ন্যায়বিচার- পাকেচক্রে পুলিশি তদন্ত by মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী
ফৌজদারি মামলায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার
সঙ্গে অনিবার্যভাবে সম্পৃক্ত পুলিশের ভূমিকা। পুলিশি তদন্ত ও সাক্ষ্য
সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য, যা মানবাধিকার নিশ্চিত
করার ক্ষেত্রেও সম্পৃক্ত। মামলা দায়েরের পর ঘটনা উদ্ঘাটন, সাক্ষ্য-প্রমাণ
সংগ্রহ, অনুসন্ধান, পটভূমি অবলোকন, অপরাধ ব্যাখ্যা, ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ ও
প্রতিবেদন প্রণয়ন পুলিশি তদন্তের ভিত্তি। মূলত যেকোনো মামলার সত্য-মিথ্যা
পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে। এ কার্যক্রমে যত বেশি থাকবে স্বচ্ছতা, তত বেশি
নিশ্চিত হবে মামলার বিচার-প্রক্রিয়ায় সফলতা। এ সফলতাই সমাজে হ্রাস করতে
পারে অপরাধপ্রবণতা।
প্রচণ্ড মনস্তাত্ত্বিক ও পেশাগত চাপ অতিক্রম করে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের মাধ্যমে মামলার সত্য-মিথ্যা উন্মোচন করতে হয় পুলিশকে। অভিযোগ প্রমাণের অংশ হিসেবে মামলার সাক্ষীকে আদালতে হাজির করাও পুলিশের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। মামলার সাক্ষীদের নির্বিঘ্নে সাক্ষ্য প্রদানও নিশ্চিত করতে হয় পুলিশকে। সাক্ষী হাজির না হলে তার দায়ভারও পড়ে পুলিশের ওপর। এমনকি অভিযোগকারীকে বিচার কার্যক্রমে হাজির করিয়ে মামলা প্রমাণের গুরুদায়িত্ব বহন করতে হয় পুলিশকে। পুলিশকে শপথ নিয়ে আদালতে সাক্ষ্যও উপস্থাপন করতে হয়। এভাবেই পুলিশের তদন্ত, সাক্ষ্য, আলামত ইত্যাদি বিজ্ঞ বিচারকের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট বিচার-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মামলার সত্যতা বা অসারতা প্রমাণ করতে হয় বিচারককে। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার পর্বতসম কর্তব্য পালনের পাশাপাশি পুলিশের এ তদন্ত বিরাট দায়িত্ব, যা ফৌজদারি মামলার বিচার কার্যক্রমে অতি প্রাসঙ্গিক। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭১(২) ধারায় পুলিশি তদন্তের সুস্পষ্ট পথনির্দেশনা রয়েছে। মামলার এজাহার গ্রহণ, তদন্ত সম্পাদন, সাক্ষীদের ১৬১ ধারার জবানবন্দি গ্রহণ, আলামত সংগ্রহ ও জব্দ তালিকা তৈরির পর্যায়ক্রমিক প্রতিটি স্তর তাৎপর্যপূর্ণ।
পুলিশের এসব কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পরবর্তী ধাপে আদালতের বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হয়। পুলিশ আদালতে যেভাবে মামলার বিষয়বস্তু উপস্থাপন করে, আদালতে তা রেকর্ডের মাধ্যমে বিচারের গন্তব্য এগিয়ে যায় সেভাবেই। পুলিশি তদন্ত বিলম্বিত হলে বিচারও বিলম্বিত হয়। তদন্তে বিলম্ব মানে বিচারে বিলম্ব। বিচারে বিলম্ব মানে অবিচারের পথ প্রশস্ত করা। তা বিচারকের জন্য শুধু বিব্রতকর নয়, বিচারপ্রার্থীদের জন্যও অপূরণীয় মানসিক, শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতির কারণ। বিশেষ করে মামলার প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে তদন্ত প্রতিবেদনের অসামঞ্জস্যতা ন্যায়বিচারের পথে সৃষ্টি করে বিশাল প্রতিবন্ধকতা। এতে পুলিশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সমান্তরালে আদালতের মর্যাদাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এভাবে তৈরি হয় বিচারবঞ্চিত ব্যক্তিদের ক্ষোভ ও যন্ত্রণার পটভূমি। এর বিষময় প্রতিক্রিয়ার সংক্রমণ ঘটে সমাজে, যার ফল অসহায় মানুষের নীরবে অশ্রুপাত ও ক্ষতবিক্ষত অন্তরের অভিশাপ।
