ছন্দহীন এক পার্লামেন্ট : সরকারি আর বিরোধী দল মিলেমিশে একাকার
ছন্দহীন এক পার্লামেন্টের যাত্রা শুরু
হলো। সরকারি আর বিরোধী দল মিলেমিশে একাকার এই সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী
এমপিরাও এসেছেন নজির সৃষ্টি করে। তাদের ১৫৪ জন নির্বাচিত হয়েছেন বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
১৪৬ জন এমপি হয়েছেন কম ভোটের রেকর্ড
গড়ে। সরকারে আছেন বিরোধী দলের সদস্যরা। বিরোধী দলের চেয়ারম্যান হয়েছেন
ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। এমনই এক ছন্দহীন অবস্থায় সূচনা
হয়েছে দশম সংসদের। দীর্ঘ ২৬ বছরের মধ্যে এই প্রথম দেশের অর্ধেক ভোটারের
প্রতিনিধিত্বকারী দল বিএনপির অংশগ্রহণ নেই এই সংসদে। ভোট বর্জন করা বিরোধী
জোট শুরু হওয়া সংসদকে আখ্যায়িত করেছে সাংবিধানিক গোঁজামিলের সংসদ হিসেবে।
এদিকে উদ্বোধনী ভাষণে প্রেসিডেন্ট মো. হামিদ সমঝোতায় আসতে আলোচনার জন্য
বিরোধী জোটের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। ব্যতিক্রমী এ সংসদে প্রধানমন্ত্রী,
স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা, সংসদ উপনেতা গুরুত্বপূর্ণ এ চার পদে দায়িত্ব
পালন করছেন চার নারী। বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ সংসদে দেয়া ভাষণে নতুন
সংসদকে নতুন কনসেপ্ট বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে
সরকারি ও বিরোধী দল সমস্যার সমধান করবে। তবে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে
বক্তব্য রাখার সময় একবারের জন্যও রওশন মুখে আনেননি তার দলের প্রধান হুসেইন
মুহম্মদ এরশাদের নাম।
ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর সভাপতিত্বে গতকাল সন্ধ্যা ৬ টায় অধিবেশন শুরু হয়। এসময় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, জাতীয় পার্টি (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ সরকার ও বিরোধী দলীয় এমপিরা উপস্থিত ছিলেন। ৫ই জানুয়ারি ভোটের পর ৮ই জানুয়ারি নবনির্বাচিত এমপিদের নামে গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। ৯ই জানুয়ারি এমপিরা শপথ নেন। এরপর ১২ই জানুয়ারি নতুন মন্ত্রি সভা গঠিত হয়। এ পর্যন্ত দশম সংসদের সদস্য হিসেবে ২৯৮ জন এমপি শপথ নিয়েছেন। এরমধ্যে টাঙ্গাইল ৮ আসনের সংসদ সদস্য শওকত মোমেন শাহজাহানের মুত্যুতে ওই আসন শূন্য রয়েছে। এ হিসেবে ২৯৭ জন এমপি নিয়ে দশম জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হলো। এবারই প্রথম সংসদে সর্বোচ্চ সংখ্যক স্বতন্ত্র এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এবার ১৬ জন এমপি স্বতন্ত্র হিসেবে সংসদে যোগদান করেছেন। এবারই প্রথম স্বতন্ত্র এমপিদের নিয়ে আলাদা জোট হয়েছে। ১৫জন স্বতন্ত্র এমপিকে নিয়ে গঠিত এ জোটের সভাপতি হয়েছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা হাজী মোহাম্মদ সেলিম।
সমঝোতার আহবান প্রেসিডেন্টের
সংঘাত ও নৈরাজ্যের পথ পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসার জন্য বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের প্রতি আহবান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, রাজনীতির নামে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা দমন করতে হবে। জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। গত ৫ বছর শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে পথে আমরা হেঁটেছি সে পথেই বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। জাতীয় সংসদে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস হিংসার রাজনীতি কখনও দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। বরং তা রাজনৈতিক পরিবেশকে অন্ধকারাছন্ন করে তোলে। প্রেসিডেন্ট বলেন, মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ২০০৯ সালে কতিপয় বিরোধী রাজনৈতিক দল অসহযোগিতা ও সংঘাতের পথ গ্রহণ করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকেই তারা যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠে। তারা ক্রমাগতভাবে সংসদ বর্জন, সংবিধান সংশোধনের কাজে সহযোগিতা করেনি। বিএনপিবিহীন নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্বাচন প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোট বর্জনের ডাক দিয়ে সহিংসতা এবং নির্বাচন পরবর্তী হিন্দু সমপ্রদায়ের ওপর হামলার সমালোচনাও করে তিনি বলেন, রাজনীতির নামে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির এ ধরনের অপচেষ্টা দমন করতে হবে। জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রতি আহবান জানান তিনি। বিরোধী জোটের উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট বলেন, সরকারে সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে সাহায্য করুন। রাজনীতি থেকে হিংসা, হানাহানি ও সংঘাত অবসানের মাধ্যমে সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখুন। ভাষণে প্রেসিডেন্ট গত পাঁচ বছরে মহাজোট সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন।
স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন: ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী আবারও স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন। ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন এডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনের শুরুতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সর্বসম্মতিক্রমে তারা নির্বাচিত হন। রংপুর-৬ আসনের সদস্য শিরিন শারমিনের নাম প্রস্তাব করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তার প্রস্তাব সমর্থন করেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। পরে প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা সর্বসম্মতিতে পাস হয়। এরপর ডেপুটি স্পিকার পদে গাইবান্ধা-৫ আসনের সদস্য ফজলে রাব্বী মিয়ার নাম প্রস্তাব করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ। তার প্রস্তাব সমর্থন করেন চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ। এই প্রস্তাবটিও সর্বসম্মতিতে পাস হয়। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখের সংসদ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বিদায়ী ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী। ভাষণে দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন আমাদের গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে উল্ল্যেখ করেন। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের বিকল্প কেবলই গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে নির্বাচনের বিকল্প নেই। তাই এটা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো এবং গণতন্ত্রের ভিতকে আরও মজবুত করতে নিরলসভাবে কাজ করার জন্য সকল সংসদ সদস্যের প্রতি আহ্বান জানান। এর আগে অধিবেশনের শুরুতে তিনি বলেন, দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে আমি আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রথমেই সফল নেতা শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা নির্বাচিত হওয়ায় আমি আনন্দিত ও গৌরবান্বিত বোধ করছি। আমি সকল সংসদ-সদস্যের পক্ষ থেকে তাঁকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। তিনি দশম সংসদের সব সংসদকে অভিনন্দন জানান। এরপর তিনি ২০ মিনিটের জন্য সংসদ অধিবেশন মূলতবি করেন। এসময় নবনির্বাচিত স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার শপথ গ্রহণ করেন। সংসদ ভবনের ৭ম তলায় প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ে তাদের শপথ পাঠ করান প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। শপথ শেষে স্পিকার তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ বিজয় বাংলাদেশের সব নারীর। বিরতি শেষে পুনর্নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিনের সভাপতিত্বে আবারও অধিবেশন শুরু হয়।
