মঙ্গলযাত্রা!-অচিরেই মঙ্গল গ্রহে আবাস গড়তে যাচ্ছে মানুষ। পুরোদমে চলছে সে প্রস্তুতি। মঙ্গলযাত্রায় সঙ্গী হতে পারেন এক বাংলাদেশিও

‘ধূমায়িত কফির কাপে চুমুক দিয়ে দিন শুরু হলো মঙ্গল গ্রহের চার বাসিন্দার। হাতে অনেক কাজ। মার্স স্যুট (মঙ্গল গ্রহের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, এমন পরিধেয় কাপড়) গায়ে চাপিয়ে প্রস্তুত হলেন তাঁরা। রোভারের (একধরনের রোবটিক গাড়ি) সাহায্যে আশপাশটা ঘুরে দেখতে হবে, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আপডেট জানাতে হবে, আগামী দিনগুলোর জন্য খাবারের বন্দোবস্ত রাখাও জরুরি। চারদিকে ধু ধু প্রান্তর। মাঝে জনমানব বলতে কেবল তাঁরা চারজন। দূরে, আড়ালে বসে কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী তাঁদের ওপর নজর রাখছে কি না, কে জানে!’

>>মঙ্গল গ্রহ: হতে পারে সৌরজগতে মানুষের নতুন আবাস!
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি বলে মনে হচ্ছে? কল্পনাই বটে। তবে একে ‘আকাশ কুসুম’ বলার উপায় নেই। ২০২৩ সাল নাগাদ মঙ্গল গ্রহের স্থায়ী বাসিন্দা হতে যাচ্ছেন গুটি কয়েক মানুষ। ইতিমধ্যেই পুরোদমে চলছে সে প্রস্তুতি। আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য ঠেকলেও সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সত্যিই এমনটা হতে যাচ্ছে, সে নিশ্চয়তা দিচ্ছেন নোবেলজয়ী ডাচ পদার্থবিদ অধ্যাপক ডক্টর জেরার্ড থুফট। ‘অধিকাংশ মানুষের মতো আমারও শুরুতেই মনে হয়েছিল, এই পরিকল্পনা কখনোই কাজে আসবে না। কিন্তু পরে যখন পুরোটা জানলাম... বিশ্বাস করুন, এটা সম্ভব!’

মার্স ওয়ান

মঙ্গল গ্রহে মানুষের স্থায়ী বসতি গড়ে তোলার এই পুরো কার্যক্রমটি পরিচালনা করছে মার্স ওয়ান নামে একটি প্রতিষ্ঠান। নেদারল্যান্ডসের এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ব্যাস ল্যান্ডসড্রপ ২০১২ সালের মে মাসে পুরো পরিকল্পনাটি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে চারজন মানুষ স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে মঙ্গল গ্রহে পা রাখবেন। যাঁরা আর কখনোই পৃথিবীতে ফিরে আসবেন না। ‘আসবেন না’ না বলে অবশ্য আসতে ‘পারবেন না’ বলাটাই শ্রেয়। কারণ, ল্যান্ডসড্রপের ভাষ্যমতে, ‘ফিরে আসার মতো প্রযুক্তি আমরা তৈরি করিনি।’
‘আপনি কি মঙ্গলের প্রথম স্থায়ী বাসিন্দা হতে চান?’ রীতিমতো এমন বিজ্ঞাপন দিয়ে ২০১২ সালে শুরু হয়েছিল এই কর্মযজ্ঞ। প্রথমবার চারজন মঙ্গলের বাসিন্দা হবেন। দুই বছর পর পর তাঁদের সঙ্গে নতুন বাসিন্দা যোগ হবেন। খাবার থেকে শুরু করে চিকিৎসাসেবা, সবকিছুর সংস্থান তাঁদের নিজেদের করে নিতে হবে। পৃথিবী থেকে কোনো রসদ পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ নেই।
সম্ভাব্য সব রকম পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশনা দেওয়া থাকবে। বসবাসের পাশাপাশি তাঁরা সেখানে গবেষণার কাজ করবেন। এভাবে ধীরে ধীরে মঙ্গল গ্রহে পুরো একটা জনবসতি গড়ে তোলার পরিকল্পনা মার্স ওয়ানের। প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পের আর্থিক বন্দোবস্তের প্রক্রিয়াও ‘চমকপ্রদ’। মঙ্গল গ্রহে যাত্রা থেকে শুরু করে সেখানে বাসিন্দাদের প্রতি মুহূর্তের কার্যকলাপ নিয়ে তৈরি হবে একটি ‘টিভি রিয়েলিটি শো’। সুদূর লালচে গ্রহটাতে বসে গুটিকয় মানুষ কীভাবে বেঁচে আছেন, কী খাচ্ছেন, কী করছেন—সবই আপনি দেখতে পাবেন পৃথিবীতে বসে! রিয়েলিটি শোর আয় থেকেই প্রকল্প বাস্তবায়নের পুরো টাকা উঠে আসবে বলে আশা করছেন ব্যাস ল্যান্ডসড্রপ আর তাঁর দল।

আছে বিতর্কও

‘আপনার চুলে আর কখনো বাতাস খেলা করবে না। তুষারের ওপর হাঁটলে কেমন শব্দ হয় আর কখনো শোনা হবে না। শোনা হবে না পাখির ডাক। এগুলো যদি আপনার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, তাহলে মঙ্গলের অভিযান আপনার জন্য নয়!’ বলছেন স্বয়ং ব্যাস ল্যান্ডসড্রপ! তবু দেখা গেল, একটা বড়সংখ্যক মানুষ নীল-সবুজ পৃথিবী ছেড়ে লালচে মঙ্গলে পাড়ি জমাতে চান। কিন্তু কেন?
‘একবার মঙ্গলে চলে গেলে কার্যত পৃথিবীর কাছে আমি মৃত। আকাশ নাকি মানুষের সীমানা, আমি সীমানা ছাড়িয়ে যেতে চাই।’
‘ছোটবেলায় তারা দেখতাম। মনে হতো, একদিন ওই তারাগুলো ছুঁয়ে দেখব। তবে পৃথিবীর পাহাড়, বৃষ্টি, সাগর আর আমার পরিবার—তাদের মিস করব ঠিক।’
‘আমি চাই একদিন মঙ্গল গ্রহে আমার একটা স্ট্যাচু তৈরি হোক। হা হা হা!’
‘শেষ মুহূর্তে আমার ছোট্ট ছেলে কনার যদি পেছন পেছন হেঁটে আসে, বলে, “বাবা, তুমি যেয়ো না”, হয়তো সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও করতে পারি।’
একটি তথ্যচিত্রে এভাবেই নিজেদের মনোভাব তুলে ধরেছেন কয়েকজন সম্ভাব্য মঙ্গলযাত্রী। তথ্যচিত্রটি দেখতে পারেন নিচের ইউটিউব লিঙ্কে। তবে একটা আগাম সতর্কতা। মার্স ওয়ান ওয়ে নামে এই ভিডিওচিত্রটি দেখতে বসে চোখের পানি ধরে রাখা আপনার জন্য একটা ‘কঠিন পরীক্ষা’ হতে পারে!
https://www.youtube.com/watch?v=Fk0LLX47deA
এই অভিযান নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্কও। কিছু মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই নিয়ে ‘রিয়েলিটি শো’ নির্মাণকে অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না। এরই মধ্যে মার্স ওয়ান নিয়ে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। মার্স ওয়ান যদিও দাবি করছে, সব জেনেশুনেই অভিযাত্রীরা মঙ্গলে যেতে রাজি হয়েছেন। তবু, কিছু মানুষকে অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেওয়া কতখানি যৌক্তিক, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়ে।
মার্স ওয়ানের পরিকল্পনা২০১৫২০১৫ সালের জুলাই মাস নাগাদ চারজনের ছয়টি দল, অর্থাৎ মোট ২৪ জনের বাছাই সম্পন্ন হবে বলে আশা করছে মার্স ওয়ান। বাছাইপর্ব শেষে কৃত্রিমভাবে তৈরি মঙ্গল গ্রহের পরিবেশে শুরু হবে তাঁদের প্রশিক্ষণ। চলবে একটানা সাত বছর।
২০১৬মঙ্গল গ্রহে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য স্যাটেলাইট স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি, মঙ্গলে পৌঁছে যাবে অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম।
২০১৮মঙ্গলে পাঠানো হবে কিছু রোভার। রোবটিক হাতবিশিষ্ট এই স্বয়ংক্রিয় গাড়ি মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসবাসযোগ্য জায়গা খুঁজে বের করবে।
২০২০জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামসহ (লাইফ সাপোর্ট ইউনিট), মানুষের বাসস্থান তৈরির কাজ শুরু করবে রোভার।
২০২২
সেপ্টেম্বর মাসে যাত্রা শুরু হবে চার অভিযাত্রীর। পৃথিবী থেকে মঙ্গলে পৌঁছাতে তাঁদের সময় লাগবে প্রায় সাত মাস।

—মো. সাইফুল্লাহ, সূত্র: মার্স ওয়ানের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট এবং ইউটিউব

No comments

Powered by Blogger.