বাংলায় ‘বাট’ সংক্রমণ
এবারের বইমেলা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। দেশে যাওয়াটা আর হলো না। মেলার প্রথম দিনে মানুষের ঢল। বাঙালি বই ভালোবাসে—এই ভাবনাতেই বুক ভরে ওঠে। তাই যেমন বইমেলার ছবি দেখব, তেমনি বাংলায় কথা শুনব। শুধুই বাংলায়। ভিড়ে মাইক হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন টেলিভিশন সাংবাদিক। এলোপাতাড়ি ধরে ফেলেছেন মেলা-উৎসাহী কাউকে। প্রশ্ন করছেন, ‘কেমন লাগছে বইমেলা?’ ‘ভালো। কিছুটা অবাক হয়েছি মেলা এদিকটা (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) চলে আসায়, বাট...’ আরও একজনকে প্রশ্ন, ‘আপনার কেমন লাগছে?’ ‘ভালো লাগছে, ঘুরে বেড়াচ্ছি, বই দেখছি, বাট...’ ওই টেলিভিশনের পর্দাতেই, নবীন ক্রিকেট খেলোয়াড়, যিনি বাংলাদেশ দলের সঙ্গে চলেছেন বিদেশে: ‘লক্ষ্য আমাদের বড়, বাট...’ টক শোর অতিথি: ‘উনি বললেন, ওঁর দল এতে (সন্ত্রাসে) জড়িত ছিলেন না, বাট...’ বাঙালি ‘বাট’ নিয়ে মেতেছে। বাট হয়ে গেছে অনেকটা ডাল-ভাতের মতো। স্কুলের ছাত্র কথায় কথায় বাট বলে থাকে। তরুণেরাই বাট বলেন বেশি। তবে গৃহবধূও বাট বলেন হরহামেশা, গৃহপরিচারিকাও। বড়লোকের বাড়ির ড্রয়িংরুম বাট-এ সরগরম। তা এত বাট কেন? ‘তবু’ বা ‘কিন্তু’ কী দোষ করল? এতকাল এই বাংলা শব্দ দুটি ব্যবহার করেই তো কথা বলেছি, দিব্যি আলাপ চালিয়ে গেছি। বাটের সঙ্গে অবশ্য যোগ হয়েছে আরও অনেক ইংরেজি শব্দ। সম্ভবত বাটের পরেই আসবে ‘সো’, আর তার পরে ‘দেন’, ‘বিকজ’ ইত্যাদি। ছেলেবেলায়, চল্লিশের দশকের শেষ নাগাদ, বেশ কিছুদিন আমাদের রেশনের চাল খেতে হয়েছিল। সেই চালে থাকত প্রচুর কাঁকর। চালটাও ছিল বহুদিনের গুদামজাত। শিগগিরই কি কাঁকরসম ইংরেজি শব্দের বকুনিতে বাংলা চিনতেও আমাদের কষ্ট হবে? ‘তবু’ বা ‘কিন্তু’ মিশেল দিই কেন? ইংরেজি করে বলাটা স্মার্ট বলে? আসলে তো স্মার্ট হচ্ছে দুটো ভাষাই ভালো জানা, যাতে মিশেল না দিতে হয়।
আমাদের দেশের অধিকাংশ ‘শিক্ষিত’ মানুষ সত্যিই ইংরেজি জানেন না। অধিকাংশ ‘বাট’-মুগ্ধ তরুণের ইংরেজিজ্ঞান অত্যন্ত সীমিত, তা যে কারণেই হোক। এ ক্ষেত্রে বাট-সো-দেন-বিকজের বহুল ব্যবহার একধরনের হীনম্মন্যতাই। বইয়ের সংখ্যা আর সাহিত্যচর্চার (বিশেষ করে কবিতা) দিক থেকে বিচার করলে লিখিত বাংলায় আমরা অনেক এগিয়েছি। তবে বাংলা তো আমার মুখের ভাষাও। কথ্য ভাষার জন্যও তো আমরা সংগ্রাম করেছি, শুধু বইয়ের ভাষার জন্য নয়। মুখের ভাষা বাংলায় যে জিনিসটা বেড়ে চলেছে, সেটাকে বলা যেতে পারে যথেচ্ছাচার, অরাজকতা। বাট সংক্রমণ এবং অন্যান্য ইংরেজি শব্দের মিশেল একটি মস্ত উদাহরণ। তবে হরেক রকমের উদাহরণ সহজেই মিলবে। যেমন, আজকাল একটি অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করছি। কোনো সম্মানিত ব্যক্তির কোনো কর্মের কথা বলতে গেলে যথাযথ ক্রিয়াপদটির সঙ্গে একটি ‘ন’ যোগ করা (যথা ‘করেন’ বা ‘করতেন’) শালীন বাংলার একটি নিয়ম। এটা আজ যেন উঠে গেছে। কদিন আগে টেলিভিশনে এক সাংবাদিকের মুখে শুনছিলাম: মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলল...(‘বললেন’ নয়)। ওই টেলিভিশনেই জাতীয় সংসদে এক সাংসদকে বলতে শুনলাম, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যা ভারতের কাছ থেকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা এনেছিল (‘এনেছিলেন’ নয়)। তরুণ কণ্ঠশিল্পীকে দেখেছি, গুরুর কথা উঠতেই তার সশ্রদ্ধ হাত কানের লতি ছুঁয়েছেন, অথচ গুরুর কর্মের বেলায় ক্রিয়াপদে ‘ন’-এর প্রয়োগ নেই। শুনি, ‘গুরু আমাকে খুব আদর করত’, ‘খুব যত্ন করে গান শেখাত’ ইত্যাদি। ‘প্রস্তাবনা’ শব্দটির অর্থ কী? টেলিভিশন উপস্থাপকদের মুখে এটা প্রায়ই শুনি। অমুক সংগঠন প্রস্তাবনা দিয়েছেন। সেদিন একটি নামকরা টেলিভিশন চ্যানেলের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রস্তাবনা শব্দটি শুনলাম বার কয়েক। শুনলাম উপস্থাপকেরই মুখে। তিনি ওটাকে ব্যবহার করছেন প্রস্তাব অর্থে।
আসলে প্রস্তাবনার অর্থ হলো ভূমিকা। যেমন, কোনো রচনার ভূমিকা। তবে কথ্য বাংলা নিয়ে ভাবনার সবচেয়ে বড় দিক হলো শুদ্ধ বা প্রমিত উচ্চারণে আমাদের বিশাল ঘাটতি। বাংলা ভাষার এই প্রমিত রূপ জাতির একটি অমূল্য সম্পদ। অথচ এই সম্পদকে আমরা অহরহ অবহেলা করে থাকি। বাংলার অনেক আঞ্চলিক রূপ আছে, যা আমাদের ভাষায় চিত্তাকর্ষক বৈচিত্র্য এনেছে। বেঁচে থাক সেই বৈচিত্র্য। এটা না থাকলে বাংলা একঘেয়ে হয়ে যেত। তবে যে বাংলা বাঙালি জাতিকে একসূত্রে গেঁথে রেখেছে, সে বাংলা প্রমিত বাংলা। সে বাংলা আজও অবহেলিত। কিছু সংস্কৃতিমনা মানুষ আর রেডিও-টেলিভিশনের সংবাদ পরিবেশকের মুখেই ভালো বাংলা শুনতে পাই। তাঁদের বাইরেও জিনিসটি প্রায় অনুপস্থিত। তরুণ প্রজন্মের মুখেও প্রমিত বাংলা উচ্চারণ শুনতে পাই না। একুশের মিছিলেও না। শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণের প্রতি এই অবহেলা সবচেয়ে প্রকট আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে। অথচ তাঁদের কাছেই তো আমরা সেই বাংলা আশা করি, যা সমগ্র বাংলার মানুষের জন্য। অর্থাৎ, প্রমিত বা শুদ্ধ বাংলা আশা করি। তার কারণ, তাঁরা যখন জাতীয় সংসদে কথা বলেন, ভাষণ দেন, তা সাধারণত সারা বাংলার জন্য। তাঁদের জেলার মানুষের জন্য নয়। অথচ তাঁদের মধ্যেই প্রমিত বাংলা অনুপস্থিত। অনেক মন্ত্রীই প্রমিত বাংলার ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পারেন না। অথচ তাঁরা ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বাংলার গরবে সহসা স্ফীত হন। ভালো কথা, বর্তমান মন্ত্রিসভায় তো একজন মন্ত্রী রয়েছেন, যিনি খুব ভালো বাংলা বলেন। বাংলা সংস্কৃতিতে তাঁর অবদান রয়েছে। আমরা কি দাবি করতে পারি না, উনি সহকর্মীদের ভালো বাংলা বলতে উৎসাহিত করবেন এবং প্রয়োজনে তালিম দেবেন? অনেকে হয়তো চোখ কপালে তুলবেন। প্রস্তাবটা করার মতো সাহস কুড়িয়ে পেয়েছিলাম ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আমগাছতলায়।
মাহফুজুর রহমান: জাতিসংঘের সাবেক অর্থনীতিবিদ, গ্রন্থকার, প্রাবন্ধিক।
মাহফুজুর রহমান: জাতিসংঘের সাবেক অর্থনীতিবিদ, গ্রন্থকার, প্রাবন্ধিক।
No comments