চাচার পাঁচালি- বাকশাল by মাহবুব তালুকদার
চাচা বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসলেই ঝানু পলিটিশিয়ান। নির্বাচনটা তিনি করিয়েই ছাড়লেন।
আমি বললাম, অপারেশন সাকসেসফুল, বাট পেশেন্ট ইজ ডেড।
আমি বললাম, অপারেশন সাকসেসফুল, বাট পেশেন্ট ইজ ডেড।
পেশেন্ট কোন বড় বিষয় নয়, বড় বিষয় হচ্ছে অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে কিনা! এক্ষেত্রে ডাক্তার
হাসিনা শতভাগ সফল। চাচা আরও বললেন, এরপর তার কাজ হচ্ছে মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার করা।
সেটা কি করে সম্ভব?
শেখ হাসিনার জন্য সবকিছুই সম্ভব। চাচা উদ্দীপ্ত হয়ে জানালেন, দেখছো না বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন তাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেভাবেই তারা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খালেদা জিয়া নির্বাচনে না আসার সমালোচনা পর্যন্ত করেছে রাশিয়া।
এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হয়ে গেল না?
তারা তো সরকার বা রাষ্ট্রের বিপক্ষে কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি। বিরোধী দলের কি করা উচিত ছিল আর কি করা উচিত হয়নি বললে তা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হয় কি করে? চাচা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, বলতে পারো বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন বর্জন করে কি অর্জন করলেন?
একটা প্রহসনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেই বা তিনি কি অর্জন করতেন?
শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলে তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী তো হতে পারতেন। এখন তার আমও গেছে, ছালাও গেছে। আওয়ামী লীগ আগামী ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে। সে জন্যই তো তারা ২০৪১ সাল পর্যন্ত রূপকল্প ঘোষণা করেছে।
তাহলে কি দেশে আর কোন নির্বাচন হবে না?
নির্বাচন অবশ্যই হবে। এবারের নির্বাচনে একটা মডেল তৈরি হয়ে গেছে। আশা করি নির্বাচন কমিশন মডেলটির স্থায়ী রূপ দেবে। এই মডেল অনুসরণ করলেই আওয়ামী লীগের পোয়া বারো। ‘শেখ হাসিনার সরকার বারবার দরকার’ স্লোগানটি এখন জাতীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছে।
চাচার কথাবার্তায় আমি রীতিমতো বিভ্রান্ত। আরও বিভ্রান্ত সরকারি দলের সিনিয়র নেতাদের কথাবার্তা শুনে। যেসব সরকারি নেতা ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ কিংবা ‘নিয়ম রক্ষার নির্বাচন’ বলে অভিহিত করেছেন, তারাই এখন বলছেন পাঁচ বছরের আগে আর কোন নির্বাচন নয়। নির্বাচন বিষয়ে সংলাপ হতে পারে পাঁচ বছর পরে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব পর্যন্ত এমন স্ববিরোধী উক্তি করেছেন। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? আমি চাচাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি যে নির্বাচনের মডেলের কথা বলেছেন, তা কি রকম?
সব কথা তো প্রকাশ্যে বলা যায় না। চাচা রহস্যময় হাসি হাসলেন। বললেন, বাংলাদেশে যে নির্বাচন হয়েছে, তাতে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যাপার ছিল, তা মানি। মেনিপুলেশনের ব্যাপার ছিল, তা-ও মানি। ভোটার সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, এ কথা স্বীকার করতেও আপত্তি নেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইলেকশন হয়েছে কিনা। যে কোন মূল্যে ইলেকশন হওয়াই হচ্ছে এই মডেল।
আমি বললাম, কিন্তু ইলেকশন গ্রহণযোগ্য হয়েছে কিনা, সেটা কোন ব্যাপার নয়?
চাচা দু’চোখে অগ্ন্যুৎপাত সৃষ্টি করে আমার দিকে তাকালেন। সরোষে বললেন, কার কাছে গ্রহণযোগ্য? কে গ্রহণযোগ্যতার সার্টিফিকেট দেবে? বিদেশীরা? ইলেকশনের ব্যাপারে আমরা তাদের বয়কট করেছি।
তাহলে আপনি বলছেন, নির্বাচন যথাযোগ্য হয়েছে?
