‘ফিরিয়ে দাও আমার বারোটি বছর...’
১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলার রায় ঘোষণার পর কেন জানি প্রথমেই বদনী মেম্বারের কথা মনে পড়েছিল আমার। বদনী মেম্বার নামে এলাকার মানুষ চেনেন তাঁকে। আনোয়ারার খোট্টাপাড়া গ্রামে এই নামে এত ব্যাপক তাঁর পরিচিতি, ভালো নাম যে মরিয়ম বেগম, এ কথাই জানেন না অনেকে। গত তিন মেয়াদে খোট্টাপাড়ার নির্বাচিত ইউপি মেম্বার তিনি। তো, অস্ত্র মামলার এত জাঁদরেল সব আসামির নাম ছাপিয়ে তাঁর কথাই বা প্রথমে মনে পড়ল কেন? পড়ল, কারণ এই অস্ত্র মামলার আট নম্বর আসামি ছিলেন তিনি। ১০ ট্রাক মামলায় যেখানে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ও তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-আমলাদের হাত রয়েছে বলে তথ্য বেরিয়ে আসছিল, সেখানে এক গ্রাম্য মহিলার নাম জড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাটি কৌতূহলী করে তুলেছিল আমাকে। ২০০৫ সালের কোনো এক দিন (তারিখটা মনে নেই) সাংবাদিকসুলভ কৌতূহলে ছুটে গিয়েছিলাম আনোয়ারার খোট্টাপাড়া গ্রামে। সঙ্গে ছিলেন সহকর্মী প্রথম আলোর আনোয়ারা থানা প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন। বাড়ি চিনতে কোনো অসুবিধা হলো না। গ্রামের মানুষ সবাই চেনেন তাঁর বাড়ি। তাঁকে আড়ালে ‘দস্যু ফুলন’ ডাকা হয় এমন কথা শুনেছি গ্রামের মানুষের কাছেই। এ রকম নামকরণ কেন হলো,
তার ঈষৎ নমুনা পেলাম বাড়ির প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে। ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছিল বদনী মেম্বারের বাজখাঁই গলা। সালিস করতে বসেছেন তিনি। স্ত্রীর ওপর নির্যাতনকারী এক পুরুষকে যেভাবে বাক্যবাণে বিদ্ধ করছিলেন তিনি, তাতে অভিযুক্ত ব্যক্তির অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাওয়ার কথা। ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দেখলাম, চেয়ারে বসে আছেন বদনী মেম্বার। তাঁর সামনে কাঁচুমাচু বদনে দাঁড়িয়ে আছেন অভিযুক্ত। তবে নিজের এলাকায় যত দাপুটেই হোক, মরিয়ম বেগম ওরফে বদনী মেম্বার আসলে খুব সাধারণ বাঙালি মুসলমান পরিবারেরই এক নারী। তাই যেখানে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলাকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলছেন ‘হাইপ্রোফাইল মামলা’ বা রায় ঘোষণার পর আসামিপক্ষ পাল্টা বলছে ‘হাইপ্রোফাইল পলিটিক্যাল রায়’, সেখানে এই মরিয়ম বেগম কেন আট নম্বর আসামি হলেন, সেটা বড় প্রশ্ন হয়ে আছে অনেকের কাছে। সেই প্রশ্নটাই আমি করেছিলাম তাঁকে, ‘কেন আপনাকে আসামি করা হয়েছিল?’
খুব অল্পে রেগে যাওয়ার অভ্যাস তাঁর, সেই রাগ সামলে জবাব দিলেন, ‘কেন আবার, আসল দোষীকে আড়াল করতে।’ খুব বিমর্ষ হয়ে মরিয়ম বেগম বললেন, ‘পাঁচ মাস জেল খেটেছি বিনা দোষে। অনেক টাকা খরচ হয়েছে। আমাদের এই পাড়ার লোকজনকে শুধু শুধু আসামি করেছিল। এজাহারে নাম ছিল না। কিন্তু অভিযোগপত্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এখন আল্লা মুক্তি দিয়েছেন। অপবাদ থেকে মুক্তি পেলাম আমরা।’ মরিয়ম বেগমের মতো অপবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছেন খোট্টাপাড়ার আরও ১৪ জন মানুষ। ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলায় আসামি করা হয়েছিল এ পাড়ার ১৭ জনকে। তাঁদের মধ্যে দুজন মৃত্যুবরণ করেছেন অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়েই। দ্বীন মোহাম্মদ নামের একজনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। বাকি ১৪ জন বেকসুর খালাস। বিচারের রায়ে খালাস পেয়ে কেউ ছুটছেন মাজার জিয়ারত করতে, কেউ বা মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করেছেন বাড়িতে। এই মানুষগুলোর জীবনের ১০টি বছর কেটেছে মামলার বোঝা কাঁধে নিয়ে। ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ হয়তো জানবে না কী দুঃসহ সেই কষ্টের বোঝা! খোট্টাপাড়ার মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল গ্রামসংলগ্ন সিইউএফএল ঘাটকে ঘিরে। কেউ ঠিকাদারি, কেউ পরিবহন কেউ বা এমনকি কুলি-কামিনের কাজও করতেন। খোট্টাপাড়ার মানুষের আর কোনো অপরাধ কি ছিল না? ছিল।
খুব অল্পে রেগে যাওয়ার অভ্যাস তাঁর, সেই রাগ সামলে জবাব দিলেন, ‘কেন আবার, আসল দোষীকে আড়াল করতে।’ খুব বিমর্ষ হয়ে মরিয়ম বেগম বললেন, ‘পাঁচ মাস জেল খেটেছি বিনা দোষে। অনেক টাকা খরচ হয়েছে। আমাদের এই পাড়ার লোকজনকে শুধু শুধু আসামি করেছিল। এজাহারে নাম ছিল না। কিন্তু অভিযোগপত্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এখন আল্লা মুক্তি দিয়েছেন। অপবাদ থেকে মুক্তি পেলাম আমরা।’ মরিয়ম বেগমের মতো অপবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছেন খোট্টাপাড়ার আরও ১৪ জন মানুষ। ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলায় আসামি করা হয়েছিল এ পাড়ার ১৭ জনকে। তাঁদের মধ্যে দুজন মৃত্যুবরণ করেছেন অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়েই। দ্বীন মোহাম্মদ নামের একজনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। বাকি ১৪ জন বেকসুর খালাস। বিচারের রায়ে খালাস পেয়ে কেউ ছুটছেন মাজার জিয়ারত করতে, কেউ বা মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করেছেন বাড়িতে। এই মানুষগুলোর জীবনের ১০টি বছর কেটেছে মামলার বোঝা কাঁধে নিয়ে। ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ হয়তো জানবে না কী দুঃসহ সেই কষ্টের বোঝা! খোট্টাপাড়ার মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল গ্রামসংলগ্ন সিইউএফএল ঘাটকে ঘিরে। কেউ ঠিকাদারি, কেউ পরিবহন কেউ বা এমনকি কুলি-কামিনের কাজও করতেন। খোট্টাপাড়ার মানুষের আর কোনো অপরাধ কি ছিল না? ছিল।
বন্দরসংলগ্ন এলাকা বলে এখানে ছোটখাটো কিছু চোরাচালানোর ঘটনা ঘটত প্রায়ই। জাহাজ থেকে বিদেশি সিগারেট, টেলিভিশন বা এ রকম কিছু পণ্যের অবৈধ বিকিকিনি চলত। স্থানীয় পুলিশও অবহিত ছিল। খুব সম্ভবত নিয়মিত বখরা পেয়ে চুপচাপ থাকত তারাও। এমনকি বদনী মেম্বারেরও এসব বিষয়ে প্রশ্রয় ছিল বলে লোকমুখে জেনেছিলাম তখন। ধারণা করি, এসব ‘দুর্বলতাকে’ই কাজে লাগিয়েছিল তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সিইউএফএল ঘাটে অস্ত্র আটকের সেই ‘বিরাট কর্মযজ্ঞের’ দায় চাপানো হয়েছিল এই চুনোপুঁটিদের কাঁধে। খোট্টাপাড়ার কথা তো গেল। এই অস্ত্র মামলার আসামি পুলিশের দুই সদস্যের কাহিনি আরও করুণ। বলতে গেলে পুলিশের এই দুই সার্জেন্ট হেলাল উদ্দিন ও আলাউদ্দিনের সাহসিকতা ও দায়িত্বশীলতার কারণেই উদ্ধার হয়েছিল ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালানটি। এপ্রিল মাসে কয়লা ডিপো পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ছিলেন হেলাল উদ্দিন। ওই একই সময়ে সার্জেন্ট আলাউদ্দিন ছিলেন বন্দর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ। ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের রাতে এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা সিইউএফএল ঘাটে ছুটে যান। ঘটনাস্থল থেকে বেতার মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে অস্ত্রের ব্যাপারে খবর দেন। তাঁদের দেওয়া খবরের ভিত্তিতেই ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ভেবেছিলেন পেশাগত দায়িত্ব পালনে এই সাহস ও সততার জন্য পুরস্কৃত হবেন তাঁরা। কিন্তু পুরো ব্যাপারটি হঠাৎ এমন উল্টো দিকে মোড় নেবে কল্পনাও করতে পারেননি তাঁরা। অস্ত্র আটকের পর যে পাঁচজনকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয়েছিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে, তাঁদের তো ছেড়ে দেওয়া হলোই, উপরন্তু খড়্গ নেমে এল সাহসী দুই পুলিশ কর্মকর্তার ওপর। ১০ ট্রাক অস্ত্র থেকে দুটি একে-৪৭ রাইফেল খোয়া গেছে এবং সেগুলো এই দুই কর্মকর্তা চুরি করে বিক্রি করেছেন এই অভিযোগে নির্মম অত্যাচার চালানো হয় তাঁদের ওপর।
পিটিয়ে পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে সার্জেন্ট হেলালের। দুর্ধর্ষ আসামির মতো পায়ে ডান্ডা বেড়ি পরিয়ে তাঁকে হাজির করা হয়েছিল আদালতে। দুই বছর চার মাস কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটাতে হয়েছে তাঁকে। একই ধরনের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সার্জেন্ট আলাউদ্দিনও। অথচ সরকার পরিবর্তনের পর অপরাধ তদন্ত বিভাগের রিপোর্টে দেখা যায়, ১০ ট্রাক অস্ত্রের মধ্যে কোনো একে-৪৭ রাইফেলই ছিল না। ২০০৫ থেকে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট পর্যন্ত দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছে হেলালের পরিবার। হেলালের মা-বাবা দুজনই স্কুলশিক্ষক। সেই শিক্ষক দম্পতির ছেলে হেলালের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল অপরাধী হিসেবে। হেলাল উদ্দিন ও আলাউদ্দিন চাকরি ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু কে ফিরিয়ে দেবে তাঁদের হারানো সময়? সার্জেন্ট আলাউদ্দিন যেমন পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘সব মানুষের কাজের একটি পিক টাইম থাকে। আমি তো জীবনের সেই সময় হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমি বৃদ্ধ। ছয় বছর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার শেষে নতুন জীবন পেয়েছি বটে, তবে সে জীবনের কোনো স্বাদ নেই। আমার পুরো জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। সামাজিক জীবনে আমি আর আমার পরিবার ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই পাইনি। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার জীবনটা তছনছ হয়ে গেল।’ আজ বদনী মেম্বার, খোট্টাপাড়ার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলো আর দুই দায়িত্ববান পুলিশ কর্মকর্তার মনেও হয়তো ঘুরছে সুচিত্রা সেনের সেই সংলাপ ‘ফিরিয়ে দাও আমার বারোটি বছর...’। তাঁদের জীবনের সোনালি সময়গুলো কে ফিরিয়ে দেবে?
মামলা, তদন্ত, বিচার-প্রক্রিয়ায় যত দিন ‘ওপর মহলের’ হাত থাকবে, তত দিন এই অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে না আমাদের। তত দিন দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে কোনো না কোনো নির্দোষ ব্যক্তির বুক ভেঙে নেমে আসবে এ রকম হূদয়-নিংড়ানো দীর্ঘশ্বাস!
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com
মামলা, তদন্ত, বিচার-প্রক্রিয়ায় যত দিন ‘ওপর মহলের’ হাত থাকবে, তত দিন এই অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে না আমাদের। তত দিন দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে কোনো না কোনো নির্দোষ ব্যক্তির বুক ভেঙে নেমে আসবে এ রকম হূদয়-নিংড়ানো দীর্ঘশ্বাস!
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com
No comments