চাল আর চক্রান্তের খেলায় জয়-পরাজয়
রাজনীতি সার্বিক অর্থেই হচ্ছে চাল আর চক্রান্তের খেলা। সঠিক সময়ে সঠিক চাল চালতে পারা যেমন অপরিহার্য গুণ হিসেবে বিবেচিত, তেমনি চক্রান্তের জাল বোনাকেও রাজনীতির খেলায় অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না, যদি-না সেই চক্রান্ত সংকীর্ণ স্বার্থে পরিচালিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দুটি ঘটনাকে এখানে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা যেতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসার খেলায় দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নানা প্রয়াস। এটা হচ্ছে রাজনীতির সেই কুটিল খেলাগুলোর একটি, নৈতিক দিক থেকে যাকে গ্রহণযোগ্য মনে না হলেও যা হচ্ছে রাজনীতির অংশ। একইভাবে বিএনপির জামায়াতকে সঙ্গে রাখাও হচ্ছে রাজনৈতিক কৌশল, যেটাকে ঠিক ষড়যন্ত্রের পর্যায়ে ফেলা যায় না। বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতির অঙ্গনে যেসব ঘটনা ইদানীং ঘটে গেছে, তার সবটাই বলা যায়, ছিল চাল আর চক্রান্তের জাল বোনার খেলা। যে খেলায় এক দল বিজয়ী হয়েছে আর অন্যদের বরণ করে নিতে হয়েছে পরাজয়। এক দল জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে সহিংস রাজনৈতিক চালে প্রতিপক্ষের কিস্তিমাতের খেলায় ছিল মত্ত, অন্যদিকে প্রতিপক্ষও কুটিল রাজনৈতিক চালে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরাশায়ী করার খেলায় কম পিছপা হয়নি। সময় সাক্ষ্য দিচ্ছে, কে সেই কুটিল চক্রান্তের খেলায় বিজয়ী হয়ে বের হয়ে এল এবং কে সেখানে হলো পরাজিত। তবে রাজনীতি যেহেতু চলমান এক খেলা, ফলে পরাজিত পক্ষের সেখানে পরাজয় মেনে নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকার অবকাশ নেই। পরবর্তী চাল কীভাবে এবং কখন চালতে হবে, সেই ছক যথাসময়ে কষে নেওয়া হচ্ছে দক্ষ রাজনীতিকের দায়িত্ব। এবার সরাসরি রাজনীতির বাইরের জয়-পরাজয়ের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যাক।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোয় সংবাদমাধ্যম যেহেতু হচ্ছে রাজনীতির খেলার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, ফলে রাজনীতির জয়-পরাজয়ের প্রভাব সংবাদমাধ্যমের ওপরও কিছুটা পড়তে বাধ্য। রাজনীতির খেলার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার সংবাদমাধ্যম হলেও এই মাধ্যমের সেই অংশগ্রহণ অনেকটা যেন হচ্ছে খেলার মাঠের রেফারির সমতুল্য। রেফারিবিহীন প্রতিযোগিতা যেমন গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয় না, সংবাদমাধ্যমহীন রাজনীতিও অনেকটা একই অর্থে গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। ফলে রেফারি যেন খেলার মাঠের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে না ওঠেন, সেদিকে লক্ষ রাখা সংবাদমাধ্যমের নিজ স্বার্থেই কাম্য। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির আলোকে সংবাদমাধ্যম সেই দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে কি? আমি তো বলব, না, অনেকটাই ব্যর্থতার পরিচয় সংবাদমাধ্যম দেখিয়েছে। মোটা দাগের বিভাজনে দেশের সংবাদমাধ্যম এবং সংবাদমাধ্যমের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী (দৈনিক পত্রিকার অনুসৃত পথ, এর কলাম লেখক এবং এর সঙ্গে যুক্ত পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল বা জাতীয় পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী) সবাই দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। টেলিভিশন টক শোর বক্তাদের এখানে আমি অন্তর্ভুক্ত করছি না। কেননা, এঁদের বেলায় বিভাজনের মাত্রা ছিল সৌজন্য রেখা অতিক্রম করে যাওয়া। পত্রিকার কলাম লেখকদেরও এ কারণে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না যে তাঁরা সবাই নিজস্ব অবস্থান থেকেই মতামত ব্যক্ত করছেন, যে অবস্থান আমাদের অনেকের কাছেই খুব পরিষ্কার। ফলে ইনিয়ে-বিনিয়ে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা তাঁরা করলেও তাঁদের লেখার মধ্য দিয়েই পরিচিত সেই অবস্থান আরও অনেক বেশি পরিষ্কার হয়ে গেছে।
তবে প্রশ্ন তোলা যায় সংবাদপত্রের নিজস্ব কলাম লেখকদের বেলায়। তাঁদের অবস্থান কিন্তু সংবাদপত্রের নিজস্ব অবস্থানকেই তুলে ধরে এবং তাঁরা যখন একতরফাভাবে কোনো একটি পক্ষের হয়ে সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেন, তখন কিন্তু রেফারির নিরপেক্ষ অবস্থানকেই করে তোলে প্রশ্নবিদ্ধ। ছোট একটি দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা যাক। যে পত্রিকার সঙ্গে ১৫ বছর ধরে আমি যুক্ত, তার এক কলাম লেখক বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর ওয়াশিংটন, লন্ডন আর টোকিওতে নিন্দা আর প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাওয়ার উল্লেখ করে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা হারানোর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি হয়নি, তা নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ যে দ্বিধাবিভক্ত, তা আমাদের সবার জানা। তবে কথা হচ্ছে, একটি পক্ষ যখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে ভোটদাতাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলার ব্রত নিয়ে ময়দানে নেমেছিল, সে রকম অবস্থায় ভগ্নাংশ ভোটারের উপস্থিতিও প্রমাণ করে যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকলে আরও অনেক বেশি ভোটার হয়তো ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হতেন। ফলে পটকা আর বোমাবাজির মতো পেশিশক্তির জোর দেখিয়ে মানুষকে ভয়ে ভোটকেন্দ্রের বাইরে রাখা যে আনুপাতিক সব রকম হিসাব-নিকাশকে জলো করে দেয়, তা তো আমাদের অজানা থাকার কথা নয়। ভোট বর্জনকারীরা যদি পেশিশক্তির আশ্রয় না নিয়ে অহিংস পথে ভোট বর্জনের আহ্বান নাগরিকদের প্রতি জানাতেন এবং সেই অনুযায়ী তাঁরা কাজ করতেন, সে রকম অবস্থায় আসলেই বলা সম্ভব হতো যে দেশের ব্যাপক সংখ্যাধিক্য জনগণ পাতানো নির্বাচন বর্জন করেছে। বাংলাদেশের বেলায় তা হয়েছে কি? তবে কেন শুরুতেই পক্ষপাতদুষ্টভাবে এক পক্ষের ঠুনকো যুক্তি মেনে নিয়ে সেটাকে যুক্তিসংগত করে তোলার জন্য আন্তর্জাতিক সমাজকে সেই বিতর্কে নিয়ে আসা? হ্যাঁ, ওয়াশিংটন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচন নিয়ে হতাশ এবং সেই হতাশার পেছনে নিশ্চয়ই দেশটির সংগত কিছু কারণ থেকে থাকবে। তাই বলে এটা ভেবে নেওয়া নিছক বোকামির পর্যায়ে পড়বে যে, আমাদের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় বাংলাদেশের জনগণের সাফল্য দেখতে যুক্তরাষ্ট্র সদা উদ্গ্রীব।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সাম্প্রতিক সব চালের কোনোটাই বিশ্বজুড়ে এমন ইঙ্গিত দেয় না যে অন্য দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হচ্ছে ওয়াশিংটন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে বিশ্বের একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলোর সবচেয়ে বড় মিত্র হচ্ছে ওয়াশিংটন। ফলে ভিন দেশের গণতন্ত্র নিয়ে দেশটির হা-হুতাশও কুম্ভীরাশ্রুর বাইরে কিছু নয়। বরং আমরা ধরে নিতে পারি যে, নিজস্ব লাভক্ষতির হিসাব-নিকাশ থেকেই সেই অবস্থান গ্রহণ, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে নয়। অন্যদিকে ওয়াশিংটনের পাশাপাশি লন্ডন আর টোকিওকে টেনে আনাও ছলচাতুরী ছাড়া কিছু নয়। আমরা জানি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে লন্ডন কিংবা টোকিও ওয়াশিংটনের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে—তা ইরাকে লক্ষাধিক নিরীহ মানুষের নিধন বলুন কিংবা ড্রোন হামলা চালিয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মতো অমানবিক আচরণই বলুন। অর্থাৎ প্রচুর কথার হেরফের করার মতো সৎ সাহস কিংবা নিরপেক্ষ আচরণ কখনোই তারা দেখাতে পারেনি এবং বাংলাদেশের বেলায়ও যে ব্যতিক্রমী কিছু হবে, তা মনে করারও কোনো কারণ নেই। তার পরও বলতে হয়, টোকিওর অবস্থান এ ক্ষেত্রে অনেকটাই নীরব দর্শকের মতো। বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূতের দুঃখ প্রকাশ করে দেওয়া বিবৃতির বাইরে অন্য কোনো প্রতিক্রিয়া টোকিও দেখায়নি। ফলে এটাকেও ঠিক ঝড় বয়ে যাওয়া হিসেবে গণ্য করা যুক্তিসংগত হয় কি? বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচন বিতর্কিত হওয়ার পরও বলতে হয়, নির্বাচন ঘিরে দেখা দেওয়া বিতর্ক আর মতভেদের আলোকে সবচেয়ে বড় পরাজিত পক্ষ এখানে হচ্ছে সংবাদমাধ্যম। রেফারি যখন একটি দলের পক্ষ হয়ে বাঁশি বাজাতে শুরু করেন, সেই খেলার ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে, তা তো সহজেই অনুমানযোগ্য। ফলে এক দলের জয় এবং অন্য দলের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সেই খেলা শেষ হলেও সবচেয়ে বড় পরাজিত পক্ষ সেখানে, যিনি হচ্ছেন রেফারি নিজে, সেই সত্য তো সবারই জানা।
No comments