নেতাদের কাছে আকুল আবেদন
কী কী ঘটতে পারে আগামী কয়েক দিনে? কেউ জানে না। এই প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই। ছয় মাস আগে যদি কোনো মন্ত্রীকে পেয়ে কোনো সাংবাদিক জিজ্ঞেস করতেন, কী হবে, জানেন কিছু? উত্তর আসত, আপনি কিছু জানেন? এখনো অবস্থা তা-ই। কী হবে, কেউ জানে না। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীও জানেন না, কী হবে। তাঁদের নিশ্চয়ই পরিকল্পনা আছে, ছক আছে, ছক ১, ছক ২, ছক ৩। কিন্তু ছক অনুযায়ী যে সব সময় সবকিছু হবে, তা তো নয়। ২০০৬ সালের আগে বিএনপির ক্ষমতাকেন্দ্রের খুব কাছের একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হবে। তিনি বলেছিলেন, হয় বিএনপি আবার নির্বাচিত হবে, না হলে অন্য কেউ ক্ষমতায় আসবে, আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসবে না। কী হয়েছিল, আপনারা জানেন। তবে ২০০৬ সালের আগে আমার একটা ভবিষ্যদ্বাণী এই কলামেই প্রকাশিত হয়েছিল, আমি বলেছিলাম, ঠিক সময়ে নির্বাচন হবে এবং তার মাধ্যমে দেশের পরিস্থিতি ভালো হয়ে আসবে। আমার ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক বলে প্রমাণিত হয়নি। এখন কী কী হতে পারে, আমরা একটা তালিকা করতে পারি। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে: সংলাপ আসলে হবে না। সমঝোতা হবে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই এখনকার খেলায় জয়লাভ করে নির্বাচনে যেতে চায়। উইন উইন পরিস্থিতি বলে কিছু নেই
কাজেই কেউ ছাড় দেবে না বিন্দুমাত্র। সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে, দুই নেত্রী বসতেও পারেন, কিন্তু সমঝোতা হবে না। রাজপথে কঠোর থেকে কঠোরতর আন্দোলন হবে। জ্বালাও-পোড়াও হবে। ঘটবে আরও অনেক মৃত্যু। এর মধ্যেই একতরফা নির্বাচন করার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ। সেটা যদি ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এর মতো প্রহসনের নির্বাচন হয়, তাও। তারপর কঠোরভাবে দেশ শাসন করার চেষ্টা চালাবে। বিরোধী দলও কঠোরভাবে উৎখাতের আন্দোলন চালিয়ে যাবে। স্কুল-কলেজ বন্ধ। রাস্তাঘাট অচল। ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে। অর্থনীতির অবস্থা হয়ে পড়বে কাহিল। আমদানি-রপ্তানিতে পড়বে ভাটা। মানুষ মারা যাবে। দেশ আর দেশের মানুষ পাবে সীমাহীন কষ্ট। এর পরিণতিতে যা যা হতে পারে, ক) ১৯৯৬-এর মতোই আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় নির্বাচন আয়োজন করবে, বিরোধী দলের দাবি মেনে নিয়ে, খ) বিরোধী দল একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়বে। দেশ কোনোরকমে চলতেই থাকবে। গ) অসাংবিধানিক কোনো সমাধান চেপে বসবে। ত্যক্তবিরক্ত মানুষ সেটাকেই স্বাগত জানাবে। অথবা ২০০৬ কিংবা ২০০৭-এর মতো একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতিকালেই পটপরিবর্তন ঘটে যাবে। এই বিকল্পগুলোর কোনোটাই আশাপ্রদ নয়। মানুষের ক্ষতি হবে। মানুষ মারা যাবে। জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। একটা মানুষের জীবনও মূল্যবান। একটা মানুষেরও জীবন বিপন্ন হয়, এমন কোনো কর্মসূচি কোনো পক্ষেরই দেওয়া উচিত নয়। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে এ রকম ভয়ংকর খেলা আমাদের নেতারা কেন করবেন? এটা তো কেবল তাঁদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি নয়, ১৬ কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ তাঁদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। আর গণতন্ত্রের চেয়ে ভালো কোনো শাসনপদ্ধতি তো আপাতত আমাদের পৃথিবীতে নেই।
