ভারত- হায়দরাবাদ থেকে তেলেঙ্গানা by আলী ইমাম মজুমদার
প্রতিবেশী ভারতে শাসনকাজ সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য মাঝেমধ্যে বিভিন্ন রাজ্য ভাঙাগড়া হয়। এ ধরনের ভাঙাগড়ায় বিপরীতমুখী স্বার্থের সংঘাত থাকে বলে ব্যাপারটি কিন্তু সহজ নয়।
অতীতের ভাঙাগড়াগুলোও সহজে হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে ঘটেছে সংঘাত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিদের সুবিবেচনাপ্রসূত মতামতের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হয়েছে। ঠিক তেমনি দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশকে ভেঙে তেলেঙ্গানা নামের একটি রাজ্য গড়ার জোর দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। এটা নিয়ে দফায় দফায় আন্দোলন হয়েছে। প্রাণহানিও ঘটেছে বেশ কিছু মানুষের। ১৯৬৯ আর ১৯৭২-এ আন্দোলনের তীব্রতা ছিল প্রকট। কিন্তু তখন আলোর মুখ দেখেনি দাবিটি। তা দেখল ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ভারতের ২৯তম রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রায় সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে তেলেঙ্গানার। সম্প্রতি লোকসভা ও রাজ্যসভায়ও জনপ্রতিনিধিরা যখন এটা নিষ্পত্তি করেন, তখনো কিন্তু বিষয়টি সহজসাধ্য ছিল না। তবে প্রধান দুটো দল একমত হওয়ায় অন্যদের আপত্তি ধোপে টেকেনি।
ফেডারেল সরকারব্যবস্থায় এ ধরনের রাজ্য বিভক্তির পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকে। উভয় পক্ষ প্রায় ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান নেয়। তা সত্ত্বেও জনগণের বৃহত্তর কল্যাণ বিবেচনায় রেখে একপর্যায়ে একটা সমাধান করতে হয়। আর এটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। আবার এ ধরনের দাবি একটি মেনে নিলে সমধর্মী দাবিও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর কেন্দ্রীয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট রাজ্যও এ ধরনের দাবির পক্ষে ঢালাওভাবে অবস্থান নিতে পারে না। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর পর্যালোচনার পরই একেকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবু নিজ নিজ অবস্থানে থেকে অনেকে আন্দোলন চালায়। ভারতে গত বিজেপি সরকারের সময়ে তিনটি নতুন রাজ্য গঠিত হয়েছিল। সেগুলো হচ্ছে উত্তর প্রদেশ, ওডিশা আর বিহার ভেঙে যথাক্রমে উত্তরাঞ্চল, ছত্তিশগড় আর ঝাড়খন্ড। এখনো জোর দাবি চলছে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ, আসামের বোড়োল্যান্ড আর পশ্চিমবঙ্গের গুর্খাল্যান্ডসহ আরও কিছু অঞ্চলে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি রাজ্য গঠনের সময়ে তার ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ সব দিক বিবেচনা করতে হয়। পার হতে হয় জটিল সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
কতগুলো দিক বিবেচনায় তেলেঙ্গানাকে প্রকৃত অর্থে সম্পূর্ণ নতুন একটি রাজ্য বলা যাবে না। এ অঞ্চল মূলত ব্রিটিশ-ভারতে হায়দরাবাদ রাজ্যের অংশবিশেষ। ১৯৪৮ সালে এর ভারতভুক্তি হয়। এর আগে ইংরেজ শাসকেরা রাজ্যটির বেড়ার নামক একটি অংশ মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়। ভারতভুক্তির পরও মারাঠাভাষীর কিছু অংশ মহারাষ্ট্র আর কানাড়াভাষী কিছু অংশ কর্ণাটকের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তেলেগুভাষী অংশটিকে ১৯৫৬ সালের রাজ্য পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকালে অন্ধ্র প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সেই হায়দরাবাদ নগরই হয় অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী।