পুলিশের সঠিক তদন্তে মামলা টিকে যায়, আবার অস্বচ্ছ তদন্তে মামলায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে তদন্ত কর্মকর্তার দক্ষতা, যোগ্যতা ও স্বচ্ছতা। তদন্ত কর্মকর্তার পেশাগত সততা, দক্ষতা, ব্যক্তিগত মূল্যবোধ ও দায়িত্ব পালনে নির্মোহ ভূমিকা মামলার ভাগ্য নির্ধারণে পালন করে শক্তিশালী ভূমিকা। মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র এবং আনুষঙ্গিক নথিপত্রে অসম্পূর্ণতা, অস্পষ্টতা কিংবা ত্রুটি-বিচ্যুতি মামলার মেরিটকে অনিবার্যভাবে দুর্বল করে, যা আইনের জাল ছিন্ন করে অপরাধীর বেরিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করে। অনেক মামলার রায়ে বিচারকের পর্যবেক্ষণে এসব অসংগতি ধরা পড়ে। যেমন অনেক ক্ষেত্রে মামলার জব্দ তালিকা থাকে, কিন্তু আলামত থাকে না, কিংবা জব্দ তালিকার সঙ্গে আলামতের অসংগতি থাকে। মামলার শুনানিতে তুলে ধরা এসব ব্যত্যয়-বিচ্যুতি অপরাধীর অনুকূলে চলে যায়।
রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন, ভিসেরা ও সুরতহাল প্রতিবেদনে শ্লথতা, কিংবা কারও প্রতি বৈরিতা বা করুণা পুলিশি তদন্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মামলা তদন্তে উদাসীনতা ও অবহেলা মামলা জটের কারণ। আবার তদন্তে তাড়াহুড়া বা অতি দ্রুততা ন্যায়বিচার বিনষ্টের কারণ। পুলিশি তদন্তের তথ্য-উপাত্ত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে অপরাধীর সাজা বা নির্দোষ ব্যক্তির অব্যাহতি নিশ্চিত করতে হয় বিচারককে। বিচারকের সম্মানিত আসনটি অভিযুক্তকে এক কলমের খোঁচায় শাস্তি বা মুক্তি দেওয়ার জন্য নয়। বিচারকের নির্ভুল রায়ের পথ উন্মুক্ত হয় নিখুঁত তদন্তের মাধ্যমে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের আদর্শ সমুন্নত রেখে যে তদন্ত সম্পাদিত হয়, তা বিচার-প্রক্রিয়ার ‘মেরুদণ্ড’ হিসেবে কাজ করে। এ মেরুদণ্ড দুর্বল হলে মামলার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। মূলত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও ন্যায়ের পথে নিষ্ঠাবান একজন পুলিশ কর্মকর্তার যথার্থ তদন্তই বিচারকের বিচারিক চোখ উন্মোচন করে দেয় এবং মামলার বিচার কার্যক্রমকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেয়।
সুতরাং মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে নিখুঁতভাবে পরিবেশনের পূর্বশর্ত হলো তদন্ত কর্মকর্তার পেশাগত জ্ঞান, সততা ও সুনাম। তদন্ত প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হবে কর্মকর্তার জ্ঞান, যুক্তি ও প্রজ্ঞা। তদন্তের আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং তদন্তে মন্থরতা ও দীর্ঘসূত্রতার যে সংস্কৃতি, তা আইনের শাসনের পরিপন্থী। নৈতিক চেতনা আরও উন্নত করতে প্রয়োজন পুলিশের জীবনমান উন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি। শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ফৌজদারি বিচারকাঠামোয় পুলিশি তদন্তের দক্ষতা ও স্বচ্ছতা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পাথেয় ও প্রেরণা। অপরাধ দমনে যেমন প্রয়োজন অদম্য শক্তি ও সাহস, মামলা তদন্তেও চাই দক্ষতা ও স্বচ্ছতার বহিঃপ্রকাশ।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: সাবেক প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, বর্তমানে মিল্ক ভিটার এমডি।
No comments