ভারতের গণতন্ত্রের ‘প্রদর্শনী’ by শশী থারুর
ভারতের স্বাধীন নির্বাচন কমিশন আগামী
সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। বিশ্বের একক বৃহত্তম গণতান্ত্রিক
ভোটাধিকার চর্চার এ কার্যক্রম চলবে আগামী ৭ এপ্রিল থেকে ১২ মে পর্যন্ত
দীর্ঘ ৩৭ দিন ধরে, নয়টি পর্বে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভোট গ্রহণের তারিখের
মধ্যে থাকবে এক সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যবধান। ৮১ কোটি ৪০ লাখ ভোটার একটি নতুন
(এবারেরটি ষোড়শ) পার্লামেন্ট তথা সরকার নির্বাচিত করবেন। দেশজুড়ে নয় লাখ ৩০
হাজারেরও বেশি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ৫০০টির বেশি রাজনৈতিক
দলের ১৫ হাজার প্রার্থী থেকে নিজেদের প্রতিনিধি বেছে নেবেন ভারতের ভোটাররা।
গণতন্ত্র নিঃসন্দেহে একটি প্রক্রিয়া, এটি কোনো একক ঘটনা নয়। কিন্তু ভারতে
নির্বাচন প্রকৃতই ঘটনার সমাহার, যা প্রতিবারই প্রশংসা কুড়ায়। এ দেশের
নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের চালচিত্রই এর কারণ। ভারতে নির্বাচন মানেই সুবিশাল
উপকরণ ও নিরাপত্তাগত চ্যালেঞ্জ আর অসংখ্য বিচিত্র ভাষার সংশ্লিষ্টতা।
অক্ষরজ্ঞানহীন ভোটারদের সুবিধার জন্য এখানে প্রার্থীরা শুধু নামে নন,
প্রতীক দিয়েও চিহ্নিত হন।
ভারতে নির্বাচনী পোস্টার, ভোটার তালিকা ও ব্যালট পেপারের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কাগজ তৈরিতে ভালো আকারের একটি বনের সমপরিমাণ গাছ লাগে। দেশে তৈরি হাজার হাজার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ভারতের গরম, ধুলাবালু আর লোডশেডিংয়ের ধকল সহ্য করে ভোট গণনার সময় না হওয়া পর্যন্ত নিরাপদে ফলাফল সংরক্ষণ করে। অনেক সময় এ গণনা হয় কয়েক সপ্তাহ পরে। কারণ, শেষ ভোটটি না পড়া পর্যন্ত তা শুরু হয় না। এবার ভোট গণনার তারিখ ১৬ মে। তা ছাড়া প্রতি নির্বাচনেই অন্তত একটি কাহিনি পাওয়া যাবে, যাতে নির্বাচনী কর্মকর্তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে তুষারপাত বা দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মতো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়েন।
তার পরও বলতে হয়, কিছু বৃহত্তর বিষয় এই ব্যাপক নির্বাচনী কর্মযজ্ঞের আড়ালে থেকে যায়, যা উপেক্ষা করা চলবে না। ভারতের নির্বাচন কালক্রমে দেশটির রাজনৈতিক ক্ষমতার মঞ্চের পরিসর অনেক বাড়িয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা এ দেশের আইন পরিষদগুলোর শ্রেণীগত গঠন বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী বছরগুলোতে এতে উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবীদের আধিক্য থাকলেও সেই চিত্রটি বদলে গিয়ে এমপিরা এখন বিচিত্র এক গোষ্ঠী। এখন আইনসভার সদস্যদের মধ্যে গ্রামীণ ভারতের প্রতিফলনই বরং বেশি।
তবে বিশেষ করে উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলোতে সংবাদপত্রের ভাষায় ‘মাফিয়া ডন’, ‘ডাকাত সর্দার’ ও ‘সমাজবিরোধী’ হিসেবে পরিচিতদের যে লোকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করছেন, তা ভারতের গণতন্ত্রে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ভূমিকাকে অস্বস্তিকর প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। গত চারটি লোকসভার অন্তত ১০০ জন সদস্যের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ছিল। এতে করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ ধীরে ধীরে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে গেছে। তাদের ভোট দেওয়ার হারও ক্রমেই কমছে।
তবে দরিদ্ররা ঠিকই ভোট দেন। যুক্তরাষ্ট্রে চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানে গরিবেরা বেশি সংখ্যায় ভোট দেন না। বারাক ওবামা নির্বাচিত হওয়ার আগে নিউইয়র্কের হার্লেমের কৃষ্ণাঙ্গদের গড়ে মাত্র ২৩ শতাংশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতেন। কিন্তু ভারতে এর বিপরীতটাই সত্য। এখানে গরিবেরাই প্রখর রোদে পুড়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেন। এ আশায় যে তাঁদের ভোটে কিছু পরিবর্তন আসবে। অন্যদিকে তাঁদের অভিমত বা সংখ্যা ভোটের ফলাফল প্রভাবিত করতে সামান্যই ভূমিকা রাখবে, এটা জেনে অধিকতর সুবিধাভোগী শ্রেণীর ভোটাররা ঘরে বসে থাকেন। ভারতে ভোটের বিষয়ে সমীক্ষায় বরাবরই দেখা গেছে, সবচেয়ে গরিবেরা জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি হারে ভোট দেন। অন্যদিকে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা ভোট দেন জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশ কম হারে।
স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের রাজনীতিক ও আমলাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় পরিবর্তন গণতন্ত্রের সক্রিয়তারই প্রমাণ। তবে অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন, সাধারণভাবে দেশের রাজনীতিক শ্রেণীর যে নিম্নমান, তা নিয়ে উৎফুল্ল হওয়ার অবকাশ নেই। ক্ষমতাকে অভিন্ন কল্যাণের জন্য কাজে লাগানোর দক্ষতা নয়, বরং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় গুণের প্রতিফলনই ভারতের সাংসদদের মধ্যে ক্রমশ বেশি করে দেখা যাচ্ছে। নৈরাশ্যবাদীদের অনেকেই ভারতের গণতন্ত্রকে এমন একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেন, যেখানে অপরাধী, দুর্নীতিবাজ পুলিশ, সুযোগসন্ধানী ও তদবিরবাজ, মাস্তান ও দালাল, কমিশনভোগী ও ঘুষখোর রাজনীতিক ও আমলা, মাফিয়া ডন ও ব্যক্তিগত গুন্ডাবাহিনী, বর্ণভিত্তিক কর্মী ও ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের লাগামহীন রাজত্ব চলছে।
তার পরও গণতন্ত্রই কিন্তু ভারতের প্রতিটি ধর্ম-বর্ণ ও সংস্কৃতির মানুষকে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ করে দিচ্ছে। কোথাও সামাজিক নিপীড়ন বা বর্ণবাদের অত্যাচার থাকলে (বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ভুক্তভোগীদের প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ করে দেয়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন নির্বাচনের বিজয়ীদের মধ্যে রয়েছেন প্রথাগতভাবে অনগ্রসর শ্রেণীর কিছু প্রতিনিধি। ব্যালটের ক্ষমতার জোরেই কিন্তু তাঁরা ওই স্থানে পৌঁছতে পেরেছেন, যার কথা তাঁদের পূর্বপুরুষেরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্যের এর চেয়ে চমকপ্রদ নজির আর হতে পারে না।
আবার এ কথাও মানতেই হয় যে নির্বাচন অনেককে উগ্রপন্থী মতামত প্রচারের সুযোগ করে দেয়। অনেকে আছেন যাঁরা ভারতকে একটি
হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান, যা হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের নিয়ে হিন্দুদের জন্য একটি আবাসভূমি। অনেকে আছেন যাঁরা বিদেশি বিনিয়োগের
ওপর সংরক্ষণবাদী বিধিনিষেধ আরও কঠোর করতে চান। কেউবা মনে করেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যর্থতার চেয়ে বরং কেন্দ্রে কঠোর হাতের শাসন বেশি কাম্য।
আগামী মে মাসের নির্বাচনের বিজয়ী পক্ষ যখন সরকার গঠন করবে, তখন তাদের চ্যালেঞ্জ হবে বাইরের কোনো শক্তির পরোয়া না করে বিপরীতমুখী আদর্শ ও স্বার্থে ভরা ভারতে বহুত্ববাদিতার আদর্শকে টিকিয়ে রাখা। তাদের জনগণের সৃষ্টিশীল শক্তিকে মুক্ত করে তাকে পূর্ণতা দিতে সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যে বিচ্ছিন্নতার বদলে ঐক্যকেই এগিয়ে নেবে, সে ব্যাপারে আমি একরকম নিঃসন্দেহ। ভারত বলতে আমাদের শুধু বুঝতে হবে ঐক্যবদ্ধ ভারতকেই, যা এর বিচ্ছিন্ন অংশগুলোর যোগফলের চেয়েও বেশি কিছু।
বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতোই ভারতেও সব সময়ই ডিক্রি আর ধর্মযুদ্ধ (যেখানে কট্টরপন্থার রমরমা থাকবে আর ভিন্নমত দমন করা হবে কঠোরভাবে) এবং সহনশীলতা, ভিন্নমত ও সহযোগিতাকে স্বীকৃতি দিয়ে এর চর্চা করা হয় এমন দুটি ভিন্ন জগৎ থাকবে। নির্বাচনের এই ক্ষণে বিশ্বজনসংখ্যার এক-ষষ্ঠাংশের আবাসভূমি ভারতের উচিত দ্বিতীয় জগৎটির এক শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত তুলে ধরা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: ভারতের মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী।
No comments