ভাষার সাযুজ্য থাকলেও এর একটি ঐতিহাসিক পৃথক সত্তা ছিল। ১৭২৪ সাল থেকে পৃথক দেশীয় রাজ্য হিসেবে এর শাসনভার ছিল নিজাম পরিবারের হাতে। সীমানার কিছু পরিবর্তন হলেও ব্রিটিশরা এ সত্তা বহাল রাখে। ব্রিটিশ-ভারতের ৫৫৬টি দেশীয় রাজ্যের মধ্যে এটি ছিল সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ। মূল হায়দরাবাদ রাজ্যের আয়তন ছিল দুই লাখ ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। কেটে নিয়ে অন্ধ্রের সঙ্গে যেটুকু দেওয়া হয়েছে, তার আয়তন এক লাখ ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। আর বর্তমান লোকসংখ্যা সাড়ে তিন কোটি। অবিভক্ত অন্ধ্র প্রদেশের আয়তন দুই লাখ ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার। আর লোকসংখ্যা সাড়ে আট কোটি। এর সরকারি ভাষা তেলেগু ও উর্দু। সুজলা-সুফলা এ রাজ্যকে ভারতের খাদ্যভান্ডার বলা হয়। চাল ছাড়াও চিনিসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য ও মৎস্য উৎপাদনে অগ্রণী এ অন্ধ্র প্রদেশ।
পাশাপাশি শিল্পায়নেও অনেক অগ্রসর। মাথাপিছু গড় আয়ের দিক দিয়ে ভারতে দ্বিতীয়। অন্ধ্রের রাজধানী হায়দরাবাদের আয়তন ৬৫০ বর্গকিলোমিটার। আর জনসংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। ভারতের চতুর্থ জনবহুল শহর। এ নগর রাজ্যের জিডিপি আর কর প্রদানে শীর্ষে রয়েছে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া তথ্যানুসারে ভারতের নগরওয়ারি বিবেচনায় হায়দরাবাদ ব্যাংক আমানতে ষষ্ঠ আর ঋণ প্রদানে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এখানে রয়েছে প্রায় এক হাজার ৩০০টি উঁচু মানের আইটি ফার্ম। এর মধ্যে মাইক্রোসফটসহ বেশ কিছু নামজাদা বহুজাতিক কোম্পানিও আছে। অর্থাৎ ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে এ নগরে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা অনুসারে, এটি ভারতের দ্বিতীয় ব্যবসাবান্ধব শহর। এর অর্থ ব্যাপক বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এখানে সুশাসনও স্বাভাবিক মাত্রায় রয়েছে। আগামী ১০ বছর নগরটি উভয় রাজ্যের যৌথ রাজধানী থাকবে বটে। এরপর চলে যাবে তেলেঙ্গানার ভাগে।
হায়দরাবাদ তেলেঙ্গানার রাজধানী হিসেবে পাবে। তবে উল্লেখ করা যথার্থ যে তেলেঙ্গানা নামক অঞ্চলটি অন্ধ্র প্রদেশের অন্য অঞ্চল থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে। তাদের অভিযোগ রয়েছে সুষম উন্নয়ন না হওয়ার। যেকোনো কারণেই হোক এ অভিযোগের বাস্তবতা লক্ষণীয় হয়। যেমন গোটা অন্ধ্র প্রদেশের শাসনব্যবস্থায় তেলেঙ্গানাবাসীর সংখ্যা শতকরা ২০ জন। আর শীর্ষস্তরে এর অনুপাত শতকরা পাঁচজন। সুতরাং সূচনায় রাজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে তারা কিছু হোঁচট খাবে। তবে রাজনৈতিক দূরদর্শিতাসম্পন্ন নেতৃত্ব থাকলে নতুনভাবে গঠনের পর্যায়ে অঞ্চলনির্বিশেষে সবার সহযোগিতা নিতে নতুন সরকার সচেষ্ট থাকবে। নিজামের শাসনকাল থেকেই এ রাজ্যের অবকাঠামো উন্নত ছিল। ব্রিটিশের সাধারণ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এর নিজস্ব সেনাবাহিনী, বিমান পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, রেলওয়ে, ডাক যোগাযোগব্যবস্থা, মুদ্রা ও বেতার সম্প্রচারব্যবস্থা ছিল। অর্থনীতিও পেছনে ছিল না। এখন মাঝখানে যেটুকু পিছিয়েছে, তা থেকে বিদ্যমান অবস্থায় দ্রুত উত্তরণ সম্ভব।
