মানবিক ব্যাংকিং সোনার পাথরবাটি? by ফারুক মঈনউদ্দীন

অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবা কিংবা ইনক্লুসিভ ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের পাশাপাশি মানবিক ব্যাংকিং সেবার একটা ধারণা সম্প্রতি আলোচনায় চলে আসছে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় গতানুগতিক ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে মানবিক কথাটা হয়তো খাপছাড়া শোনাতে পারে, এ যেন সোনার পাথরবাটি। সে জন্যই বোধ হয় আমেরিকান ঔপন্যাসিক মার্ক টোয়েন কৌতুক করে মন্তব্য করেছিলেন, ব্যাংকার হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি আকাশে সূর্য থাকলে ছাতাটি ধার দেন, কিন্তু বৃষ্টি শুরু হওয়ামাত্র সেই ছাতা ফেরত চান।
এখানে একটা কথা বলে রাখা উচিত, এটি মার্ক টোয়েনের উদ্ধৃতি কি না সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। আমেরিকায় এ-জাতীয় কৌতুকপূর্ণ অনেক মন্তব্য মার্ক টোয়েনের নামে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তবে মন্তব্য যাঁরই হোক, কথাটির ভেতর আমাদের প্রথাগত ব্যাংকিংয়ের চরিত্র ফুটে ওঠে। প্রথাগত ব্যাংকিংয়ে যেমন কেবল জামানত প্রদানে সক্ষম ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হয়, তেমনি কোনো গ্রহীতার ব্যবসা খারাপ হলে বা কোনো বিপর্যয় ঘটলে সেখান থেকে যথাশিগগির সম্ভব বিনিয়োগ তুলে নিয়ে ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার কৌশলও গ্রহণ করা হয়, এসব প্রবণতাও মানবিক ব্যাংকিংয়ের দর্শনের পরিপন্থী।
কিন্তু যেকোনো সেবা কিংবা উদ্যোগ যদি মানুষ কিংবা সমাজের কল্যাণার্থে পরিচালিত হয়, তাহলে তার সঙ্গে মানবিক কথাটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যায়। সে হিসেবে ব্যাংকিং যদি ব্যবসার পাশাপাশি সমাজ ও অর্থনীতির কল্যাণ নিশ্চিত করে, তাহলে তাকে মানবিক ব্যাংকিং বলাটা সংগত কারণেই অসংগত হবে না। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে যেহেতু মুনাফাকে কেন্দ্র করেই সব উৎপাদন-প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়, সেখানে মানবিক বিবেচনাটি গৌণ হয়ে পড়ে, ফলে কার্ল মার্ক্সের বর্ণিত সত্যিকার পুঁজিবাদের স্বরূপ হয়ে ওঠে দানবীয়। কিন্তু পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে মানবিক কিছু অনুপান যদি যুক্ত করা যায়, তাহলে এটিই হতে পারে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতা ও পতনের পর কিছুটা মন্দের ভালো।
আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট দখল আন্দোলনের কারণ যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে বুঝতে পারি যে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে পুঁজিপতি এবং বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থলোভ, সীমাহীন দুর্নীতি, সরকারি নীতিনির্ধারণে ধনবাদী পরিবার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যায় প্রভাব— এসবের বিরুদ্ধেই ছিল বিক্ষোভকারীদের মূল প্রতিবাদ। আমেরিকার সচেতন মানুষের এই প্রতিবাদ অন্যান্য দেশের মানুষের চোখ খুলে দিয়েছে যে কেবল মুনাফা হতে পারে না একটা অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।
অতিসম্প্রতি পত্রিকার এক রিপোর্টে দেখা যায়, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মোট ছয়টি এলাকার মধ্যে সীমিত হয়ে পড়েছে ব্যাংকের ব্যবসা। এই ছয়টি এলাকা হচ্ছে ঢাকার মতিঝিল, রমনা, গুলশান, ধানমন্ডি এবং চট্টগ্রামের কোতোয়ালি ও ডবলমুরিং। ২০১৩ সালের জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী, মোট আমানতের ৪৩ শতাংশ এবং মোট ঋণের ৬৩ শতাংশ কেন্দ্রীভূত রয়েছে এই ছয়টি এলাকায়। এই হিসাব থেকে ধারণা করা যায়, কেবল বড় এবং সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির মধ্যে ব্যাংকিং সেবা সীমাবদ্ধ থাকার একটা প্রবণতা গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে। পুঁজিবাদের প্রথম থেকেই আমরা দেখি ব্যাংকের ঋণ সৃষ্টির প্রথম অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করে যে অর্থ বা তহবিল, তার প্রধান উৎস হচ্ছে অনুৎপাদনশীল শ্রেণীর কাছ থেকে সংগৃহীত অলস অর্থ এবং পুঁজিপতিদের উৎপাদন ও বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট উদ্বৃত্ত। কেবল আমাদের দেশে নয়, সব দেশে এবং কালে ব্যাংকিং সেবার এই কেন্দ্রীভবন যে কেবল অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী তা নয়, দেশের সুষম উন্নয়নের পথে বাধা এবং সর্বোপরি সঠিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বহুমুখীকরণ বা ডাইভারসিফিকেশনের মূলনীতির বিরোধী।

আমরা আমাদের দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবা বা ব্যাংকিংয়ের মূল দর্শন বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি, যাতে সমাজের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে স্বল্প বা বিনা খরচে আর্থিক তথা ব্যাংকিং সেবার অন্তর্ভুক্ত করা যায়। নামমাত্র জমা দিয়ে কৃষক এবং গার্মেন্টস শ্রমিকদের অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা এই প্রয়াসের একটা উদাহরণ। কৃষি এবং দরিদ্রবান্ধব ব্যাংকিংয়ের কথা কেউ কেউ আগে কালেভদ্রে বলে থাকলেও তার সঠিক বাস্তবায়নের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কখনো নেওয়া হয়নি। অবশেষে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং সেবার মানবিক দর্শনগুলো ব্যাংকিং নীতিমালার আওতায় এনে সেসব বাস্তবায়নের একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমনকি যেসব সেবা ব্যাংকিং কার্যক্রমের আওতায় পড়ে না, সেসবের বাস্তবায়নও নিশ্চিত করা হয়েছে ক্রমবর্ধমান সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) অধীনে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে। এখানে উল্লেখ করা যায়, ২০১২ সালে কেবল আমাদের ব্যাংকগুলো ৩০৫ কোটি টাকা খরচ করেছে সিএসআর খাতে, যা ২০০৭ সালে ছিল মাত্র ২৩ কোটি টাকা।
মানবিক তথা অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংয়ের প্রধান পূর্বশর্ত হচ্ছে স্বল্প খরচে ব্যাংকিংসেবা নিশ্চিত করা। স্বল্প ব্যয়ে অনাড়ম্বর গ্রামীণ শাখা খোলার মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের জন্য কম খরচে সেবা নিশ্চিত করা যায়। ব্যাংকের শাখা খোলার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভৌগোলিক সম্প্রসারণমুখী যে নিয়ম চালু করেছে, অর্থাৎ একটি শহুরে শাখার বিপরীতে একটি গ্রামীণ শাখা, সেটি আমাদের পল্লি অর্থনীতির ভিত শক্ত করার পথে একটা বড় পদক্ষেপ হতে পারে। কারণ, অবহেলিত পল্লির নিভৃতে পড়ে থাকা সাধারণ মানুষকে ব্যাংকিং পরিসেবার আওতায় আনতে না পারলে মানবিক কিংবা অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং কোনোটিই নিশ্চিত করা যাবে না। কিন্তু ব্যয়বহুল সাজসজ্জা এবং উচ্চ স্থায়ী খরচের কারণে পল্লি শাখাগুলো কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর কোনো কোনোটির গ্রামীণ শাখার আয়তন শহুরে শাখার চেয়ে বড়, এমন উদাহরণও আছে।