চাচা কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে বললেন, তোমার এই ‘যথাযোগ্য’ শব্দটা আমার খুব মনঃপূত হয়েছে। সত্যি বলতে কি, আমাদের যোগ্যতা অনুসারে এই নির্বাচন ‘যথাযোগ্য’ হয়েছে। খোদ আমেরিকা পর্যন্ত নবনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বৃটিশ পার্লামেন্ট তো পুনরায় নির্বাচন দাবি করেছে।
যার বিয়ে তার মনে নেই, পাড়া-পড়শির ঘুম নেই। চাচা বললেন, বিদেশীদের দাবিনামা আস্তে আস্তে চাপা পড়ে যাবে। সবাই বুঝতে পেরেছে, দেশের মানুষ নির্বাচন মেনে নিয়েছে। যেসব দুষ্কৃতকারী নির্বাচন মেনে নেয়নি, সহিংসতার সৃষ্টি করেছে কিংবা উস্কানি দিয়েছে, তাদের পরিণতি তো চোখের সামনে দেখতেই পাচ্ছো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর মধ্যে দু’টি হার্ডল পার হলেন।
কি রকম?
প্রথমত তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করলেন এবং কৌশলে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখলেন। দ্বিতীয়ত তিনি বিএনপি থেকে জামায়াতকে বিচ্ছিন্ন করতে সফল হচ্ছেন এবং হয়েছেন।
কিন্তু জামায়াতকে তিনি নিষিদ্ধ করছেন না কেন? আমি বললাম।
নিষিদ্ধ করার দরকার কি? কাজ সুসিদ্ধ হলেই হলো। চাচা শান্তকণ্ঠে বললেন, একবারে নয়, জামায়াতকে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করা হবে। বিএনপিও ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
বিএনপি নিশ্চিহ্ন হবে কিভাবে?
ওরা তো ইলেকশনেই আসতে পারবে না। এরপর যত ইলেকশন হবে, সংবিধান মেনে নিয়ে সবই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই হতে হবে।
বিএনপি যদি তাতেই রাজি হয়ে যায়?
তখন নতুন কোন কৌশল করে ওদের বাদ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
এ কথার অর্থ কি?
নির্বাচন কমিশন যেন সরকারের সাহায্য ছাড়াই বিএনপিকে বসিয়ে দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে!
চাচা! একটা বিষয় আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
কি বিষয়?
নির্বাচনী প্রতীক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী অন্যান্য দলের সদস্যদের নৌকা প্রতীক ব্যবহার করার সম্মতি দিয়ে কমিশনে চিঠি দিয়েছেন। সে অনুযায়ী রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুরা নৌকায় চড়ে বৈতরণী পার হলেন। কিন্তু এরশাদ যখন লাঙ্গল প্রতীক ব্যবহারের অনুমতি না দিতে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিলেন, তার চিঠি আমলেই নেয়া হলো না। এক যাত্রায় এমন পৃথক ফল হয় কি করে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
এটাই তো নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার প্রমাণ। এরশাদের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী জেনেই তা কমিশন আমলে নেয়নি।
কিন্তু এরশাদকেও লাঙ্গল প্রতীক নিয়েই নির্বাচনে জিতিয়ে আনা হলো। তিনি তো নির্বাচনই করতে চাননি।
এটা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মহানুভবতা বলতে পারো। এরশাদ সাহেব নিজের ভালমন্দ বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। আসলেই তিনি খুব অসুস্থ। সত্যি কথা হলো, তিনি একজন মানসিক রোগী।
এ কি কথা বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি। মানসিক রোগী না হলে কেউ নিজের মাথায় পিস্তল ধরে! পিস্তলের ভেতরে যদি গুলিভর্তি থাকতো তখন কি হতো? বারবার যার মুখের কথা ফসকে যায়, তার হাত ফসকে যাওয়াটা কি অস্বাভাবিক কিছু?