১৯৯০ থেকে এ পর্যন্ত গণতন্ত্রের ২২-২৩ বছরে আমাদের অনেক অপ্রাপ্তি আছে, আবার অনেক প্রাপ্তিও আছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, আমাদের মেয়েরা কাজে যাচ্ছে, আমাদের দেশে আর কেউ না খেয়ে মারা যায় না, অনেকের বাড়িতেই স্যানিটারি ল্যাট্রিন হয়েছে, সবারই প্রায় টিউবওয়েল আছে, প্রবৃদ্ধি ভালো, প্রবাসীদের পাঠানো টাকায় আমাদের অর্থনীতি চাঙা, এদিক থেকে আমরা উভয় দলের আমলেই মোটামুটি ঠিক পথেই চলেছি, কৃতিত্ব উভয় রাজনৈতিক দলের সরকারকেই দিতে হবে। আবার আমাদের অনেক না-পাওয়া আছে। আমাদের এমন কতগুলো প্রাপ্তি আছে, যা আমরা পেতে চাইনি। যেমন জঙ্গি হামলা, যেমন অগণতান্ত্রিক আচার, যেমন দুর্নীতি, যেমন বল্গাহীন দলীয়করণ এবং গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র, নির্বাচিত স্বৈরাচার। তবু মোটের ওপর, আমাদের গণমাধ্যম স্বাধীন, তারা স্বাধীনভাবে কথা বলে, স্বাধীন মত তুলে ধরে। পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই। সেসবের সুফলও আমরা পেয়ে আসছি। কাজেই আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের এমন পরিস্থিতি তৈরি করা উচিত নয়, যাতে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমাদের সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয়ই দেশপ্রেমিক। আর যে কথা নেতারা নিজেরাই বলছেন, এক-এগারোর স্টিম রোলারটা সবচেয়ে বেশি যায় রাজনীতিবিদদের ওপর দিয়েই, সেটাও তো তাঁদের মনে রাখার কথা, মনে থাকার কথা। তাহলে তাঁদের বিবেকের কাছে আমাদের আকুল আকুতি, আপনারা বসুন। উভয় পক্ষের নেতারা সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে বসুন। সংবিধান মোতাবেকই সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা সম্ভব, যদি নেতারা আন্তরিক হন, যদি নেতারা বোঝেন, এটাই সবচেয়ে ভালো বিকল্প, একটা মানুষের জীবনও যদি তা দিয়ে বাঁচানো যায়, সেই চেষ্টা তাঁদের করা উচিত। আমার নিজের ধারণা হলো, মোটামুটি রকমের নিরপেক্ষ একটা সরকারের অধীনেই যদি নির্বাচন হয় এবং তা যদি খুব বিলম্বিত না হয়, তাতে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে।
এই সুযোগ কেন বিএনপি ছেড়ে দেবে? বানরের পিঠাভাগের গল্প না আবার হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত। আমরা তাই দুই দলের শুভবুদ্ধির কাছে, সুবিবেচনার কাছে আরেকবার আকুল আবেদন জানাই। আপনারা বসুন। প্রথমেই যদি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী পর্যায়ে না হয়, তবে মহাসচিব পর্যায়ে আলোচনা শুরু হোক। উভয় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে আপনারা একমত হোন, সদস্য কারা হবেন, ঠিক করে ফেলুন। তারপর আসুন, সবাই মিলে নির্বাচন করি। নির্বাচনের উৎসবে মেতে উঠুক দেশ। দেশের মানুষ ভোট দিক। তারা তো এক দিনের রাজা। একটা দিনেই তারা পর্দাঘেরা ঘরে ঢুকে নিজের রাজাগিরি ফলায়। এবং আমরা বিশ্বাস করি, এ দেশের মানুষ রায় দিতে কখনো ভুল করে না। এবারও করবে না। আমার কলামের নামটাই অরণ্যে রোদন। আমার এই রোদন যেন অরণ্যে হারিয়ে না যায়। একবার, অন্তত একবার আমার কলামের নামকরণ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হোক। কবীর সুমনের একটা গান বরং আপনাদের শোনাই:
মাঝে মাঝে কিছু ঝগড়াই হোক
হোক না ভীষণ বাগিবতণ্ডা
বিরুদ্ধমত ঝাঁজিয়ে উঠুক
মুলতবি থাক মিঠাই-মণ্ডা
জোর হোক শুধু গলার আওয়াজ
গায়ের জোরটা তোলাই থাকগে
ডান্ডার চেয়ে ঠান্ডাই ভালো
ষন্ডামি সব চুলোয় যাক গে