নতুন রাজ্য হিসেবে তেলেঙ্গানার এ অভ্যুদয়কে ভারতের রাজনৈতিক এমনকি সিভিল সমাজ নিরঙ্কুশভাবে স্বাগত জানাচ্ছে না। এখানে একটা তীব্র দ্বিধাবিভক্তি লক্ষণীয়। একটি অংশ এ ধরনের পুনর্গঠনের পক্ষে থাকলেও অপর অংশটি সক্রিয়ভাবে বিরুদ্ধে। যারা পক্ষে তারা বলছে একটি ভূখণ্ড তার পূর্ব সত্তা ফিরে পেলে নিজদের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ পাবে। সমৃদ্ধির গতি আরও বাড়বে। পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলো নজরে আসবে। ক্রমান্বয়ে অবসান ঘটবে তাদের পশ্চাৎপদতার। অপর অংশটির মতে, এ সিদ্ধান্ত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ভাষাভাষী ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়াবে। একের পর এক নতুন রাজ্য গঠনের দাবি আসতে থাকবে। তাঁরা আরও বলছেন, এ প্রবণতা ভারতকে ক্রমান্বয়ে ‘বলকানাইজেশন’-এর পথে নিতে পারে। এ ধরনের মতামত পোষণকারীদের মধ্যে কুলদীপ নায়ারের মতো প্রথিতযশা সাংবাদিকও রয়েছেন। উল্লেখ্য, ‘বলকানাইজেশন’ একটি ভূরাজনৈতিক শব্দ। একটি দেশ বা অঞ্চল পরস্পরের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত হওয়াকে ‘বলকানাইজেশন’ বলে অভিহিত করা হয়। এ শব্দটি মূলত ১৮১৭ থেকে ১৯১২ সময়কালে অটোমান সাম্রাজ্যের বলকান উপদ্বীপের অঙ্গরাজ্যগুলো বিভিন্ন রাজ্যের বিভক্তি থেকে নেওয়া হয়। ভারতের ক্ষেত্রে এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য বলে অনেকে মনে করেন না। তাঁদের বিবেচনায় এখানে ফেডারেল সরকারব্যবস্থা থাকলেও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার, সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল, সুসংগঠিত সামরিক বাহিনী ও দক্ষ আমলাতন্ত্র রয়েছে। ব্যাপকভাবে না হলেও এ ধরনের দু-একটি ক্ষেত্রে নতুন রাজ্য গঠনকে প্রয়োজনীয় বিকেন্দ্রীকরণ বলে ইতিবাচক রূপে চিহ্নিত করছেন তাঁরা।
কেবল কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা কোনো দেশের জন্য সুফল আনে না। শুরু থেকেই ভারত এ সত্য উপলব্ধি করে শক্তিশালী কেন্দ্রের অধীনেই কার্যকর রাজ্য প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। আর সময়ের প্রয়োজনে এসব রাজ্য নিয়ে কিছু ভাঙাগড়া চলতেই পারে। অন্ধ্র প্রদেশ ভাঙা নিয়ে দাবি দীর্ঘদিনের। কয়েক যুগ পর দাবিটি পূরণ হতে চলছে। কতিপয় ক্ষেত্রে সাময়িক অসুবিধা হলেও শেষাবধি তা কেটে যাবে বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। অন্য রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। আর একে নজির রেখে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবিও আসতে পারে। আসলেই সথেষ্ট যৌক্তিকতা না থাকলেও তা দেওয়া হবে এরূপ মনে করার কোনো কারণ নেই। সব আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে ভারতের ২৯তম রাজ্য তেলেঙ্গানা সুষম উন্নয়ন ও সংহতির পথে এগিয়ে যাবে—এটিই প্রত্যাশা।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments