফুটে আছে। পার্কের প্রবেশপথে এক বুড়ো ভিখারি তার ব্যারেল অর্গানে বহুদিন আগে ভুলে যাওয়া মধুর সুর তুলছে। জায়গাটা শান্তিপূর্ণ ও বান্ধব মনে হল। কামিনী নিজেই বাইরে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে এলো।
কামিনীর খানিকটা আশংকা ছিল শাড়ি পরার কারণে লোকজন তার দিকে তাকিয়ে থাকবে, কিন্তু কেউ সেদিকে কোনো নজরই দিল না। তার চোখে পড়ল ছোট ছেলেমেয়েরা পার্কের পুকুরে নৌকা চালাচ্ছে, মহিলারা হাঁসকে খাওয়াচ্ছে আর ছেলেরা দর্শকদের বৃত্তের মাঝখানে শব্দকরা খেলনা উড়োজাহাজ চালাচ্ছে। তার চোখে পড়ল বেশকিছু জোড় তাদের চারপাশের পৃথিবীকে বেমালুম ভুলে গিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঘাসের ওপর জায়গা করে নিয়েছে।
সে নিজেও পার্কে স্বঘোষিত বক্তাদের ঘিরে রাখা জনতার সঙ্গে যোগ দিয়ে তাদের বক্তৃতা আর তাদের উত্ত্যক্ত করা শ্রোতাদের প্রশ্নবান শুনল।
যখন সে হোটেলে ফেরার জন্য পা বাড়ায় নৈঃসঙ্গের অনুুভূতি তাকে পেয়ে বসে। সে বুঝতে পারল তার জীবনে এ প্রথম একটি অপরাহœ কাটল যেদিন কেউ তার সঙ্গে কথা বলেনি। সে ছাড়া আর সবারই কথা বলার মতো কেউ না কেউ আছে। নিজেকেই সে প্রশ্ন করল, এই নির্বান্ধব দেশে সে কেন আসতে গেল?
পরের দিনগুলোতে কামিনী তার প্রশ্নের কোনো জবাব পায়নি। তার জীবন দ্রুত একটি ছকে বৃত্তাবদ্ধ রুটিনে বাঁধা হয়ে গেল- এক বা আধ পেনি ভাড়ায় বাসে আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে যাওয়া, জনাকীর্ণ ট্রেনে স্ট্যাপ ধরে আধঘণ্টা ঝুলে থাকা, আবার বাস ধরা, লেকচার শোনা, ক্যাফেটেরিয়াতে মধ্যাহ্নভোজ, আরও লেকচার, আবারও বাস ধরা, স্ট্যাপ ধরে ঝুলে বাড়ি ফেরা- অবশ্য হোটেলকে যদি বাড়ি বলা যায়- যেখানে মামুলি শুভেচ্ছা বিনিময় ছাড়া কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। সেখানে প্রয়োজনীয় কথোপকথন ফিসফিস করে সেরে নিতে হয়। যেখানে সংবাদপত্রের পাতা উল্টানোর শব্দ চারদিকে ছড়ানো শেষকৃত্যের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দেয়, সেখানে।
ভারত ছেড়ে আসার পর কামিনী মনের ভেতর একটি অস্পষ্ট প্রত্যাশা লালন করেছে যে একদিন রবার্ট স্মিথের সঙ্গে তার দেখা হয়েও যেতে পারে। সে জানে এই প্রত্যাশা হাস্যকর। কারণ সে জানে তিনি আফ্রিকা কিংবা আমেরিকাতেও থাকতে পারেন। এমনকি তিনি যদি ইংল্যান্ডে থেকেও থাকেন লন্ডনের ঘূর্ণায়মান আশি লাখ মানুষের মাঝে অকস্মাৎ ঘটনাচক্রে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা মোটেও উজ্জ্বল নয়। আর যদি তার সঙ্গে দেখাই হয় তিনি কি তাকে চিনতে পারবেন? সে তাকে কি বলবে? কিংবা তিনি তাকে কি বলবেন? সে টেলিফোন বইতে তার নাম খুঁজতে চেষ্টা করে। কিন্তু ডিরেক্টরিতে পাতার পর পাতা স্মিথ নামে ভর্তি দেখে সে নিরাশ হয়ে পড়ে। আর আদ্যক্ষরের বহু নাম। আর যদি সে তাকে ফোনে পেয়েই যায় সে জানে না কোন অজুহাতে তাকে ফোন করবে।
তা সত্ত্বেও চিন্তাটা তার মাথায় রয়েই গেল এবং তা বাতিলে পরিণত হল। সে বিশ্বাস করতে শুরু করল সে যদি ইচ্ছে করে, যে কোনো ভাবে যে কোনো স্থানে তার সঙ্গে দেখা হয়েই যাবে। সে বইয়ে পড়েছে মানুষ যদি একই বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয় তাহলে তাদের পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসাটাই স্বাভাবিক। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে এরপর কি ঘটবে সবটাই তার মনের মধ্যে সাজানো। তিনি হ্যাট তুলে জিজ্ঞেস করবেন, ‘মিস গার্ভে, আমার মনে হয় না আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
‘আমি যদি ভুল না করে থাকি আপনি মিস্টার স্মিথ। হ্যাঁ, অবশ্যই, আগে আমাদের নিশ্চয়ই দেখা হয়েছে। তবে সেটাকে দেখা পেয়ে আনন্দিত হওয়া বলা যায় কি-না আমার সন্দেহ আছে। তা কেমন আছেন মিস্টার স্মিথ?’ তারপর এক আলাপ নিয়ে যাবে অন্যটাতে।
তার পলিটেকনিক টার্ম প্রায় শেষ হয়ে আসছে। তার ইচ্ছেশক্তি কিংবা কোনো ঘটনাচক্র কামিনী ও রবার্ট স্মিথকে মুখোমুখি করাতে পারেনি। অন্য যে কোনো দিনের মতোই একদিন সে টিউব স্টেশনে যাওয়ার বাস ধরল। আবার আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বেরিয়ে অন্য প্রান্তে যখন পরের বাস ধরতে এলো, দেখল রাস্তা লোকারণ্য, গাড়ি সরিয়ে দেয়া হয়েছে। দূর থেকে তার কানে এলো ব্যাগপাইপের সুর আর বড় ড্রাম বাজানোর শব্দ। সে নিজের হাতের খবরের কাগজটিতে চোখ ফেলল, দেখল সফররত কোনো রাজাবাদশাহকে এ সময় রানীর এ পথ অতিক্রম করার কথা। সে ঠিক করল ক্লাস বাদ দেবে, তারপর জনতার সঙ্গে যোগ দিল।
দলপতি তার নির্দেশের দণ্ড উঁচু-নিচু করছে, পেছনে বাজিয়ে যাচ্ছে স্কটিশ কামিনীর বাদকদল। তাদের পেছনে ধীর গতিতে রাজকীয় চালে আসছে গার্ভের দল। তাদের উঁচু পশমি টুপি, জ্বলজ্বলে পিতলের বোতাম লাগানো টকটকে লাল কোট, বেয়নেটসহ রাইফেল সবই বর্শার অরণ্যের মতো দ্যুতি ছড়িয়ে তার মধ্যে একটি উত্তেজনার সঞ্চার করছে। গার্ভ সদস্যরা তার সামনে এসে বিরতি দিয়ে রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু পরই এলো অশ্বারোহী সৈন্যদল আর তাদের একডজন কালো ঘোড়ায় টানা রানীর সোনালি কোচ। গার্ডসদস্যরা সোজা হয়ে আনত হল। রানী এবং তার রাজকীয় অতিথি ব্যান্ডের সঙ্গে যোগ দিয়ে উঁচু গলায় সুর মেলানো জনতার দিকে হাত নেড়ে চলে গেলেন।
ব্যান্ড মিছিল চলে যেতেই জনতার শৃঙ্খল ভেঙে পড়ল। অফিসের পথে ছুটে যাওয়া মানুষের ধাক্কার পর কামিনী মোহগ্রস্তের মতো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। দেখল, কেবল তার সামনের মহিলাটিই যেমন ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে। কামিনী তার ফোঁপানোর শব্দ শুনল, যখন ঘুরে দাঁড়াল দেখল হাতের ঠিক উল্টো পিঠ দিয়ে তিনি চোখ মুছছেন। হাতব্যাগের ভেতর থেকে রুমাল বের করার জন্য সবকিছু তছনছ করে ফেলছেন। কামিনী যে তাকে দেখছে এটা নজরে আসার পর তিনি বিব্রতবোধ করলেন। তিনি বললেন, সৈন্যবাহিনী আর শোভাযাত্রার কথা উঠলে আমি যে কী রকম বোকামি শুরু করে দিই। এরা সবসময় আমাকে কাঁদিয়ে ছাড়ে।’
কামিনী বলল, ‘এটা খুব আবেগময় একটা ব্যাপার! আর দেখতে কী চমৎকার! একসঙ্গে এত বেশি সৈন্য খুব সুন্দর দেখায়, তাই না?’
তিনি বললেন, ‘তোমার কথা অদ্ভুত শোনাচ্ছে। আমার বন্ধু সবসময় বলত, একজন সুন্দরী মহিলাকে দেখায় খোলা তরবারি হাতে সহস্র সৈন্যের মতো। আসলে আমার বন্ধু সবসময় এই কথাটা আমাকেই বলত। সে ভারতেও গিয়েছিল, ভারতকে পছন্দও করত। তিনি তার রুমাল খুঁজে পেলেন এবং তা দু’চোখে চেপে ধরলেন। কামিনী অনুভব করল তার পাজোড়া ভারী হয়ে এসেছে।
সে জানে একজন আগন্তুককে এ ধরনের প্রশ্ন করার অধিকার তার নেই, কিন্তু কোনো একটা কিছু জোর করে তাকে দিয়ে প্রশ্ন করানো, ‘আপনার বয়ফ্রেন্ড এখন কোথায়?’
তিনি অশ্র“ভেজা মুখ ফেরালেন।
বললেন, যুদ্ধে নিহত হয়েছে, ডি-ডেতে।
(উ-উধু : দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিজয়ের দিন।)
‘‘আমি আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। আর পনের মিনিটের মধ্যে আমরা লন্ডন এয়ারপোর্টে অবতরণ করতে যাচ্ছি। দয়া করে সিটবেল্ট বাঁধুন এবং ধূমপান থেকে বিরত থাকুন। ধন্যবাদ।”
দরজার উপরের প্যানেলে আরও বেশি সতর্কবার্তা। লাল হরফে জ্বলছে : ‘সিটবেল্ট বাঁধুন, ধূমপান নিষেধ।’
কামিনী জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। এখনও মেঘের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে আর নিচে তুলতুলে তুলার বিশাল সাগরের মতো বিছিয়ে আছে মেঘ। আর সিকিঘণ্টার মধ্যে সে ইংল্যান্ডে পৌঁছবে, এটা বিশ্বাসই হতে চাচ্ছে না- যে ইংল্যান্ডের কথা সে বইয়ে পড়েছে বন্ধু ও আত্মীয়দের কাছে শুনেছে, ছবিতে দেখেছে, সেই ইংল্যান্ডে নিজে কখনও আসবে বিশ্বাসই হয়নি। অলৌকিক ঘটনার দিন ফুলিয়ে যায়নি। আর বৃত্তি নিয়ে মাসভর বড্ড পীড়াদায়ক সিদ্ধান্তহীনতা, পাসপোর্ট, ভিসা, বিদেশী মুদ্রা, আয়কর ছাড়পত্র ও হেলথ সার্টিফিকেট সবার ঝামেলা চুকিয়ে সে সত্যিই লন্ডন যাচ্ছে।
এয়ার হোস্টেস বিনীতভাবে স্মরণ করিয়ে দিল, ‘আপনার সিটবেল্ট ম্যাডাম।’ কোমর ঘিরে সিটবেল্ট লাগাতে গিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘হ্যাঁ, তাই তো, দুঃখিত।’ ইংল্যান্ডে থাকাটা আনন্দদায়ক হবে কি-না ভাবছিল। যতটুকু পড়েছে, যা শুনেছে এ এক সুন্দর দেশ। তবে মানুষের ব্যাপারে তার সন্দেহ ছিল। তাদের হাতে তার পরিবার অনেক ভুগেছে। অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় তার বাবা ও ভাইয়েরা জেলে গিয়েছে, জেলখানায় তাদের পেটানো হয়েছে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষের ছাত্রী সে তখন নিজেও সাত দিনের ডিটেনশন খেটেছে। কোনো ইংরেজের সঙ্গে দেখা হওয়া বলতে যা বোঝায় ম্যাজিস্ট্রেট রবার্ট স্মিথ ছাড়া আর কারও সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি।
এ এক দুর্বোধ্য ঘটনা।
ঘটনাটি ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সময়কার। কলেজছাত্রীদের দলের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সেও দেশাত্মবোধক গান গেয়েছে, কোনো বিদেশীকে দেখামাত্রই চেঁচিয়ে ‘ভারত ছাড়’ স্লোগান দিয়েছে। পুলিশ তাদের পাকড়াও করে এবং তাদের দ্রুত বিচারের জন্য সোপর্দ করার প্রস্তুতি নেয়া হয়। সে ছাড়া মেয়েদের আর সবাই দোষ স্বীকার করে এবং তাদের সতর্ক করে ছেড়ে দেয়া হয়। তাকে থানা হাজতে নেয়া হয়। পরদিন তাকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রবার্ট স্মিথ, আইসিএস এর এজলাসে হাজির করানো হয়।
দৃশ্যটি কামিনী বেশ ভালোই স্মরণ করতে পারছে। বর্ষাকাল তখন প্রবল দাপট দেখাচ্ছে। খাম, কাগজ আর কালির ভ্যাপসা গন্ধ আদালতে ছড়িয়ে আছে। ম্যাজিস্ট্রেটের টেবিলে আলোর বৃত্তাকার ছায়া, আর একটি আলো একদিকে হলদে কাগজের ফাইলের স্তূপের পাশে বসা পেশকারের টেবিলে- এ ছাড়া আর সব অন্ধকার। ম্যাজিস্ট্রেট হালকা লাল চুলের এক যুবক। পরনে ছোট-হাতা শার্ট, আর ঢিলে টাইয়ের গিঁটটা বুকের মাঝামাঝি টেনে নামানো। বিশ্ববিদ্যালয়, নৌকাবাইচ আর রাগবি ম্যাচের একটি আভা তখনও তাকে ঘিরে আছে। তিনি তখন একটি বইয়ে ডুবে আছেন। যাদের বিচার হচ্ছে তাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না।
পেশকার কামিনীর নাম, তার বাবার নাম এবং তার অপরাধের ধরন পড়ে শোনায়।
হিন্দুস্তানি ভাষায় পেশকার জিজ্ঞেস করে, ‘দোষী না নির্দোষ?’
‘নির্দোষ।’
তার দিকে না তাকিয়ে টেনে টেনে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ‘তার বয়স কত জিজ্ঞেস কর।’
দোভাষীর অনুবাদের অপেক্ষা না করে কামিনী নিজেই বলল, ‘সেভেনটিন-সতর। আর তাকে বলুন, ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে তার নিজ দেশের জন্য কাজ করুন!
ম্যাজিস্ট্রেট চোখ তুলে তাকান। ম্যাজিস্ট্রেটের স্ফাত-ধূসর চোখ কাক-কালো চুলঘেরা মুখমণ্ডল থেকে নেমে চুলের গোছা যেখানে পড়েছে সেই খোলা কাঁধ ও লম্বা গলা বেয়ে তার তারুণ্যভরা দেহ পরিক্রমণ করে আর চোখে এসে মিলিত হয়।
তিনি বিড়বিড় করে বলেন, ‘অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য মিল।’ তার চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে তিনি পেশকারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী যেন তার নাম।’
‘কামিনী... কামিনী গার্ভে।’
‘মিস গার্ভে, তোমার স্কুলে কি কোনো কবিতা পড়ায়?’
‘হ্যাঁ... না’ কামিনী তোতলায়। তারপর আক্রমণাÍক কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘এর সাথে এই মামলার কি সম্পর্ক? ওরা কি আদালতে বসে উপন্যাস পড়ার জন্য আপনাকে বেতন দেয়?’
‘উপন্যাস নয়, ইয়ং লেডি, কবিতা। জেলখানায় পড়ার জন্য বইটা তোমাকে ধার দেব। দণ্ড ৭ দিন, এ ক্লাস। তারপরও যদি রূঢ় আচরণ করতে থাকো তাহলে আদালত অবমাননার দায়ে আরও সাত দিন বেশি খাটতে হবে।’
পরদিন কামিনী চমৎকার বাঁধাই হিলারি বেলকের সংগৃহীত কবিতার একটি খণ্ড হাতে পেল। তাতে লিখা : জেলখানায় সুখকর পাঠ। যে মানুষটি তোমাকে এখানে পাটিয়েছে তার শুভেচ্ছাসহ।
এক চিলতে কাগজে পৃষ্ঠা চিহ্নিত করা, সেখানে একটি কবিতার দুটি পঙ্ক্তি, নিচে লাল কালিতে দাগানো। পাশে কামিনীর নামের দুটি আদ্যক্ষর ‘কে জি’। সেই লাইন দুটি :
তার মুখ যেন রাজার আদেশ
কখন একসাথে সব তরবারি বেরিয়ে আসে।
কামিনী ঠিক করল স্মিথের এ আচরণের কথা সংবাদপত্রগুলোকে জানাবে। সে নিশ্চিত, এতে তার চাকরি যাবে। কিন্তু সাত দিন পেরোবার আগে তার নিজের সম্পর্কে নিশ্চয়তাই কমে গেল। যখন বাড়ি ফিরে এলো, শুনল স্মিথ পদত্যাগ করেছেন। ক’দিন পর তিনি ইংল্যান্ড ফিরে গেলেন।
কবিতার পঙ্ক্তি দুটির মানে যে খুব বুঝতে পেরেছে তা নয়, তবে এতে যে তার চেহারার প্রশংসা করা হয়েছে এটা ঠিক। আর এ প্রথম কেউ একজন এমন প্রশংসা করল। এরপর যতবারই সে আয়নার দিকে তাকিয়েছে, ততবারই শব্দগুলো তার কাছে ফিরে এসেছে : তার মধ্যে এমন একটা অনুভূতি কাজ করেছে যেন স্মিথ তার দিকে তাকিয়ে আছেন, যা তার উদীয়মান দায়িত্ব সম্পর্কে বিব্রতকর সচেতনতার সৃষ্টি করছে। এ ঘটনাটি ইংরেজদের সম্পর্কে তার মনোভাবের পরিবর্তন ঘটায়নি, তবে তাদের যে লাজুক মনে করা হতো, এ বিশ্বাস তার আর রইল না।
বায়ুস্তরে উড়োজাহাজের লাগাতার ঝাঁকুনিতে কামিনী তার দিবাস্বপ্ন থেকে ছিটকে পড়ল। মেঘের স্তর কেটে বহু লাল ছাদের বাড়ি আর টারমাকের কাটাকাটি করে যাওয়া রাস্তা এবং গুবরে পোকার মতো হামাগুঁড়ি দিয়ে চলা সারি সারি গাড়ির উপর দিয়ে উড়োজাহাজ নেমে আসছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে রানওয়ে স্পর্শ করল এবং চাকার ওপর ভর করে শুল্ক বিভাগের শেডের কাছে গিয়ে থামল।
জাহাজের জানালার পাশে বসে দীর্ঘ সময় ধরে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ড দেখল। শরতের উষ্ণ অপরাহ্নে তার হোটেলের উল্টোদিকের পার্কভর্তি মানুষ লালচে সূর্যালোকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আগে যত সবুজ দেখেছে তার চেয়েও সবুজ পার্কের ঘাস আর বেষ্টনী ধরে বহু বিচিত্র গ্ল্যাডিওলাস ফুল ফুটে আছে। পার্কের প্রবেশপথে এক বুড়ো ভিখারি তার ব্যারেল অর্গানে বহুদিন আগে ভুলে যাওয়া মধুর সুর তুলছে। জায়গাটা শান্তিপূর্ণ ও বান্ধব মনে হল। কামিনী নিজেই বাইরে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে এলো।
কামিনীর খানিকটা আশংকা ছিল শাড়ি পরার কারণে লোকজন তার দিকে তাকিয়ে থাকবে, কিন্তু কেউ সেদিকে কোনো নজরই দিল না। তার চোখে পড়ল ছোট ছেলেমেয়েরা পার্কের পুকুরে নৌকা চালাচ্ছে, মহিলারা হাঁসকে খাওয়াচ্ছে আর ছেলেরা দর্শকদের বৃত্তের মাঝখানে শব্দকরা খেলনা উড়োজাহাজ চালাচ্ছে। তার চোখে পড়ল বেশকিছু জোড় তাদের চারপাশের পৃথিবীকে বেমালুম ভুলে গিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঘাসের ওপর জায়গা করে নিয়েছে।
সে নিজেও পার্কে স্বঘোষিত বক্তাদের ঘিরে রাখা জনতার সঙ্গে যোগ দিয়ে তাদের বক্তৃতা আর তাদের উত্ত্যক্ত করা শ্রোতাদের প্রশ্নবান শুনল।
যখন সে হোটেলে ফেরার জন্য পা বাড়ায় নৈঃসঙ্গের অনুুভূতি তাকে পেয়ে বসে। সে বুঝতে পারল তার জীবনে এ প্রথম একটি অপরাহœ কাটল যেদিন কেউ তার সঙ্গে কথা বলেনি। সে ছাড়া আর সবারই কথা বলার মতো কেউ না কেউ আছে। নিজেকেই সে প্রশ্ন করল, এই নির্বান্ধব দেশে সে কেন আসতে গেল?
পরের দিনগুলোতে কামিনী তার প্রশ্নের কোনো জবাব পায়নি। তার জীবন দ্রুত একটি ছকে বৃত্তাবদ্ধ রুটিনে বাঁধা হয়ে গেল- এক বা আধ পেনি ভাড়ায় বাসে আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে যাওয়া, জনাকীর্ণ ট্রেনে স্ট্যাপ ধরে আধঘণ্টা ঝুলে থাকা, আবার বাস ধরা, লেকচার শোনা, ক্যাফেটেরিয়াতে মধ্যাহ্নভোজ, আরও লেকচার, আবারও বাস ধরা, স্ট্যাপ ধরে ঝুলে বাড়ি ফেরা- অবশ্য হোটেলকে যদি বাড়ি বলা যায়- যেখানে মামুলি শুভেচ্ছা বিনিময় ছাড়া কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। সেখানে প্রয়োজনীয় কথোপকথন ফিসফিস করে সেরে নিতে হয়। যেখানে সংবাদপত্রের পাতা উল্টানোর শব্দ চারদিকে ছড়ানো শেষকৃত্যের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দেয়, সেখানে।
ভারত ছেড়ে আসার পর কামিনী মনের ভেতর একটি অস্পষ্ট প্রত্যাশা লালন করেছে যে একদিন রবার্ট স্মিথের সঙ্গে তার দেখা হয়েও যেতে পারে। সে জানে এই প্রত্যাশা হাস্যকর। কারণ সে জানে তিনি আফ্রিকা কিংবা আমেরিকাতেও থাকতে পারেন। এমনকি তিনি যদি ইংল্যান্ডে থেকেও থাকেন লন্ডনের ঘূর্ণায়মান আশি লাখ মানুষের মাঝে অকস্মাৎ ঘটনাচক্রে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা মোটেও উজ্জ্বল নয়। আর যদি তার সঙ্গে দেখাই হয় তিনি কি তাকে চিনতে পারবেন? সে তাকে কি বলবে? কিংবা তিনি তাকে কি বলবেন? সে টেলিফোন বইতে তার নাম খুঁজতে চেষ্টা করে। কিন্তু ডিরেক্টরিতে পাতার পর পাতা স্মিথ নামে ভর্তি দেখে সে নিরাশ হয়ে পড়ে। আর আদ্যক্ষরের বহু নাম। আর যদি সে তাকে ফোনে পেয়েই যায় সে জানে না কোন অজুহাতে তাকে ফোন করবে।
তা সত্ত্বেও চিন্তাটা তার মাথায় রয়েই গেল এবং তা বাতিলে পরিণত হল। সে বিশ্বাস করতে শুরু করল সে যদি ইচ্ছে করে, যে কোনো ভাবে যে কোনো স্থানে তার সঙ্গে দেখা হয়েই যাবে। সে বইয়ে পড়েছে মানুষ যদি একই বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয় তাহলে তাদের পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসাটাই স্বাভাবিক। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে এরপর কি ঘটবে সবটাই তার মনের মধ্যে সাজানো। তিনি হ্যাট তুলে জিজ্ঞেস করবেন, ‘মিস গার্ভে, আমার মনে হয় না আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
‘আমি যদি ভুল না করে থাকি আপনি মিস্টার স্মিথ। হ্যাঁ, অবশ্যই, আগে আমাদের নিশ্চয়ই দেখা হয়েছে। তবে সেটাকে দেখা পেয়ে আনন্দিত হওয়া বলা যায় কি-না আমার সন্দেহ আছে। তা কেমন আছেন মিস্টার স্মিথ?’ তারপর এক আলাপ নিয়ে যাবে অন্যটাতে।
তার পলিটেকনিক টার্ম প্রায় শেষ হয়ে আসছে। তার ইচ্ছেশক্তি কিংবা কোনো ঘটনাচক্র কামিনী ও রবার্ট স্মিথকে মুখোমুখি করাতে পারেনি। অন্য যে কোনো দিনের মতোই একদিন সে টিউব স্টেশনে যাওয়ার বাস ধরল। আবার আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বেরিয়ে অন্য প্রান্তে যখন পরের বাস ধরতে এলো, দেখল রাস্তা লোকারণ্য, গাড়ি সরিয়ে দেয়া হয়েছে। দূর থেকে তার কানে এলো ব্যাগপাইপের সুর আর বড় ড্রাম বাজানোর শব্দ। সে নিজের হাতের খবরের কাগজটিতে চোখ ফেলল, দেখল সফররত কোনো রাজাবাদশাহকে এ সময় রানীর এ পথ অতিক্রম করার কথা। সে ঠিক করল ক্লাস বাদ দেবে, তারপর জনতার সঙ্গে যোগ দিল।
দলপতি তার নির্দেশের দণ্ড উঁচু-নিচু করছে, পেছনে বাজিয়ে যাচ্ছে স্কটিশ কামিনীর বাদকদল। তাদের পেছনে ধীর গতিতে রাজকীয় চালে আসছে গার্ভের দল। তাদের উঁচু পশমি টুপি, জ্বলজ্বলে পিতলের বোতাম লাগানো টকটকে লাল কোট, বেয়নেটসহ রাইফেল সবই বর্শার অরণ্যের মতো দ্যুতি ছড়িয়ে তার মধ্যে একটি উত্তেজনার সঞ্চার করছে। গার্ভ সদস্যরা তার সামনে এসে বিরতি দিয়ে রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু পরই এলো অশ্বারোহী সৈন্যদল আর তাদের একডজন কালো ঘোড়ায় টানা রানীর সোনালি কোচ। গার্ডসদস্যরা সোজা হয়ে আনত হল। রানী এবং তার রাজকীয় অতিথি ব্যান্ডের সঙ্গে যোগ দিয়ে উঁচু গলায় সুর মেলানো জনতার দিকে হাত নেড়ে চলে গেলেন।
ব্যান্ড মিছিল চলে যেতেই জনতার শৃঙ্খল ভেঙে পড়ল। অফিসের পথে ছুটে যাওয়া মানুষের ধাক্কার পর কামিনী মোহগ্রস্তের মতো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। দেখল, কেবল তার সামনের মহিলাটিই যেমন ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে। কামিনী তার ফোঁপানোর শব্দ শুনল, যখন ঘুরে দাঁড়াল দেখল হাতের ঠিক উল্টো পিঠ দিয়ে তিনি চোখ মুছছেন। হাতব্যাগের ভেতর থেকে রুমাল বের করার জন্য সবকিছু তছনছ করে ফেলছেন। কামিনী যে তাকে দেখছে এটা নজরে আসার পর তিনি বিব্রতবোধ করলেন। তিনি বললেন, সৈন্যবাহিনী আর শোভাযাত্রার কথা উঠলে আমি যে কী রকম বোকামি শুরু করে দিই। এরা সবসময় আমাকে কাঁদিয়ে ছাড়ে।’
কামিনী বলল, ‘এটা খুব আবেগময় একটা ব্যাপার! আর দেখতে কী চমৎকার! একসঙ্গে এত বেশি সৈন্য খুব সুন্দর দেখায়, তাই না?’
তিনি বললেন, ‘তোমার কথা অদ্ভুত শোনাচ্ছে। আমার বন্ধু সবসময় বলত, একজন সুন্দরী মহিলাকে দেখায় খোলা তরবারি হাতে সহস্র সৈন্যের মতো। আসলে আমার বন্ধু সবসময় এই কথাটা আমাকেই বলত। সে ভারতেও গিয়েছিল, ভারতকে পছন্দও করত। তিনি তার রুমাল খুঁজে পেলেন এবং তা দু’চোখে চেপে ধরলেন। কামিনী অনুভব করল তার পাজোড়া ভারী হয়ে এসেছে।
সে জানে একজন আগন্তুককে এ ধরনের প্রশ্ন করার অধিকার তার নেই, কিন্তু কোনো একটা কিছু জোর করে তাকে দিয়ে প্রশ্ন করানো, ‘আপনার বয়ফ্রেন্ড এখন কোথায়?’
তিনি অশ্র“ভেজা মুখ ফেরালেন।
বললেন, যুদ্ধে নিহত হয়েছে, ডি-ডেতে।
(উ-উধু : দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিজয়ের দিন।)
‘যবন’
মানে গ্রিস জাতি। অভিধানে যবনের অর্থ নির্ধারিত হয়ে আছে দীর্ঘকাল থেকে।
যবন যদি গ্রিস জাতির নাম হয়, তাহলেও তো অন্য কোনো জাতিকে সে নামে ডাকার
অবকাশ নেই। যদি ডাকা হয় তাহলে তাতে হীনম্মন্যতারই কেবল পরিচয় বহন করে।
রামপ্রসাদ রায় রচিত ‘সঙ্গীত জিজ্ঞাসা’ সঙ্গীত-গ্রন্থখানা পড়ে এ ধরনের একটা
বিভ্রান্তিকর তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। গ্রিস জাতিকে মুসলিম জাতিতে পরিণত
করে প্রতিষ্ঠিত সত্যকে যেন তিনি অস্বীকার করতে চেয়েছেন। ‘হিন্দুস্তানি
রাগসঙ্গীতে যবন-সংস্কৃতির প্রভাব’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘এককালে যবন বলিতে
একমাত্র গ্রিকদিগকেই বুঝাইত। সঙ্গীতে যবন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যবন শব্দটি
সংকীর্ণ অর্থে প্রধানত মুসলমান সম্প্রদায়কেই বুঝায়।’ এটাকে অনায়াসে সত্যের
অপলাপ বলে আখ্যায়িত করা যায়। কেননা, মুসলমানদের আগমন ভারতবর্ষে না ঘটলে
রাগসঙ্গীতের আবির্ভাবই ঘটত না। যে জাতি রাগসঙ্গীত সৃষ্টি করে সমগ্র
ভারতবর্ষের সঙ্গীতকে আকণ্ঠ সমৃদ্ধ করেছে তাদের সংকীর্ণ অভিধায় অভিহিত করার
কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে, তা কিছুতেই স্বীকার করা যায় না। এ কথা
অবশ্য সত্য, ভারতবর্ষের সঙ্গীতে মিসর, গ্রিস, আরব, পারস্য প্রভৃতি দেশের
প্রভাব রয়েছে। কিন্তু এটা সম্ভব হয়েছে আমীর খসরুর রাগসঙ্গীত সৃষ্টির পর,
তার আগে নয়। রামপ্রসাদ রায় সে কথা নিজেই স্বীকার করে লিখেছেন, “... যেসব
ব্যক্তির অবদান ভারতীয় সঙ্গীতের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করিয়াছে তাহাদের মধ্যে
সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য নাম হইল অসামান্য শ্র“তিধর, সঙ্গীত স্রষ্টা আমীর
খসরু। তিন প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় সঙ্গীতের সহিত পারস্য দেশীয় সঙ্গীতের
সুসামঞ্জস্য সংমিশ্রণ করে ভারতীয় সঙ্গীত ধারাকে মাধুর্যমণ্ডিত করিবার কাজে
পথপ্রদর্শক। বর্তমানের হিন্দুস্তানি সঙ্গীতপদ্ধতি আমীর খসরুর নিকট সীমাহীন
ঋণে আবদ্ধ। ভারতীয় ধ্র“পদ গানের সহিত পারস্য দেশের গজল গানের সংমিশ্রণ
ঘটাইয়া ‘খেয়াল’ গান প্রবর্তনের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তাহারই।”
খেয়াল
গান ও খেয়াল গানের প্রকৃত রূপকারের কথা বলতে গিয়েই অত কথার অবতারণা। তার
আগে খেয়াল গানের কিছু কথা। ফার্সি ভাষায় ‘খেয়াল’ অর্থ ‘কল্পনা’। নানাবিধ
তান-বিস্তার ইত্যাদির দ্বারা বিভিন্ন তালে রাগ গানকে বলা হয় খেয়াল। বলা যায়
সুরের ‘বিহার’ খেয়াল গানের মূল বৈশিষ্ট্য। খেয়াল গানের বিষয়বস্তু প্রধানত
শৃঙ্গার রসাত্মক, তবে সঙ্গীতের শিল্প-সৌন্দর্যের মাধ্যমে এর প্রকাশ। আমীর
খসরু খেয়ালের আবিষ্কর্তা। তবে তিনি সৃষ্টি করেন ‘ছোট খেয়াল’ (Slow kheyal)।
এ প্রকার খেয়ালের গতি চপল। রচনা খুব সংক্ষিপ্ত। স্থায়ী ও অন্তরাতে এ গান
সীমাবদ্ধ। স্থায়ী ও অন্তরা দুটিই দু’চরণে রচিত হয়। পরবর্তীকালে জৌনপুরের
সুলতান হুসেন শাহ্ শর্কী আরেক ধরনের খেয়াল প্রচলন করেন, যার নাম ‘বড় খেয়াল’
(ঝষড়ি শযবুধষ)। এ ধরনের খেয়ালের গতি বিলম্বিত। চাল গম্ভীর। মন্থরগতিতে এর
বিস্তার। এ গানের রচনাপদ্ধতি ছোট খেয়ালের মতোই। স্থায়ী ও অন্তরার মাধ্যমেই এ
খেয়াল পরিবেশিত হয়। অষ্টাদশ শতকে মোগল-সম্রাট মুহম্মদ শাহ্র আমলে বিখ্যাত
সঙ্গীতজ্ঞ নিয়ামত খাঁ এ খেয়াল গান নবরূপে সমৃদ্ধ করেন। ফলে খেয়ালের
জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। তিনি খেয়ালে বিভিন্ন ধরনের বিস্তার, বোলতান ইত্যাদি
সংযোজন করে নতুনরূপে খেয়ালের গান করতেন।খেয়াল
গানকে প্রচলিত করার নেপথ্য কাহিনী হিসেবে প্রচলিত আছে যে, নিয়ামত খাঁ
ছিলেন মূলত বীণাবাদক। তিনি মোগল সম্রাট মুহাম্মদ শাহর দরবারে নিয়োজিত
ছিলেন। তিনি মোগল দরবারের প্রথামাফিক গায়কদের সঙ্গে অনুসঙ্গ যন্ত্রী হিসেবে
বীণা বাজাতেন। শিল্পী হিসেবে এ কাজটা তার মনঃপূত ছিল না। তিনি এ অবস্থা
থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে সঙ্গীতের গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত
নেন এবং রাজদরবার থেকে ছুটি নিয়ে ‘খেয়াল’ গানের সাধনায় একনিষ্ঠভাবে নিজেকে
নিয়োজিত করেন। তিনি দুটি কাওয়াল বালককে তার গবেষণালব্ধ খেয়াল গানে পারদর্শী
করে তোলেন। বালকদ্বয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খেয়াল পরিবেশন করে বিশেষ সুনাম
অর্জন করে।তাদের সুখ্যাতির কথা
অচিরেই মোগল দরবারে পৌঁছে। মোগল সম্রাট বালক-শিল্পীদ্বয়কে দরবারে খেয়াল
পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। নতুন পদ্ধতিতে পরিবেশিত খেয়াল গান শুনে
সম্রাট অভিভূত হয়ে পড়েন এবং বালক দু’জনকে রাজদরবারে নিয়োগ করেন। অনতিকালের
মধ্যেই তিনি জানতে পারলেন, বালক দুটির গুরু নিয়ামত খাঁ। তার কাছে তালিম
নিয়েই বালকদ্বয় সুখ্যাতি অর্জন করেছে। নিয়ামত খাঁ নতুন পদ্ধতির এ খেয়াল
গানের উদ্ভাবক। তিনি নিয়ামত খাঁকে আমন্ত্রণ করে এনে রাজদরবারে সঙ্গীতজ্ঞ
হিসেবে নিয়োগ গদান করেন। নিয়ামত খাঁ সম্রাটের আহ্বানে রাজদরবারে যোগ দেন।
সঙ্গীত-প্রেমিক সম্রাট নেয়ামত খাঁর নতুন রীতির খেয়াল গান শুনে এত মুগ্ধ হন
যে, তাকে ‘শাহ’ উপাদিতে ভূষিত করেন। বিশিষ্ট সঙ্গীত শাস্ত্রকার ও গোস্বামী
লিখেছেন, তানসেন ও মিশ্রী সিং (নবাৎ খাঁ) ছাড়া এর আগে আরও কোনো সঙ্গীতজ্ঞ এ
দুর্লভ উপাধিতে ভূষিত হননি।নিয়ামত
খাঁর শিষ্য কাওয়াল বালকের দু’জনের পরিচয় সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। ড. করুণাময়
গোস্বামী লিখেছেন, পূর্বে প্রচলিত মত এই যে, কাওয়াল বালকদ্বয় গোলাম রসুল ও
মিঞা জানী। গোলাম রসুল (১৭০০-১৭৭০) ছিলেন দিকপাল খেয়ালগুণী। লখনৌয়ে তিনি
প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। ... গোলাম রসুলের পুত্র টপ্পা গানের প্রচলয়িতা
গোলাম নবী ওরফে শৌরী মিঞা। ... অপর কাওয়াল বালক বলে কথিত মিঞা জানীও গোলাম
রসুলের সমকালে লখনৌয়ে বিখ্যাত খেয়ালগুণীরূপে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু
কাওয়াল বালকদ্বয় যে গোলাম রসুল ও মিঞা জানী নন এ কথাই বর্তমানে অধিকতর
গৃহীত। সেই বালকদের শনাক্ত করা হয় বাহাদুর ও দুলহে বলে। অষ্টাদশ শতকের
মধ্যভাগে বাহাদুর-দুলহে বিশিষ্ট খেয়াল গায়করূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং
তারা একটি খেয়াল গীতিধারা সৃষ্টিতে সক্ষম হন বলে জানা যায়।খেয়াল গানের
আধুনিক রূপায়ণের মধ্য দিয়েই শুরু হয় নিয়ামত খাঁর সঙ্গীত জীবনের শ্রেষ্ঠতম
অধ্যায়।নিয়ামত
খাঁ ছিলেন তানসেনের কন্যাবংশীয় একজন সুবিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ। খেয়াল গানের
অসামান্য রূপান্তরের কৃতিত্বের জন্য মোগল-সম্রাট মুহাম্মদ শাহ্ তাকে
‘সদারঙ্গ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। বীণাবাদ পরিবারে জন্মগ্রহণ করার ফলে তিনি
বীণাবাদনে পারদর্শিতা অর্জন করেন। পরে তিনি খেয়াল গানের আমূল পরিবর্তন সাধন
করে খেয়াল গানের আধুনিক রূপকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।খেয়াল
গানের সঙ্গে নিয়ামত খাঁ সদারঙ্গের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সদারঙ্গের খেয়াল
আজও সদারঙ্গের খেয়াল নামেই পরিচিত। খেয়াল এখনও নতুনত্ব-সন্ধানী সঙ্গীতরীতি,
শুধু ক্লাসিক বা পুরাতনরীতি সর্বস্ব নয়।সদারঙ্গ
মোগল-সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে আনুমানিক ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ
করেন। তার জন্ম-সময়ের তথ্য তার রচিত একটি গানে পাওয়া যায় :আবন কহ গয়ে অগম
ভঈলওয়াউনকো, ভুজ ফরকত হৈ অঁখি মোরীবাঈ।সগুন বিচারো রেখোরে বখনাবেগ মিলনবা
হোয় সদারঙ্গীলে ‘আলমগীর’ সাঈ॥নিয়ামত
খাঁ বা ন্যামৎ খাঁর পিতার নাম লাল খাঁ সানী। তার পিতামহের নাম খুশহাল খাঁ।
খুশহাল খাঁ বিলাস খাঁর জামাতা। বংশপরম্পরায় তারা সঙ্গীতজ্ঞ। সদারঙ্গ
দিল্লির মোগল সম্রাট মুহম্মদ শাহ্র রাজত্বকাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। সদারঙ্গ
ছিলেন একজন কুশলী বীণকার, গায়ক ও গীতিকার। তিনি একদিকে যেমন অজস্র খেয়াল
রচনা করেছেন, তেমনি আবার বহু ধ্র“পদ ও ধামারও রচনা করেছেন। সদারঙ্গ রচিত
ধ্র“পদ, ধামার ও খেয়ালগুলো কাব্যের দিক দিয়ে খুবই রসোত্তীর্ণ ছিল। তার রচিত
গানের মধ্যে ধামার ও খেয়াল গানের আধিক্যই বেশি। তিনি সরগম ও তেলানা দিয়েও
ধ্র“পদাঙ্গের গান রচনা করেছেন। তবে খেয়াল গানের আধুনিক রচয়িতা ও প্রবর্তক
হিসেবেই তিনি সমধিক প্রসিদ্ধ। তার রচিত খেয়াল সম্পর্কে বলা চলে, ‘বিলাস
স্রোতে ভাসমান বাদশাহ্রা যখন চটুলতার সঙ্গে মিশ্রিত করে এমন এক অপরূপ বস্তু
সৃষ্টি করলেন, যা তরলতাকে দ্রবীভূত করে অন্তত ক্ষণিকের জন্যও জীবন
সম্বন্ধে একটা মূল্যবোধ এনে দিতে সমর্থ হয়েছিল। সেই অপরূপ বস্তু হল
কলাবন্তী খেয়াল।বাদশাহ্ মুহম্মদ
শাহ্র দরবারে নিয়ামত খাঁ নামে তিনি রবাবী ও বীণকার ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি
‘সদারঙ্গ’ নামে খেয়াল রচনা করেন। মাঝখানে তিনি দরবার ছেড়ে চলে যান এবং
খেয়াল গানে পারদর্শিতা লাভ করেন। দু’জন কাওয়াল বালককে তালিম দিয়ে খেয়াল
গানে নতুনত্ব এনে জনপ্রিয় করেন এবং সম্রাট মুহম্মদ শাহ্কে খেয়াল গানে মুগ্ধ
করে আবার রাজদরবারে ফিরে আসেন। সম্রাট তাকে ‘শাহ সদারঙ্গ’ সম্মানে ভূষিত
করেন। সদারঙ্গের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার ফলেই কণ্ঠসঙ্গীতে খেয়ালের স্থান
সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।সদারঙ্গ খেয়াল গানে
যুগান্তর এনে দিয়েছিলেন। তিনি খেয়াল গানের স্থায়ী ও অন্তরার মধ্যে প্রতি
গানে এক একটি বিশেষ ভাবকে কেন্দ্র করেছেন। ফলে সে গান হয়ে উঠেছে মোহনীয়।
সহজ মানবিক-প্রেম, নায়ক-নায়িকার ভাব অবলম্বন করেই তিনি গান রচনা করেছেন।
তিনি গানে এনেছেন সংক্ষিপ্ত ও সহজ ঋতু বর্ণনা, মানসিক গুণবর্ণনা, কোথাও
একটুখানি জীবনচিত্র, আবার কোথাও ভক্তি ভাব। বাণী গানের সুরকে কোথাও
ভারাক্রান্ত করেনি। সদারঙ্গ খেয়ালকে শুধু বিশিষ্ট রূপদানই করেননি, এমন একটি
ভাষা ও কার্যকরী রীতি সৃষ্টি করেছেন যার দরুন আজও অভিজাত খেয়াল-সদারঙ্গী
খেয়াল এ দুই দিক থেকে বিশিষ্ট। সদারঙ্গের খেয়ালে ভাষা খেয়াল-আঙ্গিকের
বিশিষ্ট ফর্মরূপে ব্যবহৃত। পরবর্তী খেয়াল রচয়িতারা এ বিশিষ্ট ফর্মেই গান
রচনা করেছেন। তিনি ব্রজভাষা, লখনৌর ভাষা ও পাঞ্জাবি ভাষাতে দক্ষ ছিলেন বলে
তার কবিতায় এ ভাষা ইচ্ছামতেি ব্যবহার করতে তার কিছুমাত্র অসুবিধা হতো
না।হিন্দুস্তানি
সঙ্গীতে যেসব দিকপাল, সঙ্গীতজ্ঞ নিজের উদ্ভাবিত রীতিপদ্ধতি সংযোজন ঘটিয়ে
সঙ্গীতের উৎকর্ষ সাধন করে গেছেন তাদের মধ্যে নিয়ামত খাঁ সদারঙ্গ অন্যতম।
খেয়াল রীতির গান উদ্ভাবন করেও কয়েক শতাব্দী আগে আমীর খসরু ও হুসেন শাহ্
শর্কী যে কাজ অসমাপ্ত রেখে গিয়েছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রূপদান করে সদারঙ্গ তাকে
যুগ-যুগান্তরের অমূল্য সম্পদে পরিণত করে দিয়ে গেছেন। খেয়াল গানের বিকাশের
ক্ষেত্রে নিয়ামত খাঁ সদারঙ্গের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ
থাকবে।সদারঙ্গ
রচিত খেয়াল গানে সম্রাট মুহম্মদ শাহ্র নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার কারণ
হয়তো, তিনি মুহম্মদ শাহ্র দরবারের সঙ্গীতজ্ঞ এবং বাদশাহ্র প্রিয়পাত্র হওয়ার
নিদর্শনস্বরূপ তার রচনায় মুহম্মদ শাহ্র নাম উল্লেখ করেছেন। নিয়ামত খাঁ তার
রচিত গানে ভণিতা হিসেবে ‘সদারঙ্গীলে’ ব্যবহার করতেন।সদারঙ্গ
ধ্র“পদ, ধামার ও খেয়াল গান রচনা ছাড়াও বীণাবাদ্যের প্রভূত উন্নতি সাধন
করেছিলেন এবং এতে কণ্ঠসঙ্গীতের অনুরূপ আলাপচারীর প্রবর্তন
করেছিলেন।সদারঙ্গের
বহুমুখী অবদান সঙ্গীত ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। সর্বোপরি খেয়ালের
আধুনিক গীত রূপের উদ্ভাবন ও তার প্রতিষ্ঠার মাঝেই সদারঙ্গের সর্বোচ্চ
সঙ্গীতগৌরব নিহিত। - See more at:
http://www.jugantor.com/literature-magazine/2014/02/28/73229#sthash.y2Shbdcy.dpuf
<a
href='http://platinum.ritsads.com/ads/server/adserve/www/delivery/ck.php?n=acd94d5f'
target='_blank'><img
src='http://platinum.ritsads.com/ads/server/adserve/www/delivery/avw.php?zoneid=780&amp;n=acd94d5f'
border='0' alt='' /></a>
No comments