আওয়াজ যে যত পারে দিক। শুধু গায়ের জোর দেখানোর প্রতিযোগিতায় না নামলেই হলো। দুঃখের বিষয় হলো, সেটাও হচ্ছে। এত রক্ত, এত গুলি, এত কাঁদানে গ্যাস, এত রাবার বুলেট, এত ককটেল, এত বোমা, এত পেট্রল, এত আগুন কেন? বন্ধ করুন এসব। আমাদের নেতারা কবে বুঝবেন সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট। হে প্রভু, তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি। যদি আমাদের কোনো প্রত্যাশাই পূর্ণ না হয়? যদি তাঁরা সমঝোতা না করে সংঘাতকেই একমাত্র পথ ও গন্তব্য করে তোলেন? তবু বলব, আশা ছাড়ব না। হয়তো ধ্বংসের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠবে নতুন কোনো পথ, সৃষ্টির। বাঁচার। এগিয়ে যাওয়ার। যেখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা নির্ভয়ে স্কুলে যাবে। যেখানে সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্বজন ফিরে আসবে কি আসবে না, এই নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকবে না। যেখানে ব্যবসায়ী জানবে, তার রপ্তানির গাড়ি ঠিক জায়গায় পৌঁছাবে, দোকানদার জানবে দোকান খুললে কোনো অসুবিধা নেই। এবার মাহমুদুজ্জামান বাবুর গানের কথায় বলি: ভোর হয়নি, আজ হলো না;
কাল হবে কি না তাও জানা নেই,
পরশু ভোর ঠিক আসবেই
এই আশাবাদ তুমি ভুলো না।
একটা জাতির গড়ে ওঠার ইতিহাসকে এক দিন, দুই দিন, এক মাস, দুই মাসের মাপকাঠিতে দেখলে তো চলবে না, মাপতে হবে যুগের হিসাবে। গত দুই যুগে আমরা অনেক এগিয়েছি, আগামী দুই যুগ পরে আমরা একটা আলোকিত দেশই দেখব। হয়তো আমরা তা দেখে যেতে পারব না, কিন্তু আমাদের সন্তানেরা পারবে, ঠিক পারবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
মাঝে মাঝে কিছু ঝগড়াই হোক
হোক না ভীষণ বাগিবতণ্ডা
বিরুদ্ধমত ঝাঁজিয়ে উঠুক
মুলতবি থাক মিঠাই-মণ্ডা
জোর হোক শুধু গলার আওয়াজ
গায়ের জোরটা তোলাই থাকগে
ডান্ডার চেয়ে ঠান্ডাই ভালো
ষন্ডামি সব চুলোয় যাক গে
আওয়াজ যে যত পারে দিক। শুধু গায়ের জোর দেখানোর প্রতিযোগিতায় না নামলেই হলো। দুঃখের বিষয় হলো, সেটাও হচ্ছে। এত রক্ত, এত গুলি, এত কাঁদানে গ্যাস, এত রাবার বুলেট, এত ককটেল, এত বোমা, এত পেট্রল, এত আগুন কেন? বন্ধ করুন এসব। আমাদের নেতারা কবে বুঝবেন সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট। হে প্রভু, তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি। যদি আমাদের কোনো প্রত্যাশাই পূর্ণ না হয়? যদি তাঁরা সমঝোতা না করে সংঘাতকেই একমাত্র পথ ও গন্তব্য করে তোলেন? তবু বলব, আশা ছাড়ব না। হয়তো ধ্বংসের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠবে নতুন কোনো পথ, সৃষ্টির। বাঁচার। এগিয়ে যাওয়ার। যেখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা নির্ভয়ে স্কুলে যাবে। যেখানে সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্বজন ফিরে আসবে কি আসবে না, এই নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকবে না। যেখানে ব্যবসায়ী জানবে, তার রপ্তানির গাড়ি ঠিক জায়গায় পৌঁছাবে, দোকানদার জানবে দোকান খুললে কোনো অসুবিধা নেই। এবার মাহমুদুজ্জামান বাবুর গানের কথায় বলি: ভোর হয়নি, আজ হলো না;
কাল হবে কি না তাও জানা নেই,
পরশু ভোর ঠিক আসবেই
এই আশাবাদ তুমি ভুলো না।
একটা জাতির গড়ে ওঠার ইতিহাসকে এক দিন, দুই দিন, এক মাস, দুই মাসের মাপকাঠিতে দেখলে তো চলবে না, মাপতে হবে যুগের হিসাবে। গত দুই যুগে আমরা অনেক এগিয়েছি, আগামী দুই যুগ পরে আমরা একটা আলোকিত দেশই দেখব। হয়তো আমরা তা দেখে যেতে পারব না, কিন্তু আমাদের সন্তানেরা পারবে, ঠিক পারবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments