রাজনীতি ও অর্থনীতি- ব্যাংকঋণ পুনর্বিন্যাসের প্রণোদনা by ফারুক মঈনউদ্দীন
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং
প্রবিধি এবং নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) অতিসম্প্রতি দুটো সার্কুলারের মাধ্যমে
মেয়াদোত্তীর্ণ এবং খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন,
পুনঃ তফসিলীকরণ এবং
ডাউন পেমেন্ট আদায়ের ব্যাপারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কিছুটা নমনীয় হওয়ার
সুযোগ করে দিয়েছে। উভয় সার্কুলারে স্বীকার করা হয়েছে দেশের অস্থিতিশীল
(রাজনৈতিক) পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও শিল্প খাতের উপকরণ ও
পণ্যের স্বাভাবিক পরিবহন বিঘ্নিত হয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিরূপ প্রভাব
পড়ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা হারাচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি
শিল্প।
এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির সব খাতের ঋণখেলাপি হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই বিবেচনায় ঋণগ্রহীতা এবং ঋণদানকারী ব্যাংক—উভয় পক্ষের নাজুক অবস্থার কথা বিবেচনা করে এই দুই সার্কুলারের মাধ্যমে ডাউন পেমেন্ট আদায়, সুদের হার নির্ধারণ এবং ঋণ পুনর্গঠন কিংবা পুনঃ তফসিলীকরণের বিষয়টি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার শর্ত সাপেক্ষে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এসএমই কিংবা কৃষিঋণ ছাড়া অন্যান্য ঋণের মেয়াদকাল পুনর্গঠন করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। উল্লেখ্য, এই শিথিলতার সুযোগ গ্রহণের মেয়াদ ৩০ জুন ২০১৪ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
স্মরণে থাকার কথা, ২০০৯ এবং ২০১০ সালে ভোগ্যপণ্য, ইস্পাত—এসব খাতে বিশ্বমন্দার কবলে পড়ে বহু আমদানিকারক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হলেও শেয়ারবাজারের উল্লম্ফনের সময় এবং পতনের আগে পর্যন্ত ব্যাংকগুলো এই বাজার থেকে প্রচুর মুনাফা তুলে নিতে পেরেছিল। ২০১০ সালের শেষ প্রান্তে এসে শেয়ারবাজারের সেই মাতাল বুদ্বুদ বিস্ফোরিত হলে বহু অসতর্ক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী প্রায় পথে বসে যান, তার সঙ্গে আটকা পড়ে যায় বিভিন্ন ব্যাংকের বিপুল ঋণ। বিশ্বের পণ্য বাজারের পতনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আটকে পড়া ঋণের সঙ্গে যুক্ত হয় শেয়ারবাজারে লগ্নি করা ঘোষিত এবং অঘোষিত বিপুল ঋণ। এই ঋণের মধ্যে সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ভোক্তা ঋণ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেওয়া ব্যবসায়িক ঋণ।
এমন পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় ব্যাংকগুলো যখন খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় কঠিন সময় পার করছিল, তখন ২০১২ সালের শেষে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ, মেয়াদ নির্ধারণ এবং ডাউন পেমেন্ট আদায়ের নিয়মগুলো আরও কঠোর করা হয়। সেই নতুন নীতিমালায় মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ৯০ দিনের সীমা অতিক্রম করলেই ‘নিম্নমান’ শ্রেণীকৃত হয়ে পড়ে, যার সীমা আগে ছিল ১৮০ দিন। একইভাবে আগের ২৭০ দিনের মেয়াদোত্তীর্ণ ‘সন্দেহজনক’ ঋণের সময়সীমা কমিয়ে করা হয় ১৮০ দিন এবং ৩৬০ দিনের মেয়াদোত্তীর্ণ ‘মন্দ’ শ্রেণীর মেয়াদ কমিয়ে করা হয় ২৭০ দিন।
ঋণ শ্রেণীকরণের এই কঠোরতর নীতিমালার কারণে বহু মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ দ্রুত শ্রেণীকৃত হয়ে পড়ে এবং প্রাথমিক ধাপের শ্রেণীকৃত ঋণগুলো আচমকা পরবর্তী বিরূপ ধাপে নেমে যায়। শ্রেণীকরণের আইন পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছিল ব্যাংকগুলোর ২০১২ সালের হ্রাসকৃত মুনাফায়। অথচ সে সময় ব্যবসায়ী মহল এবং ব্যাংকগুলোর অধিকাংশই ২০০৮-পরবর্তী বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য হ্রাসের ধকল সামলাতে ব্যস্ত। তবু একটি আন্তর্জাতিক মানের শ্রেণীকরণ নীতিমালা প্রবর্তনের স্বার্থে স্থিতিপত্রে বিরূপ ফলাফল সত্ত্বেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিবর্তিত নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে তৎপর হয়েছিল। তবে তার জন্য ২০১৩ সালে নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছিল ব্যাংকিং খাতের মোট শ্রেণীকৃত ঋণ।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত বছরে ব্যাংকিং খাতের নিট মুনাফা কমেছিল ১০৪ শতাংশ, যার প্রধান কারণ ছিল খেলাপি ঋণের উল্লম্ফন। মুনাফা হ্রাসের এই হার বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে ছিল ২৮ শতাংশ, অর্থাৎ সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতেই মূলত মুনাফা হ্রাস পেয়েছিল সবচেয়ে বেশি হারে। এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে ২০১১ এবং ২০১২ উভয় বছরেই ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা ছিল ১৯,৭০০ কোটি টাকা, অথচ নিট মুনাফা ছিল যথাক্রমে ৯,১০০ এবং ৪,৪০০ কোটি টাকা। দুই বছরে একই পরিমাণ পরিচালন মুনাফা থাকা সত্ত্বেও নিট মুনাফার এই বিশাল পার্থক্য থেকে সহজেই বোঝা যায়, ২০১২ সালের পরিচালন মুনাফার একটা বিশাল অংশ চলে গিয়েছিল শ্রেণীকৃত ঋণের বিপরীতে সংস্থান বাবদ। কারণ, কেবল বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে গিয়েছিল প্রায় ৮১ শতাংশ। (সাধারণ পাঠকদের জন্য জানানো প্রয়োজন, খেলাপি বা মন্দ ঋণের বিপরীতে পরিচালন মুনাফা থেকে নির্দিষ্ট হারে কুঋণ সংস্থান রাখতে হয়, যার ফলে কমে যায় নিট মুনাফা)।
এ ছাড়া বিরূপ বিনিয়োগ পরিবেশ, তারল্যসংকট, আমানতের উচ্চ সুদ ব্যয়, আমদানি বাণিজ্যে ভাটা—এসব কারণে ২০১২ সাল ব্যাংকগুলোর জন্য খুব সুখকর বছর ছিল না। তার সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যুক্ত হয় হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, যা ব্যাংকগুলোকে আরও নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়। এ রকম বিরূপ পরিস্থিতিতেও বিভিন্ন মহলের চাপ উপেক্ষা করে ঋণ শ্রেণীকরণ এবং পুনঃ তফসিলীকরণ নীতিমালা কঠোরতর করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে বাড়তি শ্রেণীকরণের চাপ হজম করে ব্যাংকগুলো নতুন বছর শুরু করার পরপরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়কে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতা পর্যবসিত হয় তাণ্ডবে, যার বৈশিষ্ট্য ছিল পরিকল্পিত নাশকতা। লক্ষণীয়, এই নাশকতা পরিচালিত হয়েছে অবকাঠামো—যেমন রেললাইন, সড়ক, ট্রেন ও যানবাহন, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সরকারি দপ্তর ইত্যাদির বিরুদ্ধে। সবচেয়ে অপূরণীয় ক্ষতি করা হয়েছে দেশের বৃক্ষ সম্পদের।
নজিরবিহীন এই সহিংসতা, জাতীয় ও ব্যক্তিগত সম্পদের ধ্বংসযজ্ঞ ইত্যাকার তৎপরতায় দেশের পরিস্থিতি যেমন ছিল উত্তাল, তেমনি স্থবির ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। ফলে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগবিমুখ হয়ে পড়েন, বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যায় উদ্বেগজনক হারে। তার বিরূপ প্রভাব পড়ে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ওপর। আগের বছরের বাড়তি শ্রেণীকৃত ঋণের বোঝা বাড়লেও নতুন ঋণ বিতরণ প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। ২০১৩ সালের নভেম্বরে ব্যাংকগুলোর বাড়তি তারল্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৬ হাজার কোটি টাকা, জানুয়ারিতে যা ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা, এ রকম অলস তহবিল ব্যাংক বা অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলকর নয়।
রাজনীতি কখনোই অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে চলতে পারে না। একসময় বাণিজ্য, উৎপাদন ও বণ্টন, জাতীয় আয় ও সম্পদ ইত্যাদির সঙ্গে সরকার ও কানুনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করার শাস্ত্রটিরই নাম ছিল রাজনৈতিক অর্থনীতি। সুতরাং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকার তথা রাজনীতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হয় দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু ২০১৩ সালের প্রায় পুরোটাজুড়েই একযোগে ও বিচ্ছিন্নভাবে চলেছে বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড, যার কুফল জাতি ভোগ করবে আগামী বছরগুলোতে।
গত বছরের এই অস্থিরতা ও ধ্বংসলীলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের উৎপাদন ও সুস্থির কর্মকাণ্ডের ধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ঋণ পুনর্বিন্যাস ও শ্রেণীকরণের নিয়মাচারে ছাড় দেওয়ার গৃহীত উদ্যোগ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প ও অর্থনীতির কতখানি ক্ষতি হয়েছে। পুনঃ তফসিলীকরণ, ডাউন পেমেন্ট এবং পুনর্গঠিত মেয়াদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত শিথিল নিয়মাবলি ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতাদের কিছুটা অবকাশ দিতে পারে।
এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করা হবে, নির্যাতিত সংখ্যালঘুরাও বিভিন্নভাবে সহায়তা ও অনুদান পেতে পারেন। তবে ঋণগ্রহীতা নন, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বস্বান্ত হয়েছেন দেশজুড়ে এমন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা নগণ্য নয়। এঁদেরও উৎপাদন ও বাণিজ্যের ধারায় নিয়ে আসার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কারণ, অর্থনীতিতে এই অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনাহীন খাতের অদৃশ্য সমধিক গুরুত্ববহ। এ ব্যাপারে এনজিও বা মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক দায়িত্বের আওতায় স্বল্প সুদে সহায়তা প্রদান করতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এই বিষয়ে দিতে পারে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা।
বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি বা মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ বিষয়ে যে শিথিলতার অবকাশ দিয়েছে, তার সুফল ঋণগ্রহীতাদের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও ভোগ করতে পারবে। কারণ, এতে শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের হার কমে আসার ফলে মন্দ ঋণ সংস্থানের পরিমাণও হ্রাস পাবে। তবে এই সুযোগের অপব্যবহার করে স্বেচ্ছাখেলাপি এবং ২০১৩-পূর্ব খেলাপি ঋণগুলো যাতে পুনর্গঠিত না করা হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। অনেক কিছুর বিনিময়ে আমাদের ব্যাংকিং খাতে আন্তর্জাতিক মানের ঋণ শ্রেণীকরণ এবং প্রকৃত মুনাফা প্রদর্শনের যে স্বচ্ছ নিয়ম চালু হয়েছিল, তা এই শিথিলতার সুযোগে যাতে বিনষ্ট না হয়।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
No comments