মহাত্মা গান্ধীর সাদাসিধে জীবন ও নিরাড়ম্বর চলাফেরা নিয়ে একটা কৌতুক চালু আছে। বলা হয়, ‘ইট ওয়াজ ভেরি এক্সপেনসিভ টু কিপ বাপুজি ইন পোভার্টি।’ গ্রাম ও শহরের অনুপাত রক্ষা করার জন্য আমাদের ব্যাংকগুলোর গ্রামীণ শাখা খোলার ব্যাপারে গান্ধীজি সম্পর্কে কৌতুকটা পুরোপুরি প্রযোজ্য। তাই দেখা যায়, পল্লি অর্থনীতির স্বল্প আয়ের মানুষদের সেবা দেওয়ার জন্য শাখা খোলা হলেও সেগুলোর স্থায়ী এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এত বেশি থাকে যে তাদের সেবার খরচও বেড়ে যায়। এই উচ্চ খরচের কারণে গ্রামীণ শাখাগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারে না। তবে আশার কথা যে বাংলাদেশ ব্যাংক সমপ্রতি শাখা খোলার খরচের বিষয়টিকে যৌক্তিক সীমায় নামিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছে।
সম্প্রতি মানবিক ব্যাংকিং নামে ড. আতিউর রহমানের একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটির ভূমিকায় লেখকের একটি মন্তব্য আমাদের সামনে মানবিক ব্যাংকিংয়ের সীমানাটা আরও বিস্তৃত ও স্পষ্ট করে দেয়। তিনি লিখেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমানোও একধরনের মানবিক ব্যাংকিং। কেননা, গরিব মানুষই মূল্যস্ফীতির আঘাতে বেশি করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।’ আমাদের মতো সাধারণ মানুষ মনে করে, মানবিক ব্যাংকিং মানেই দান-খয়রাত, কৃষিঋণ-জাতীয় কিছু একটা কর্মকাণ্ড, কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাও যে মানবিক ব্যাংকিংয়ের অংশ, এই দৃষ্টিভঙ্গিটা আমাদের চিন্তাধারাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করবে সন্দেহ নেই। এই নতুন দর্শন থেকে আমাদের চেতনাগত যে অভিজ্ঞানটি যুক্ত হয়, তা হলো শুধু কৃষিঋণ কিংবা দরিদ্র কৃষকের জন্য ১০ টাকায় অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা নয়, গ্রিন ব্যাংকিং, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণ, উপজাতিদের জন্য ঋণসহায়তা, বর্গাচাষিদের জন্য ঋণ—এসবই মানবিক ব্যাংকিংয়ের প্রয়াস। কারণ, যে ব্যাংকিং সেবা সাধারণ মানুষ, স্বদেশ, পরিবেশ ও বিশ্ব এবং বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে আসে, সেটিই মানবিক ব্যাংকিং। তাই এমনকি ব্যাংকগুলো যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ, কৃষি কিংবা আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের জন্য ঋণ দেয়, সেগুলোও মানবিক ব্যাংকিং বিবেচনা না করার কোনো কারণ নেই। তবে বিনা জামানতে ভোক্তাঋণ, কিংবা মাইক্রো ফিন্যান্স—জামানতহীনতা কিংবা উচ্চ পরিচালন ব্যয়ের অজুহাতে যেগুলোর সুদের হার অত্যধিক বেশি, সেসব ঋণকে মানবিক ব্যাংকিংয়ের সংজ্ঞায় ফেলা যাবে কি না, তা বিতর্কসাপেক্ষ।
এ ছাড়া সম্প্রতি এজেন্ট ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা এজেন্ট ব্যাংকিং চালুর মতো একটা যুগান্তকারী উদ্যোগ আমাদের দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবার ক্ষেত্রে খুলে দেবে এক নতুন দরজা। ব্যাংকগুলোর নির্বাচিত এজেন্টরা ব্যাংকের পক্ষ হয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতি সাধারণ মানুষের কাছে স্বল্প খরচে পৌঁছে দিতে পারবে ব্যাংকিংয়ের প্রচলিত সব সেবা ও সুবিধা। এ ছাড়া বিআরডিবির অধীনে পল্লি সঞ্চয় ব্যাংক স্থাপন করে আমানত সংগ্রহের নতুন সিদ্ধান্ত গ্রামাঞ্চলের ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের নগণ্য সঞ্চয়কে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক জাতীয় সঞ্চয়প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করতে সক্ষম হবে। এসব উদ্যোগ ও প্রয়াস যদি সফল হয় এবং তার মাধ্যমে বিস্তৃত হয় ব্যাংকিং সেবা, তাহলে বলা যাবে প্রথাগত ব্যাংকিংয়ের আওতায়ও মানবিক ব্যাংকিং সংযোজন এবং অনুশীলন করা সম্ভব।

ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.