আমি কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললাম, চাচা! দেশের এ অবস্থা কি আপনি স্বাভাবিক মনে করছেন?
অবশ্যই স্বাভাবিক। এখনকার মন্ত্রিসভা আওয়ামী লীগের আগের মন্ত্রিসভাগুলোর চেয়ে অনেক বেশি পাকাপোক্ত। আমু তোফায়েল নাসিম- এরা সবাই তারকা রাজনীতিবিদ।
কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও তো কয়েকজন তারকা রাজনীতিবিদ ছিলেন।
খালেদা জিয়া কি রাজনীতি বোঝেন? মোটেই না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে তার ভুলের খেসারত দিতে হবে।
রাজনীতিতে কাকে কখন ভুলের খেসারত দিতে হয়, সেটা সময় বলে দেবে। তবে খালেদা জিয়ার ভুলটা কি?
তার তো সবটাই ভুল। তিনি জনগণের ভোটে সংসদ সদস্য হলেন, কিন্তু জনগণের কথা বলতে সংসদে বসলেন না। তিনি যাতে আদৌ সংসদ অভিমুখী না হতে পারেন, শেখ হাসিনা তার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তবে তুমি হয়তো বলবে, খালেদা জিয়া নির্বাচিত হয়েও যখন সংসদে যাননি, তার আর নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে যাওয়ার দরকার কি?
আমি তা বলবো না। সংসদ বর্জন আর সংসদে যেতে না পারা এক কথা নয়। তবে বিরোধী দলবিহীন সংসদ গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়।
বিরোধী দলবিহীন কে বললো? বেগম রওশন এরশাদ এখন বিরোধী দল নেতা। তিনি সরকারের সঙ্গেও আছেন আবার বিরোধী দলেও আছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এটা এক বিরল দৃষ্টান্ত।
বিরল কথাটা বোধ হয় ঠিক হলো না। পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তা বলতে পারো। এটা সাধারণ বিরোধী দল নয়, গঠনমূলক বিরোধী দল। দলের নেতারা বলেছেন, তারা কেবল গঠনমূলক বিষয়ে বক্তব্য রাখবেন। জাতীয় পার্টির মন্ত্রীরা সরকারের পক্ষেও যেমন আছেন, আছেন তেমন বিরোধী দলেও।
সংসদে হ্যাঁ কিংবা না ভোটের সময় তারা কোনদিকে ভোট দেবেন?
চাচা বললেন, তারা সরকারি দলের হয়ে সর্বদা হ্যাঁ ভোট দেবেন, আবার বিরোধী দল হিসেবে না ভোট দেবেন।
তাহলে কি তারা দু’বার ভোট দেবেন?
তা হতেই পারে। তবে এসব ভোটাভুটিতে সরকারি দল সর্বদাই জয়যুক্ত হবে। বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি না ভোট দিলেও তাতে সিদ্ধান্তের কোন নড়চড় হবে না। ফলে কিছুই আসবে যাবে না।
দেশে তাহলে বাকশাল চালু হয়ে গেল না?
চাচা ভ্রু-কুঞ্চিত করে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, বাকশালের ব্যাপারটা কিছু বোঝো তুমি? বাকশাল অর্থ বোঝো?
বললাম, বাকশাল হচ্ছে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা।
মোটেই না। বাকশাল হচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্র। পঁচাত্তর সালে যে বাকশাল হয়েছিল, তা-ও একদলীয় ছিল না। বহুদলীয় গণতন্ত্রই ছিল তার রূপরেখা। বাকশাল হচ্ছে গণতন্ত্রের সর্বশেষ কথা। গণতন্ত্রের নির্যাসও বলতে পারো।
বলছেন কি চাচা!
ঠিকই বলছি। চাচা হাসিমুখে বললেন, শেখ হাসিনা বাকশাল কায়েম করতে চাইলে সমগ্র জাতি সাধুবাদ জানাবে। তিনি যদি বিএনপিকে তাতে যোগ দিতে বলেন, বিএনপি’র উচিত হবে অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তাতে যোগদান করা। কথাটা পারলে খালেদা জিয়ার কানে পৌঁছে দিও।
No comments