নতুন কনসেপ্টের সংসদ- বিরোধী দলীয় নেতা: এদিকে স্পিকারকে ধন্যাবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন বিরোধী দলীয় নেতাসহ সরকারি ও বিরোধী দলের বেশ কয়েক নেতা। রওশন এরশাদ তার বক্তব্যে বর্তমান সংসদ একটি নতুন কনসেপ্ট বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বিরোধী দল হিসেবে সরকারে থাকা এবং সরকারের খারাপ কাজের সমালোচনা এবং ভাল কাজের প্রশংসা আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-এর মতো একটি নতুন কনসেপ্ট। বক্তব্যের শুরুতে রওশন এরশাদ স্পিকার শিরিন শারমিনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মাননীয় স্পিকার, আপনার মতো একজন প্রফেশনাল একাডেমিক ট্যালেন্ট, ফেয়ার অ্যান্ড পারফেক্ট লেডি পুনরায় স্পিকার নির্বাচিত হওয়ায় আমরা গর্বিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, জাতির জনক যদি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন না দেখতেন, তাহলে এই সংসদও হতো না এবং আমরাও সদস্য হতে পারতাম না। জিয়াউর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, তার অবদানের কথা আমি স্বীকার করছি। কিন্তু তার রাজনৈতিক দল দুর্ভাগ্যজনকভাবে নির্বাচনে আসেনি। এটা দুঃখজনক। কিন্তু কোন দল নির্বাচনে আসবে না বলে নির্বাচন হবে না, এটা হতে পারে না। বিরোধীদলীয় নেতা দেশের সকল প্রয়াত ও জীবিত কীর্তিমানদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান। রওশন এরশাদ বলেন, আমাদের দেশের মূল সমস্যা হলো রাজনৈতিক হানাহানি। আমরা কখনও দেখিনি আমাদের বিরোধী দল এবং সরকারি দল জাতির প্রয়োজনে এক সঙ্গে কাজ করেছে। বর্তমান সংসদ সম্পর্কে তিনি বলেন, অনেকেই বলছে এটা গৃহপালিত বিরোধী দল। কিন্তু আমরা সরকারে অংশ নিলেও প্রকৃত বিরোধী দলের মতো সরকারের ভাল কাজের প্রশংসা করবো এবং খারাপ কাজের সমালোচনা করবো। রওশন এরশাদ স্পিকারের প্রতি আহবান রেখে বলেন, আমাদের প্রকৃত বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা রাখতে যথেষ্ট সময় দেবেন এবং দৃষ্টি রাখবেন বলে আশা করি।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, আমরা সরকারের খারাপ কাজে সমালোচনা এবং ভাল কাজে প্রশংসা করবো। এটা হবে আমাদের ব্যতিক্রম প্রচেষ্টা। জাতীয় পার্টি যেন ইতিবাচক রাজনীতি উপহার দিতে পারে আমি সেই দোয়া কামনা করবো। এ জন্য জন্য দেশের মানুষকে বলবো, আপনারা দেখবেন বিরোধী দলেও থেকে জাতীয় পার্টি তার দায়িত্ব ভালভাবে পালন করবে। জনগণকে এক্যবদ্ধ রাখা এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিতকতা রক্ষায় শত প্রতিকূল অবস্থা ছিন্ন করে জাতির কাছে এই সংসদ উপহার দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান রুহুল আমিন হাওলাদার। নতুন স্পিকার নির্বাচিত হওয়ায় শিরিন শারমিন চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
অধিবেশন কক্ষের খণ্ডচিত্র: সন্ধ্যা ৬টায় অধিবেশন শুরুর নির্ধারিত সময় থাকলেও ২০ মিনিট আগেই কক্ষে প্রবেশ করেন জাতীয় পার্টির চেযারম্যান এইচএম এরশাদ। তার সঙ্গে আসেন দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার। সংসদের রেওয়াজ অনুযায়ী সংসদ নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতার পাশের আসনে বসেন উপনেতারা। নবম সংসদের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশের আসনে বসেন সরকারি দলের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তবে বিরোধীদলীয় নেতা রওশনের পাশে বসেন এরশাদ। যদিও দলটির পক্ষ থেকে এখনও কাউকে উপনেতা নির্বাচিত করা হয়নি।
এদিকে অধিবেশন কক্ষে এরশাদকে আগে থেকে বসা দেখে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের বেশ কয়েক নেতা তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এ তালিকায় প্রথমে ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি প্রায় ৫ মিনিট এরশাদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরই আসেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এ সময় এরশাদকে কিছুটা বিমর্ষ দেখা গেছে। এদিকে প্রায় আধা ঘণ্টা পর সংসদ কক্ষে প্রবেশ করেন প্রথমবারের মতো বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। পাশে বসে থাকলেও এরশাদ-রওশনের মধ্যে কোন কথা হয়নি। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের পর অধিবেশন ২ মিনিটের জন্য মুলতুবি করা হয়। এরপরই আসন থেকে উঠে যান এরশাদ। এর ৫ মিনিট পর সংসদ লবিতে গিয়ে বসেন রওশন।
তথ্যমন্ত্রীর ব্রিফিং: এইচ এম এরশাদের সঙ্গে ৫ মিনিট কুশল বিনিময়ের পর অধিবেশন কক্ষে দায়িত্বরত বিটিভি ও সংসদ টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানদের কাছে আসেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। এ সময় তিনি তাদের বেশ কিছু সময় ব্রিফিং করেন। হাতের ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে দেন ক্যামেরা কাদের দিকে তাক করতে হবে। সুষ্ঠু প্রচারণার স্বার্থে তিনি এ ব্রিফিং করেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সামনের সারিতে বিরোধী দলের ৬ আসন: রওশন এরশাদের নেতৃত্বে থাকা জাতীয় পার্টির জন্য সামনের প্রথম সারিতে ছয়টি আসন দেয়া হয়। বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসেন রওশন এরশাদ। পরের আসনে এইচএম এরশাদ। এরপর বসেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। সামনের সারির পরের চারটি আসনে যথাক্রমে বসেন হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও ফজলে হোসেন বাদশা। এদিকে আগের সংসদের মতোই এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশের আসনে বসেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। এরপর যথাক্রমে বসেন বেগম মতিয়া চৌধুরী, আবুল মাল আবদুল মুহিত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু (৯ম সংসদে তিনি ছিলেন মাঝের সারিতে), সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও এডভোকেট রহমত আলী। এদিকে সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদকে এবার দেয়া হয়েছে মাঝের সারির দ্বিতীয় সারিতে। এর আগে অধিবেশন শুরুর ৫ মিনিট আগে সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে সংসদে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় উপস্থিত এমপিরা টেবিল চাপড়ে তাকে স্বাগত জানান। এর দুই মিনিট পর অধিবেশন কক্ষে আসেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ। ৬টা ১০ মিনিটে চেয়ারে বসেন ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী। কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দশম জাতীয় সংসদের অভিযাত্রা।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনীত: স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে সংসদ কার্য পরিচালনার জন্য ৫ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচন করা হয়। স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী তাদের নাম ঘোষণা করেন। এ তালিকায় রয়েছেন আবুল কালাম আজাদ, এইচএন আশিকুর রহমান, বেগম সাহারা খাতুন, নুরুল ইসলাম সুজন ও একেএম মাইদুল ইসলাম।
শোক প্রস্তাব উত্থাপন: চলতি সংসদের সদস্য শওকত মোমেন শাজাহানসহ সাবেক এমপি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মৃত্যুতে অধিবেশনের প্রথম দিনে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এই তালিকায় উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, সাবেক আইন পরিষদের সদস্য মমতাজ আহমেদ, মহানায়িকা সুচিত্রা সেন প্রমুখ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারি ও বিরোধী দলের বেশ কয়েক নেতা তাদের স্বরণ করে বক্তব্য দেন। পরে এক মিনিট নীরবতা পালন করে প্রয়াতদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়।
টুঙ্গিপাড়া যাচ্ছেন স্পিকার: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় যাচ্ছেন পুনর্নির্বাচিত স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় তাদের সেখানে যাওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে সকাল ৭টায় ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে পুষ্পস্তাবক অর্পণ করবেন তিনি। এ সময়ে তার সঙ্গে চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজসহ পাঁচ হুইপ থাকবেন বলে সংসদ সচিবালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সাংবিধানিক গোঁজামিলের সংসদ: বিএনপি
