নদীর জন্য আমরা কী করেছি?
আমরা সেই জাতি যে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা করতে জানি না। তার প্রকৃত দৃষ্টান্ত হচ্ছে নদীর পরিচর্যা না করা। হাজার বছর আগে আমাদের নদী ছিল সহস্রাধিক। বর্তমানে ছোট-বড় মিলে নদ-নদীর সংখ্যা সাত শতাধিক বলা হলেও কার্যত নদীর সংখ্যা ২৩০। মূলত অযত্নেই বিলীন হয়েছে এ নদীগুলো। দেশের বুক চিরে বয়ে চলা নদীগুলো আমাদের জন্য আশীর্বাদ ছিল। আমরা এ নদীগুলোর পরিচর্যা করিনি। সর্বোচ্চ যতখানি অবহেলা প্রদর্শন করা যায়, আমরা তা-ই করেছি। নদীকে যদি আমরা শত্রু হিসেবে গণ্য করতাম, তাহলেও সাবধান হতাম। প্রতিদিন যেন আমরা নদীর টুঁটি টিপে হত্যা করি। নির্মম সেই হত্যাকাণ্ড। আমাদের চোখের সামনে প্রবহমান নদীগুলোয় এখন আর কোনো প্রবাহ নেই। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও আমরা অনেক নদীর প্রবাহ বন্ধ করেছি। আমাদের দেশের নদীগুলো হতে পারত যোগাযোগের অন্যতম পথ। আমরা সে কাজ করিনি। অত্যন্ত স্বল্প ব্যয়ে দেশের অভ্যন্তরে মালামাল পরিবহন করা যেত। দেশে রেলপথ তৈরি করার সময়ে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল ব্রিজ-কালভার্ট তৈরি করা। রেলপথের পাশাপাশি যখন আমাদের সড়কপথ সম্প্রসারিত হয়েছে, তখন অসংখ্য ব্রিজ-কালভার্ট করতে হয়েছে। আমরা জলপথের পরিবর্তে রেল ও সড়কপথ বেছে নিয়েছি। ব্রিজ-কালভার্টগুলোর মুখে থাকে জলের গভীরতা। সেই গভীরতার চারদিক দিয়ে প্রথমত বাঁশের বেড়া দিয়ে মাছ ধরা চলতে থাকে। আস্তে আস্তে সেই ব্রিজের মুখে গভীর জলাশয় ঘিরে আল দিয়ে পুকুর তৈরি করা হয়েছে। এভাবে হাজার হাজার ব্রিজ-কালভার্টের মুখ বন্ধ করে মাছ চাষ হচ্ছে। ফলে শুধু পানিপ্রবাহই বন্ধ হয়নি, অল্প বৃষ্টিতেই ছোট্ট ছোট্ট স্থানগুলোয় বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। জলের অসংখ্য ক্ষীণধারা একখানে মিলিত হয়ে জলের বিশাল প্রবাহ সৃষ্টি হয়।
কিন্তু সেই ক্ষীণ প্রবাহগুলো বন্ধ হওয়ায় মূল নদী তার যৌবন হারাতে বসেছে। আমাদের দেশে অনেক নদী শুধু খননের অভাবে প্রাণ হারিয়েছে এবং হারাচ্ছে। বর্ষাকালে নদী যখন দুই পাড় ভাঙে, তখন ভেঙে যাওয়া মাটিগুলো দিয়ে নদী ভরাট হয়। ভরাট হওয়া স্থানগুলো খননের মাধ্যমে গভীর করা প্রয়োজন। খনন করা হয় না বলে পরবর্তী বছরে যখন বর্ষা মৌসুমে নদী ভরে যায়, তখন গভীরতা না থাকার কারণে নদীর দুই পাড় ভাঙতে থাকে। যেহেতু গভীরতা কম, তাই পাড় ভেঙে ভেঙে নদী তার স্থান তৈরি করে নেয়। এতে নদী বাঁক পরিবর্তন করে এবং নতুন নতুন এলাকা নদীতে বিলীন হয়। নদীগুলো যদি খনন করা হতো এবং একই সঙ্গে পাড় বেঁধে দেওয়া হতো, তাহলে নদীর পাড় ভাঙত না। আমাদের দেশে যখন বন্যা দেখা দেয়, তখন শুরু হয় তৎপরতা। বন্যার মৌসুম শেষ হলে আমরা আবার ভুলে যাই নদীর কথা। দেশীয় তত্ত্বাবধানে অনেক নদীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। আবার অনেক নদী আছে, যেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে নিজস্ব তত্ত্বাবধান ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন। তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-ধরলাসহ অনেক নদ-নদী রয়েছে, যেগুলো বাঁচাতে পাশের দেশেরও সহযোগিতা প্রয়োজন। তিস্তা নদী বর্তমানে আলোচনার শীর্ষে। তিস্তার উজানে ভারত। এই নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ভারতের সহযোগিতা অবশ্যই প্রয়োজন। তিস্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই তিস্তায় বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে যে সামান্য পরিমাণ পানিপ্রবাহ আসে, এতে সম্ভব নয়। বর্ষা আসতে এখনো দুই মাস বাকি। এরই মধ্যে তিস্তার পানিপ্রবাহ একেবারেই নেমে এসেছে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের কাছে এখন পানির পরিমাণ প্রায় ৪০০ কিউসেক। এর নিচে পানির পরিমাণ কখনোই নেমে আসেনি। এই পানি দিয়ে সেচ প্রকল্প চলবে না। দ
বিতীয় পর্যায়ে যে তিস্তা সেচ প্রকল্প শুরু হওয়ার কথা ছিল, সেটা সম্ভব হবে না এমনকি প্রথম পর্যায়ের যে প্রকল্পটি চলছে, তা-ও বন্ধ হবে। কয়েক বছর ধরেই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার শেষ নেই। এই আলোচনার ফল এখন পর্যন্ত শূন্য। আলোচনার যে ধরন, তাতে মনে হচ্ছে, এ আলোচনা শেষ পর্যন্ত প্রহসনই থেকে যাবে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে হলে আসলে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ও ভারতে উভয় দেশেই সুশীল সমাজ, মানবাধিকারকর্মী, নদী সংগঠনের সংগঠক, সাংবাদিকসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রথমত যে নদী-তীরবর্তী মানুষের অধিকার নদীতে, সেটার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। তা ছাড়া তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি প্রায় অসম্ভব। কেন্দ্রীয় সরকার সম্মত হলেও অনেক সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজি হচ্ছে না। এভাবে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি বিলম্ব করার সুযোগ নেই। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নেওয়া প্রয়োজন। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি না হলে মানুষের জীবন ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাংলাদেশের পানির প্রধান উৎস। যত দূর শোনা যাচ্ছে, চীন উজানে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথই বদলে দেবে। যদি তা-ই হয়, তাহলে তিস্তার পানি না পেলে ভয়াবহতা সৃষ্টি হবে। ব্রহ্মপুত্রের পানি না পেলে দেশব্যাপী পানি-সংকটে ভুগতে হবে। আমাদের সব ব্রিজ-কালভার্টের সামনে থেকে পানিপ্রবাহের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। আমাদের বড় ও ছোট নদীগুলো খনন করতে হবে এবং পাড় বেঁধে দিতে হবে। নদী আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক নদীগুলো রক্ষায় বক্তব্যসর্বস্বতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশের দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, নদী নিয়ে চুক্তির ব্যাপারে পানিসম্পদমন্ত্রীকে সংশ্লিষ্ট করা হয় না। সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী বিশ্ব নদী দিবস সম্পর্কে জানতেনই না। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নদীবিষয়ক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল রিভার্স ব্রাজিলে এক সম্মেলনে ১৯৯৭ সালে নদীকৃত্য দিবস চালু করে। বিশ্বের অনেক দেশেই দিবসটি উদ্যাপিত হয়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়া সত্ত্বেও সরকারি কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয় না এ দিবসটি উদ্যাপনের। নদীর জন্য আমাদের রাষ্ট্র বিশেষ কিছু করে না। রাষ্ট্র নদীর জন্য কাজ করুক—এটাই আমাদের প্রত্যাশা। শুধু আইন পাস করা নয়, নদীর পরিচর্যা আমাদের প্রয়োজন।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও সিনেটর, রিভারাইন পিপল।
wadudtuhin@gmail.com
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও সিনেটর, রিভারাইন পিপল।
wadudtuhin@gmail.com
No comments