দশম সংসদ অধিবেশনকে ‘সাংবিধানিক গোঁজামিলে’র সংসদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি। দলটি বলেছে, প্রহসন, নাটক ও গণতন্ত্র ধ্বংসের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মাত্র ৫ শতাংশ ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়েছে। এখন সাংবিধানিক গোঁজামিলের মধ্য দিয়ে সে সরকার সংসদ গঠন করেছে। এটা হলো ‘সং’দের সংসদ। এ সংসদের কোন কর্তৃত্ব নেই। গতকাল বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, গত ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের নামে যে প্রহসন হয়ে গেল তাতে ১৫৩ জন কুশীলব বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ১৪৭ আসনের এমপিরা মাত্র ৫ শতাংশ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। গণতন্ত্রকে হত্যা করে, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে যে সংসদ গঠিত হয়েছে তার কোন কর্তৃত্ব নেই। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মাত্র যে ৫ ভাগ ভোটে নির্বাচিত হয়েছে তাতে শুধু আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা যায়। এতে কোন কর্তৃত্ব নেই। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নৈতিক পরাজয় হয়েছে। মির্জা আলমগীর বলেন, আবারও প্রমাণ হয়েছে, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। তাদেরকে আজ অস্ত্রের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার সমালোচনা করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, সমপ্রতি সারা দেশে যে পরিমাণ ক্রসফায়ারে হত্যা করা হচ্ছে তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এখন যেখানে-সেখানে বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া যাচ্ছে। গতকালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পল্লবীতে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বিরোধী দলকে নির্মূল করতেই এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে। গুম, খুনের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মির্জা আলমগীর বলেন, ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। দুই-একদিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হবে। তা বিএনপি চেয়ারপারসনই করতে পারেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যের সমালোচনা করে মির্জা আলমগীর বলেন, ইনু সাহেব যে ভাষায় কথা বলছেন তা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। এটা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বহির্ভূত। তিনি অতীত ভুলে গেছেন। অতীতে হত্যা, সন্ত্রাস ও মানুষ খুনসহ সহিংস ঘটনার সংস্কৃতি ইনু সাহেবই শুরু করেছিলেন। এসব ঘটনার কারণে তার নাম ইতিহাসে চিরদিন লেখা থাকবে। কারণ, তিনি গণবাহিনী তৈরি করেছিলেন এবং আজকে যাদের সঙ্গে ক্ষমতায় আছেন তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন। তথ্যমন্ত্রীকে তার অতীতের কথা স্মরণ করে বিএনপি চেয়ারপারসন সম্পর্কে কথা বলার আহ্বান জানান মির্জা আলমগীর। বিএনপি কতদিন কঠোর কর্মসূচি এড়িয়ে চলবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সচেতনভাবে সব সময় সংঘাত ও সংঘর্ষ এড়িয়ে চলছি। আমরা কথা বলার সুযোগ চাই। তবে, সময় বেঁধে দিয়ে আন্দোলন হয় না। তা সরকারের পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখন দমন, নির্যাতন বন্ধ হয়নি। বিএনপির কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা হতাশ নয় বরং উজ্জীবিত। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার জানা মতে, কোন রাষ্ট্র সরকারকে বৈধতা দেয়নি। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তারেক রহমানের শাশুড়ির বিরুদ্ধে দুদকের মামলা দায়েরের অনুমোদন দেয়ার নিন্দা জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, আমরা এই মামলা প্রত্যাহারের আহ্বান জানাচ্ছি। তারেক রহমানের শাশুড়ি হওয়ায় নোংরা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে দুদক এই মামলা করার অনুমোদন দিয়েছে। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন মামলার রায় কি হবে। রায় না দেয়ার আগেই তারা বলতে পারবে কি রায় দেয়া হচ্ছে। রায় না হওয়া পর্যন্ত এই বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি, আসাদুল করিম শাহিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
No comments